ছবিঃ দীপাঞ্জন সরকার
রেড লাইটের ভালোবাসা
রিফা সানজিদাপ্রকাশিত : নভেম্বর ২৯, ২০১৭
ললিতা বিরক্ত হয়ে ভুরু কোঁচকায়, দ্যাখ, ওসব ভালবাসার কথা বলিস না।
ক্যান, বলব না ক্যান? কথার মাঝখানে বাধা পড়ায় বিরক্ত হয় সেলিম। এরপর সে চুপসে যায় ললিতার ধমক খেয়ে। মেয়েটাকে ভয় পায় সে । কিসের ভয় হ্যাঁ? নিজেকেই অনেকবার এ প্রশ্ন সে করেছে। উত্তর ঘুরেফিরে এসে পড়ে এক কথায়, হয়তো মেয়েটাকে হারানোর ভয়। সেলিম জানে, ললিতা কি কাজ করে। তবু মেয়েটার মধ্যে কিছু আছে, সে সম্মান করে।
রেড লাইটের এ জায়গাটায় প্রথমবার যখন সে আসে, ঘুরেফিরে বোকার মতো দেখতে থাকে এদিক-ওদিক। এক দালাল এসে স্বভাবমতো পাকড়াও করে জিগেশ করে, কি চায়?
সেলিম বেকুবের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দালাল জিজ্ঞেস করে, টাকা আছে? কত?
সেলিম পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে ওপরে তাকায়। ললিতাকে দেখতে পায়। ললিতা তারে দ্যাখে না। সে আরও বছর দুয়েক আগের কথা। তার পকেটে ৩০০ টাকা ছিল। সে হাত তুলে ললিতাকে দেখায়। দালালটা ৩০০ টাকা বাগিয়ে নিয়ে জানায়, এত কমে ওই মেয়ে সম্ভব না, অন্য কাউকে দেখতে পারে আজ। সেলিম অপমানিত বোধ করে। ছোটলোক সে, কিন্তু অত নয়। এরপর রোজ এসে টাকা নিয়ে দাঁড়াতো সে, আর ললিতাকে দেখে-দেখেই চলে যেত। এই যে এ পর্যন্ত আসতে অনেক সেটিং করতে হয়েছে তার। আর এখানে সেটিং মানেই টাকা।
সে তখন ছিঁচকে এক ছিনতাইকারী ছিল। আর আজ! নিজের ওপর গর্ব হয় তার। ললিতার ঘরে শুয়েই সে দিবাস্বপ্ন দ্যাখে। ললিতা আবারও ঝাঁঝালো গলায় বলে, তুই এখন যা। আমার ধান্দার সময় এটা।
ললিতার এমন আচরণে কষ্ট পায় সেলিম। মুখ ব্যাজার করে সে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে বের হয়ে যায়।
ললিতা টের পায় তার রাগ। হ্যাঁ বেশ তো, করুক রাগ। বুঝুক সে ললিতার ভালোবাসা অত সস্তা নয়। পুরুষ মানুষ বড় কুকুরের জাত। এদের বেশি লাই দিতে হয় না, ভাবে সে। পতিতা হতে পারে, কিন্ত সে চাইলেই ভালোবাসার ক্ষেত্রে অত আধুনিকতা দেখাতে পারে না। সব মেয়ের মতো স্বাদ-আহ্লাদ তারও আছে। কিন্ত এ ক্ষেত্রে পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বনই শ্রেয়! ইচ্ছে করেই একটু দূরে রাখে সে সেলিমকে।
এর সাথে সংসার পাতা যায় কীনা, আগে তা পরখ করতে হবে। মা বলত, ভালো পুরুষের অনেক ধৈর্য থাকে। দেখা যাক, এর আছে কীনা। এর আগেরবারও তো কেউ একজন ভালোবাসার কথা বলেছিল। কই, সে ভালোবাসা তো আর সত্যি হয়নি! সেই শুয়োর অন্য একজনকে নিয়ে ভেগেছে এই এখান থেকেই। কত বড় হারামজাদা! মনে মনে আচ্ছা করে গাল দেয় ললিতা আগের সেই পুরুষকে।
সেলিম তার সাথে কী আসলে খেলছে নাকি সত্যি ভালোবাসে, ললিতা বুঝতেই পারে না। মেয়েরা যত না জটিল, তারচেয়ে বেশি তো পুরুষ! ভাবে সে, তার দ্বিতীয় বিয়ে করা মা তাকে যে পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়, সে পুরুষ তাকে একটা বছর ধরে এমন সুখে রেখেছে, তার তো ভ্রম হয়েছিল, এই বুঝি সুখের জীবন! কই, তার ভালোবাসায় তো খাদ ছিল না। তবে তারে এমন জায়গায় বেচে দিল ক্যান সে? ভেবে কূল-কিনারা পায়নি ললিতা। সেসব নিয়ে প্রথমে অনেক কেঁদেছে সে। এখন আর কান্না আসে না। তার কোনও পিছুটান নেই। কিচ্ছু নেই। এখন যা, তা-ই জীবন। এই যে সেলিম আসে, তাকে সংসার-ঘরকন্নার কথা শোনায়, তার ভালোই লাগে । কিন্তু মুখ ফুটে সে ভালোলাগাটুকু দেখায় না। এর কারণ আছে। পুরুষ মানুষ অত সোজা নয়। ভেবে সে গর্বিত হয় যে, সেলিম জানে না কিংবা বোঝে না ললিতাও তাকে চায়। তবে এত তাড়াহুড়োর কি, সময় আছে তো। চোখ বন্ধ করে ললিতা নিজেকে সেলিমের রানির আসনে বসায়। একটা লাল শাড়ি পরে সে চেয়ারে পা উঠিয়ে হুকুম করছে চাকরকে, যেমন করে সেলিম বলে, তুই শুধু আয়েশ করবি। চাকর থাকব। চাকর, বড়লোকের বাইত যেমুন থাহে।
সেলিম লোক হিসেবে মন্দ নয়। দেখতে ভালোই। শুধু গায়ের রং সাহেবদের মতো নয়। তাতে কি? টাকা থাকলেই সুখ। আর সেলিম তাকে বলেছে তাদের ভাগ্য খুলে যাবে আর কয়েকটা দিনের মধ্যেই! তবে কি কাজ, সে বিষয়ে সেলিম কখনোই মুখ খোলে না। লোকটা চেহারায় বোকা হলেও ভারি চতুর, জানে ললিতা। তবে সেলিমের ধান্দা নিয়ে তার মাথা ব্যথা কি! সে নিজেও তো দেহ বিক্রি করে। পুরুষ মানুষের কাজ করাটাই আসল কথা। অন্তত সেলিম তার স্বামীর মতো নিজের স্ত্রীকে তো আর বেচে দেবে না।
৭ দিন ধরে সেলিম আসে না। ললিতার বুক কাঁপে। লোকটা কি তবে ধোঁকা দিয়েছে তাকে? অবশ্য আগেও এমন করে হঠাৎ আসত না কিছুদিন। তখন ললিতার এত আশঙ্কা হয়নি কেন? সেলিমকে পাত্তা দিত না বলে? সে সত্যি রাগ করে আছে ললিতার ওপর? ললিতার এমন ভাবনার স্রোত ঠেলে একসময়ে সেলিম এসে ঢুকল ঘরে।
তাকে দেখে এই প্রথমবারের মতো ললিতা এত খুশি হয়, এ খুশি আজ আর সে গোপন করে না। সেলিম টের পায়, ললিতা হয়তো তাকে ভালোবাসে। সেলিম আজ অনেকক্ষণ থাকে। ললিতাও ভালো-মন্দ কথাবার্তা বলে। যাবার সময় সেলিম বলে, দ্যাখ ললিতা, আমি এতিম মানুষ, এই দুইন্নায় কেউ নাই। আমি দুই কথা কই না, পরশু আইলে আমরা এখান থিকা সোজা নিজের ঘরে গিয়া উঠুম। সব সেটিং আছে। সে যে এতিম একথা আগেও বহুবার বলেছে। ললিতা জানে, তবে আজ মায়া লাগছে কেন? আজ মাস খানেক ধরেই সেলিম এই ঘর বাঁধার কথা বলছে। এখানেও এই ডেরায় সেটিং আছে তার। বুঝেছে ব্যাপারটা ললিতা আগেই।
ললিতার উত্তরের অপেক্ষা না করে সেলিম বেরিয়ে যায়। ললিতার আফসোস হয়, আরেকটু দাঁড়ালো না কেন সেলিম? তাহলেই সে আজ বলতো, আমিও ভালোবাসি তোমারে!
পরশু হয়। সকাল থেকে ললিতার বুক কাঁপতে থাকে। অজানা আশঙ্কায় নাকি আনন্দে, সে বুঝতে পারে না। সেলিম আসবে তো আজ?