রিয়াজ মাহমুদের গল্প ‘যে বনে আগুন জ্বলে’

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২০

গালাগাল দেয়ার কোনও সময়সীমা নেই। যখনই মনে আসে গালাগাল দিতে থাকে। গালাগাল দিতে দিতে ঘুমাতে যায় মেহরুন। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরেও সে গালাগাল দেয়। আস্ত একটা দিন ফুরোয় মানে জীবনের একটা আয়ু ফুরোয়। সেদিকে কোনও খেয়াল নেই। কাজকর্মও তেমন নেই। একবেলা রাঁধে, তিনবেলা খায়। ভেতো বাঙালি। কোরমা-পোলাওতে পেট ভরে না। বিরিয়ানি, পোলাও গলা সমান খেলেও ভাতের খিদে থেকে যায়। পেটের খিদে ভাতে মিটায়। মনের খিদে মিটায় কে? গালাগালিই শেষ সম্বল।

মনের জ্বালা কমে, জিভের ব্যায়ামও হয়। একের ভিতর দুই। এ যেন বাম্পার অফার। কেউ একজন কৌতূহলি মেহেরুনকে প্রশ্ন করে, কারে এত গালি দাও বউ? সদ্য তেতেওঠা তেলের কড়াইয়ে পানির ছিটা পড়ার সাথে সাথে যেমন জ্বলে ওঠে, তেমন জ্বলে উঠে মেহরুন জবাব দিল, কারে আর! মোর সোহাগের সোয়ামিরে।

একটা পার্লারে বিউটি শিয়ানের কাজ করতো মেহেরুন। এক পলকের দেখায় প্রেম। হঠাৎ মনের মধ্যে সুখের অনুভূতি। আকাশে বাতাসে কানাকানি। তার কথা ভেবে কখনো মনে হয়, পৃথিবীতে আছি। পরক্ষণে মনে হয়, এ কোথায় আমি! চারদিকে সুখের আবাস। সুখের ঢেউ মনের নদীতে আপন মনে দুলে যায়। কত কী ভাবনা হৃদয়পটে ভেসে ওঠে। কত আশা আর স্বপ্নের আনাগোনা চোখের মাঝে। ঘুমাতে গেলেও আনন্দ। জেগে থাকলে আরো আনন্দ।

সবুজ শ্যামল নির্মল পরিবেশ যাবতীয় দূষণ ঘিরে রাখে। এ যেন আমার আমি নয়। এ এক নতুন আমাকে খুঁজে পাই। কারণে-অকারণে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তার ছবি। সে ব্যথা কইতেও পারি না, সইতেও পারি না। অতঃপর প্রণয়ের চূড়ান্ত সফলতা বিয়ে। মেহেরুনেরও যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন তাকে হারাবে কেন! বিয়ে করে সুখি হতে চাইলো। যাকে ভালোবেসেছে তাকেই বিয়ে করেছে। আকাশের জোৎসনা আর মেঘেদের হাসি দাম্পত্যজীবন রঙিন করে তুললো।

বিউটিশিয়ানের কাজ ছেড়ে সংসার বাঁধলো। স্বামীর বুকে মাথা রেখে পরম স্নেহে অতীত যন্ত্রণা ভুলে যেতে চাইলো। যন্ত্রণা তো ভুলতে দেয় না নিজেকে। বারে বারে সামনে আসে। নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। সুখের ঘরে যন্ত্রণা হানা দেয়। যন্ত্রণার হাত থেকে নিস্তার নেই কারোর। মেহেরুন নিস্তার পাবে কেন! তার বুকেও যন্ত্রণার কাঁটা বিঁধালো তারই স্বামীর প্রথম স্ত্রী! ভরা নদীর উজান ঢেউ কূলে আছড়ে পড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিল। যে আকাশে শরৎয়ের মেঘ খেলা করতো, সেখানেই কালবৈশেখী ঝড়ের বজ্রনিনাদ শুনা গেল। মুহূর্তেই হাবিয়া দোজখের অগ্নিকুণ্ড ফুলকি দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করলো মেহেরুনের জীবন্ত আত্মাকে।

বহুবিবাহ প্রথা চলে গেছে। পুরুষে রচিন্তায় বহুবিবাহের বাসনা এখনো উঁকি দিয়ে যায়। কেউ প্রকাশ করে। কেউ গোপনে লোভ সংবরণ করে। পূর্বসূরীর কাছ থেকে পাওয়া বাসনা ত্যাগ করা এত সহজ নয়। মেহেরুনকে না জানিয়েই বিয়ে করেছে। তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর এক মেয়ে, দুই ছেলে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথেই থাকে সে। নানা কাকুতি মিনতি করে মেহেরুনকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছে। তখনও তার প্রথম স্ত্রীর কথা বলেনি। অনেক রাত করে মেহেরুনের স্বামী তার কাছে আসতো। আবার অনেক ভোরে চলে যেত। আসা-যাওয়া কাকপক্ষীও টের পাওয়ার উপায় ছিল না।

সময়ের সাথে সাথে মেহেরুনের শ্বশুর-শ্বাশুড়িও জানতে পারে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা। তারা তাকে বাড়িতে তুলতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিয়ের সময় যে স্বপ্ন মেহেরুনের অপূর্ণ জীবনকে পূর্ণতা দিল, এখন আবার শূন্য হতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে মাতৃগর্ভে ভ্রণও বিকাশ লাভ করছে। সে তার আগমনী পূর্বাভাস দিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। সুখের স্বপ্নে বাঁধা ঘরে যন্ত্রণার নগ্ন মুহূর্ত দরজায় এসে দাঁড়ালো। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি লোক পাঠিয়ে হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করেছে। বিয়ে করা যেন মস্ত পাপ। দুজনের সম্মতিতে বিয়ে করে যন্ত্রণার আগুনে মেহেরুন একাই পোড়া শুরু করলো।

ক্রমাগত চুলোর আগুন চিতার আগুনে রূপ নিল। তার স্বামীর আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কোনোভাবেই তার সাথে মেহেরুন যোগাযোগ করতে পারছে না। এভাবে সপ্তাহ পার হলো। মাস ফুরিয়ে গেল। পাশের রুমের ভাড়াটিয়া পরিবর্তন হলো। বাড়িঅলা ভাড়ার জন্য মেহেরুনকে চাপ দেয়া শুরু করলো। মাতৃগর্ভের বেড়ে ওঠা ভ্রণ আকৃতি ধারণ করতে শুরু করলো। সেও অধিকার চায়। পৃথিবীতে আসার প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনিশ্চয়তার এই পৃথিবী মানুষের বড়ই প্রিয়। আসার সময় দুনিয়াকে জানিয়ে আসে। যাওয়ার সময় কাঁদিয়ে বিদায় হয়। ভরণ পোষণের জন্য যে টাকা-পয়সা তার স্বামী বহন করতো, তা বন্ধ হয়ে যায়।

কপালের নিচে দু‘চোখের অবস্থান হয়তো তাই! কপালে কি লিখা আছে তা পড়তে পারেনি মেহেরুন। আর কোনো উপায় না দেখে কখনো কপাল চাপড়ানো নয়তো স্বামীর চৌদ্দগুষ্ঠিকে গালাগাল দিয়ে মনের খেদ মেটায়। এছাড়া মেহেরুনের সান্ত্বনা পাওয়ার আর কোনো উপায় নাই। একজন নারীর কত উপায় থাকে। স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেবর-ননদ, ননদের জামাই। মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন। মেহেরুনের বাবা-মা থেকেও নেই। একটা ভাই ছিল, সে তার স্ত্রীকে নিয়ে শহরের অন্যপ্রান্তে থাকে। কখনো বোনের খবরও নেয় না। এক বান্ধবীর সহযোগিতায় বিউটিশিয়ানের কাজ পেল। সেও এখন নেই। আবারও চাকরি করার চেষ্টা করলো। বেকারের দেশে চাকরি পাওয়া অমবশ্যার চাঁদ পাওয়ার মতো।

দুঃখ ও কষ্টের সাথে যন্ত্রণা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গর্ভের সন্তানও পেটের ভিতর ক্ষুদার জ্বালায় উলট-পালট করতে থাকে। মেহেরুন দুর্বল হয়ে পড়ে। তার সামনে দুটো পথ। ভিক্ষাবৃত্তি নয়তো পতিতাবৃত্তি। অন্যের ধারে ধারে হাত পেতে বেড়ানো মর্যাদাহীন। অন্যের কিয়ৎক্ষণের আনন্দের শয্যায় সাথী হওয়া আরো অমর্যাদার। পেটের ক্ষুদা তো আর মর্যাদা মানে না। প্রকাশ্যে হাত পাতার চেয়ে গোপনে শরীর পাতা শ্রেয়। মেহেরুন আর ভাবতে পারে না। যন্ত্রণার নীলে সে আরো রঙিন হয়ে উঠেছে। বিশাল এই শহরের অসহায় নারী সহায় খুঁজতে থাকে। কপালের দোষ দিতে দিতে বোবা কপাল আর দোষের দায় নিতে চায় না। অসহায় মেহেরুন শয্যায় পড়ে থাকে।