রিফাহ সানজিদার গল্প ‘পাহাড়ের ডাক’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৫, ২০২১
শীতের দুপুরে তাতানো রোদে একটা কাক এসে বসল বারান্দায়। কাকটা সুরিন্দরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সেও চেয়ে দ্যাখে কাকটা সেই কখন থেকে বসে আছে। ভাতের প্লেট থেকে একটা হাড় ছুড়ে দেয় সুরিন্দর। তার ভেতর পশুপাখির প্রতি বেশ একটা টান আছে। নেই কেবল মানুষের জন্য। তবে এ কথাও পুরোপুরি সত্যি নয়। মায়ের জন্যে তার মায়া হয়। কেমন ছিল সে নারী? চেহারা দেখতে ইচ্ছে হয়। সেটা কোনোদিন সম্ভব নয় বলেই সুরিন্দরের মায়া হচ্ছে আরও বেশি। অন্য কারও কথা তার খুব একটা মনে পড়ে না। কাকটা বিদেয় হয়নি, বসে আছে এখনও।
হাড়টা খেয়ে সে আবারও তাকিয়ে আছে সুরিন্দরের দিকে। কাকটা আরও খাবার চাইছে। আজ আরেকটু মায়া দেখালে রোজ এসে চাইবে, অথচ এমন মায়ার বাঁধন কোনও কালেই সে চায়নি, না পশু-পাখির কাছে, না মানুষের কাছে। প্লেটের মাংসটুকুও ছুঁড়ে দেয় সে, এইবার কাকটা উড়ে যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুরিন্দর। কাকটা দেখতে তার পিসির মতো ছিল। পিসি নাকি আক্ষেপ করে গাঁয়ের মানুষদের বলে বেড়াতো, একটা জন্তুকে নিয়ে এসেছিলাম, মানুষ করেছিলাম আর দ্যাখো! এখন আমার খবর পর্যন্ত নেয় না হারামজাদাটা।
অথচ প্রতিমাসে যে টাকা সে পাঠায়, সেটা চেপে গ্যাছে মহিলা। ফোন করে খবর নেয়ার মানুষ যে সে নয়, তা কে না জানে? হ্যাঁ, মাঝে-মধ্যেই সে এসব পশুপাখির মধ্যে কিছু মানুষের স্বভাব দেখতে পায়। যেমন, গলির মুখে যে কুকুরটা দাঁড়িয়ে থাকে রোজ, সে তার ছোটবেলার বন্ধু অজিতের মতো। এ কুকুরটা খাবার খায় না, রোজ গলিতে দাঁড়ায়, সে দোকানে গেলেই কাছে এসে গা ঘঁষে। অন্য কুকুরগুলো খাবার চাইতে আসে, সে আসে না। স্কুলে যাবার পথে অজিত রোজ তাকে ফল পেড়ে দিত। নিজের কষ্ট করে পাড়া ফল সে রেখে দিত সুরিন্দরের জন্য। একরাতে অজিতের বেশ জ্বর হলো। দুদিন পর মরেও গ্যালো। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। সুরিন্দর নিজের গ্রাম ছেড়ে ফুপার কাছে চলে এলো। নিজের গ্রামে আপন বলতে অজিতই ছিল তার। সারাদিন বাইরে ঘুরে রাতে ঘরে ফিরলেই সৎ মায়ের চড় খেয়ে ঘুমুতে যেত সুরিন্দর। তবু দিনগুলো ভালোই কাটতো। অজিতের পর গ্রামে তার কেউ রইলো না আর। সে কত বছর আগের কথা, সেটা মধ্যবয়েস পেরিয়ে যাওয়া সুরিন্দর মনে করতে পারে না।
এখানে শহরে রাত জাগে সে। সিক্যুরিটিদের রাত জাগতে হয়। রাতে সে বিচিত্র সব জিনিস দেখতে পায়, শুনতে পায়। তার গ্রামের পাহাড়ের শব্দ। সে আর অজিত মিলে যেসব পাহাড়ে ঘুরত। আর জুমের সময় ওরা ওপর থেকে উৎসব দেখত। পাহাড় নাকি কমে আসছে এখন গাঁয়ে, পাহাড়গুলো কেটে ফেলা হচ্ছে সব, সে শুনেছে। আজকাল অজিতের কথাও শুনতে পায় সে। অজিত তাকে বলে, চল, আমরা পাহাড়ে ঘুরে আসি। সে নিজেদের ভাষায় কখনও জবাব দ্যায়। কখনও চুপ থাকে।
আজকাল রাতে এসব পাহাড়ের ডাক, বন্য পাখির শব্দ আর অজিতের আসা-যাওয়া ঘন ঘন হয়। অজিত তাকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দ্যায়, পাহাড়ে। দিনের বেলায় তার কাজ থাকে না। উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে সে বসে থাকে। তাকে নিয়ে অনেক কানাঘুষো হয় এই ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে। সুরিন্দর একা একা রাতে পাহাড়ি ভাষায় কী যেন বলে বেড়ায়। একথা সবাই জানে।
বাড়ির মালিক নরম গলায় বলে, ওর বয়েস হয়েছে। বুঝতেই তো পারেন, কিন্তু ডিউটি বরাবর করছে রাতে।
মালিক তাকে ডেকে মাঝে মধ্যেই জিজ্ঞেস করেন, সুরিন্দর, অমন মন খারাপ করে বসে থাকো ক্যানো?
সুরিন্দর জবাব দ্যায়, না তো! আমার চেহারাই অমন কাঠখড়ের মতো।
মালিক আবার জিজ্ঞেস করেন, রাতে নাকি তুমি কথা বলো? কার সঙ্গে?
সুরিন্দর বলে, জেগে থাকার জন্যে নিজেই কথা বলি, নিজের সঙ্গেই।
মালিক খুশি হন। সুরিন্দর তাকে চিন্তায় ফেলতে চায় না। এর অনেক দয়া আছে তার ওপর। গ্রাম ছেড়ে আসার পর তার অন্ন-বস্ত্রদাতা এই মানুষটাই ছিল। তাকে কেউ বোঝেনি, শুধু এই মানুষটা বুঝেছে। কাজ দিয়েছে। থাকতে দিয়েছে। তাই তার কাছে মালিক ভগবান তুল্য।
পাহাড় তাকে কখনও ভালোবাসেনি। কিন্তু সে বেসেছিল। পাহাড়ের মধ্যে থাকা পশুপাখি আর মানুষ। পাহাড়ের মধ্যে সে প্রথম দেখেছিল মালতিকে। বিয়েও হয়েছিল তাদের। আর মালতি বিয়ের পরদিন উধাও হয়ে গ্যালো। পাহাড়ে মিলল তার লাশ, অক্ষত, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে মালতি। এরপর থেকে সুরিন্দর গ্রামে সহজভাবে চলাফেরা করতে পারলো না। সবাই তাকে রহস্য-দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো। আগে থেকেই সবাই জানতো তার দয়া মায়া বলে কিচ্ছু নেই, কে জানে নিজের নতুন বউকে সে কী করেছে! এরপর সে গ্রাম ছাড়লো। পাহাড়ে গেলেই সে দেখত মালতি যেন আগের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর হাসি মালতির, যেন পাহাড়ের ঝর্ণা।
রাত বাড়লে হিম হিম কুয়াশার মধ্যে অজিত আসে। বলে, চল যাই পাহাড়ে।
সুরিন্দর ফিসফিস করে বলে, জানিস, পাহাড় নাকি কমে যাচ্ছে। চল যাই, তার আগেই যাই।