রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ১৯

প্রকাশিত : আগস্ট ১৬, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

জেকোনেত্তা: রাজার কানে খবর পৌঁছানোর আগেই সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। সেনাধ্যক্ষ, আপনি তৈরি হোন। আমিও হিস্টাফাসকে খবরটা পৌঁছে দিয়ে আসি। হিস্টাফাস থিউস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত রাজার কাছে খবরটা গোপন রাখতে হবে।
ব্রাসিডাস: সে নিয়ে ভাববেন না। আপনি যখন আমায় বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছেন, সে বন্ধুত্বের মর্যাদা আমি রক্ষা করে যাব।

জেকোনেত্তা: আপনার মতো দেখতে যারা সুপুরুষ এবং সাহসী তাদের সত্যিই আমার ভালো লাগে। যে কোনো নারীর জন্য সত্যি আপনি একজন সুপুরুষই বটে। আমি আশা করি সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী নারীর অভাব আপনার কখনো হবে না।
(বালক ক্রীতদাসের প্রবেশ)
ক্রীতদাস: প্রভুপত্নী, একটু আগে রাজার প্রহরীরা আপনার পুত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। সবাই বলছে উনি নাকি জোকাস্তা আর সস্ত্রাতাসকে হত্যা করেছেন।

জেকোনেত্তা: হায় ঈশ্বর, রাজা কেমন করে এ খবর জানতে পারলো। সেনাধ্যক্ষ আপনি যে বললেন রাজার কাছে এখন পর্যন্ত কেউ এ খবর পৌঁছে দেয়নি।
ব্রাসিডাস: সত্যি বলছি জেকোনেত্তা, আমার কোনো গুপ্তচর রাজাকে এ খবর পৌঁছায়নি। বালক তুমি  তোমার কার্য সম্পাদন করেছে। এবার ভেতরে যাও। (ক্রীতদাস বালক চলে যাবার পর) এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, নিশ্চয় রাজার নিজস্ব কিছু গুপ্তচর রয়েছে যারা আমার আজ্ঞাবহ নয়।

জেকোনেত্তা: আমি কি করবো? আমার পুত্রকে আমি কোনোভাবেই হারাতে চাই না। তার আগে আমি নিজেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবো।
ব্রাসিডাস: ভেঙে পড়লে চলবে না। বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য শান্তভাবে সব কিছু ভেবে দেখতে হবে। বর্তমান কারা-প্রধান আমার স্নেহভাজন। কারাকক্ষে যাতে হিস্টাফাস কোনো কষ্ট না পায় সেদিকে তাকে নজর রাখতে বলবো।

জেকোনেত্তা: হিস্টাফাসকে আমার আগেই থিউস থেকে সরিয়ে দেয়া দরকার ছিল। কেন যে আমি সেটা করলাম না। কেন যে আমি আগেই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। শুধুমাত্র আপনার ওপর নির্ভর করা আমার ঠিক হয়নি।
ব্রাসিডাস: রাজা হলোফারনেসের সিদ্ধান্ত রোধ করা কঠিন। নিশ্চয় তিনি হিস্টাফাসকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। দু’দুটো হত্যার অপরাধী হিস্টাফাস একা। এক্ষেত্রে একমাত্র ক্রানমারই আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।

জেকোনেত্তা: ক্রানমার। আপনি ব্যবসায়ী ক্রানমারের কথা বলছেন?
ব্রাসিডাস: হ্যাঁ।

জেকোনেত্তা: কিন্তু তিনি কি করে আমায় সাহায্য করবেন?
ব্রাসিডাস: ক্রানমারের কোনো অনুরোধ ফেলবার মতো দুঃসাহস হয়তো রাজার হবে না। একমাত্র ক্রানমারের নির্দেশেই রাজার মত পরিবর্তন হতে পারে।

জেকোনেত্তা: নিশ্চয় তাহলে আমি ক্রানমারকে সে অনুরোধ জানাবো।
ব্রাসিডাস: কিন্তু রানী, আপনাকে মনে রাখতে হবে ক্রানমার এ উপকারের জন্য নিশ্চয় কোনো শর্ত আরোপ করবেন। অথবা পরে কোনোদিন আপনার কাছ থেকে ভিন্ন কোনো সাহায্য আশা করতে পারেন।

জেকোনেত্তা: মার মন বুঝতে চেষ্টা করুন। পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য সে কিনা করতে পারে। ক্রানমারের কাছেই আমাকে নিয়ে চলুন।
ব্রাসিডাস: মহামান্য রানী, রাজা এদিকেই আসছেন। সাবধান, রাজাকে কিছুই বুঝতে দেয়া চলবে না। (রাজার প্রবেশ) মহান রাজা হলোফারনেসের জয় হোক।

হলোফার: থিউসের সকলের জয় হোক।
ব্রাসিডাস: মহান রাজা, বহুক্ষণ যাবত একটি গুরুতর খবর দেয়ার জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি। খবরটি খুবই দুঃখজনক। বিশেষ করে মহামান্য রানী জেকোনেত্তার জন্য।

হলোফার : সম্ভবত খবরটি ইতিমধ্যেই আমার কর্ণগোচর হয়েছে। তবুও বলুন কী খবর?
ব্রাসিডাস: সস্ত্রাতাস আর জোকাস্তার-খুনীকে আবিষ্কার করা গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হত্যাকারী রানী জেকোনেত্তার একমাত্র পুত্র হিস্টাফাস। যথাসম্ভব দ্রুত এখন হিস্টাফাসকে গ্রেফতার করা দরকার।

হলোফার: হিস্টাফাসকে খানিক আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। পদবীতে আপনার চেয়ে ক্ষুদ্র কিন্তু আপনার চেয়েও বেশি কর্তব্যপরায়ণ একজন সাধারণ গুপ্তচর, আমার কাছে গোপনে খবরটি আরো আগেই পৌঁছে দেয়।
ব্রাসিডাস: ক্ষমা করবেন মহান রাজা, আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।

হলোফার: আপনার কোনো ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে যোগ্যতার। এক্ষেত্রে যা বিবেচনার বিষয় তা হলো, একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির চেয়ে নিম্নপদস্থ ব্যক্তি কাজে অধিক যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারে।
জেকোনেত্তা: মহান রাজা, আমি মনে করি হিস্টাফাসের পক্ষে কখনোই এই কাজ করা সম্ভব নয়। সস্ত্রাতাস ও জোকাস্তার সাথে হিস্টাফাসের কোনো বিরোধ ছিল না।

হলোফার: হিস্টফাসই যে প্রকৃত হত্যাকারী এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। তবে কেন সে হত্যা করেছে সে খবরও আমরা পরে জানতে পারবো। রানীকে আর একটি খবর দেয়ার আছে। হিস্টাফাস রাজ পরিবারের লোক হিসাবে যাতে কোনো সুবিধা না পায়, কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি যাতে হিস্টাফাসের ব্যাপারে আমার ওপর কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে, তার জন্য আমি একটু আগেই হিস্টাফাসের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে এসেছি। সম্ভবত ইতিমধ্যে তা কার্যকর করাও হয়ে গেছে।

অষ্টম দৃশ্য
(হলোফারনেসের রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের একটি ব্যক্তিগত কক্ষে আলাপরত সেনাপতি ব্রাসিডাস, রানী জেকোনেত্তা ও ব্যবসায়ী ক্রানমার। সময় রাত। গভীর নিস্তধ্বতা চারদিকে)  

ক্রানমার: বিলাস দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে সে আমার বাণিজ্যের ভীষণ ক্ষতি সাধন করেছে। সে ক্ষমতায় থাকলে থিউসের আইনের আরো নানা রকম সংস্কার ঘটাবে। যুব সম্প্রদায়কে খুশি করবার জন্য সে নতুন নতুন আরো আইন প্রয়োগ করবে। হলোফারনেস থিউসকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলবার জন্য হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন জেকোনেত্তা, তাকে এখন দমন করা দরকার।
জেকোনেত্তা: সে এখন পতনের দোর গোড়ায় উপস্থিত। সে অহংকারী। সে অহংকারের পতন ঘটবে আমাদের হাতে।

ব্রাসিডাস: (স্বগত) তার এই পতন আমার ভাগ্যের চাবিকাঠি খুলে দেবে। সিংহাসন এবং রূপবতী জেকোনেত্তা, দুই হবে আমার। যদিও জেকোনেত্তাকে বিশ্বাস করা হবে চরম ভুল। আমার শুধু দরকার তার রূপ ও দেহসুধা। চলবে