রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’
পর্ব ১৮
প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০২১
বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
সপ্তম দৃশ্য
(হলোফারনেসের প্রাসাদের একটি কক্ষে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে জেকোনেত্তা। একপাশে দাঁড়িয়ে সেনাধ্যক্ষ। জেকোনেত্তা পায়চারী শেষ করে সেনাধ্যক্ষের কাছে এসে দাঁড়ায়)
জেকোনেত্তা: সেনাধ্যক্ষ, আপনি কি নিশ্চিত হয়ে বলছেন যে, হিস্টাফাসই এ দুটো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে?
ব্রাসিডাস: হ্যাঁ মাননীয়া, গুপ্তচরদের তাই ধারণা। তাদের কাছে সবরকম প্রমাণ পর্যন্ত রয়েছে। রাজা হয়তো এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হিস্টাফাসকে গ্রেফতার করবেন।
জেকোনেত্তা: সেনাধ্যক্ষ কি মনে করেন না যে, হিস্টাফাস যখন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তখন এর পেছনে তার নিশ্চয় কোনো যুক্তি ছিল।
ব্রাসিডাস: কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করে না প্রিয় রানী। হিস্টাফাসও এ হত্যার পেছনে যথেষ্ট কারণ তৈরি করে নিয়েছিল। একজন সাধারণ নাগরিক নিজের চোখে দেখেছে যে হিস্টাফাস জোকাস্তাকে হত্যা করবার আগে তাকে বলাৎকার করে।
জেকোনেত্তা: সে দোষটা নিশ্চয় আমার পুত্রের নয়, বয়সে সে যুবক। আর জোকাস্তা সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। জোকাস্তার প্রতি হিস্টাফাসের শারীরিক আকর্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক। আপনি তো জানেন রোমের বহু সম্রাটও সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী নারীদের সাথে এ ধরনের আরচণ করে থাকেন।
ব্রাসিডাস: সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী নারীর প্রতি যে কোনো পুরুষের আকর্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক, আপনার এ যুক্তি আমি না মেনে নিয়ে পারছি না। (জেকোনেত্তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।) এবং আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, জোকাস্তার প্রতি একদা আমার নিজেরও খানিকটা দুর্বলতা ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাজা হলোফারনেস সস্ত্রাতাস ও জোকাস্তার এ মৃত্যুকে সহজভাবে নেবেন না। জোকাস্তাকে তিনি বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন।
জেকোনেত্তা: আমার ভয়টাও সেখানে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বিশেষ কিছু দুর্বলতা থাকে। যে দুর্বলতাগুলোকে সে কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে মানুষ গোড়ামীর পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। জোকাস্তার প্রতি হলাফোরনেসের স্নেহ একটা গোড়ামীর পর্যায়ে চলে গেছে। দেশের ভেতর এতকিছু ঘটছে সে দিকে নজর না দিয়ে জোকাস্তার খুনীকে বের করার জন্য সে মাথা খারাপ করে ফেলেছে।
ব্রাসিডাস: রাজা হলোফারনেসের প্রথম যৌবনে জোকাস্তা প্রিয় বোনের মতো তার অনেক আদর যত্ন করেছে। হলোফারনেস সে স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। জীবনের সুন্দর স্মৃতিগুলোর কথা অবশ্যই ভোলা যায় না। যেমন পৃথিবীর সমস্ত ঘটনার চেয়ে মা ভিন্ন এক মানুষ আমার কাছে।
জেকোনেত্তা: জোকাস্তার প্রতি তার স্নেহ তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। হলোফারনেসের সেটা বোঝা উচিত ব্রাসিডাস।
ব্রাসিডাস: পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন কিছু দিক থাকে যেখানে সে আত্মসমর্পণ না করে জীবন দেয়াটাকেই শ্রেয় মনে করে। সেটা ভালো কি মন্দ সে বিচার নাই বা করলেন।
জেকোনেত্তা: (কিছুটা স্বগতোক্তির মতো) সামান্য একটা মেয়ে কি না এখন বিরাট একটা ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। মৃত প্রাণহীন একটা মেয়েই তাহলে আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হতে পারে? কাজটা করবার আগে আমার আর একটু বিবেচনা করা দরকার ছিল।
ব্রাসিডাস: ঘটনা পরম্পরায় মানুষের মধ্যে কখনো কখনো এমন ক্রোধের জন্ম নেয় যখন বিবেচনা করে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে যা হোক মহামান্য রানী, হিস্টাফাস এখন ঘোরতর বিপদের সম্মুখীন রয়েছেন।
জেকোনেত্তা: সেনাধ্যক্ষ, রাজার আগে খবরটা আমাকে দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এটা একটা বিরাট বন্ধুত্বের পরিচয়। যে বন্ধুত্ব আজ দেখালেন এর প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়। তবুও বন্ধু হিসাবে এটা রাখুন আপনার কাছে।
(উপহার প্রদান)
ব্রাসিডাস: রানী জেকোনেত্তার রূপের মতোই তার ব্যবহারও মনোমুগ্ধকর। রাজা হলোফারনেস রানীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেন কি না আমার জানা নেই। তবে থিউসে এমন একজন রয়েছেন যিনি রানী জেকোনেত্তার রূপ ও গুণে মুগ্ধ এবং সর্বদা বিশ্বস্ত।
জেকোনেত্তা: মধুর বাক্যালাপ দিয়ে নারীর হৃদয় মন জয় করবার এমন উদাহরণ বিরল। ব্রাসিডাস, নারীর মন সর্বদা তুষ্টি পছন্দ করে, রাজা হলোফারনেসের এই সত্যটাই জানা নেই।
ব্রাসিডাস: এখন থেকে নিশ্চয় আমরা পরস্পরের সঙ্গ লাভ করতে পারি?
জেকোনেত্তা: নিশ্চয়। তবে স্মরণ রাখবেন, আপনি রাজার বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী।
ব্রাসিডাস: রাজা হলোফারনেস আমাকে দিয়েছেন পদ এবং খ্যাতি। কিন্তু সুখ, তা একমাত্র রানীই দিতে পারেন আমাকে।
জেকোনেত্তা: আপনি অতিরিক্ত বিনয়ী।
ব্রাসিডাস: ধন্যবাদ রানী।
জেকোনেত্তা: বিনয় কাকে বলে হলোফারনেসের জানা নেই। সে উদ্ধত স্বভাবের। নারী মাত্রই বিনয়ী পুরুষ পছন্দ করে। আবার পুরুষকে পুরুষের মতোই ঋজু ভঙ্গিতে দেখতে চায়। কথাটা যদিও পরস্পর বিরোধী হয়ে গেল।
ব্রাসিডাস: দুশ্চিন্তার কিছু নেই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই পরস্পর বিরোধী সত্তা দেখা যায়। একটা মানুষের মধ্যে হাজার মানুষের চরিত্র মিলেমিশে থাকে। প্রত্যেক মানুষের অন্তরেই স্নেহ ভালোবাসা মমতা রয়েছে। এবং এ কথাও সত্য যে, প্রয়োজন মতো সে নিষ্ঠুর আচরণও করে। মানুষ পরোপকারী এবং একই সাথে সে স্বার্থান্বেষী। ঘটনার দ্বারাই মানুষের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
জেকোনেত্তা: হিস্টাফাসের এখন বাঁচার একটি মাত্র পথ খালো আছে। আর তা হচ্ছে থিউস ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। সেনাধ্যক্ষ, হিস্টাফাসের পালাবার ব্যাপারে আশা করি আপনি আমায় সাহায্য করবেন।
ব্রাসিডাস: সে ধরনের কোনো সাহায্য করা হবে অন্যায়। কারণ আমি রাজা হলোফারনেসের আজ্ঞাধীন এবং থিউসের সেনাধ্যক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে হিস্টাফাস একজন হত্যাকারী, সে সাথে একজন রমণীর সম্ভ্রমও সে নষ্ট করেছে। তবে কথা হলো, এই সব ঘটনার পরও আমি তাকে পালাতে সাহায্য করবো, কারণ স্বয়ং রানী জেকোনেত্তা আমায় এ কাজের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। চলবে