রিফাহ সানজিদার অণুগল্প ‘নরসুন্দর’

প্রকাশিত : মার্চ ০৯, ২০২৩

এদিকের পাড়াগুলো এখনও সেই পুরনো ধাঁচের বাড়িঘরে ভরা। মন্ত্রীসাহেবের জন্মস্থান বলেই হয়তো রাস্তাগুলো কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে অন্যসব কিছুতে আদি চাটগাঁর একটা ছবি ভাসে।

 

এদিকের বাসিন্দা জেলে আর কামার-কুমারদের বাড়ির সন্তানেরা এখন স্কুলে যায়। বৃদ্ধ জেলেদের পুরোনো ব্যবসাটা এখনো আছে। কারণ, সমুদ্রের একটা অংশ এসে মিশেছে এই দিকে, একেবারে শেষে।

 

জেলে আর কামারদের পুরোনো বাড়িগুলো একেবারে ভেতরের দিকে। সেসব ছাড়িয়ে গলি থেকে বড় রাস্তায় উঠতে গেলেই প্রথম যে দোকান, তার মালিক ধীরেন চন্দ্র। আগে ছিল ধীরেনের বাবা নরেণ চন্দ্রর।

 

গোটা তিন পুরুষ ধরে ওদের নাপিতের ব্যবসা। ধীরেন এসে ছেড়ে দিয়েছে। তবে ব্যবসাটা আছে।

 

৭১ সালে আটকে পড়া বিহারীদের একটা বড় অংশ থাকে এদিকের উন্নত পাড়ায়। শরিফ তারই একজন। সে ধীরেনের কাছ থেকে দোকান ভাড়ায় নিয়ে নিয়েছে। টিকে থাকার তাগিদে বিহারীদের এখন ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে নানা পেশায়।

 

শরীফের দাদা এখানকার প্রথম অধিবাসী। তার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। সেসব এখন আর নেই। যুদ্ধের পরপরই শেষ হয়ে গ্যাছে। এরপর তাদের পরিবার থেকে গ্যাছে এখানেই। যুদ্ধ শেষে ফিরতে পারেনি আর। ওদের ফিরিয়ে নেয়নি জন্মভূমি পাকিস্তান।

 

এদেশেও অনেকটা করুণার আশ্রয়ে সেই সময় টিকে গ্যাছে তারা। গোটা কয়েক আঘাত আর পালটা আঘাতের সংঘাতে ৭১ এর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু পরিবারের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর মিলেছিল।

 

ধীরেনের দাদার প্রতিবেশী ছিল শরীফের দাদা। ধীরেনের দাদা ওদের আশ্রয়ে রেখেছিল। ক্ষোভ আর ঘৃণার রেশে তাদেরকে আর পড়তে হয়নি। যুদ্ধ থেমে গ্যাছে সেই কবে! এখনও তবু ওদের আলাদা চোখেই দ্যাখে অনেকে।

 

শরীফের দোকানে যারা চুল কাটাতে আসে তারা দ্যাখে, গোটা কয়েক দুর্গার ছবি ঝোলে ওর দোকানে। আছে গণেশের ছবিও। যিনি কিনা ব্যবসার সমৃদ্ধির প্রতীক। লোকে অবাক হয়, আজকাল অনেকেই জানে এ দোকান শরিফের। শরিফ হাসে।

 

সে যখন ধীরেনের কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেয়, ছবিগুলো তখনকার। ধীরেন খুব ভক্তি করতো এদের। শরিফ জিজ্ঞেস করেছিল, এই দেবদেবি কারা?

 

ধীরেন তখন জানিয়েছিল, মা দুগ্গা আর গণেশার কথা। গণেশের মূর্তি রেখে কিভাবে তাদের ব্যবসা প্রসার হয়েছে, সেই কথাও বলে ধীরেন। ধীরেনের এত ভক্তি দেখে শরিফ আর ছবিগুলো ফেলে দিতে পারেনি। এরপর থেকে ওগুলো আছে এখানে, আগের মতোই।

 

শরিফ সেগুলো যত্ন করেই মুছে রাখে। তার ব্যবসাও ধীরেনের মতোই ভালো চলছে। বরং বলা যায়, একটু বেশিই ভালো চলছে। দুপুর রোদে যখন একটা হালকা বাতাসে গণেশার ছবিটা দোল খায়, শরিফ তখন নিশ্চিন্ত মনে খদ্দেরের চুলে কাঁচি চালিয়ে যায়।