রৌদ্র বসন্ত

মাহতাব হোসেন

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৮, ২০১৮

হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফরম ভর্তি মানুষ থই থই করছে। ভিড়ের মধ্যে ক’বার যে ধাক্কা খেলাম সে হিসেব বের করতে হলে আঙুলের কড়ে গোনা ছাড়া উপায় নেই আর। সেটাও গুনতে হবে প্ল্যাটফরমের বাইরে গিয়ে নিরিবিলি কোনো এক জায়গায়। নাহলে হিসেবে ভুল হয়ে যেতে পারে। একটা লেডিস কামরার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় স্থূলকায় এক নারী ধাক্কা মেরে সামনে এগিয়ে গিয়ে ট্রেনে প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লেন। অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা। তবুও পেছনে ফিরে একবার দেখলেনও না যে, তিনি কাউকে ধাক্কা দিয়েছেন কি না, কেউ ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল কি না; সে সময়টুকু কোথায়? ট্রেন ছেড়ে দিল। মানুষজনের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে, এটাই যেন শেষ ট্রেন। দ্য লাস্ট ট্রেন। যে কোনো মূল্যে এই ট্রেন ধরতেই হবে। না ধরলে বিশাল বিপদের মধ্যে পড়ে যেতে হবে।

মানুষ বোঝাই করে ট্রেনটা হইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফরম কাঁপিয়ে চলে গেল। কিন্তু মোটেও প্ল্যাটফরমে ভিড় পাতলা হলো না। মনে হলো, লোকজন আরও বেড়ে গেছে। কোত্থেকে এতো লোকজন আসছে, আর কোথায় চলে যাচ্ছে, অদ্ভুত! মিনিট কয়েক পরে, পাশের প্ল্যাটফরমে আরেকটা ট্রেন শব্দ করে এসে থামলো। দ্রুত হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেলাম, সেদিকে যাওয়ার সময়েও বেস কয়েকবার ধাক্কা খেলাম। আজ ধাক্কা আমার কপাল লিখন। ট্রেন থেকে লোকজন নামতে শুরু করেছে। এবার প্ল্যাটফরমে আরও ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। ভিড়ের স্রোতে আমি সামনের দিকে যাওয়ার বদলে ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে একেবারে পেছনে চলে এলাম।

হাওড়া ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কমপ্লেক্স এবং বড় স্টেশনের মুকুট তার মাথায়। ১৬৩ বছরের পুরনো এ স্টেশনটির প্ল্যাটফরমের সংখ্যা ২৩টি। একটা প্ল্যাটফরমে দাঁড়াতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছিল, মানে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। আর বাকিগুলোতে? এই মুহূর্তে আমার পক্ষে আর অন্য কোথাও আর পা বাড়ানো সম্ভব না। জলপাইগুড়ি থেকে নন্দদুলাল কাকার আসার কথা। আমরা বলি নন্দকাকা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ওঠার আগে নন্দকাকা বাসায় ফোন দিয়েছেন, তাকে যেন সকাল সকাল হাওড়া স্টেশন থেকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এখন ফোন বন্ধ। নন্দকাকা বিয়ে করেননি, ওখানে একটা চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে আট বছর ধরে কাজ করছেন। বছরে একবার বসন্তের শেষদিকে কলকাতায় আসেন। সাথে আমাদের জন্য নিয়ে আসেন নানা উপহার। শৈশব-কৈশোরে এইসব উপহারের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল, এখন সেসব ফিকে হয়ে গেছে। নন্দকাকা আমাদের বাড়িতে দিন পনের থেকে ফের চা বাগানে ফিরে যান।

বাসা থেকে মা ভোরের দিকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে পাঠিয়ে দিলেন নন্দ কাকাকে নিয়ে যেতে। আমিও আর্লি মর্নিং অর্ধ ঘুম হওয়া মানুষটা বাসে বাদুর ঝোলা হয়ে চলে এলাম হাওড়া। স্টেশনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর ধাক্কা খেতে খেতেই ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে। উঁহু, নন্দ কাকার কোনো পাত্তা নেই। কোন ট্রেনে আসবে সেটাও আমি জানি না। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো? থই থই লোকজনের মধ্যে বিরক্তি আর চেপে রাখা সম্ভব হলো না আমার। সদ্য এসে থামা ট্রেনের প্ল্যাটফরমের বহির্গমন পথে এসে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রত্যকেটা যাত্রীকে খেয়াল করলাম। খুবই কঠিন কাজ তারপরেও করতে হলো। কোথাও নন্দ কাকা নেই। তার মানে এই ট্রেনেও নন্দ কাকা আসেনি। উফফ।

প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে এসে স্টেশনের সাথে দেয়ালে আঁটকানো নলকূপে পানি খেলাম। ইট সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে সুন্দর মতো নলকূপ লাগিয়ে যাত্রীদের পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে গলা না শুকিয়ে উপায় নেই। কয়েক ঢোক খেয়ে ও মুখে পানির ছিটে দিয়ে পাতাল পথে নেমে এলাম। এটাকে সাহেবী ভাষায় সাবওয়ে বলে। সাবওয়েভর্তি লোকজন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কলকাতা শহরের পথে লোকের ঢল নামে। যেন লেগে আছে বারো মাসের রথযাত্রা। এখন কোথায় যাবো? নন্দ কাকাকে ছাড়াবাড়ি গেলে মা নির্ঘাত আমার হাড় গুঁড়ো করে দেবেন। তারচেয়ে হগলি নদীর ধারে ঘুরে ফিরে বাড়ি চলে গেলেই হয়। সাবওয়েতে নেমে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কয় নম্বর লেন দিয়ে বের হবো? কয়েকটা পথ ভাগ হয়ে গেছে রাস্তার বাম পাশে, কয়েকটা ডান পাশে নদীর দিকে। একটা হাওড়া ব্রিজের কাছে গিয়ে উঠেছে। ব্রিজের কাছে উঠবো? সেখানেও সেই একই ভিড়। কী দরকার। ১০ নম্বর লেন দিয়ে হাঁটা ধরলাম। পাতাল পথেও বেশ ভিড়। দুইদিকে হকারের উৎপাত। কেউ আপেল কমলা নিয়ে বসেছে, কেউ পেয়ারা, মৌসুমী ফল নিয়ে বসেছে। একদিকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ নিয়ে সারবদ্ধভাবে বসে আছে। কলকাতা শহরে হকারের সংখ্যা কত? নির্ঘাত ৫-৭ হাজার তো হবে। হকার আর মানুষজনের হই হল্লা উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম নদীর ধারের ফুটপাতে। পেটে খিদে জেঁকে বসেছে। সকালে নাস্তা করা হয়নি। হেঁটে হেঁটে ফুটপাত ধরে বাঁ দিকে চলে এলাম। ফুটপাতের একটা দোকানে গরম গরম পুরি ভাজা হচ্ছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম পুরি খাওয়ার জন্য তরকারি রয়েছে। গরম তাওয়ায় ডিম ভেঙে ওমলেট বানানো হচ্ছে। পাউরুটিও রয়েছে। ফুটপাতের দোকানে ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চের বেশ আয়োজন।

তাওয়ায় ছ্যাঁকা পাউরুটির টুকরোর সাথে ওমলেট নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পকেটে টাকা পয়সা নেই তেমন। চারটা পুরি আর তরকারি অর্ডার করে বসলাম। পাশে এক ভদ্রলোক খেয়ে দেয়ে টেবিলের ওপর এঁটো প্লেট রাখতেই মধ্যবয়স্ক দোকানি খেঁকিয়ে উঠলেন। দোকানি লোকটার বয়স হয়েছে। চুলের দুই পাশ দিয়ে পাকা চুল বেরিয়ে গেছে। তামাটে চেহারার লোকটা রেগে গিয়ে বললেন, নিচ মে রাখ দো। আঙুল দিয়ে এঁটো প্লেটের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন। খরিদ্দার লোকটা বিব্রত হলেন বোঝা যায়। কোনো কথা না বলে লজ্জিত ভঙ্গিতে নিচে রেখে দিলেন এঁটো প্লেট। তারপর পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গুনে গুনে ১৪ টাকা দিয়ে চলে গেলেন। পুরো দৃশ্যটা কেমন যেন বিষণ্ণ বিষণ্ণ, যদি ফ্রেমে ধরে রাখা যেত, তাহলে সিরিয়ালের ভালো একটা দৃশ্য হতো।

সদ্য কড়াই থেকে নামানো চারটা পুরি ও তার পাশে তরকারি ছড়িয়ে প্লেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন মধ্যবয়স্ক দোকানি। উঠে প্লেটটা নিয়ে দোকানের সামনে পাতানো নড়বড়ে বেঞ্চে বসে দ্রুতই মুখে পুড়লাম। খাওয়া মন্দ হলো না। আর দুই-একটা পুরি হলে আরও ভালো হতো। কিন্তু পকেটের অবস্থা ভালো না। মা গুনে গুনে টাকা দেন। বাবা পোস্ট অফিসের চাকরি থেকে রিটায়্যার করেছেন। দোতলার ভাড়া দিয়েই পুরো সংসার চলে। নিচ তলায় আমরা থাকি, ওপর তলা ভাড়া। পৈতৃক বাড়ি বলে রক্ষা। আমারও কোনো চাকরি বাকরি নেই। বাবার কথা শুনে পোস্ট অফিসের চাকরিতে আবেদন করে বসে আছি দু’বছর ধরে। চাকরিটা হবো হবো করেও হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হবে কি না কে জানে। নাও হতে পারে, প্রযুক্তির প্রসারের যুগে যেভাবে দিন দিন পোস্ট অফিসের গুরুত্ব কমছে তাতে চাকরি না হলেও অবাক হবার কিচ্ছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমার কী হবে জানি না। দেখা গেল মাস্টার্স শেষ করে আমাকে ট্যাক্সি চালাতে হচ্ছে। কলকাতা শহরে ট্যাক্সিতেও ইদানীং মানুষজন কম চড়ে। ট্যাক্সি তেলে চলে ভাড়া বেশি। কেউ উঠতে চায় না। উবের চলে এসেছে। লোকজন স্মার্ট মোবাইল ফোন দিয়ে উবের ভাড়া করে। ভাড়াও নাকি কম আসে। আমার একদিন উবেরে চড়া হলো না। হবে কি করে আমার তো স্মার্ট মোবাইল ফোন নেই।

দুই গ্লাস পানি খেয়ে নদীর ঘাটের দিকে এগোতে থাকলাম। ঘাটের টিকেট কাউন্টারগুলোও বেশ আধুনিক হয়ে গেছে। আধুনিক ছেলে মেয়েরা বসে নৌ যানের টিকেট বিক্রি করে। লঞ্চে করে ওপারে যাওয়া যায়। গিয়ে কী হবে? আসলে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। এম্নিতেই গেলেই হয়। রোদ চিড়বিড় করে মাথার ওপর গলে পড়ছে। নদীর মাঝে গেলে একটু ভালো লাগবে। আর এখন মা’কে জবাবদিহী করতে হবে না। নন্দ কাকার মোবাইলে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলাম, ধরেননি। উনি হয়তো স্টেশনে নেমে ফোন করবেন। ফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছি। যদি স্টেশনে নেমে ফোন করেন, তাহলে আমি ধরে কী বলবো, স্টেশন থেকে চলে এসেছি? এটা শোভনীয় হবে না। তারচেয়ে ফোন বন্ধ থাকাই ভালো, বলতে হবে চার্জ ছিল না বন্ধ হয়ে গেছে।

খাওয়ার পরে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করে। ঘাটে ঢোকার মুখেই একটা চায়ের দোকান, পকেটে কয়েকটা কয়েন রয়েছে। হাত দিয়ে বের করে দেখলাম ৩ টা দুই টাকার কয়েন। অন্য পকেটে আরও ছোট কাগজের নোট আছে বোধহয়।ভাঁড়ের চা নিলাম। এতোটুকু চায়ের জন্য পাঁচ টাকা খরচ করতে হলো। সামান্য চায়ের জন্য এতোগুলো টাকা খরচ করতে হয়, খুব কষ্ট লাগে। আসলে হুট করেই যেন কলকাতা শহরে চায়ের দাম বেড়ে গেল। চা খেয়ে, এঁটো কাপটা রেখে কাউন্টারে চলে গেলাম। মনটা আসলে উশখুশ করছে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। টিকেট কাউন্টারে ফর্সা মতো এক অল্প বয়সী নারী বসে আছেন। একটা দশটাকার সোনালি-রূপালি মেশানো কয়েন কাউন্টারের ভেতরে ঢুকিয়ে বললাম, একটা বাবুঘাট।

বাবুঘাট লেখা একটা টিকেট আর দুইটা দুই টাকার কয়েন বাড়িয়ে দিলেন। আমিও ফের হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ। ফর্সা মতো নারী হাসলেন। সাধারণত কেউ টিকেট বিক্রেতাদের ধন্যবাদ জানান না, এজন্য তাদের মুখে হাসি হাসি ব্যাপারটা আসে না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করলো, ম্যাডাম এই চাকরিটা কীভাবে পেলেন?
এই তো আবেদন করেছিলাম, ব্যস হয়ে গেল।
আমি তো কত জায়গায় আবেদন করলাম, আমার তো হচ্ছে না।
ভদ্র মহিলা হয়তো হেসে বলবেন, দেখুন চেষ্টা করে হয়ে যাবে।

কিছুই বলা হলো না। আমি হেঁটে হেঁটে দুই নম্বর ঘাটের দিকে এগোতে থাকলাম। ‘ব্যস হয়ে গেল’ বললেই তো আর চাকরি হয় না। চাকরি নিতে লাগে ঘুষ। হয়তো এরাও ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি দুই নম্বর ঘাট খুঁজছি। গতকাল রাত থেকে মনটা অস্থির হয়ে আছে। ক্যানবেরা থেকে পিঙ্কি ফোন করেছিল। তিন বছর পর ওর কণ্ঠ শুনলাম গতরাতে।
‘বিমল, স্পিকিং?’
‘হ্যাঁ। কে বলছেন?’
‘তাহলে নম্বর ঠিক আছে। তুই কি বিয়ে করেছিস?‘
‘না। আপনি কে?‘
‘ওহ, আমাকে চিনলি না রে গাধা, আমি পিঙ্কি।‘
‘ওহ।‘
‘জানি বিয়ে করিস নি, নাহলে মাসিমা তো বলতো...।‘

এরপর থেকেই মনটা কেন জানি অস্থির। ফোন কেটে দিয়েছিলাম। আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। লং ডিস্ট্যান্স কল। টাকা বেশি খরচ হবে। আসলেই কি টাকার জন্য কেটেছি? বুঝতে পারছি না। কারণ টাকা তো আমার খরচ হচ্ছিল না। হচ্ছিল পিঙ্কির, আমার তো কথা বলতে সমস্যা হবার কথা না। এই সামান্য আলাপই হলো। আর হ্যাঁ সে আমাকে গাধা বলেছিল কেন? দেশে থাকতে সে কখনো আমাকে সম্বোধন করেনি। কেন গাধা বলল? এটা টু মাচ। রাতে ঠিক ঠাক ঘুম হলো না। সকাল সকাল মা উঠিয়ে পাঠালেন স্টেশনে। পিঙ্কির কথার সাবলীল ভাবে উত্তর দিয়েছি। ওকে বেশ প্রাণোচ্ছ্বল মনে হলো। সুখে থাকলে মানুষ এমনই প্রাণোচ্ছ্বল হয়।

দু’নম্বর ঘাট দিয়ে অনেক লোক বেরোচ্ছে। একদিকে সরে ভদাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, আমার পেছনে লম্বা লাইন। অপেক্ষা করছি লোক বেরোনো শেষ হলেই লঞ্চে ওঠার যাত্রীদের যাওয়া শুরু হবে। প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোকের লম্বা লাইন শেষ হবার পর, আমাদের ঢোকার সুযোগ হলো। ঢুকেই লঞ্চ পেয়ে যাবো এমন ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাইনি। আমার ভাগ্যের প্রতিটি বাঁকে বিড়ম্বনা। জীবনে সহজে কোনো কিছুই হাতে পাই নি। একটা চাকরির অপেক্ষায় আছি। সেটাও হয়তো পেয়ে যাবো, কিন্তু তার আগে ঘষামাজা খেয়ে লাইফের ছাল বাকলা উঠে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম ঘাটে। আমার বাঁ পাশে ঝুলন্ত হাওড়া ব্রিজ সমুজ্জ্বল দাঁড়িয়ে। পিঁপড়ের মতো গাড়ি ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আসছে। ব্রিজের ফুটপাত ধরে মানুষের মিছিল। যে মিছিলের মধ্যরাতের আগে শেষ নেই। সবখানেই মানুষের গিজগিজ।

বিভিন্ন জায়গার লঞ্চএসে ঘাটে ভিড়তে শুরু করেছে। একটার পাশে আরেকটা, তারপর আরেকটা। চারটা লঞ্চ পর পর এসে দাঁড়িয়ে গেল। ফেয়ারিতলা, শোভাবাজার, বলে ডাকতে শুরু করলো লঞ্চের লোকজন। বাবুঘাট শুনতেই জিজ্ঞেস করলাম, বাবুঘাট কোনটা?
‘ভিত্তার সে চালা যাও।‘
‘ভেতর দিয়ে কয় নম্বর লঞ্চে যাবো?’
‘চার নম্বর বাবুঘাট কা লঞ্চ হ্যায়।‘

শোভাবাজারের লঞ্চে উঠে ভেতর দিয়ে একটা লঞ্চ থেকে আরেকটা লঞ্চে লাফিয়ে লাফিয়ে চতুর্থ লঞ্চে উঠে এলাম। এটাই আগে ছেড়ে দিল। একেবারে লঞ্চের কিনারে সিট পেয়ে পেয়ে গেলাম। ময়লা পানির স্তর থেকে পরিষ্কার পানিতে চলে এলো লঞ্চ। এরপর ঘুরে বাবুঘাটের দিকে মুখ করলো। বাবুঘাটে আমার কোনো কাজ নেই। ভালো লাগছে না, অস্থিরতা কমানো দরকার। ওপারে নেমে কিছুক্ষণ হেঁটে হেঁটে বাসে উঠে পড়বো। মনটা আসলে অশান্ত। হঠাৎ করে পিঙ্কির ফোন করার কোনো দরকার ছিল না। সে সুখে আছে সুখেই থাকুক, অনর্থক শুকিয়ে যাওয়া ঘায়ে খোঁচানোর দরকারটা কি? প্রায় তিন বছর আগে আমার ফোনে ফোন করেছিল। কোনো দরকার নেই। তারপরেও... সম্ভবত ভাই ফোঁটার দিন ছিল সেটা।

লঞ্চে আমার পাশে টি শার্ট আর লেগিন্স পরা একটা মেয়ে বসেছে। ফোনে কথা বলছে বেশ জোরে জোরে। ইঞ্জিনের শব্দের কারণে কথা দূরে যাচ্ছে না। কোনো বিষয় নিয়ে সম্ভবত উত্তেজিত মেয়েটি। ফোনের ওপারে মনে হয় নির্ঘাত মেয়েটির প্রেমিক। কথা বার্তা আর রাগের ধরন দেখে তাই মনে হলো। লঞ্চ হুগলি নদীর মাঝখানে চলে এসেছে। রোদকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নদীর বাতাস। এই সময়টা গোটা কলকাতার বাতাসে ধুলো। নদীর বাতাসে ধুলো নেই। এখান থেকে হাওড়া ব্রিজটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। একটু ঘুরে তাকালে হাওড়া স্টেশনের সুদৃশ্য লাল কমপ্লেক্স। ব্রিজের দিকে তাকিয়ে নতুন করে আরেকবার বিস্মিত হলাম। যতবার নদী পারাপার হই ততবারই এই ঝুলন্ত ব্রিজের নির্মাণশৈলীর কথা ভেবে বিস্মিত হই। বাসে করে পার হলে সেটা মনে হয় না। এই যেমন সকালেই কিছু মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে ঝুলন্ত হাওড়া ব্রিজ ব্রিটিশদের নির্মাণ করে যাওয়া স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর।

তবে সে বিস্ময় কেটে গিয়ে পাশের মেয়েটার কথার ধরনে বিস্মিত হচ্ছি। মেয়েটার ফোনালাপে ঘুরে ফিরে একটাই বাক্য আসছে, ‘আমি কিন্তু নদীর মাঝখানে, লাফ দেব।‘ মেয়েটা কি সত্যি লাফ দেবে? যদি সত্যি লাফ দিয়ে দেয়। ঘুরে মেয়েটাকে একটু পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলাম। খুবই সাদামাটা একটা মেয়ে। বাতাসে চুল উড়ছে। ইঞ্জিনের শব্দে কথা এখন কেটে কেটে যাচ্ছে। চেহারা দেখে মনে হলো এই মেয়ে লাফ দেবে না। ওর সে সাহস নেই। প্রেমিককে ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার হিসেব কি ঠিক থাকবে? আমি যা ভাবি তার উল্টো ঘটে। পিঙ্কির রাতের কথাগুলো মাথায় ঘুরঘুর করছে। মেয়েটা আমাকে ফোন না দিলেও পারতো। আবার কোনো একদিন ফোন দিয়ে বসবে। আবার তিন বছর পর, কিংবা পাঁচ বছর পর অথবা আজকেই...

লঞ্চ এপারের কাছাকাছি চলে আসছে। আমি উঠে একেবারে লঞ্চের কিনারে চলে এলাম। মেয়েটাকেও দেখলাম উঠে দাঁড়িয়েছে, কান থেকে ফোন নামে নি। নদীরটলটলে জল। রোদের তলে অনেক বাতাস। নদীর মাঝ বরাবর কয়েকটা চিল ওড়াউড়ি করছে। দূরে বিবেকানন্দ সেতু দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা পিংকি যদি আজ ফের ফোন করে বসে? লঞ্চ ঘাটে ভিড়বে, সাইরেন দিচ্ছে। প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। কয়েকবার ঘুরিয়ে, উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখলাম। সিমেন্সের মোবাইল। এক দুর্গাপূজায় নন্দ কাকা-ই ফোনটা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। নদীর বুকে ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারলাম। টুপ করে ডুবে গিয়ে পানিতে একটা আলোড়ন তুলেছে। তাকিয়ে আছি ছোট ছোট ঢেউগুলোর দিকে। ততক্ষণে লঞ্চ ঘাটে ভিড়ে গেছে।