রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ৭

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

তৃতীয় দৃশ্য
(ব্যবসায়ী ক্রানমারের গৃহ। ক্রানমার ও ক্রোনাস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপরত। তাদের সামনে রয়েছে দামী মদ ও মদ পানের মূল্যবান সব পাত্র। দুজনেই পানরত অবস্থায় আলোচনা করছিল। দামী খাদ্যসামগ্রী সাজানো ছিল।)

ক্রোনাস: রাজা হলোফারনেস এখন জেকোনেত্তার শয্যাসঙ্গী। একদিন থিউসের যে উগ্র খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা জয়ী হয়েছিলাম, সেই লোকগুলোই এখন আবার আমাদের শাসন করবে।
ক্রানমার: ঘটনাচক্রে ক্রীতদাসও কখনো কখনো প্রভুর মালিক হয়ে দাঁড়ায় ক্রোনাস।

ক্রোনাস: রাজা ফিলোটাস যুদ্ধ শেষে কতগুলি খুনী উগ্র খ্রিষ্টানদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। হলোফারনেস সেই উগ্র খ্রিষ্টানদের নেত্রীকেই কিনা রানী করে নিলেন। হায় দেবতারা!
ক্রানমার: ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে হলোফারনেসের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ক্ষমতাই মানুষের স্বভাবকে বদলে দেয়। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করবার জন্য তখন সে যে কোনো পথ অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না।

ক্রোনাস: ক্রানমার, এর খুব সহজ অর্থ হচ্ছে হলোফারনেস একদা খ্রিষ্টধর্মের যে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, থিউসে এখন সেই খ্রিষ্টধর্মই মাথা তুলে দাঁড়াবে।
ক্রানমার: হলোফারনেসের সাথে জেকোনেত্তার এই বিবাহের একটি শুভ দিকও রয়েছে। এতে করে খ্রিষ্টান জগতের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব নতুন করে বৃদ্ধি পাবে। রোম থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বহু খ্রষ্টান সমাজই আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।

ক্রোনাস: কিন্তু এই বন্ধুত্বের ভিন্ন ফলাফল কি দাঁড়াবে ভেবে দেখেছো? এ দেশের উগ্র খ্রিষ্টানরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
ক্রানমার: উগ্র খ্রিষ্টানরা খানিকটা মাথা তুলে দাঁড়ালেও, দেশের জন্য তা তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের বাণিজ্যের ক্ষেত্র প্রসার করা। আর সেজন্য খ্রিষ্টানদের সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব হওয়া দরকার।

ক্রোনাস: কেন?
ক্রানমার: সম্রাট কন্স্টানটাইনের শাসনকাল থেকে খ্রিষ্টধর্ম সর্বত্র প্রসার লাভ করেছে। খ্রিস্টানদের হাতেই এখন পৃথিবীর বেশির ভাগ ধন সম্পদ। সে জন্যই ওদের সাথে আমাদের একটা বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার। হলোফারনেস ও জেকোনেত্তা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ  হওয়াতে এ সম্পর্ক গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

ক্রোনাস: ক্রানমার, তুমি তোমার ব্যবসার সুবিধার কথা ভাবছো। দেশের কথা একবার ভাবো। যুগ যুগ ধরে যে উগ্র খ্রিষ্টানরা আমাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছিল, তুমি কি চাও, তারা আবার থিউসের ক্ষমতা ফিরে পাক?
ক্রানমার: রাজনীতি তোমার বিষয় ক্রোনাস। আমি ব্যবসায়ী। ব্যবসার স্বার্থ আমার কাছে সবার আগে। বিশ্বের মানুষ কে কোন্ ধর্মে বিশ্বাসী সেটা আমার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হলো আমার বাণিজ্যিক সফলতা।

ক্রোনাস: হায়! কী বললে তুমি? আশ্চর্য ক্রানমার! তুমি কি অস্বীকার করতে পারো যে, থিউসের স্বাধীনতা লাভের পরই তোমার বাণিজ্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়? যেখানে আগে রোমানরা এদেশের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে রেখেছিল, সেখানে এখন তোমার একচ্ছত্র অধিকার।
ক্রানমার: না, সে কথা আমি অস্বীকার করি না। আর এ কথাও তুমি অস্বীকার করতে পারবে না যে, যাতে রোমানদের হাত থেকে এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একচ্ছত্র আমার অধিকারে চলে আসে, সেজন্যই সেদিন আমি থিউসের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলাম। বহু অর্থ সাহায্য যুগিয়েছিলাম।

ক্রোনাস: ঠিক। এখন বুঝতে পারছি এ সব কিছুই ছিল শুধু তোমার বাণিজ্যিক স্বার্থ, দেশপ্রেম নয়।
ক্রানমার: হ্যাঁ। আজ আবার বাণিজ্যিক স্বার্থেই সকল খ্রিষ্টান জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হওয়া দরকার। খ্রিষ্টানদের দেশেও আমি আমার বাজার তৈরি করতে চাই। দরকার বোধে এখানকার বাজারেও খ্রিষ্টানদের পণ্য বহন করে আনা হবে।

ক্রোনাস: শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়িয়ে তুলবার জন্য দেশের আদর্শের বিরুদ্ধে চলে যেতে চাইছো! তোমরা ব্যবসায়ীরা অর্থ ছাড়া কি আর কিছুই বোঝ না?
ক্রানমার: ক্রোনাস, তোমরা সব সময় আমাদের ব্যবসায়ী বলে গাল দাও। কিন্তু এই ক্রানমারের মুনাফার অর্থে ভাগ না বসালে আবার তোমাদের চলে না। তোমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আমার আর্থিক সাহায্য না পেলে এক পাও এগুতে পারে না।

ক্রোনাস: কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তোমাকে যে-সব সুবিধা দিয়েছে, তার কথাই বা ভুলে যাও কী করে? থিউসের স্বাধীনতার পর তোমাকে একচ্ছত্রভাবে ব্যবসা করার সুবিধা দেয়া হয়েছে। ক্রানমার, থিউসের স্বাধীনতার কারণেই তুমি আজ এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছো।

ক্রানমার: থিউসের স্বাধীনতা শুধুমাত্র আমাকে নয়, তোমাকেও প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। আজ তুমি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারকের আসনে আসীন। থিউস স্বাধীন না হলে তোমার এ পদে বসার সৌভাগ্য হতো না। ওখানে বসতো একজন রোমান। ক্রোনাস, তুমি-আমি-আমাদের মতো লোকেরা নিজ নিজ স্বার্থেই থিউসের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা যখন পেয়েছি, নিজ নিজ স্বার্থের কথাই সবার আগে আমরা ভেবেছি।
ক্রোনাস: নিজ নিজ স্বার্থ বলতে কি বোঝাতে চাও তুমি?

ক্রানমার: শুধু ক্রানমার একা নয়, তোমরাও কেউ দেশের স্বার্থের কথা ভাবতে যাওনি। মহৎ সাজবার জন্য মাঝে মাঝে তোমরা সাধারণ মানুষ বা কৃষক আর শ্রমিকের পক্ষে গলাবাজী করেছো। কিন্তু আমি ক্রানমার চাই আর না চাই, দেশ আমার দ্বারা খানিকটা উপকৃত হয়েছে।
ক্রোনাস: দিনের পর দিন তুমি শুধু ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় বানিয়েছো। তাতে দেশের কী উপকার হয়েছে শুনি?

ক্রানমার: ক্রানমার তার সব সম্পদ একা চিবিয়ে চিবিয়ে খায় না। ক্রানমার ভোগ বিলাস করে বটে। কিন্তু সেটা তার মোট সম্পদের কতটা? বাকি সম্পদগুলো কে ভোগ করছে? ক্রানমারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে থিউসের যে সকল লোক কাজ করছে, রাষ্ট্র নিশ্চয় তাদের খাওয়া-পরার সেস্টাস যোগায় না। যোগায় এই ক্রানমার, যাকে তুমি দুবেলা ব্যবসায়ী বলে গাল দাও।
ক্রোনাস: থিউসের শ্রমিকরা তোমার জন্য কাচপাত্র তৈরি করে দেয়। সে পাত্র বিক্রয় করে বিশাল মুনাফা উপার্জন করো তুমি। তুমি একা।

ক্রানমার: খুব সত্যি কথা।
ক্রোনাস: যারা পাত্র তৈরি করে তারা কখনো কখনো না খেয়েও থাকে, আর তোমার প্রাসাদ রাজার প্রাসাদকেও ছাড়িয়ে যায়।

ক্রানমার: যখন আমি ছোট ছিলাম তোমার মতো করেই ভাবতাম। মনে হতো মালিকরা ঠকাচ্ছে। যে পাত্র আমি বিক্রয় করি দশ সেস্টাস, তার জন্য একজন কারিগর পায় মাত্র দেড় সেস্টাস। তোমার কি ধারণা বাকি সাড়ে আট সেস্টাস আমার লাভ। না, তা নয়। নগদ টাকা খরচ করে আমাকে কাঁচামাল কিনতে হয়। যারা শ্রমিদের কাজের তদারিক করে ওদের পয়সা দিতে হয়। তোমার দেশকে শুল্ক দিতে হয়, যে দেশে পাত্র বিক্রয় হচ্ছে সে দেশও শুল্ক পায়। রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিতে হয়, রাজন্যদের উপহার সামগ্রী পাঠাতে হয়। সে সাথে রয়েছে ঝড় বন্যায় জাহাজ ডুবির ভয়, জলদস্যুদের আক্রমণের আশঙ্কা। চলবে