রিমান্ড,আইনি কথা আর বাস্তবতা
মোঃ সোহাইল জামিল সরকারপ্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০১৮
রিমান্ড শব্দের অর্থ ফেরত আনা বা তলব করা, অর্থাৎ আমলযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের হেফাজত থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসার নামই হচ্ছে রিমান্ড। বাংলা একাডেমীর অভিধান অনুযায়ী, রিমান্ড শব্দটির অর্থ সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত থেকে পুলিশের হেফাজতে পাঠানো। রিমান্ড শব্দটি ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ সালের কোথাও খুজে পাওয়া যাবেনা। তাহলে খুব সহজেই প্রশ্ন আসতে পারে পুলিশ রিমান্ড চায় কোন আইনে? উত্তরটাও খুব সহজ, ফৌঃকাঃ ধারা ১৬৭ মতে পুলিশ আদালতের কাছে অভিযুক্ত কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করে থাকে আর এটাকেই আমরা রিমান্ড বলে জানি।
সাধারণত পুলিশ রিমান্ডের জন্য লিখিত আবেদন করার সময় "উপযুক্ত পদ্ধতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে" কথাটি উল্লেখ্য করে। এই উপযুক্ত পদ্ধতিটা যে কি সেটা সাধারন মানুষের আর জানার বাকি নাই, শুধুই কি সাধারন জনগণ? এই খবর সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌছেছে। আর এই জন্যই ২০০৩ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বনাম বাংলাদেশ মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কিছু দৃষ্টান্ত-নির্দেশনা দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত যার মধ্যে (১)স্বচ্ছ কাচের দেয়াল বেষ্টিত ঘরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে (২)জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে অভিযুক্তের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে (৩)প্রতিবার রিমান্ডের মেয়াদ তিনদিনের বেশি হবেনা (৪)কাচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে তার আইনজীবী বা আত্মীয়ের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে আদালত কিন্তু দিক নির্দেশনার কোথাও বলেনি এই দিক -নির্দেশনা না মানলে পুলিশের বা প্রশাসনের কি হবে? আর সে জন্যই সর্বোচ্চ আদালতের এই দিক- নির্দেশনা নিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনের তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। তবে ২০১০ সালে পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে থেকে পর পর তিনজন মারা যাওয়ার ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য রিমান্ড বিষয়ে পুলিশের উপর ১২টি দিকনির্দেশনা জারি করে। কিন্তু হায় তাতেও কোন ফলাফল আসেনি । এখানেই শেষ নয় অমানবিক নির্যাতন করে মানুষ মেরে ফেলা বন্ধের বিষয়ে ২০১৩সালে "নির্যাতন ও হেফাজত মৃত্যু(নিবারন) আইন সংসদে পাশ করা হয় যার শুরুতেই বলা হয়-
নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে প্রণীত আইন
যেহেতু ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হইয়াছে;এবং
যেহেতু ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত দলিলের মাধ্যমে উক্ত সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হইয়াছে; এবং
যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করিয়াছে; এবং
যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করিয়া নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশে উপরিউক্ত সনদে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহের কার্যকারিতা প্রদানে আইনী বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল:—
কিন্তু এতকিছুর পরেও বন্ধ হচ্ছেনা রিমান্ড নামে নির্যাতনের এই নৃশংস পদ্ধতি। নৃশংস শব্দটি শুনতেই অনেকে হয়ত বলবেন রিমান্ডের সাথে এই শব্দটা জুরে দেয়া কতটা প্রাসঙ্গিক? রিমান্ডের সাথে নৃশংসতা শব্দটির প্রাসঙ্গিকতা দেখাতে গেলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোরটের উদাহরণ দিতে হবে যেখানে নৃশংস নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের উল্লেখ্য করা হয়েছে, সে রিপোর্ট গুলো পড়লে দেখা যায় রিমান্ডে নেয়া অভিযুক্তকে ১৪ ধরনের নির্যাতন করা হয় যার সবগুলোই নৃশংস যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল "গিটা নির্যাতন, বাদুর ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, বোতল থেরাপি, ডিম থেরাপি, ডিস্কো ডান্স নির্যাতন, সিলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন, উলঙ্গ করে মারা ইত্যাদি" নির্যাতনের ধরন অনুযায়ী এই প্রত্যেকটা নৃশংসতার নাম করন করা হয়েছে।
এখন আমরা যদি দেখি রিমান্ডে পুলিশ আসলে কোন ধরনের অভিযুক্তদের কে নেয় এবং এই সকল নৃশংস নির্যাতন করে থাকে? তাহলে আমরা দেখতে পারব ৮০ % অভিযুক্তই রাজনৈতিক মামলায় আটক। এখন কথা হচ্ছে এই যে পুলিশ আইনের আশ্রয় নিয়ে বা দোহাই দিয়ে একজন অভিযুক্ত কে রিমান্ডে নিচ্ছে সেই একই আইন আবার একজন আটক ব্যাক্তিকেও কিছু মৌলিক অধিকার দিয়েছে কিন্তু হায় অভিযুক্ত ব্যাক্তি তার প্রাপ্য আইনি অধিকার টুকু থেকে পুরপোরিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন খুব সহজেই সকলের মনে একটা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, এত এত আইন থাকার পরেও কেন রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধ হচ্ছেনা অথবা এত এত আইন করে কি লাভ হয়েছে যদি রিমান্ড নামের নির্যাতন বন্ধই না হয়? উত্তরটাও খুব সহজ, একটা রাষ্ট্র যখন অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, যখন রাষ্ট্রের সকল অংগ ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করনে ব্যাস্ত থাকে তখন একে অপরের অন্যায় কাজগুলো কে বৈধতা দিয়ে থাকে নিজের অস্তিত্ত রক্ষার জন্য আর সেই সুযোগেই এই রিমান্ড নামের সকল বেআইনি কাজগুলো সমাজে নিয়ম হিসেবে স্থান পেয়ে যায়। রিমান্ডের নামে এই নির্যাতন আমাদের দেশে এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে অথচ একটি স্বাধীন দেশে রিমান্ডের নামে এমন নির্যাতনের সুযোগ রাখাটা অগণতান্ত্রিক যা কখনোই কাম্য নয় তাই আমাদের উচিৎ রিমান্ডের মত সকল বে আইনি নিয়ম গুলোকে চিরতরে এই দেশ থেকে বিদায় করে দেয়া আর সে জন্য দরকার পুলিশের কাছে থেকে এই দায়িত্ত তুলে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে দেয়া সাথে সাথে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা কায়েম করা।
লেখক:- শিক্ষানবীশ আইনজীবী, গাজীপুর জজ কোর্ট।