রিফাহ সানজিদার গল্প ‘ডার্ক টেল’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১
সব চরিত্র কাল্পনিক কিংবা সত্যি
প্রথম দেখা
আমি তাকে প্রথম দেখলাম মেট্রোতে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।
আমি একা বসে আছি, সে কালো বিন্দুর মতো খেলতে লাগলো আমার সামনের যাত্রীর কোলে।
প্রথমে আমি বুঝলাম না, সেটা কি। আমার মধ্যে ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো।
তারপর আবার তাকে দেখলাম বারে। সে বার বন্ধুদের সাথে মদ খাচ্ছিলাম। সে বিয়ারের গ্লাসের ওপর একটা নীল বিষণ্ণ মারমেইডের মতো লেজ ছড়িয়ে দিয়েছিল। আমি সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলাম আর তার পরপরই একরাশ হতাশা আমাকে গ্রাস করলো।
আমি তাকে তৃতীয়বার দেখতে পেলাম একটা অদ্ভুত জায়গায়। শাওয়ারের কলের মুখে, সে হাঁ করে আমাকে দেখছে। আমি মৃদু হাসলাম, আমার প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে রাতে।
তারপর আমার দাদির ফিউনারেলে সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ফাদারের শান্তির বাণী শুনছিলাম, আর টের পেয়েছি, সে আমার কাঁধে একটা হাত রাখলো।
এরপর আমি তার ছায়ার মতো হয়ে রইলাম, সে যেখানে যায় আমিও তার সাথে গেলাম, কিংবা সে আমার সাথে। একটা বন্ধুর পার্টিতে আমি এত মানুষের মধ্যে হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম, আমি তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম, কারণ আমি সেখানে একা বোধ করছিলাম। তখনই প্রথমবার অন্যরা তাকে দেখতে পেল।
আমার এক বন্ধু ডাক্তারের সাথে কথা বললো। ডাক্তার আমাকে চেক-আপের পর জানালেন, উনি তৃতীয় স্টেজের ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
আমি তখন হেসে বললাম, জানি, আমি ওকে প্রথমবার মেট্রোতেই দেখতে পেয়েছিলাম।
শয়তানের শেষকৃত্য
গতরাতে একজন শয়তানের মৃত্যু ঘটেছে। তাই পরদিন তার বাকি বন্ধুরা জমা হলো শেষকৃত্যে। যথারীতি কাল্ট মিউজিক বাজিয়ে শুরু হলো শেষকৃত্য। দশজন শুয়োরমুখী অর্ধ-মানব আকৃতির শয়তানেরা চারপাশে বাজাতে লাগলো সে করুণ সুর। সুরের ঝড়ে গাছে আগুন লাগলো।
পাখিরা পুড়ে মরলো দু-একটা। সূর্যের কান পর্যন্ত সে সুর পৌঁছে গেল। সূর্য কর্কশ সুরে বিরক্ত হয়ে তার তেজ বাড়িয়ে দিলো। আর খিস্তি করলো দুয়েকটা। শয়তানদের ফিউনারেলের নিয়ম হলো, তার করা সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর বর্ণনা দেবেন শয়তানদের যাজক।
যাজক শুরু করলেন, আমাদের আজকের মিলিত শোক জাহান্নামের লালচে প্রতীক মহান শয়তানের উদ্দেশ্যে। কালরাতে যে শয়তান আমাদের ছেড়ে গেছে তার জন্য আমাদের আজকের এই শোকবার্তা পৌঁছে দেবেন মহান শয়তান। মৃত শয়তানের ভালো কাজগুলো নিয়ে আজ আমরা গর্ব করবো, আমাদের বিদেহী শয়তান আজ থেকে এইসব মহৎ কর্মের ঊর্ধ্বে, তিনি দুজন ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তির লালসা জুগিয়ে তার শয়তান জীবন শুরু করেন।
এরপর হে শয়তানেরা, তিনি করেছেন আরো মহৎ কর্ম। একবার এক রাষ্ট্র শাসক কে করেছেন পথভ্রষ্ট। তারপর এক ব্যাংক গভর্নরকে দিয়ে করিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার আত্মসাৎ, এরপরও তোমরা শিক্ষা নেবে না তার জীবন থেকে? অবশ্যই নেবে।
এখানেই শেষ নয়, বনরক্ষককে দিয়ে সব গাছ কাটিয়ে সাফ করেছে। মানবদের পরিবেশ আর জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে তাদের কর্ম দিয়েই।
হে শয়তান শিশুরা, মানবদের পথভ্রষ্ট করো-নইলে মৃত্যুর পর বলার মতো তোমার কিছুই থাকবে না, নিজের লাল শিংয়ের প্রতি অবিচার করো না। যাজক আরো অনেক মহৎ কাজের বর্ণনা দিতে লাগলেন মৃত শয়তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। আর একটা শয়তান শিশু তখন নিজের সদ্য গজানো ছোট স্যাটানিক হর্ণ ছুঁয়ে দেখছিল।
লকলকে জিহ্বা
সরকারি দপ্তরে আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম, তারপর আমার ডাক আসলো। আমি কাউন্টারের ফাক দিয়ে উঁকি দিতেই ভেতরে থাকা লোকটা লকলকে জিহ্বা বের করে আমাকে বললো, মালপানি আছে? আমি তার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম, তাকে লকলকে জিহ্বার কথা বলতেই সে আমার কথা শুনতে পেল না, আবার বললো তার দু`ফুট জিহ্বা বের করে, মালপানি আছে? আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
একটা অটোরিকশা ডাকতেই লোকটা তার লাল পান, মিশ্রিত চারফুট লম্বা একটা জিহ্বা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মিটার ছাড়া যাইবেন? আমি এইবার ভীত হলাম। আমার নিশ্চয়ই ভ্রম হচ্ছে, ডাক্তার যেতে বলেছিল আরো একবার। অথচ আমি অবহেলা করছি নিজেকে।
একটা ফুটপাথের চায়ের দোকানে বসে পড়লাম, আমার চারপাশে লকলকে লাল-কালো জিহ্বার লোকেরা চা-ব্রেড খাচ্ছে সেখানে। আমি দৌড়ে পালাবো ভাবছিলাম। আমার ধারণা, আমি পুরো পাগল হয়ে গেছি, এখনই একবার ডাক্তার দেখিয়ে আসা উচিত। ডাক্তারের কাছে গেলাম, ডাক্তার হেসে অভ্যর্থনা জানালেন, আমি হড়বড় করে সবটা খুলে বলতেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
আমার ধারণা আপনি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন, অতি মাত্রার ডোজগুলোও কাজ করছে না, হিসহিস করে বললো আমার পুরোনো ডাক্তার।
তখন আমি ওর সরীসৃপের মতো জিহ্বা দেখতে পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমি দেখলাম আকাশে বজ্র বোঝাই মেঘ, দারুণ বাতাসে রাস্তায় হাঁটছিলাম, আর তখন আমি একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম,যেটা পুরো শহরজুড়ে বাজছে। মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠটা বলছে, কাল রাত থেকে সকল দুর্নীতি লিগালাইজড করে দেয়া হয়েছে, সহযোগী আগ্রহী নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে , অতি সত্বর যারা বাদ পড়েছে তাদের শহরের পূর্বদিকের ভ্যাকসিন সেন্টারে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।