রুদ্র হকের গল্প ‘আতরের গন্ধ’
প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০১৯
আতর কি মৃত মানুষের শরীর থেকে উৎপন্ন হয়? মাঝে মাঝে বাসে উঠে বসা মাত্রই আমি আতরের উৎকট গন্ধ পেতে থাকি। এ সমস্যাটা প্রায়ই হয় আমার। একজন বুড়ো ভিক্ষুক ভারী চশমার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মৃত্যুর বদলে তিনি টাকা চাইছেন। আমি যমদূত ভেবে টাকা বাড়িয়ে দিলাম। তার মুখভরা গ্রামীণ রেখাচিত্র। অথচ আমি কল্পনা করে এসেছি মৃত্যু আসলে এক হাওয়া শুনশান শান্ত মফস্বল হতে আসে। যে শহর আমি ছেড়ে এসেছি; সেই শহরে আর ফেরা হয়নি।
ছায়াঘেরা শান্ত আকাশের নিচে ঝোপঝাড়ে ঘেরা কবরের নিচে শায়িত কিছু পরিচিত শবদেহের মতোই নির্জন সেই শহর স্মৃতি হয়ে আছে চোখে। আমি জানি কিংবা সবাই জানে একটি বিন্দুতে আমরা সকলেই মিলিত হবো একদিন। শরীরশূন্য হয়ে হাওয়ায় ধীরে ধীরে জড়ো হবো সবাই। তারপর শুধু উড়ে বেড়ানো আকাশ থেকে আকাশে।
তবু আতরের গন্ধ আমার অসহ্য ঠেকে। মনে হয় মৃত্যুর সঙ্গে এর গভীর কোনো যোগসাজোশ আছে। সফেদ পোশাকের কোনো বৃদ্ধর শরীরে যখন এই আতরের গন্ধ পাই, আমার মনে হয়, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা এই বিচ্ছিরি বুড়োকে কেন যমদূত এখনই ডেকে গুম করছে না। এক বুড়োর পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে আমি খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছিলাম চোখ উল্টে তাকে মরে যেতে। তিনি আমার পিতা। অনেক লোকের ভিড়ে ছোট্ট এক বালকের মৃত্যু দেখে ফেলার মতো ছিল ব্যাপারটা। শুধু তাই নয়, একটা নিশ্চল নগ্ন স্নান আর তার ঝুলে পড়া লিঙ্গও দেখে ফেলার খুব সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তারপর সেই আতরের গন্ধ।
স্বপ্নের ভেতরও তিনি ফিরে ফিরে আসতেন। আমি ভয়ংকরভাবে ঘৃণা করতাম তার এই ফিরে আসা। একবার তার মাথায় সজোরে আঘাত করে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। আরও কিছু পরিচিত লাশ, শায়িত, ঘুমন্ত দেখেছি আমি। আর সেই বিদঘুটে আতরের গন্ধ। যে বৃদ্ধের হাতে দু’টাকার ময়লা নোট ধরিয়ে দিয়েছি আমি, তার জন্য আমার অশেষ করুণা রইলো। কেননা আর কিছুদিন পরই, হয়তো আজই তার শরীর কফিনে পুরে দেয়া হবে। কফিনের মূল্য কত? এই ভাবতে ভাবতেই কমদামি কাঠের কিছু কফিন চোখে পড়লো রাস্তায়, বাসের জানালায়। ব্যবহৃত কফিনের ফেরতযোগ্যতা কি আছে? নাকি শিশুদের জন্য খেলনার নৌকা হয়ে রূপান্তর ঘটে তার?
বাসের সিটে কেন আমি রোজ আতরের গন্ধ পাই, এর সদুত্তর কেউ দিতে পারেনি। ফিসফিস করে একদিন পাশের যাত্রীকে, আমার প্রেমিকাকে, বাসের হেলপারকে জিগেস করেছি। যেহেতু তাদের নাক নেই, ঘ্রাণশক্তি নেই শুধু বিস্মিত হবার ক্ষমতাই আছে, তারা তাই হয়েছে।
দীর্ঘ জ্যামে বসে তন্দ্রার ভেতর আমার মনে পড়ে, সুনসান মফস্বলের সেই বালকের কথা। অন্যসব মানুষের সাথে মিশতে না পারার ভেতরও মিশে যাবার অদ্ভুত এক মৌনকৌশল রপ্ত করেছিলো সে। একা একা দীর্ঘ মাইল স্কুলের রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে রাজহাঁসের তাড়া খেত বৈদ্য বাড়ির পুকুর ঘাটের কিনারায় এসে। স্কুল ড্রেসের টাইয়ের লাল অংশটার জন্য? কেন তাকে দেখলেই কঁক কঁক করে মায়ের বয়েসি রাজহাঁসগুলো তাড়া দিতো তাকে? তার শরীরে কি তারা মৃত্যুর গন্ধ পেত? ভয়ে, অমঙ্গল কামনায় এই তাড়িয়ে ফেরা?
ক্লাসে মন্টি একদিন নেপথলিন গিলে ফেলেছিল বলে খুব হৈ চৈ। বমি করার বৃথা চেষ্টা করে রক্তিম হয়ে ফিরে এসে একটা নেপথলিন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল সে, দেখো কি সুঘ্রাণ! না, নেপথলিনে মৃত্যুর গন্ধ নেই, নেপথলিনে আছে অসীম এক সুবাস।
কী সুবাসময় এই পৃথিবী! ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে শহরের এক নামি সংগীতশিল্পী (নারী, বয়স আটত্রিশ) খুব আকুল হতেন। আমার কাছে হন্যে হয়ে, এবং আমার কাছেই চাইতেন ছাতিম ফুল। আমি ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অন্ধকার থেকে আসা আতরের গন্ধ পেয়ে সরে এসেছি। অথচ নারী শরীরের ঘ্রাণ আমাকেও কি ভীষণ আকুল করে। এক নারী নির্মাতার (বয়স ২৬) শরীরের ঘ্রাণ আমাকে আকুল করে তুলেছিল। আমি তার সাদা স্তনে মুখ ঘষতে ঘষতে তাকে ব্যকুল করে তুলেছিলাম। তার বগলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে আমিও কি উন্মাদ হয়ে উঠিনি?
বাস দীর্ঘ জ্যামে বসেই আছে। একটু একটু করে এগোচ্ছে, আর যাত্রীরা কেউ কেউ খুব ঘুমুচ্ছে। কারো হাতে ফুলের মতো আমড়া ণরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে ভ্রাম্যমান বণিকেরা। এর চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো এই ভেবে অনেকেই নেমে পড়ছেন। আমিও কিছুটা পৃথক কিছুটা সন্দেহের চোখে মধ্য দুপুরের দিকে তাকিয়ে দেখি ভুল ঋতুতে ডেকে চলছে একটা কোকিল। রাস্তায় দারুণ উত্তাপে ভ্যাপসা গরমে গাড়ির টায়ার পোড়া এই গন্ধের সঙ্গে নারী যোনির ঘ্রাণের খুব মিল পাই আমি।
কী সুবাসময় এই পৃথিবী! বলে নিজেই হাসতে থাকি— হা হা...
ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে পেট খালি করা হিসু করি আমি। পেছন থেকে বন্ধু কাঁধে থাপ্পড় দিয়ে চমকে দেয়— ‘রাস্তার পাশে হেঁটে হিসু ছেড়ে চলে যাওয়া জনগণ— হেঁটে হেঁটে কূটনৈতিক হয়ে যাই’ বলে হাসতে থাকে আদর। থমকে যাওয়া হিসু অস্বস্তি নিয়ে শেষ হয়। স্বস্তির হাওয়া আসে, হেঁটে হেঁটে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমরা সামনে হাঁটি। আদর জিগেস করে, আতরের গন্ধটা এখনও পাস? মাথা নাড়ি।
একটা বড় মিছিল চলে যায় নাকের ডগা দিয়ে। আমরা আড় চোখে তাকিয়ে দেখি। একদল মানুষ মৃত্যুর গন্ধ গায়ে মেখে স্লোগান দিতে দিতে হেঁটে চলে যায়।