রোকসানা দরোজা খুলছে না
দেবদুলাল মুন্নাপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০১৯
বিয়ের পর কলাবাগানে ছোটো ফ্ল্যাটে রোকসানা আর আমি সংসার পাতি।
ফ্ল্যাটের দরোজা ছিল বেশ সুন্দর। কাঠের দরোজা। কারুকাজ করা। আমরা ডোরবেল লাগালাম। সেটির উপরে রোকসানা একটি স্টিকার লাগালো। তাতে লেখা, ‘ডাক দিয়ে যাই’। আর দরোজার ভেতরের অংশে আবিমাল গুজম্যানের কারাবন্দি একটি পোস্টার। আমরা বাইরে যাবার এবং ভেতরে ঢোকার মুখে কখনো কখনো গুজম্যানকে দেখতাম।
আমার নানাবাড়িতে একটা দরোজা ছিল। আকারে সব দিক থেকে ছোট। ঢুকতে গেলে মাথা নুইয়ে ঢুকতে হতো। আবার পাশাপাশি দুজন ঢুকতে-বেরুতে পারতো না। অনেকের বাসায় কাঁচের দরোজা থাকে। কালীঘাটের ম্যানেজারের চা বাংলোয় এমন দেখেছিলাম।
বান্দরবানের পাহাড়ে এক জুমক্ষেতের পাহাড়াদারের মাটির ঘরে কোনো দরোজাই ছিল না। একরাত ছিলাম। একটু ভয়ই কাজ করেছিল।
আমি যখন বাইরে থেকে বাসায় ফিরতাম, তখন দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ার সাথে সাথে ডোরবেলও বাজিয়ে যেতাম যতক্ষণ রোকসানা দরোজা খুলতো না। একদিন ঘুমিয়ে ছিল। আরেকদিন ওয়াশরুমে ছিল। ফলে দরোজা খুলতে দেরি হলো। মনে আছে, রেগে গিয়েছিলাম। রোকসানা বলেছিল, ‘তোমার জন্যে ঘুমাইয়াও শান্তি নাই, গোসলেও শান্তি নাই।’
বন্ধ দরোজার সামনে আমার বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল্লাগতো না। রোকসানাকে বললাম, ‘বাসায় ঢোকার ১৫ মিনিট আগে আমি তোমার ফোওনে রিং দিমু, বুঝবা আমি আসতেছি। তুমি দরোজা খুইলা দাঁড়ায়া থাকবা।’
রোকসানা দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু দিন তো আর সব এক রকম না। ঝগড়াঝাটি হলে বা রোকসানা বাসার বাইরে থাকলে দরোজা বন্ধই থাকতো। আমি আলাদা চাবি বানালাম।
একটি রোকসানার কাছে, অন্যটি আমার কাছে থাকে।
আমরা যে যার মতো দরোজা খুলে বেরুতাম। ঢুকতাম।
এভাবেও সুরাহা হলো না ব্যাপারটা। ছুটির দিনে বিকেলে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি, রোকসানা ঘরে নেই। আমার চাবি খুঁজলাম। কোথায় রেখেছি, ভুলে গিয়েছিলাম। ফোওন দিলাম রোকসানাকে,‘কই তুমি?’
‘ছাদে।’
‘চাবি পাইতেছি না। ঘুমের মইদ্যে এইরকম কেউরে কেউ লক কইরা যায়?’
রোকসানা চলে এলো। রেগে বললো, ‘এই দরোজা নিয়া তোমার লগে আমার একটা মীমাংসা হওয়া দরকার।’
ভাবলাম, সত্যি তো, দরোজা নিয়ে রোকসানার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করছি। তাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে বেরালাম। উদ্দেশ্যহীন অনেক ঘুরে আমরা ধানমন্ডির ‘কজমো’ রেস্টোরেন্টে পৌঁছালাম।
খাবারের অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি আমি ও রোকসানা। রোকসানার পরনে স্কাই ব্লু জিনস, মেরুন রংয়ের ফতুয়া।
সুন্দর দেখাচ্ছিল। খুনসুটি করতে ইচ্ছা হলো। বললাম, ‘আজ রাতে আমার জন্যে তোমার দরোজা খুলবা?’
রোকসানা হাসে।
বলি, ‘বিয়ের পরপর আমরা ডেইলি নাস্তার টেবিলে আগের রাতে কোনো স্বপ্ন দেখলে সেটা বইলা দিন শুরু করতাম। মনে আছে তোমার?’
রোকসানা বলে, ‘কেন মনে থাকবে না? তুমি দুই কিসিমের দরোজাকে নিয়া স্বপ্ন দেখছিলা, ইন্টারেস্টিং।’
মনে আছে, একরাতে স্বপ্নে অদ্ভুত একটা দরোজা দেখেছিলাম। নদীপাড়ে কাশবন। কাশবন পেরিয়ে কিছু দূর গেলে গরু রাখালি মাঠ। সেই মাঠ থেকে ইটসুড়কির রাস্তা অরণ্যের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যেতেই অদ্ভুত দরোজা। দরোজাটি বাঁশপাতায় চিকন কাঠি দিয়ে তালি মারা। বন্ধ দরোজা। দরোজার ওপরে লাল রঙে ক্রস দেয়া। লেখা, ‘বিপদজ্জনক।’ ইলেকট্রিক তারের খুঁটিতে যেমন থাকে।
পরদিন নাস্তার টেবিলে রোকসানাকে এই দরোজার কথা বললে সে হেসে বলেছিল, ‘এটা কোনো স্বপ্ন হইল? আজিব।’
এর কিছুদিন পর আরেকটা দরোজা দেখি। স্বপ্নে। নাস্তার টেবিলে রোকসানাকে বলি, ‘বুজছো, কালকা একটা কাঁচের ঘর দেখলাম। একটা রেইল স্টেশনের পাশে। সেই কাঁচের ঘরে কিসসু নাই। ফাঁকা। কিন্তু চাইরদিকে চাইরটা দরোজা।’
রোকসানা কিছু বলে না। শুধু হাসে।
আমি বলি, ‘হাসছো কেন হারামির মতোন?’
রোকসানা হাসি থামিয়ে বলে, ‘স্বপ্নের মিনিং এত খুঁজতে নেই।’
আমার মাঝে মাঝে দাদাজানের কথা মনে পড়ে। আমি তখন খুব ছোট। কত হবে বয়েস, সাত-আট। আব্বার চাকরিসুত্রে শ্রীমংগল থাকতাম। পূর্ব্বাশার মহল্লায়। তখন মাঝেমধ্যে দেখতাম, দাদাজান হয়তো দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ঘুমাচ্ছেন, হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বলতেন, ‘এই দরোজা খুইলা দে। কে আইসে দেক। কড়া নাড়তেছে।’ দাদাজানের বয়স তখন সত্তুরের কাছাকাছি। আমরা তাকে নিয়ে হাসতাম। বলতাম, ‘এই কে আইসে দেক।’ খুব ক্ষেপে যেতেন।
দাদাজান মারা যান ১৯ ডিসেম্বর, শেষরাতে। শীত পড়েছিল সেবার। মারা যাবার আগে ঘুম থেকে লাফ মেরে উঠেছিলেন এবং ‘এই দরোজা খুইলা দে। কে আইসে দেক। কড়া নাড়তেছে।’ বলে মূল দরোজা খুলে উঠোনে বেরিয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তার পিছু পিছু রইস মামা গিয়েছিলেন। রইস মামা দাদাজানের সাথে ঘুমাতেন। দাদাজান ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠার পর তিনিও জেগে উঠেছিলেন। আমরা শৈশবে রইস মামার কাছে একথা শুনেছি।
দাদাজানের মৃত্যুর সঙ্গে দরোজার সম্পর্ক নিয়ে আমি রোকসানাকে কিছু বলিনি। যেমন বলিনি অনেক কথাই। আমি নটরডেমে ভর্তির পরপর আব্বার পোস্টিং হলো ঢাকায়। আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকতাম তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো পিপুরা। পিপুর আব্বা ব্যাংকার। আম্মা স্কুল মিসট্রেস। ছুটির দিন ছাড়া পিপু বাসায় একা থাকতো। একদিন বাসায় আমিও একা। হঠাৎ দরোজা খুলে দেখি, পিপুও দরোজা খুলছে। পিপু দরোজা লাগায় না। আমিও না। কে আগে লাগায়, এনিয়ে যেন গোপন এক খেলায় মেতে উঠি। তবে তা ছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। পিপুই আগে দরোজা লাগালো, তারপর আমি। আমি দরোজার আইভিউ দিয়ে তাকিয়ে থাকি। দেখি, পিপু আবার দরোজা খোলে। আমি দরোজার ভেতর থেকে দেখছি, পিপু আমাদের দরোজার দিকে তাকিয়ে আছে। একঘেয়ে দুপুর। নির্জন ফ্ল্যাট। আমি দরোজা খুলে পিপুকে যেই কিছু বলতে গেলাম, অমনি সে দরোজা লাগিয়ে দিল। আমিও দরোজা বন্ধ করে ভেতর থেকে আবার আইভিউতে চোখ রাখি। একটা নেশায় যেন পেয়ে বসে আমায়। দেখছিলাম পিপু দরোজা খোলে কীনা। খোলে। আমিও সাথে সাথে দরোজা খুলে ওর মুখোমুখি।
‘পিপু?’ ডাকলাম।
‘কি?’ পিপু বললো।
‘কিছু না।’ বললাম।
পিপু ভেতরে ঢুকে গেল।
তারপর থেকে আমাদের প্রায়ই দরোজা খুললে দেখা হয়ে যেত।
রোকসানাকে বলা হয়নি পিপুর কথা। বলতে চেয়েছি। কিন্তু জানতাম, রোকসানা সব শুনে বলতো, এটা কৈশোরের কমন গল্প। এটা আর এমন কী! রোকসানাকে এমদাদ স্যারের কথাও বলিনি।
এমদাদ স্যার আমার অফিসের বস ছিলেন। মারা গেছেন। মাঝেমধ্যে তার বাসায় যেতাম। তখনো বিয়ে করিনি। অফিসের পর সময় কাটতো না। কেননা আমার কোনো বন্ধু ছিল না। এমদাদ স্যার খুব পড়াশোনা করতেন। ঘরের ভেতরে বই আর বই। বিয়ে থা করেননি। তিনিই আমায় ঘরের সব বাতি নিভিয়ে চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনিয়েছিলেন। তাকে দেখতাম, সেনেকা, শোপেনহাওয়ার, এসব থেকে উদ্বৃতি দিতেন। একদিন অফিস শেষে তিনি বেরুচ্ছিলেন, আমি জানতে চাইলাম, ‘কই যাইবেন স্যার?’ বললেন, রমনা পার্কে। হাঁটবেন। সঙ্গী হলাম। সন্ধ্যায় হ্যালোসিন আলোয় সবুজ গাছগাছালির ভেতর দিয়ে আমরা হাটছিলাম। এক ফাঁকে এমদাদ স্যারকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘স্যার আমি স্বপ্নে ঘুইরা ফিইরা খালি দরোজা দেখি। নানা কিসিমের দরোজা।’
এমদাদ স্যার বললেন, ‘মজা তো।’
বলি, ‘কিন্তু স্যার, আমি দেখতে চাই না।’
‘কেন?’ জানতে চাইলেন এমদাদ স্যার।
কী বলবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অথচ যেন অনেক কিছু বলার ছিল। বলতে চেয়েছি। অনেককে। বারবার। পারিনি। এমদাদ স্যারকে বলি, ‘স্যার, একই স্বপ্ন বারবার দেখতে ভালো লাগে? আমি খুব টায়ার্ড।’
এমদাদ স্যারকে আবছা অন্ধকারে হাসতে দেখি। বললেন, ‘তুমি স্বপ্নে ইন্ডিয়ার কাম্পির পাথর দরোজা দেখেছো? ইরানের কাশানের পুরনো দরোজা?’
বলি, ‘না স্যার।’
বললেন, ‘গুগলে সার্চ দিয়ো দেখবে। জানো, শোপেনহাওয়ার দরোজা নিয়ে কী ভাবতেন?’
‘না স্যার।’
‘শোপেনহাওয়ারের নাম তো শুনেছ?’
‘জি।’
আমাদের কথা হচ্ছিল হাঁটার ভেতর। একটা পাকা বেঞ্চিতে এমদাদ স্যার বসলেন। আমি পাশে। বললেন, ‘রাস্তা হচ্ছে সবার। ঘর হচ্ছে যার যার। রাস্তায় নেমে যেদিকেই যাবে সেদিকেই রাস্তা আপনাআপনি তৈরি হয়ে যায়। ফলে রাস্তা মানুষকে একাকীও করে দেয়। আবার শুধু ঘর বন্দিদশার জন্ম দেয়। কিন্তু দরোজা হচ্ছে রাস্তা আর ঘরের মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপনকারী। শোপেনহাওয়ার এমনটি ভাবতেন। তিনি শেষ বয়সে ঘরের দরোজা লাগাতেন না। সবসময় খোলা রাখতেন। এটা তার বড়ই রহস্যময় আচরণ। জানি না, কেন করতেন।’
এমদাদ স্যারের কাছে দরোজা বিষয়ক এসব কথা শুনে আমার মনে পড়ে, দাদাজানের কথা। তিনি ঘুম খেকে লাফিয়ে উঠে বলতেন, ‘এই দরোজা খুইলা দে। কে আইসে দেক। কড়া নাড়তেছে।’
এমদাদ স্যার বললেন, ‘এক রাষ্ট্র থেকে আরেক রাষ্ট্রে যেতেও দরোজা পেরুতে হয়। এখানে দরোজা নজরদারির কাজ করে।’
এসব কথাও রোকসানাকে বলিনি। জানতাম, বললে সে বলতো, ‘ওইসব দিয়া আমি কী করুম? দরোজা নিয়া ক্যাচাল আর ভাল্লাগে না।’
রোকসানা আর আমার সংসার সুখের। আমরা খুব হ্যাপি হতে চাই। চটপটি খাই। জোছনা রাতে লং ড্রাইভে যমুনা তীরে যাই। শপিং করি। খুনসুটি করি। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, চারপাশের সব দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পটাপট। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কোথাও ঢুকতে পারছি না।
বাসায় দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়ানাড়ার সাথে একটানা ডোরবেল বাজিয়ে যাচ্ছি।
রোকসানা দরোজা খুলছে না।
‘রোকসানা?’
ডাকছি।
রোকসানা কোনো সাড়া দিচ্ছে না।
রোকসানা দরোজা খুলছে না।