রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘মার্কসবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতা’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২৩

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক ছাত্র মেহেদী হাসান এখন জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। কিছুদিন আগে সে আমাকে একটি অনুরোধ জানিয়েছিল আমি যেন উত্তর-আধুনিকতা বা পোস্ট মর্ডানিজম নিয়ে কিছু লিখি। বিষয়টা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়, সেকারণে লিখতে চাইছিলাম না। পরে মনে হলো, কিছু লেখা যাক। কারণ প্রিয় ছাত্রের অনুরোধ বলে কথা। জানি না, আমার ছাত্র আমার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারবে কিনা। কথা হলো, একমত হওয়ার দরকার কি? মার্কসবাদ আলোচনা না করে উত্তর-আধুনিকতা আলোচনা হতে পারে না। কারণ উত্তর-আধুনিকতা মার্কসবাদীরা মুখোমুখী বা বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। ভিন্ন দিকে মার্কসবাদ সঠিকভাবে অনুধাবন না করে উত্তর-আধুনিকতা সঙ্গে তার বিরোধটা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। বর্তমান লেখাটি লেখার সময়ে প্রধানত মেহেদী হাসানের মতন আমার শিক্ষার্থীদের মাথায় রেখেছি।

 

কার্ল মার্কস জার্মানির মানুষ, যেখানে আমার ছাত্র এখন পড়াশুনা করছে। জার্মানিতে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষরা জন্মেছেন। বিশেষ করে সঙ্গীত ও দর্শনের ক্ষেত্রে জার্মানির অবদান বিরাট। কার্ল মার্কস সম্পর্কে আমি এখন যে কথাটা বলবো বহুজন সে ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হবেন না, হবার দরকার নেই। কারো সঙ্গে সেটা নিয়ে তর্ক করতে চাই না। বর্তমান বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে চাইলে কার্ল মার্কস আর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে বাদ দেয়ার সামান্য উপায় নেই। কার্ল মার্কস যা বলেছেন, তার বহু কথা দু’হাজার আড়াই হাজার বছর আগে অন্যরা বলেছেন। কার্ল মার্কসের চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের কথা গৌতম বুদ্ধ বলেছেন আরও বহু বহু আগে। পরবর্তীতে রোমের নাট্যকার সেনেকা বলেছেন দু’হাজার বছর আগে। খুব স্পষ্টভাবেই সেনেকা বলেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হচ্ছে শোষণ-বঞ্চনার প্রধান কারণ।

 

টমাস মূর তার ইউটোপিয়া গ্রন্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তিহীন পরস্পরের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল সমষ্টিগত মানুষের এক রাষ্ট্র বা সমাজের ছবি এঁকেছিলেন। সকলেই তারা মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু কীভাবে সে সমাজ আসবে সেকথা বলে যাননি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের ব্যাপারে মার্কস একই কথা বলেছেন ইতিহাসের নানা ঘটনাকে সামনে এনে। মার্কস কথাটা বলেই ক্ষান্ত দেননি। মার্কস ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তি কারণগুলো ঐতিহাসিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেইসঙ্গে তা বিলোপের পথ দেখিয়েছেন। নিজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি শুধু লড়াই করেননি, লড়তে গিয়ে শাসকদের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সেই যুগের সবচেয়ে মেধাবী মানুষদের একজন হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাননি। ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন।

 

মার্কসের সন্তানরা না খেয়ে থেকেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। কিন্তু শত দুঃখ=কষ্টের মধ্যে মার্কস কখনো তার লড়াইকে থামিয়ে দেননি। বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও  অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি স্বীকৃত। মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তা আজকের দিনে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। প্রথম মহাযুদ্ধ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে আজকের দুনিয়াকে বুঝবার সবচেয়ে বড় দর্শন মার্কসবাদ। ঘরের আয়তন বুঝতে যেমন একটা স্কেল দরকার হয়, দুনিয়াকে বুঝবার তেমন একটা স্কেল হলো মার্কসবাদ। মার্কসবাদ গভীরভাবে বুঝতে পারলে দুনিয়ার হাল হকিকত বুঝতে পারা এবং ব্যাখ্যা করতে পারা সহজ হয়।

 

মার্কস-এঙ্গেলস কোথায় দার্শনিক হিসাবে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে? মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তা আকাশ ফুঁড়ে আসেনি। মার্কস-এঙ্গেলস দুজনেই স্বীকার করেছেন তাদের পূর্বে যেসব মনীষীরা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করেছেন, তারা দুজনেই সেইসব মনীষীদের চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে নিজেদের চিন্তাকে এগিয়ে নিয়েছেন। নিজেরা হঠাৎ করে একাই সব জ্ঞান আবিষ্কার করেননি। পূর্বের জ্ঞানচর্চার মালমশলা তাদের নানাভাবে কাজে লেগেছে। না হলে চিন্তার ইতিহাসে যা তারা আবিষ্কার করেছেন তা করা তাদের পক্ষে সম্ভবই ছিল না। দুজনেই তাই নিজেদের সব মতবাদের জন্য পূর্ববর্তী চিন্তকদের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। সেইসঙ্গে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, চিন্তার ইতিহাস কখনোই থেমে থাকে না। চিন্তা কখনোই শেষ হয়ে যায় না। জ্ঞানের শেষ কথাটা কেউ বলতে পারেন না। চিন্তার ইতিহাস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পদ্ধতিতে ধারাবাহিকভাবে চলমান। ফলে দর্শনের জগতে কিংবা জ্ঞানের জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ কথা কারো পক্ষে বলবার সুযোগ নেই।

 

সেইজন্য মার্কস এঙ্গেলস নিজেরাই স্বীকার করেছেন, যা কিছু তারা বলে গেছেন সেটাই জ্ঞানের জগতের শ্রেষ্ঠ ভাষ্য নয়। পরবর্তীতে আরো বহু মনীষীরা আসবেন, বাস্তবের নিরিখে আরো মূল্যবান কথা বলবেন। মার্কস-এঙ্গেলসের এই স্বীকারোক্তি দর্শনের জগতে এক বিরাট ঘটনা। এই স্বীকারোক্তির নামই মার্কসবাদ। চিন্তার এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। সেখানে বহু মানুষের, বহু মনীষীর অবদান রয়েছে। সেই সকল চিন্তার যোগফলের আলোকে আজকের মানবসভ্যতা। মার্কস এঙ্গেলস সেখানে নতুন কিছু যুক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে আরো বহু মনীষী আরো বহু কিছু নতুনভাবে যুক্ত করবেন।

 

মার্কস-এঙ্গেলস যত কথা বলে গেছেন, তা আগামীকাল বাতিল হয়ে যেতে পারে। নতুন মনীষীরা নতুন জ্ঞানের দ্বারা নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু তাদের মৌলিক চিন্তা হলো জ্ঞানের জগতে নিজেদের সীমাবদ্ধতা ধরতে পারা। জ্ঞানচর্চার জগতে তাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতার স্বীকারোক্তি দর্শনের জগতে এক বিরাট ঘটনা। কী সেই স্বীকারোক্তি। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই সামগ্রিক এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। যা কিছু খণ্ডিত দেখা যাচ্ছে সেটা আপাত সত্য। মূল সত্য হচ্ছে সব একসূত্রে গাঁথা। জ্ঞানচর্চার এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। বহুকাল ধরে সে ধারা চলে আসছে। সেই ইতিহাসের একটি ক্ষণে তারা জন্মেছেন, জ্ঞানের জগতে কিছু নতুন চিন্তা যুক্ত করেছেন। কিন্তু জ্ঞান থেমে সেখানে থেমে থাকবে না। মার্কস এঙ্গেলস জীবিত থাকা অবস্থায় এবং তারপরেও জ্ঞানের চর্চা বা জ্ঞান অন্বেষণ চলতেই থাকবে। সেই চর্চার ভিতর দিয়ে মার্কস এঙ্গেলসের সকল রচনা অসার হয়ে দাঁড়াতে পারে।

 

মার্কস এঙ্গেলস দেখাচ্ছেন কিছুই থেমে থাকে না। সকল বিকাশের শর্ত হচ্ছে, সে নিজের বিপরীতে বিকশিত হয়। সবকিছু নিজের বিরুদ্ধে বিকাশমান। ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষের দেহ যে বেড়ে ওঠে, প্রতিনিয়ত নিজেকে হত্যা করেই বেড়ে ওঠে। নিজেকে হত্যা না করে কিছুই বিকশিত হতে পারে না। মানুষ তার শিশুবেলাকে ধ্বংস না করে কিশোর বেলা পেতে পারে না। কিশোর হবার জন্য নিজের শিশুবেলাকে ধ্বংস করতে হয়। মানুষ একই সঙ্গে শিশু আর কিশোর থাকতে পারে না। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়মে তা সম্ভবই নয়। কিশোর হবার জন্য শিশুবেলাকে হত্যা করতেই হবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সেটা ঘটবে। সেই নিয়মটা কী?

 

দুইভাবে সেই পরিবর্তন ঘটে। যার একটা হলো, পরিমাণগত পরিবর্তন আর একটাকে বলা যায় গুণগত পরিবর্তন। মানুষের দেহের এই যে পরিবর্তন, শিশু থেকে কিশোর হয়ে যাওয়া, কিশোর থেকে যুবক হয়ে যাওয়া, যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া; মানুষের জীবনচক্রের এই যে পরিবর্তন, এটা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ঘটতে থাকে। কিন্তু মানুষ প্রতি ক্ষণে ক্ষণে সেটা টের পায় না। কারণ এই পরিবর্তনটা পরিমাণগত। খুব স্বল্প পরিমাণে, সেজন্য চট করে ধরা পড়ে না। কিন্তু যখন সে শিশু থেকে কিশোরে রূপান্তরিত হয়, তখন সেটা ধরা পড়ে। শিশু থেকে কিশোর হওয়াটা একটা গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু মানুষ হঠাৎ করে একদিনে শিশু থেকে কিশোর হয় না। প্রতিনিয়তই তার ভিতর পরিমাণগত পরিবর্তন হতেই থাকে। পরিমাণগত পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই একদিন গুণগত পরিবর্তন ঘটে। ঠিক যেমন মানব শিশু, ভ্রূণ থেকে প্রতিনিয়ত পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এমন একটা অবস্থা দাঁড়ায়, যখন একদিন আর ভ্রূণের অস্তিত্ব থাকে না। মানবশিশুতে সে রূপান্তরিত হয়।

 

ভ্রুণকে নিশ্চিহ্ন না করে মানব শিশু জন্মাতে পারে না। মানব শিশু জন্মাবার পর সারাজীবন ধরে আর শিশু থাকে না। প্রতিদিন সে কিশোর যুবক বৃদ্ধ হবার পথে এগিয়ে যায়। নিজের আগের মুহূর্তকে হত্যা করে তার পরের মুহূর্ত বিকশিত হয়। যখন কিশোর হয়, তখন শিশু থাকে না, যখন যুবক হয় তখন কিশোর থাকে না, যখন বৃদ্ধ হয় তখন যুবক থাকে না। পূর্বের একটা স্তরকে ধ্বংস করে সে পরবর্তী স্তরে পৌঁছায়।

 

ঠিক যেমন সময়। সময়ের দিকে তাকালে বোঝা যাবে দুটো সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। পূর্বের সময়কে বাতিল করে পরের সময় আসে। গ্রিক দার্শনিকরা অনেক আগেই বলে গেছেন, মানুষ এক নদীতে দুবার ডুব দিতে পারে না। কারণ দ্বিতীয় ডুব দিতে দিতে প্রবাহিত পানিতে পরিবর্তন এসেছে। নদীটা তখন আর পূর্বের মতো নেই। সবকিছুই তাই পরিবর্তনশীল এবং দ্বান্দ্বিক। ঠিক সে কারণেই দিন আর রাত একসঙ্গে অবস্থান করতে পারে না। দিনকে বিদায় করেই রাতকে আসতে হয়। রাত আসা মানেই দিনের পুন আগমন শুরু হবে। রাত স্থির হয়ে, চিরস্থায়ী হয়ে বসে থাকতে পারবে না। রাত আসা মানেই সেই রাতের মৃত্যু ঘটবেই, কারণ পরের দিনটাকে আসতে হবে। ঠিক সেই দিনটিরও মৃত্যু ঘটবে, আসবে পরের রাত। পরিবর্তনশীল এক খেলা। যুবক বা বৃদ্ধ চাইলেও তার আগের অতীতকে আর খুঁজে বের করতে পারবে না। দ্বান্দ্বিক নিয়মে তা হারিয়ে গেছে। বড় জোর মানুষের স্মৃতিতে শুধু থাকবে তা। বাস্তবে আর থাকবে না। যদি প্রশ্ন করা হয় সময় কি চলে যায়? নাকি সময় প্রতিনিয়ত আসে? দুটাই সত্য।

 

সময় চলে যায় বলেই সময় আসে। সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক। সময় চলে যায় বলেই সময় আসে, সময় স্থির নয়। সময় চলমান। সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড চলমান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ততক্ষণে পাল্টে যায় সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। প্রতিনিয়তই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাল্টায়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড শুধু একা পাল্টায় না, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ভিতরে যেখানে যা কিছু আছে সবকিছু পাল্টায়। না পাল্টে থাকার নিয়ম নেই। কিছুই ক্ষণিকের জন্য স্থির থাকে না। আমরা যে স্থির দেখি সেটা আমাদের দৃষ্টিভ্রম। মানুষের দৃষ্টিশক্তি এত সূক্ষ্মভাবে সবকিছু, সব পরিবর্তন দেখতে পারে না। কিন্তু পাল্টায়। পরিমাণে পাল্টায়, আবার গুণ পাল্টায়। চলবে