রিকশা আমাদের ফাংশনাল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি
মাহা মির্জাপ্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০১৯
কেউ কেউ বলছে, মেগাসিটিতে রিকশা চলতে পারে না। আচ্ছা, যে শহরটায় আমরা থাকি সেটাকে মেগাসিটি বলে? নাকি ভাগাড় বলে? তো এই `মেগাসিটি`র` পানি সাপ্লাইয়ে হাগুহিসুর জীবাণু ঠিক আছে? মেগাসিটির রাস্তায় রডের বদলে বাঁশ ঠিক আছে? মেগাসিটির বাতাসে `এক্সস্ট্রিমলি এলার্মিং` ক্ষতিকর পার্টিকেলস ঠিক আছে? আধাঘণ্টা বৃষ্টি হলে মেগাসিটি ডুবে যাওয়া ঠিক আছে? ভুল নকশার ফ্লাইওভার ঠিক আছে? রিকশাবিহীন মেইন রোডে দশ মিনিটের পথ দেড়ঘণ্টায় যাওয়া ঠিক আছে?
আপনি ডিসেন্ট্রালাইজ করবেন না, অগণিত কৃষককে ধানে মারবেন, ভাতে মারবেন, ঋণে মারবেন, ঢাকা শহরকে আস্তাকুড়ে বানাবেন, আপনি গণপরিবহন করবেন না, আপনি স্কুলবাস করবেন না, আপনি ঋণের টাকায় ভারত থেকে ছয়শো বিআরটিসির বাস এনে বসিয়ে বসিয়ে নষ্ট করবেন, আপনি মাফিয়াদের হাতে পুরো বাস ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেবেন, আপনি ভিআইপি গেলে পোকামাকড়ের মতো মানুষজনকে রাস্তায় আটকে রাখবেন, আর হঠাৎ একদিন ঘোষণা দেবেন, মেইন রোডে রিকশা চলতে পারবে না! মেগাসিটিতে খুব যানজট হয়!
বহু বহু বছরের পুরানো একটা লোকাল ইন্ডাস্ট্রিকে আমরা কখনোই সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির মর্যাদা দেইনি। এর আগে-পিছে জড়িয়ে থাকা ব্যাকওয়ার্ড ফরওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো কখনোই লোকাল ইন্ডাস্ট্রির মর্যাদা পায়নি। শুধুমাত্র দশ লাখ রিকশার টায়ার রিপ্লেস করতেই কত টাকার বেচাকেনা হয়, কত টাকার ভ্যাট দিতে হয়, একটু হিসাব করে দেখেন। সব মিলিয়ে দশ থেকে পনের লাখ মানুষের একটা ইন্ডাস্ট্রি, গার্মেন্টসের পরে আর কোথায় কবে একসঙ্গে এত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে? আপনি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান, ভালো কথা, কিন্তু দশ লাখ মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান কি আকাশ থেকে টুপ্ করে পড়বে?
সত্যি এটাই যে, এই দেশে কখনো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হবে না। অটোমেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এগুলো এইদেশের জন্যে না। এই দেশের শিল্পায়ন হবে এই দেশের অস্বাভাবিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, এই দেশের মানুষের স্কিল, এই দেশের মাটি পানি ক্লাইমেটকে আমলে নিয়ে। এই দেশের শিল্পায়ন হবে লেবার ইনটেনসিভ। এখানে যন্ত্র আসবে মানুষের প্রয়োজনে, মানুষ যন্ত্রকে সার্ভ করবে না। কোডিং, প্রোগ্রামিং শিখিয়ে আপনি ক’টা চাকরি তৈরি করবেন? দশ হাজার, বিশ হাজার? বড়জোর এক লাখ? অথচ, আমরা একটা চার কোটি বেকারের দেশ! পাঁচ-সাত বছরে দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো লোকাল বা বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়নি, প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ পাশ করে বেরুচ্ছে, কোথাও কোনো চাকরি নেই।
এই হুহু করে বাড়তে থাকা বেকারের দেশে রিকশা দশ লাখ মানুষের ফাংশনাল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি। বন, মাটি, জলাশয় ধ্বংস করে, হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে এই ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়নি। সম্পূর্ণ লোকাল প্রযুক্তি, লোকায়ত জ্ঞান এবং বিপুল লোকায়ত চাহিদার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। কর্মসংস্থানের এই নজিরবিহীন আকালের দিনে আপনি রিকশা তুলে দিয়ে কোন উন্নয়নের ইল্যুশন তৈরি করতে চান? বহু বছর ধরে তো রিকশা বন্ধ করেই আসছেন, কই, রিকশাবিহীন রোডগুলার এই ভয়ানক করুণ পরিণতি কেন?
`মেগাসিটি` রক্ষা করতে চাইলে দুটো প্রশ্ন করেন: বিআরটিসির শত শত বাস রাস্তায় নামে না কেন? এবং কোন মাফিয়াদের বাস চলে ঢাকা শহরে... তারা কারা?
রিকশা অমানবিক, মানছি। আপনি রিকশাকে স্বয়ংক্রিয় করেন, মটর লাগানা, গতি আনেন, রিকশার ভর ও কাঠামোতে পরিবর্তন আনেন, বুয়েটকে বলেন রোবট বানিয়ে গ্ল্যামার না খুঁজে মাটির কাছাকাছি কাজ করতে, রিক্সা, থ্রি ইউলার, ইজি বাইক, টমটমকে নিরাপদ করতে, গতিশীল করতে। লোকায়ত জ্ঞান এবং লোকাল প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই তিন চাকার বাহনগুলো আপদ নয়, আমাদের লোকাল সম্পদ। এর ডিমান্ড আছে, তাই এর সাপ্লাই আছে। আমি রিক্সা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। ফেইজ আউটের পক্ষে নই।