রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘হাফলংয়ে বেড়ানো’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০২২

পাহাড়ি বৃষ্টিকে বিশ্বাস নেই। কখন নামবে আর কখন থামবে! হাফলংয়ে বেড়াতে এসে সোমবার সকালে হাঁটতে বের হয়ে প্রথমেই বৃষ্টির পাল্লায় পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম লোয়ার হাফলংয়ে। আমার অতিথিশালা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে । সকলে বলছিল এতটা পথ হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে দেখার কিছু নেই, পুরাতন ভাঙা রেল স্টেশন ছাড়া। কিন্তু আমি আসলে সেই পুরানো রেল স্টেশনটা দেখতে যাচ্ছিলাম যা সম্ভবত আট বছর আগেও ছিল।

দশ বছর অগে আমি সেই স্টেশনে নেমে হাফলং বেড়াতে আসতে চেয়েছিলাম। তখন পথটা ছিল মিটার গেজ। কিন্তু আমি ঘুরবার পরিকল্পনা করতেই ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম পথটা বন্ধ, নতুন করে ব্রডগেজ রেললাইন বসানো হচ্ছে। কিছুদিন রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকবে আগরতলার সঙ্গে হাফলংয়ের। যখন নতুন রেল পথ চালু হলো, দেখতে পেলাম সেই সঙ্গে আগের পথটা সামান্য ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন স্টেশনের নাম নিউ হাফলং। নতুন স্টেশনটা মূল শহর থেকে এখন অনেকটা দূরে সরে গেছে।

লোয়ার হাফলং নামের আগের স্টেশনটা ছিল শহর থেকে আড়াই তিন কিলোমিটার দূরে, এখনকার নিউ হাফলংয় ছয় সাত মাইল দূরে অবস্থিত। যখন লোয়ার হাফলং যাবার জন্য পথে নেমেছি তখন আবহাওয়া সবকিছুই ভালো, যেই এক কিলোমিটার পথ হাঁটা শেষ করেছি, শুরু হলো বৃষ্টি। রাস্তা কর্দমাক্ত আর বৃষ্টিও থামছিল না। ফলে একটা অটো নিয়ে বাতিলকৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত লোয়ার হাফলং স্টেশনটা দেখে এলাম।

সাত-আট মাস আগে হাফলংয়ে বিরাট এক ভূমিধস হয়েছে, স্মরণকালের মধ্যে এতবড় ভূমিধস হয়নি। কয়েকশো বাড়িঘর হারিয়ে গেছে সেই ভূমিধসে। মানুষ মারা গেছে অনেক। হাফলংয়ে এখনো সেই ভূমিধসের চিহ্ন রয়ে গেছে। নতুন রেল স্টেশনসহ অনেক কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় সেসব সারিয়ে তোলার কাজ চলছে। ফলে পথঘাট আগের মতো নেই। আগরতলা থেকে আসতে হাফলংয়ের আগের স্টেশন জেটিঙ্গা।

বিশেষ কারণে জেটিঙ্গার ভিন্ন পরিচিতি আছে। বিভিন্ন রকম পাখি এখানে আসে। নভেম্বর মাসের কোনো এক সময়ে পাখিরা আগুনে আত্মহুতি দেয় এখানে। গ্রামের মানুষ আগুন জ্বালিয়ে রাখে পাখিরা এসে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করে। খুব আলোচিত এ ঘটনাটা। জেটিঙ্গা হাফলং থেকে খুব কাছেই, কিন্তু দুটো স্টেশনে মাঝখানে আছে বিশাল এক সুড়ঙ্গ । ট্রেন সেই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়েই আসে। অনেকটা সময় সুড়ঙ্গের ভিতরে থাকে চলমান ট্রেনটা।

পরশু যখন আমরা সেই সুড়ঙ্গ পার হয়ে হাফলং স্টেশনে নামি তখন রাত প্রায় এগারোটা। সাড়ে নটায় ট্রেনটা পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু দেড়ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছায়। হাফলংয়ে বা যেকোনো পাহাড়ে নয়টা মানেই অনেক রাত। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে খাবার দোকান ছাড়া সব বন্ধ হয়ে যায়। নটার পর আর খাবারের দোকানও সাধারণত খোলা থাকে না। ট্রেনের মধ্যে বসেই আমার দুশ্চিন্তা ছিল। রাত বাড়লে কেমন করে স্টেশন থেকে সাত আট মাইল দূরের অতিথিশালায় পৌঁছাবো।

যখন আমি দিন পনেরো আগে হাফলংয়ে হোটেলে রুম বায়না দেয়ার কথা ভাবি, আমার বন্ধুর দেয়া একটি হোটেলের ফোন নম্বরে ফোন করলে বলে, তাদের কোনো রুম ফাঁকা নেই। দু একটা হোটেলে রুম থাকলেও সেগুলো পছন্দ হয় না। নিজেই তখন ইন্টারনেটে হোটেল খুঁজে দেখতে থাকি। বেশির ভাগ হোটেলে রুম নেই খ্রিস্টমাসের কারণে। ঠিক পঁচিশে ডিসেম্বর যাচ্ছি আমরা হাফলং। পরে নোহশ্রিং গেস্ট হাউসের মালিকের সঙ্গে কথা বললে জানান, পঁটিশে ডিসেম্বর সব সাধারণ রুম বুকড, একটা বিশেষ রুম ছাড়া। সে রুমটা অনেক বড় আর ভাড়া বেশি।

তিনি বললেন, পঁচিশ তারিখের পর অন্য দু একটা রুম খালি হবে। ফলে উপায় নাই দেখে প্রথম রাতের জন্য সেই রুমটাই ভাড়া করলাম। ভাড়া যে খুব বেশি তাও আবার নয়। যখন ট্রেন দেরি হচ্ছিল অতিথিশালার মালিক ফোনে জানালেন আমাদের রাতের খাবার আমাদের কক্ষে রেখে দেয়া হবে। আর অতিথিশালার ব্যবস্থাপকের ফোন নম্বর দিলেন। রাত এগারোটার দিকে শীতের মধ্যেই স্টেশনে নেমে অটো পেয়ে গেলাম। ভাড়া অনেকগুণ বেশি। অতিথিশালার মালিক আগেই বলেছিলেন, রাত বেশি হলে অটোর ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে।

ভাড়া যাই হোক, অটো যে পাওয়া গেছে শেষপর্যন্ত তাতেই খুশি আমরা। অটো চলতে শুরু করলো পাহাড়ি পথ ধরে অন্ধকারের ভিতর। চালক সহ আমরা তিনজন অটোতে। অন্ধকারে অটোর আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। চারদিকে মানুষজনের সাড়াশব্দ ঘরবাড়ি কিছুই নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে এই ভ্রমণটাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক হয়ে উঠলো। সরু পাহাড়ি পথ, দুদিকে গাছপালা, রাতের অন্ধকারে কিছু ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু ভিতর থেকে কী যেন একটা অনুভূতি অনুভব করা যাচ্ছে। অটো ছুটে চলেছে এঁকেবেঁকে, অন্ধকার চিরে, অটোর আলোতে দুদিকে সাময়িকভাবে ফুটে উঠছে আবছায়া কিছু দৃশ্য । সেই সঙ্গে অটোর হলকা গর্জন। মনে হলো পুরো ভ্রমণের এইটুকুই যেন শ্রেষ্ঠ সময়।

জনমানবহীন অন্ধকার আর গভীর নির্জন রাত, পাহাড়ী পথ, গা ছমছমে একটা ব্যাপার পুরো সময়টা মুগ্ধ করে রাখলো আমাকে। যখন অতিথিশালায় পৌঁছালাম তার কিছু আগেই নির্জন শহরটা পার হলাম। সারাক্ষণে শুধু মাত্র একজন মানুষকে দেখলাম শহরের পথ ধরে হাঁটতে। সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। রাতের অন্ধকারে রাস্তার পাশে নানান গাড়ি আর মোটরসাইকেল পার্ক করা। আমাদের অতিথিশালাটি শহরের এক কোণে, ছোট কিন্তু সুন্দর। পাহাড়ি উঁচু নিচুর সঙ্গে মিল রেখে ঘরগুলো বানানো।

যখন অতিথিশালার কক্ষে ঢুকলাম, দেখলাম বেশ বড় সুন্দর কক্ষটি। ব্যবস্থাপক রাত পর্যন্ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ব্যবস্থাপক দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করার পর বিদায় নিলেন। দুটো বড় বড় খাট, বিশাল বাথরুম। বাথরুমের ভিতর ফুলের টব রাখা। চারটা বেতের চেয়ার আর টেবিল, সেখানে আমাদের খাবার ঢাকা দেয়া। বহু পদের খাবার। মনে হলো এই রাতটাই এবারের ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ রাত। পরের দিন কাটলো বৃষ্টির ভিতর দিয়ে, এমনকি রাতটাও। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শীত বাড়ছিল রাতে এবং পরদিন সকালে ।

আমরাও বেশি বেশি কাপরচোপড় গায়ে চাপাচ্ছিলাম। ঠিক তার ভিতর দিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলো দেখে নিলাম । ঘরেও বন্দি হয়ে থাকলাম। গৃহবন্দি থাকতেও খারাপ লাগছিল না। পাহাড়ে বেড়াবার এটাও একটা ভালো দিক। ঘরে বসে গরম কফিপান আর বাইরের ঠাণ্ডা উপভোগ করা।