রেজা ঘটকের কলাম ‘বইমেলা ও বইপ্রকাশ প্রসঙ্গে’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০২১

ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই বাংলাদেশে এখন বই প্রকাশের হিড়িক লাগে। হিড়িক বলছি এই কারণে যে, অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এখন আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসেই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল ও মননশীল বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের তাড়াহুড়োর কারণে অনেক সম্ভাবনাময় ভালো বইটিও ভালো সম্পাদনার অভাবে ঠিক বই হয়ে ওঠে না।

বই প্রকাশের এই হিড়িকে এখন নতুন লেখকদের পাশাপাশি সৌখিন লেখকরাও জড়িয়ে যাচ্ছে। জড়িয়ে যাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, আমলা, মুক্তিযোদ্ধা, পলিটিশিয়ান, গৃহিনী, এমন কি ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত। এদের সৌখিন লেখক বা অপেশাদার লেখক বা মৌসুমি লেখকও বলা যায়। সারা বছর না লিখে এরা বইমেলাকে ঘিরে এক ধরনের প্রস্তুতি নেন।

বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প এখনো সম্পাদনাসহ বইয়ের যথাযথ মার্কেটিং নিয়ে অনেক ঘাটতি মোকাবেলা করছে। বরং বলা যায়, এখনো দেশে প্রকাশনার পাশাপাশি সম্পাদনা পরিষদ সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে একটি ভালো বই যেমন পাঠকের কাছে অপরিচিত থেকে যাচ্ছে। তেমনি আবার একটি খারাপ বই বিজ্ঞাপনের কেরামতিতে অনেক পাঠক কিনে ঠকছেন।
 
আমাদের প্রকাশকরা এখনো সম্পাদনা বিষয়ে ততটা সিরিয়াস নন। মার্কেটিং বিষয়ে তো তারা নিজেরাই এখনো গুদামজাতকরণের প্রতিই আস্থাশীল। ফলে নতুন লেখকদের বই অমর একুশে বইমেলার পর সারা দেশের কোনো বইয়ের দোকানে আর সহজলভ্য নয়। ওটা এক বছরের জন্য প্রকাশকের গুদামের প্রিজনসেলে বন্দি থাকে। আলোচিত ও বিখ্যাত লেখকরা প্রকাশক কর্তৃক বইয়ের এই প্রিজনবাস তেমন টের পান না। কারণ, তাদের বইগুলো বইয়ের দোকানে ঠিকই কোনো না কোনো মাধ্যমে চলে যায়।

বিপত্তি বাধে নতুন লেখকদের বেলায়। আর বছর ঘুরে যখন ফেব্রুয়ারি আসে, তখন প্রকাশক সেই নতুন লেখককে দেখলেই একটা ঝামটা মারেন। ভাই, আপনার বইটা তো সব রয়ে গেল। আমাদের প্রকাশকরা বিখ্যাত লেখকদের পেছনে বিজ্ঞাপনে যা খরচ করেন, তা পুরোটা তুলতে না পারলেও সেই লোকসানের ঝালটা নতুন লেখকদের উপর চোখ রাঙিয়ে তখন উসুল করার চেষ্টা করেন।

ফলে, নতুন লেখকরা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশক সমস্যায় ভোগেন। অর্থ্যাৎ গোটা যজ্ঞে এখনো আমাদের প্রফেশনালিজম গড়ে ওঠেনি। প্রফেশনালিজমের সেই ঘাটতি আর লোকসানের সকল ধক্কল নতুন লেখকদের মুখ ঝামটে উসুল করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেন মহামান্য প্রকাশেকরা। অন্তত মনে মনে হলেও একটু ঝাল মিটিয়ে খুশি হন।

তাই বলে তো নতুন লেখকরা বই প্রকাশ থেকে পিছু হটবে না। বরং পুরাতনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই নতুন করে নিজেদের জাত চেনাতে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আলোচনায় উঠে আসবে। জাত লেখককে প্রকাশকরা বেশিদিন দূরে ঠেলে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এমনিতে লেখক ও প্রকাশকদের সম্পর্ক অনেকটা টেস্ট ক্রিকেট আর বৃষ্টির সম্পর্কের মত। এই ভালো টগবগে পিয়ার তো এই আবার মৃদুমন্দ কাসুন্দিপনা। টক-ঝাল-মিষ্টি মধুর সম্পর্ক যাকে বলে। তো একজন জাত লেখককেও এই চিরায়ত পাহাড় ডিঙ্গিয়েই আসতে হয়।

তাই নতুন লেখকদের জন্য প্রকাশকের মুখোমুখি হবার আগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন লেখার পাণ্ডুলিপি বা ম্যানুস্ক্রিপ্টের খুব ভালো সম্পাদনা। যা পড়েই প্রকাশক যাতে হুট করেই ঠোঁঠের ডগায় ঝুলিয়ে রাখা `না` শব্দটি ফট করেই বলতে না পারে। ভালো সম্পাদনা সহ একটি ভালো ম্যানুস্ক্রিপ্ট প্রকাশককে চট করেই সিদ্ধান্ত দেবার বদলে সেই প্রকাশকের মূল্যবান সময়কে তাড়া করতে উদ্ধুদ্ধ করে।

প্রকাশ না করলেও ভালো জিনিসের কদর সেই প্রকাশকের অন্তরে একটি অনুরণন ঘটায়। যা তিনি অন্য প্রকাশকের কাছে মুখ ফসকে বলে দেন। তখন কোনো একজন প্রকাশক নতুন লেখকের সেই ম্যানুস্ক্রিপ্ট প্রকাশে অনেক সময় আগ্রহ দেখান। এভাবে নতুন লেখক নিজের একটি ভালো সম্পাদনা করা ভালো ম্যানুস্ক্রিপ্টকে প্রকাশকের নজরে আনতে নিজেকেই তৎপর করতে পারেন।

যারা সৌখিন লেখক বা মৌসুমী লেখক, তাদের বেলায় প্রকাশক কে, তার চেয়ে বই প্রকাশ করার উপর তাদের বেশি আগ্রহ। অনেকে বইয়ের পুরো খরচ নিজেই বহন করেন। অনেকে প্রোডাকশন মান উন্নত করার জন্য প্রকাশককে নিজেই খরচ দেবার জন্য তাড়না দেন। অনেকে প্রকাশকের বিনিয়োগ করা পুঁজি ওঠাতে সহায়তা করার জন্য নিজেই কিছু বই অ্যাডভান্স ক্রয় করেন।

প্রকাশকরা সৌখিন লেখকদের বই প্রকাশে পুরিপুরি ব্যবসায়ী চিন্তাই বেশি করেন। জাত লেখকদের বেলায়, বিশেষ করে বিখ্যাত লেখকদের বেলায় সেই একই প্রকাশক অ্যাডভান্স চেক নিয়ে বা নগদ নারায়ণ নিয়ে লেখকের ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে থাকেন। অনেক সময় সৌখিন লেখকদের কোনো কোনো বইও সারা দেশে বেশ আলোচনার ঝড় তোলে। রাতারাতি সেই লেখককেও পাঠক চিনে ফেলে। কিন্তু একজন নতুন লেখকের জন্য প্রতি পদে পদেই ঝড় মোকাবেলা করেই আগাতে হয়। লেখক হবা আর কষ্ট করবা না, হাড়ে বাতাস লাগিয়ে হাঁটবা, তা কি করে হয়, মহাশয়।

সুতরাং নতুন লেখকদের এবং সৌখিন লেখকদের জন্য কিছু বিড়ম্বনা বরং অপেক্ষাই করে। সেই বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় বইয়ের ম্যানুস্ক্রিপ্ট ভালো করে সম্পাদনা করা। পরে ব্যাটে বলে ঠিকমত লাগলেই ছক্কা। নতুন লেখকদের জন্য কিছুটা বেশি বিড়ম্বনা থাকে। কেননা, লেখকদের তো বই প্রকাশের জন্য নিজেদের টাকা থাকার কথা না। প্রকাশক বরং লেখককে বইয়ের কপিরাইট দিতে বাধ্য। কিন্তু যার বই অবিক্রিত থেকে গেল, প্রকাশক পুঁজি ওঠাতে পারলেন না, লোকসান গুনলেন, তার কি হবে?

অবশ্যই সেই লেখকও কপিরাইট পাবেন। সেক্ষেত্রে সেই লেখকের উচিত নিজ উদ্যোগে বইটির বিক্রি বাড়াতে প্রকাশককে সহায়তা করা। আবার প্রকাশকের উচিত বিখ্যাত লেখকদের বইয়ের সাথে নতুন লেখকের বইটিকে সতীন না বানিয়ে যথাযথ সম্মান দেওয়া। অন্তত সর্বত্র পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থাপনা নিশ্চত করা। যারা নতুন লেখক, তারা যেন মনে না করেন, আপনারা রাতারাতি একজন শামসুর রাহমান হয়ে যাবেন, যে প্রকাশক নিজ গরজে আপনার বই ছাপাবে। নিজেকে একজন হুমায়ূন আহমেদ ভাবার কথাও যদি কেউ ভাবেন, তাদের পেছনে প্রকাশক কোন যুক্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ করবে, একবার ভাবুন। জবাবটা পেয়ে যাবেন।

যদি জবাব কিছু বাকি থাকে, যেমন ধরেন, কোনো প্রকাশক আপনার বই প্রকাশে সহায়তা করলো, সুতরাং আপনিও সেই প্রকাশকের খরচ উঠিয়ে আনাতে এক ধরনের সহায়তা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন। নইলে আপনার বই প্রকাশ করার ঝুঁকি কেন প্রকাশক নেবেন, এই প্রশ্নটি নিজেকে বারবার করুন, আসল জবাবটি পেয়ে যাবেন। আমাদের কাগজের দাম বেড়েছে। ছাপার খরচ বেড়েছে। বাইন্ডিং খরচ বেড়েছে। প্লেটের দাম বেড়েছে। শুধু বাড়েনি সম্পাদনা মান। তাই বই হয়ে প্রকাশ পাবার পরেও অনেক বই ঠিক সুখপাঠ্য হয়ে উঠছে না। ভালো সম্পাদনা এই ঘাটতি অনায়াশে পুশিয়ে দিতে পারতো। প্রথমে লেখকের দায়িত্ব তার ম্যানুস্ক্রিপ্ট যথাযথভাবে সম্পাদনা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা। তারপর প্রকাশকের কাজ সেই ম্যানুস্ক্রিপ্টকে একটি সুন্দর বইয়ে রুপান্তর করা।

মাঝখানে থাকে আরো অনেক যজ্ঞ। বইয়ের ভালো একটা প্রচ্ছদ করা। একজন পাঠক কিন্তু একটি সুন্দর প্রচ্ছদ দেখলেই প্রথম দর্শনেই অনেকটা কাবু হয়ে যান, বইটি পড়ার জন্য। বইয়ের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এটি অনেকটা ভূমিকা রাখে। একটি ভালো বই অনেক সময় ভালো নামের অভাবে পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয় না। আমাদের দেশে অনেক বিখ্যাত লেখক আছেন, বড় বড় পুরস্কারও পেয়েছেন, মাগার ম্যানুস্ক্রিপ্টে সঠিক বাক্য লিখতেই ভুল করেছেন। একজন ভালো সম্পাদক তাদের এই দুর্বলতা অনায়াসে দূর করে দিতে পারেন। ভালো সম্পাদনার কোনো বিকল্প নাই। বই ভালো সম্পাদনা শেষে প্রকাশ করাই হলো একজন প্রফেশনাল প্রকাশকের কাজ।

প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় পাঁচ হাজার নতুন বই প্রকাশ পায়। কিন্তু ভালো সম্পাদিত বই প্রকাশ পায় হাতে গোনা কয়েকটি। এত বইয়ের ভিড়ে সেই বইটি খুঁজে পাওয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্চ! আমাদের প্রকাশকদের মধ্যে প্রফেশনালিজমের ঘাটতির কারণে হাজার হাজার বই প্রকাশ পাচ্ছে কিন্তু পড়ার মত বই কোথায়? প্রকাশকদের এখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে মুরগী ধরা। নতুন লেখক, সৌখিন লেখক, মৌসুমী লেখকদের এরা মুরগী ডাকে। মুরগী পেলে মুরগীর টাকায় এরা ব্যবসা করেন। মাঝখানে আবার প্রকাশক হিসেবে নিজেরা ক্রেডিট নেন।

বইমেলায় এখন ভালো লেখকদের চেয়ে আবার এসব মুরগীদের বই বেশি চলে। সারা বছর তারা নানান কিসিমের বিজ্ঞাপন করেন। স্যোশাল মিডিয়ায় নানান গ্রুপ করেন। নানান অনুষ্ঠান করেন। বই নিয়েও নানান অনুষ্ঠান করেন। এসব গ্রুপ আবার একে অপরে পরিচিত হন। বইমেলায় গিয়ে তারা নিজেদের বইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। অথবা নিজেরাই স্টলে বসেন। এরা আবার নানান কিসিমের পুরস্কারের আয়োজন করেন। নিজেরা নিজেরা নিজেদের পুরস্কার দেন। ফলে প্রতিষ্ঠিত লেখক বা জাত-লেখকদের জন্য এটা এক ধরনের বিড়ম্বনা তৈরি করে। প্রকাশকরা আবার এদের উদাহরণ দিয়ে প্রফেশনাল লেখকদের নানান কিসিমের খোঁচা মারেন। এই ধরনের খোঁচাখুঁচির মধ্যেই বইমেলা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বইয়ের বিপণন নিয়ে প্রকাশকদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখি না। যা একটি ভালো বইয়ের জন্য নয়া চ্যালেঞ্চ!

৬ ডিসেম্বর ২০২১

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা