রিয়াজ মাহমুদের গল্প ‘এমদাদের দিনরাত্রি’
প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০২০
অফিসের কর্মচারীরা যখন বসদের চামচামিতে ব্যস্ত, তখন এমদাদ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আপনমনে সবগুলো জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে ব্যস্ত। কারো ধার ধারে না সে। বসদের তোষামোদও করে না। বস তোষণের কর্পোরেট দুনিয়ায় এমদাদকে কে রাখবে? তাই একবার ছাঁটাই করতে চাইলো। মামলার ঝুঁকি এড়াতে তিন মাস আগে নেটিশও পাঠালো। ভাবলো, এবার একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। যারা এমদাদের এই আপোসহীনতাকে অপছন্দ করতো তারা মুচকি হাসি হাসলো। এবার দেমাগ ছুটিয়ে দেবে। কেউ কেউ একে অন্যকে খোঁচাখুঁচি করলো। কিন্তু এমদাদ নির্বিকার।
দিনের সমস্ত ক্লান্তি, দুর্দশা ঝেড়ে নতুন প্রত্যয়ে সকালের সূর্য যেমন নিয়ম করে ওঠে, এমদাদওঅফিসে আগেরম নিয়ম মতো আসা-যাওয়া করতে লাগল। যতটুকু তার কাজ তা মনযোগ দিয়ে করে। বাকি সময় বসে বসে একমনে পত্রিকা পড়ে। কোনো আক্ষেপ নাই। কারো প্রতি বিদ্রুপও নাই। দিন যায়, রাত আসে। পাখির কলকাকলি স্থান করে নিয়েছে শহরের যানবাহনের দূষিত শব্দ। যানজট কেড়ে নিয়েছে মানুষের মূল্যবান সময়। তবুও কর্মহীন মানুষেরা ভিড় জমায় শহরে। জীবনের ঝুঁকি আছে। আবার জীবিকারও নিশ্চয়তা আছে। জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি তুচ্ছ।
দশ-বিশ-ত্রিশ তলায় ঝুলে ঝুলে রং করে চলছে রংমিস্ত্রিরা।একটু অসাবধানতায় চিরতরে নিভে যেতে পারে প্রাণপ্রদীপ। দেখতে দেখতে এমদাদের চাকরিচ্যুতির সময় দরজায় নক করতে শুরু করলো। হঠাৎ একদিন এমদাদের ডাক পড়লো অফিসের বসদের মিটিংয়ে। অফিসের সাধারণ ব্যবস্থাপক নানা কথা জানতে চাইলো। তারপর ছেলেটা ব্যতিক্রম বলে ব্যবস্থাপক চাকরিচ্যুতিতে সায় দিল না। এ যাত্রায় এমদাদের আপসহীনতা সাধারণভাবে জয়ী হলো। কারো কারো মন কাচের আয়নার মতো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল। কেউ কেউ বসের এই আচরণকে স্বৈরাচারী বলে আখ্যা দিল। মুখ ফুটে বলার সাহস পেল না।
তাদের তেলমাখা চরিত্রকে তারা বদলাতে পারলো না। যদিও কারো সাথে এমাদদের শত্রুতা নেই। তবুও তারা আপোষহীনতাকে, নৈতিকভাবে শক্তিশালী মানুষদের কর্পোরেট দুনিয়াতে থাকতে দিবে না বলে পণ করেছে।
গোটা দুনিয়া মহামারিতে আক্রান্ত। দেশে-দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। সন্তান বাবার সহযোগিতায় এগিয়ে আসার সাহস পেল না। কে কাকে সহযোগিতা করবে! সবারই প্রয়োজন। এমদাদদের অফিসে সিদ্ধান্ত হলো বসরা ছুটি পাবে। কর্মচারীরা অফিসে এসে আধবেলা কাজ করবে। কর্মচারীদের জীবনে ঝুঁকি কিসের! চাকরি হারানোই তো তাদের বড় ঝুঁকি। বসদের জীবনটাই জীবন। কর্মচারীর ছুটি কিসের? এক অফিসে দু-নিয়ম চালু হলো। বসরা থাকবে ছুটিতে, কর্মচারীরা অফিসে। ভিতর ভিতর সবাই ক্ষিপ্ত হলেও ক্ষোভ প্রকাশ করার সাহস কারো নাই।
যেখানে তোষামদ রক্তে মিশে যায় সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ তো গুরুতর অপরাধ। অফিসে গুমট নিস্তব্ধতা। পিয়ন করিমের চায়ের কাপে চামুচের টুংটাং শব্দ আজ থেমে গেল। কি-বোডের্র খটখট শব্দ আজ প্রাণ হারালো। অদ্ভুত এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হলো যেন সবাই সবার শবদেহ কবর দেয়া প্রত্যক্ষ করছে। নববধূর লালশাড়ি বিধবার বেশ ধারণ করলো। সবাই অপেক্ষা করছে কখন প্রাণটা যাবে তা পরখ করার জন্য। মৃত্যুর পর স্বর্গে যাওয়ার লোভ থাকলেও মরণের ভয়কে জয় করতে নারাজ।
আপোষহীন এমদাদ একথা শুনার পর প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। মুহূর্তে দিকবিদ্বিক বিবেচনা না করে বলে উঠলো, আমি বসের বিরুদ্ধে মামলা করবো। এমডি, জিএম ও এজিএমসহ অফিসের তিন বসের বিরুদ্ধে আমি মামলা দিব। দেশ থেকে আইন-আদালত কি সব উঠে গেছে? মামলা করে এদের জেলের ভাত খাওয়াবো। ফাইজলামির একটা সীমা থাকা উচিত। কথাটা এমদাদের মুখ থেকে খসে পড়তে না পড়তেই যারা এতক্ষণ নানা কথা ভেবে আক্ষেপ করলো তারাই বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গিয়ে বসদের কানে একথা পৌঁছে দিল।
উচ্চ গতিতে শীতাতপ যন্ত্র চলছে। বসদের মিটিং বসেছে। এমদাদকে সেখানে ডাকা হলো। শীতাত পনিয়ন্ত্রিত কক্ষে এমদাদ ঘামতে শুরু করলো। বুকের ভিতর হৃদপিণ্ড ধপাস ধপাস শব্দ করছে। প্রচলিত সময়ের যশ-খ্যাতি ও উচ্চ বিলাসি এক ডজন চোখের তীক্ষ্ণ আগুন এমাদদকে পুড়িয়ে মারতে চাইলো। যে জিএম এমদাদকে চাকরিচ্যুত করতে বাধা দিয়েছি, আজ তার বিরুদ্ধেও মামলা করার কথা বললো। এত দুঃসাহস! প্রথমে জিএমই শুরু করলো গালাগাল। শেষ করলো এমদাদের বিভাগীয় প্রধান। উড়ন্ত পাখা কেটে দেয়ার হুমকি দিল। গালাগাল করে ক্লান্ত শ্রান্ত বসরা সবার ছুটি মঞ্জুর করলো। এমদাদ মুচকি হাসে আর মনে মনে বলে, ঠেলার নাম বাবাজি!
ছুটি সবার মঞ্জুর হলো। সবাই আনন্দ চিত্তে নিজ নিজ নীড়ে ফিরে গেল। সময়ের সাথে সাথে দুঃশ্চিন্তা বাড়লো এমদাদের ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ পলিসির কর্পোরেটে ছুটি শেষে এমদাদের চাকরি থাকবে তো?