রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ১৯
প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
জেকোনেত্তা: প্রতিশোধ! প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। কঠিন প্রতিশোধ। সে একই সাথে আমার স্বামী এবং শত্রু। সে আমার দু’দুটো পুত্রের হত্যাকারী।
ক্রানমার: রানী, সে আপনার মতো আমার সমান শত্রু। আমার বাণিজ্যের স্বার্থেই হলোফারনেসের পতন দরকার। তবে উত্তেজিত হয়ে কোনো কিছু করা ঠিক হবে না। শান্ত মাথায় সকল পরিকল্পনা সাজাতে হবে। উত্তেজনার ফল কখনোই ভালো হয় না। আপনাদের পরিকল্পনার কথা আমাকে খুলে বলুন।
জেকোনেত্তা: হলোফারনেসকে হত্যা করাই হবে আমাদের চরম লক্ষ্য। হিস্টাফাসকে হত্যার একমাত্র প্রতিশোধ হতে পারে হলোফারনেসকে হত্যা। এবং আজই যখন সে দিউনাসাসের মন্দির থেকে নাটক দেখে ফিরবে।
ক্রানমার: হলোফারনেস আমার বাণিজ্যিক স্বার্থে আঘাত হেনেছে সত্যি। কিন্তু তাকে হত্যা করার মতো কোনো ঘটনায় জড়াতে আমার খারাপ লাগবে। না, না, তাকে হত্যার চিন্তা আপাতত বাদ রাখুন। তাকে থিউসের সিংহাসনের অধিকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত করলেই সে দুর্বল হয়ে পড়বে।
জেকোনেত্তা: তাকে হত্যা করতে আপনার আপত্তি কোথায় মাননীয় ক্রানমার?
ক্রানমার: সে আমার বন্ধু। তা ছাড়া তার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধও নেই।
জেকোনেত্তা: বন্ধুত্ব এখানে বড় কথা নয়। এটা স্বার্থের প্রশ্ন। তার এ হত্যার সাথে আমাদের প্রত্যেকের স্বার্থ জড়িত। আপনার আমার এমন কি সেনাপতি ব্রাসিডাসের।
ব্রাসিডাস: হ্যাঁ মাননীয় ক্রানমার।
ক্রানমার: কিন্তু তাকে হত্যা করার কী প্রয়োজন? আমরা তাকে ক্ষমতাহীন করবো।
জেকোনেত্তা: আপনি কি তাকে জীবিত রেখে ভবিষ্যতে বিপদগ্রস্ত হতে চান?
ক্রানমার: মাননীয় জেকোনেত্তা, মানুষকে ক্ষমতাহীন করে ফেলতে পারলে সে জীবিত থাক কিংবা মৃত হোক কী আসে যায়। ক্ষমতাহীন মানুষ আর মৃত মানুষ একই কথা।
জেকোনেত্তা: মহান ক্রানমার, জীবিত মানুষের পুনরায় ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মৃতরা পুনরায় ক্ষমতা লাভ করতে পারে না। হলোফারনেসকে জীবিত রাখা হলে সে আবার ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করবে।
ব্রাসিডাস: আর সে পুনরায় ক্ষমতা লাভ করতে পারলে তা হবে আমাদের জন্য ভয়ের কারণ।
ক্রানমার: কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু মানুষকে মহিমান্বিত করে। হয়ত দেখা যাবে হলোফারনেস এখন যতটা নিন্দিত, তার মৃত্যুর পর ঘটনা উল্টো দাঁড়াবে। সে সকলের কাছে পূজনীয় হয়ে দেখা দেবে। মৃত লোকটাই তখন অন্য কারো ক্ষমতা লাভের উৎস হয়ে পড়বে।
জেকোনেত্তা: কিন্তু তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। আমার দু’দুটো পুত্র তার দ্বারা নিহত। এর প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে।
ক্রানমার: কিন্তু জনগণ কি তার এই হত্যা, মেনে নেবে, সেটাও ভেবে দেখবার বিষয়। যুবক সম্প্রদায়ের বিরাট এক অংশ এখন হলোফারনেসের ভক্ত হয়ে উঠেছে।
জেকোনেত্তা: জনগণকে শান্ত রাখা কোনো ব্যাপারই নয়। জনগণের কাছে হলোফারনেসের এখন যে চেহারা, তাকে হত্যার পরেও আমরা তা ব্যবহার করবো। এ হত্যার দায় চাপানো হবে অন্যের কাঁধে। এবং আমরাও তার মৃত্যুতে মায়াকান্না কাঁদবো।
ব্রাসিডাস: হলোফারনেসকে হত্যার পর আমরা প্রচুর লোকের সমর্থন পাবো। থিউসের বহু অভিজাত, হলোফরনেস যাদের সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়েছে, তারা সকলেই আমাদের এ হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দেবে।
জেকোনেত্তা: হলোফারনেসকে হত্যা করা হবে গৃহেই। এবং ঘোষণা দেয়া হবে তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের দ্বারাই সে নিহত হয়েছে।
ব্রাসিডাস: এবং আমার সৈনিকেরা তার দেহরক্ষীদের হত্যা করবে যাতে কখনো কেউ আসল সত্য জানতে না পারে।
ক্রানমার: লোকের মনে যদি কোনো সন্দেহ দেখা দেয়?
ব্রাসিডাস: সাধারণ লোকের সন্দেহে কিছু যায় আসে না। সমস্ত অভিজাতবর্গ ও রাজকর্মচারীদের যদি এ হত্যাকাণ্ডের পক্ষে আনা যায়, তাহলে জনগণ কি ভাবলো না ভাবলো, তাতে কি যায় আসে?
জেকোনেত্তা: রাষ্ট্র কে চালাচ্ছে তা নিয়ে রাজকর্মচারীদের মাথাব্যথা নেই। নিজেদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে তারা ভাবিত। রাজপুরুষদের দলে আনবার জন্য তাদের ভাতা এবং দৈনন্দিন সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিলেই চলবে। এরজন্য জনগণের ওপর সামান্য করের বোঝা বাড়বে মাত্র।
ক্রানমার: মৃত্যুদণ্ডই তাহলে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত হলো? এবং আজই দিউনাসাসের মন্দির থেকে ফেরার পর?
জেকোনেত্তা: হ্যাঁ।
ক্রানমার: কিন্তু আজই কেন? আমরা আরো কয়েকটা দিন ভাবার জন্য সময় নিতে পারি।
জেকোনেত্তা: কর্ম যত দ্রুত সম্পাদন করা যায় ততই মঙ্গল। না হলে দুশ্চিন্তা বাড়ে। যা করার দ্রুত না করে ফেললে, পরে নানারকম নতুন সঙ্কট উপস্থিত হতে পারে।
ক্রানমার: থিউসের পরবর্তী শাসক কে হবে সেটাও তাহলে এখন আমাদের ভেবে রাখা দরকার? যাতে পরবর্তী শাসক ক্ষমতায় এসে খুনীদের ব্যাপারে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে।
জেকোনেত্তা: আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ক্রোনাসকে থিউসের পরবর্তী শাসক নির্ধারিত করা হোক?
ক্রানমার: ক্রোনাস?
জেকোনেত্তা: হ্যাঁ। যাতে হত্যাকারীদের সম্পর্কে জনমনে কোনো প্রশ্ন না দেখা দেয়।
ক্রানমার: ক্রোনাস ক্ষমতায় এলে সকল খুনীকে এক সাথে ফাঁসিতে ঝোলাবে। সে বড় একরোখা।
জেকোনেত্তা: সে থাকবে নামমাত্র শাসক। আসল ক্ষমতা থাকবে সেনাপতি ব্রাসিডাসের হাতে। সেনাধ্যক্ষই ক্রোনাসের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
ক্রানমার: উত্তম প্রস্তাব। তাহলে এবার কাজের কথায় আসা যাক। তাকে হত্যার দায়িত্ব কে নেবে?
জেকোনেত্তা: সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। সেনাধ্যক্ষ এবং আমি দুজনে মিলেই সেটা সেরে ফেলবো।
ব্রাসিডাস: মাননীয় ক্রানমার, আপনার দায়িত্ব হবে অভিজাতবর্গ ও রাজকর্মচারীদের দলে রাখা। তাদের সমর্থন আদায় করা।
ক্রানমার: হ্যাঁ সেটা অবশ্যই আমি দেখবো। তবে তার আগে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নেয়া যাক। এ হত্যাকাণ্ডের পর আমি কী কী বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করবো?
জেকোনেত্তা: এখন থেকে সমস্ত সরকারি স্বর্ণখনিগুলো আপনার ব্যক্তিগত জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হবে। এ সবের দেখাশুনার ভার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপনার উপর ন্যস্ত থাকবে।
ক্রানমার: তথাস্তু (দূরে পেটা ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল) রাত দশটা। হলোফারনেসের মন্দির থেকে গৃহে ফিরবার সময় হয়ে গেল। জেকোনেত্তা, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়িত্ব তাহলে আপনাদের ওপর। আর আমার কাজ হলো শুধু হত্যাকাণ্ডকে সামাল দেয়া। শুভরাত্রি।
জেকোনেত্তা: শুভরাত্রি। চলবে