রেপ কালচার
রিফাহ সানজিদাপ্রকাশিত : মে ০৩, ২০১৮
রেপ কালচারের ভিত্তিটা অনেক আগে থেকেই একটু একটু করে আমাদের সমাজের মগজে ঢুকে একটা বিশাল জায়গা দখল করে নিয়েছে। যার প্রভাব সর্বত্রই এখন টের পাচ্ছি আমরা সবাই। রেপ কালচার নিয়ে বললে প্রথমেই বলতে হবে রেপ নিয়ে। রেপ শুধু যোনীতে আবদ্ধ করলে এ কালচারটা আপনি কখনোই উপলব্ধি করতে পারবেন না। যৌন হয়রানির প্রত্যেক ধাপ রেপের পূর্বলক্ষণ। বাসে, ট্রেনে, রাস্তায় মেয়েদের শরীরে হাত চালানো লোকটি সুযোগের অভাবে রেপিস্ট নয়, এটা বুঝতে হবে। তাই হয়রানি করে ক্ষান্ত হচ্ছে। এরাই সু্যোগ পেলে মানসিক বিকৃতিটা রেপ করে দেখিয়ে দেবে। অনলাইনেও একি রকম ব্যাপার। হাতে ধরার সুযোগের অভাবে কমেন্ট করেই ক্ষান্ত হচ্ছে শিক্ষিত বহু লোক।
এখন কোথাও একটা রেপের কিংবা হয়রানির ঘটনা ঘটলেই দেখা যাবে, একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দু’তিনদিন পরপরই ঘটছে। এতে যে অনলাইন মিডিয়ার ভূমিকা কতখানি, তা দেখার পর ভয়ে আছি। পোষাক থেকে শুরু করে সব কিছুতে নারীর যৌনতা খুঁজে বেড়ানোর লোকের অভাব নেই। কী অফলাইন কী অনলাইন। অনলাইনে যে কোনও প্লাটফর্ম খুললেই দেখা যাবে, নারীদের যে কোনও ছবি কিংবা লাইভে অসংখ্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের বিকৃত কমেন্ট। যে মেয়েটি অনলাইনে পেজ খুলে বিজনেস করছে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে মেয়েটি লাইভে এসে পণ্য দেখাতে গ্যালেই সমাজের রেপিস্টরা এসে হাজির হয়ে একের পর এক কমেন্টের বন্যায় বিকৃতির পরিচয় দিচ্ছে। মেয়েরাও এই কালচারের বাইরে নয়। আপু, আপনার জামাটা শরীর দেখা যায়, বদলে আসুন, নিজেকে দেখান নাকি পণ্য? কি বাজে ড্রেস, দেখতে বাজারের মেয়ের মতো একদম! এমন সব কমেন্টে বোঝা যায়, অনেক মেয়েরাই এই রেপ কালচার ফলো করছে অজান্তেই। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তাকে শেখায়, মেয়েরা আবৃত থাকবে কাপড়ের স্তূপে। তারা ভোগের জিনিস। মানুষ নয়। যৌনতা উদ্রেককারী মাংসের দলা একেকটা!
এখন যে বাসে এত যৌন-হয়রানি আর রেপ এটেম্পট বেড়ে গেছে, তার একটা গুরুত্ববাহী দিক খেয়াল করলে দেখা যায়, একটা এরকম ঘটনা ঘটলেই আরো বেশ কয়েকটা একই ধরণের ঘটনা ঘটছে! এর কারণ হিসেবে আমার নজরে এসেছে একটি বিষয়, মূলত যা নিয়ে লেখার প্রথমেই বলেছি। সেটি হলো, অনলাইন মিডিয়া। পাশের দেশ ভারতে কিংবা আমাদের দেশে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই সেটা বৃহৎ মাত্রায় বারবার দু’একদিন পরেই বিভিন্ন জায়গায় সিরিয়ালি ঘটে। এক জায়গায় ধর্ষণের ঘটনা কি তাহলে অন্য জায়গায় উস্কানি দেয়? আর অনুপ্রাণিত করে?
এবার বিভিন্ন ব্রাউজার বা অনলাইনে গজিয়ে ওঠা ভুয়া পোর্টাল গুলো খুলুন। অশ্লীল ছবি যুক্ত করে কুশ্রীভাবে যৌন-আবেদনপূর্ণ ধর্ষণের হেডলাইন আর বর্ণনা দেয়া থাকে সংবাদে। বলা যায়, যৌন-কন্টেন্টে পরিপূর্ণ এগুলো। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা ধর্ষিতার প্রতি সহমর্মিতা সেখানে উঠে আসে না কক্ষণো। এগুলোর পাঠক সুশীল সমাজের কেউ না, সচেতন পাঠকও না। এগুলোর পাঠক সমাজের একেবারে নূন্যতম মিডিয়া-জ্ঞানহীন, যা দেখি তাই বিশ্বাসকারী লোকজন। বাস ড্রাইভার কিংবা বস্তির কমদামি স্মার্টফোন চালানো একটু-আধটু পড়তে পারা ছেলেটিও এগুলোর পাঠক। এসব পোর্টালে ধর্ষণ-যৌন হয়রানিকে রীতিমতো স্বাভাবিক যৌনতার রূপ দিয়ে সংবাদ আর কন্টেন্ট পরিবেশন করা হয়। সত্য মিথ্যে ভুয়া আসল মিশিয়ে। রেপ কালচারে সুশীল-শিক্ষিত সমাজের পার্টিসিপেশন নেই, তা নয়। তবে এসব নামহীন, লাইসেন্স ছাড়া, ভুয়া সংবাদের পোর্টালগুলো এমন এক শ্রেণির কাছে এমন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে, যা রীতিমতো ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। এরাই ধর্ষণের খবর ছড়ায় এমনভাবে, যাতে পরপর একই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই আমরা। অবিলম্বে এসব পোর্টাল বন্ধ করা উচিৎ যেগুলো রেপ কালচারকে প্রতিষ্ঠিত করছে সমাজের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে। আর শিক্ষিত সমাজের এই রেপ কালচারের পালনটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফলশ্রুতি।
এই পরিবর্তনটা আনতে হবে পরিবারে। নিজের ছেলে সন্তানকে রেপ কালচার থেকে বের করে আনার জন্য ছোটবেলা থেকে নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করাতে শেখানোটা জরুরি। শুধু পরিবার কেন, শিক্ষকদের এই দায়িত্ববোধ আরো বেশি থাকা উচিৎ। সমাজ যতদিন নারীকে ভোগবস্তু হিসেবে দেখবে, নারী ধর্ষিত হবে মুখের কথায়, হাতের ছোঁয়ায়, শারীরিকভাবে, ঘরে কিংবা বাইরে, কর্মক্ষেত্রে। রেপ কালচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন আমরা রেপ শুধু যোনীতে আক্রমণ বুঝি। নারী মানুষ, শারীরিক আর মানসিক দুই কষ্টই সে অনুভব করে। তাকে হয়রানি করা হলেও রেপের সমান কষ্টে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দয়া করে এবার বুঝতে শিখুন, হে মহান সমাজ।