রেজা ঘটকের গদ্য ‘তারেক মাহমুদ নিজেই একটা কবিতা’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২৩
পঁচিশ বছরের বেশি হবে তারেক মাহমুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব। আমাদের প্রথম পরিচয় ছবিরহাটে। নব্বইয়ের শেষের দিকে। তারপর থেকে আমাদের আড্ডা হতো ছবিরহাট, টিএসসি, আজিজ মার্কেট, শাহবাগ, শিল্পকলা একাডেমি, বেঙ্গল, বাংলা একাডেমি, একুশের বইমেলা, লিটলম্যাগ চত্বর, ধানমন্ডি বত্রিশ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, পিজি হাসপাতালের পূবালী ব্যাংকের সামনে, পিজি হাসপাতালের বটতলা, কনকর্ড, বাতিঘর, পাঠক সমাবেশসহ নানান জায়গায়। তারেক আমার মতো আড্ডাবাজ-স্ফূর্তিবাজ ছিল। আমি যেমন পিরোজপুর থেকে মাইগ্রেট হয়ে ঢাকায় আসি, তেমনি তারেক পাবনা থেকে মাইগ্রেট হয়ে ঢাকায় আসে।
তারেকের সাথে যখন বন্ধুত্ব হয় তখন ওর লম্বা চুল ছিল। ক্লিন সেফ। আমি কইতাম, দোস্তো তোরে কিন্তু নজরুলের মতো লাগে। জবাবে ও বলতো, লাগে মানে কি? আমি তো জীবন্ত নজরুল। এক কবি মারা গেলে সেই কবির আত্মা তখন অন্য কবির ওপর ভর করে, জানিস না তুই! না তুই এখনও স্মার্ট হইতে পারলি না, বলেই তারেক গান ধরতো, একটা কাতলা মাছে খাচ্ছে তামাক, আম গাছেতে ঠ্যাং তুলে...
তারেক গান লিখতো। নিজেই সুর করতো। নিজেই গেয়ে শোনাতো। বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া মানে নতুন সৃষ্টি হওয়া সেই গান বন্ধুদের শুনতে বাধ্য করতো তারেক। অথবা সদ্য লেখা কবিতা শোনাতো। আমাদের এমন অনেক দিন গেছে যে, আমরা মোল্লার দোকানে লাঞ্চ করে পার্কে বসে আড্ডা মারতাম, কবিতা-গান-গপ্পো-রাজনীতি দুনিয়ার সব বিষয়ের উজির-নাজির মারার পর হুট হরে তারেক অন্য কোথাও চলে যেত! অন্য কোনো আড্ডায়।
অনেক দিন আমরা আজিজে আলুভর্তা-ডাল-ভাত দিয়ে শর্টকাট লাঞ্চ করেছি। আমাদের অনেক দুপুর গেছে পাউরুটি আর চা-সিগারেট খেয়ে। একবার আমার ঢাকা শহরে বাসা নাই। পাবলিক লাইব্রেরি তখন ২৪ ঘণ্টা খোলা। আমাদের মতো যারা বাউণ্ডুলে তাদের প্রায় সবাই তখন পাবলিক লাইব্রেরির রাতের পাঠক প্লাস বাসিন্দা। আদতে আমরা তখন পাঠকের ছদ্মবেশে তিনটা চেয়ার জোড়া লাগিয়ে বই দিয়ে বালিশ বানিয়ে ঘুমাতাম।
একবার একটানা ৫৭ রাত আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে এভাবে কাটিয়েছি। তখন দুই/তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। দুইটা আড়াইটায় ঘুমালে সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে লাইব্রেরিতে জেলখানার মতো পাগলা ঘণ্টা বাজানো হতো। পাগলা ঘণ্টা বাজানো মানে আমাদের ঘুম ছেড়ে লাইব্রেরি ত্যাগ করার কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশনামা!
ঘুমকাতুরে চোখে অনেক সময় তারেকের সাথে সক্কাল সক্কাল আজিজে দেখা হয়ে যেত। জিগাইলাম, দোস্তো কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যাবে কোথায় বলতো? তারেক বললো, ব্যাটা তুই সোজা বুড়িগঙ্গার তীরে চলে যা। ওখানে নৌকায় ঘুমানোর সিস্টেম আছে। ৫০ থেকে ৭০ টাকায় রাতের খাবারসহ আরামসে ঘুমাতেও পারবি। আমি ব্যাটা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তোর কী বিশ্বাস হচ্ছে না? ৫০ টাকায় ফলি কাইত আর ৭০ টাকায় কাতলা কাইত! কাইত বুঝিস তো?
তারেক `পথিক` নামে একটা লিটলম্যাগ সম্পাদনা করতো। আমার কয়েকটা গল্প পথিকে ছাপা হয়েছে। কোরবানির ঈদের মাংস নিয়ে আমার একটা গল্প `একটি গল্পের খসড়া` ছাপানোর পর তারেক আমাকে বলেছিল, দোস্তো তোর এই গল্পটা অন্যরকম ভালো লেগেছে আমার। লেখক বিল তো আর দিতে পারব না। চল, দুজনে একসাথে লাঞ্চ করি, আজকের খাবারের বিল কিন্তু আমি দেব!
তারেকের নেশা ছিল কবিতায়, পেশা ছিল অভিনয়ে। একবার তারেক ইংরেজিতে একটা কবিতার বই প্রকাশ করলো, নাম `ডোরা`। আমাকে বইটা গিফট করে বললো, দোস্তো তোকে বইটার দাম দিতে হবে না। তুই বরং ইংরেজিটা একটু চেকে দেখবি। নেক্সট এডিশানে তোর করা কারেকশান ভার্সান ছাপাবো। এখন শুধু একটা সিগারেট খাওয়া।
ভাষা শহিদদের নিয়ে তারেক ডকুমেন্টারি বানানো শুরু করলো। আমাকে বলতো, দোস্তো প্রোডিউচার পাচ্ছি না। কী করি বলতো? ভাষা শহিদ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে নিয়ে তারেক স্ক্রিপ্ট লিখেছিল। কোথায় কোথায় চলে যেত তথ্য সংগ্রহ করতে। ঢাকায় ফিরে সেই গল্প করতো।
`চটপটি` নামে একটা সিনেমা বানাতে গিয়ে তারেক সর্বশান্ত হলো। সিনেমার শুটিং, এডিটিং, ডাবিং শেষ করেছিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কাকে দিয়ে করাবে সেই পরামর্শ করতো। অর্থের অভাবে প্রচুর স্ট্রেস নিতে গিয়ে তারেকের স্ট্রোক করলো। পিজি হাসপাতালে তারেক ভর্তি। কবি পিয়াস মজিদের কাছে শুনে আমি ছুটে গেলাম পিজিতে। বললাম, দোস্তো তোরে হাসপাতালের সিটে একদম মানায় না। মনে শক্তি রাখ। ওপাশে আখতার ভাইরে দেখলাম। ছড়াকার আখতার হুসেন।
তারেক বললো, দোস্তো তুই ডাক্তারদের অনুরোধ করে আমারে আখতার ভাইয়েরর পাশে সিট নিয়ে দে। তাইলে দেখিস আমি বেঁচে যাব। গোটা বিকাল হাসপাতালে দৌড়ঝাপ করে আখতার ভাইয়ের পাশে তারেকের সিটের ব্যবস্থা হলো। সত্যি সত্যি সে যাত্রায় তারেক বেঁচে গেল। দুই কবি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়লো।
আমার সাথে দেখা হলেই বলতো, তোর সিনেমায় আমারে একটা পাঠ দিস। আমি বলতাম, দেখি তোর সাথে কোনো ক্যারেক্টার মিলে কিনা? মিললে আমি জানাবো। তারেক সিনেমার গল্পটা সংক্ষেপে শুনলো। তারপর বললো, তোর ডাকাত ক্যারেক্টার কিন্তু আমি করতেছি, ঠিক আছে দোস্তো! সময় মতো ডাক দিস কিন্তু! ডাকাতের লুকটা কেমন হবে তারেক অভিনয় করে দেখালো!
২৬ অক্টোবর রাতে আমি শুটিং শেষে মাত্র বাসায় ঢুকেছি। রাত তখন প্রায় ১টা। কবি শাফি সমুদ্র ফোন করে জানতে চাইল, দাদা তারেক ভাইয়ের কোনো খবর পাইছেন? জিগাইলাম কী খবর? শাফি বলল, একটু খবর নিয়ে কনফার্ম করেন। উনি নাকি মারা গেছেন? শাফির ফোন কেটে আমি জামাকাপড় বদলাই। তখন ফোন করলো অরবিন্দ চক্রবর্তী। দাদা, আপনার বন্ধু তারেক ভাই`র খবর কী? কইলাম, খাঁড়া, আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।
আমি কচি ভাইকে ফোন দিলাম। কচি খন্দকার শুটিং শেষে তখন গাড়িতে বাসায় যাচ্ছেন। কচি ভাই বললো, তারেক বিষয়ে ইতোমধ্যে আমি অন্তত ৩০-৩৫টা ফোন পেয়েছি। তুই যা শুনেছিস, ঘটনা সত্য। তারেক চলে গেছেরে! কচি ভাইয়ের ভেজা কণ্ঠ! আমি একদম বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বন্ধু তারেক সত্যি সত্যি চলে গেছে। যেখান থেকে কেউ আর কোনদিন ফেরত আসে না। তারেকের সাথে আর দেখা হবে না, এটা এখনো আমি মানতে পারছি না।
সারারাত আমি আর একটা মিনিটও ঘুমোতে পারলাম না। চোখ লাগলেই তারেক এসে আমাকে জাদু দেখায়। একবার তারেক খুব জুয়া খেলা শুরু করলো। বন্ধুরা মিলে খেলে। আমাকে কয়েক দফা আমন্ত্রণ করেও নিতে পারেনি। তারপর শাহবাগে দেখা। পকেট থেকে তাস বের করে তারেক কয়েকটা জাদু দেখালো। বললো, খেলবি? পকেটে টাকা আছে? চল বসে যাই?
সকালে `ডোডোর গল্প Story of Dodo` চলচ্চিত্রের শুটিং সেটে ক্যামেরা অন করার আগে আমার পুরো ইউনিট কবি, গীতিকার, সম্পাদক ও অভিনেতা তারেক মাহমুদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করে। আমার সেটের অনেকেই তারেককে অভিনয়ের কারণে খুব ভালো করেই চেনে। তারেকের খবর শুনে প্রোডাকশনের মানিক অনেক কান্নাকাটি করলো।
তারেক পাবনা থেকে ঢাকায় এসেছিল আদতে কবিতার টানে। কবিতা তারেককে পয়সা দেয়নি তাই অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়েছিল। দেখা হলে সুখ দুঃখের গল্প করতো। তারেকের পাগলামি আমি খুব পছন্দ করতাম। একেবারে মাটির মানুষ। ভেতরে কোনো জটিলতা ছিল না। যা সত্য তাই প্রকাশ করতো। কষ্টগুলো স্পষ্টভাবে শেয়ার করতো। ভনিতা করা অপছন্দ করতো। তারেকের জন্য আমরা বন্ধুরা কিছু করতে পারিনি, এই কষ্ট সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে! তারেক বন্ধু আমার, ভালো থাকিস, আর তোর পাগলামিটা কখনো বন্ধ করিস না...
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা