চিত্রকর্ম: মকবুল ফিদা হুসেন
রাশেদ রহমানের গল্প ‘মা, আমি তো একটা লাশ মাত্র’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২২, ২০২০
মা, আমি তো এখন একটা লাশ মাত্র! শব, মড়া। আমার মন-মস্তিষ্ক মৃত। আমার দেহ মৃত। দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ— চোখ, নাক, মুখ— হাত, পা— সবকিছু মৃত। আমার কোনো স্পন্দন নাই, অনুভূতি নাই; মা, কেন তুমি আমার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছ! কেন তোমার চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরছে? যখন আমি জীবিত ছিলাম, তোমার ডাকে কোনোদিন সাড়া দিই নাই, তোমার কাছে কোনোদিন ক্ষণকালের জন্যও বসি নাই; দূরে দূরে থেকেছি, সংসারে থেকেও সংসার করি নাই; আমি আমার মতো থেকেছি, তুমি আমাকে ধরতে পারো নাই; আমার গায়ে-মাথায় একটু হাত বোলাতে পারো নাই; আজ সুযোগ পেয়ে, তুমি বুঝে গেছ, আজ আমি আর পালাতে পারবো না; আমার মাথায় হাত দিয়ে বিমূঢ়ের মতো বসে আছ। মাছি তাড়াচ্ছ আমার মুখ থেকে। দু’টো মাছি খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে তোমাকে। বারবার এসে বসছে আমার মুখে। আমার মুখটাই শুধু খোলা। শরীরের বাকি পুরোটাই সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। গাঁয়ের লোকেরা শেষবারের মতো আমার মুখটা দেখতে আসছে। এখন আমি মৃত, মড়া; আমার কোনো শত্রু-মিত্র নাই, সবাই তোমার অমল-পাগলাকে দেখতে আসছে মা...।
এই জীবনে, মা, তোমার চোখে জল তো কম দেখি নাই। আজও তোমার চোখে জল। তুমি কাঁদছ। অবিরল-ধারায় জল ছেড়ে যাচ্ছে তোমার দু’চোখ। তুমি কি আমার মৃত্যুতে কাঁদছ মা? আমি তো— থাকা না-থাকা— সমান ছিলাম। তাহলে? নাকি ভগবানের অবিচার সইতে না-পেরে তুমি কাঁদছ, মা...?
দেখলাম তো, যতদিন জীবিত ছিলাম; নিরীহ লোক, সরল-সোজা লোক, যারা মনপ্রাণ ঢেলে ভগবানকে ডাকে; তারাই বেশি অবিচারের শিকার; মা তুমি একা নও...।
‘আমি একা নই? দুনিয়ায় আরো মানুষ ভগবানের অবিচারের শিকার...?’
‘হ্যাঁ মা। ম্যালা মানুষ ভগবানের রোষানলে পড়ে...।’
‘কেন? ভগবান এতো নিষ্ঠুর কেন...?’
‘ভগবান নিষ্ঠুর না মা। এটা তার খেলা...।’
আমি আর মা কথা বলি— এটা কিন্তু উপস্থিত কেউ, বাড়িতে গিজগিজ করছে মানুষ; পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন, তারা কেউ দেখে না। বোঝে না। এটাও ভগবানের একটা খেলা...।
উঠোনের ঠিক মাঝখানে আমি শুয়ে আছি। চিৎ হয়ে। সটান। হাত দু’টো বুকের ওপর মেলানো। মাথা উত্তর দিকে, দক্ষিণ দিকে পা। মা মাথার কাছে বসে আছে। চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। বজ্জাত মাছি দু’টো এলো নাকি আবার? মাছি দু’টো না থাকলে মা চারপাশে তাকায়। কাকে যেন খোঁজে। আমি জিজ্ঞেস করি— ‘মা, কাউকে খুঁজছো? আমাকে বলো, আমি ডেকে দিই...।’ মা কোনো কথা বলে না। আমার মাথার ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে তাকায়। মা’র চোখ কোটরাগত। ঘোলা। আজ তো অবিরাম জল ঝরছে। দক্ষিণ দিকে যে তাকিয়ে আছে— সে কিছু দেখছে কিনা, কে জানে...!
আমি যে উঠোনে শুয়ে আছি, পা মেলে, পা ঠেকে গেছে ঘাস-জঙ্গলে; এটিকে এখন আর গেরস্তবাড়ির উঠোন বলা যায় না। গেরস্তবাড়ির উঠোনের মাঝখানে কেউ শুলে, আমি দীর্ঘাঙ্গী-মানুষ তা ঠিক, উচ্চতা পৌণে ছয় ফুট; তারপরও আমারচে’ দীর্ঘ কেউ, সে হোক গালার ঠাকুর, গালার সুরেন ঠাকুর সাত ফুট লম্বা, বাংলাদেশের সবচে’ দীর্ঘ মানুষ; সে কোনো গেরস্তবাড়ির উঠোনের মাঝখানে শুলেও তার পা ঘাস-জঙ্গলে ঠেকবে না; অথচ আমাদের উঠোনে শোওয়ার পর আমার পা ঘাস-জঙ্গলে ঠেকে গেছে। এখন আমাদের, তা দীর্ঘদিন ধরেই গেরস্তালিও নাই, সেই বালুচরাচকের বড়ো ক্ষেতের মতো বিশাল উঠোনও নাই। উঠোনের পরিচর্যাও নাই যে! জায়গা আছে আগের মতোই, কিন্তু চারপাশে ঘাস, ঝোপজঙ্গল, খুড়ে কাঁটার ঝাড়, একদঙ্গল ধুতরা গাছ, অগণিত পিঁপড়ার বাসা, ইঁদুরের গর্ত, উঁইপোকার ঢিবি— উঠোন এখন মৃতপ্রায়। আমাদের বাড়ির পেছনের নদীটির মতো; অথচ দেখেছি তো, বাবা তখন বেঁচে ছিল, বাবা সরকারি চাকরি করতো, সিএন্ডবি অফিসের ওভারশিয়ার; তারপর বাড়িতে গেরস্তালি ছিল, আট-দশটা গরু ছিল বাড়িতে, ধান-পাট, তিল-কাউন-কলাইয়ে ভরে যেতো আমাদের উঠোন...।
মানুষ যে-রকম দিনে দিনে বুড়ো হয়, রোগে-শোকে জীর্ণশীর্ণ হয়, তারপর একদিন গাছের পাতা পড়ার মতো টুপ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, নদীও নাকি সে-রকম বুড়ো হয়, রোগে-শোকে ভুগতে ভুগতে একদিন চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে; তারপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়...।
বাড়ির বিশালাকার উঠোন, বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে চলা সদ্য-যুবতী-কন্যার মতো একহারা গড়নের নদী— দু’টোই খুব প্রিয় ছিল মা’র। সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠোন ঝাড়– দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠতো মা, তবুও বাড়ির উঠোন নিয়ে গর্বের সীমা ছিল না মা’র, হিন্দুপাড়ায় যে এতো বড়ো উঠোন আর কারোও বাড়িতে নাই। আর নদী! আষাঢ়ের শুরুতেই নদীতে সে কী কুলকুল স্রোত! বেদে নৌকার বহর, পানশি নৌকা, পানশির ছইয়ের ভেতর নতুন বর-কনের খুনসুটি— নদীর কতো গল্প যে করতো মা...!
আজ মা কি আমার জন্য কাঁদতে বসে তার বাড়ির প্রিয় উঠোন; এ বাড়িতে বউকালে যা পেয়েছিল, সেই ভোরের গন্ধমাখা গেরস্তালি; বাড়ির পেছনের নদী— এসবের জন্যও কাঁদছে? তা কাঁদতে পারে। কাঁদুক— কেঁদে-কেটে যদি মনটা একটু হালকা হয়...।
সেই শৈশব থেকে দেখছি, কমল-রাতুল তখন ছোট ছোট; ওরা বুঝতো কিনা জানি না, দিদি ও বড়ো দুই দাদা নিশ্চয়ই বুঝতো, দিদি হাইস্কুলে পড়ে, দুই দাদা কলেজে পড়ে, কিন্তু তারা বিষয়টি নিয়ে কিছু ভাবতো কিনা তাও আমার জানা নাই; কিন্তু আমি ভাবতাম, আমার কেন জানি মনে হতো— সংসারে মা’র দুঃখ-কষ্টের অন্ত নাই, মুখ ফুটে কিছু বলে না, এই যা...।
তবে মাকে তখনো, হরদম, বলতে শুনেছি— ভগবানের বিচার নাই। আজও তার মুখে একই কথা। ভগবানের বিচার নাই...।
বাড়ির আর কেউ অনুভব করে কিনা, জানি না; আমি কিন্তু অনুভব করতে পারি— মা’র কেন এতো দুঃখ-কষ্ট। মা’র কেন ভগবানের ওপর এতো রাগ, অভিমান; মা কেন বলে ভগবানের কোনো বিচার নাই। শৈশব-কৈশোরেও এটা বুঝতাম, যৌবনেও বুঝেছি, এখনো বুঝি...।
বাবা স্বর্গে গেছে অন্তত ত্রিশ বছর আগে! যম অনেকদিন আগেই বাবার ঘাড়ে বসে ছিল। বাবা টের পায় নাই। কিংবা কিছুটা টের পেলেও পাত্তা দেয় নাই। বুকের বামপাশে কদাচিৎ ব্যথা করে। রাতে কখনো কখনো সামান্য শ্বাসকষ্ট হয়। এ আর তেমন কী? হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। শরীরের কোথাও কুঞ্চন অনুভব করে না। চোখের দৃষ্টি, দাঁতের কাঠিন্য— সব ঠিক আছে। রাতে কুপিবাতির আলোকেই মহাভারত-রামায়ণ পড়ে। পাঁঠার রান চিবুতেও কোনো সমস্যা হয় না। তাহলে? অথচ দেখো— চাকরি থেকে অবসর নেয়ার বছর-খানেক পরই যম একদিন বাবাকে বললো— ‘আদিত্যবাবু, ভগবান আপনার জন্য ওপারবাড়ি ঘর-গেরস্তালি সাজিয়ে রেখেছে। চলুন, আপনাকে এখন যেতে হবে...।’
তখন সকাল দশটা। শীতের সকাল। কেবল উঠোনে রোদ পড়েছে। কুয়াশা বিদায় নিচ্ছে। বাবা তার ষাঁড়টার শিং পরিচর্যা করছিল...। বাড়িতে বাবার একটা ষাঁড় ছিল। ষাঁড়টি দারুণরকম সুদর্শন। পুরো শরীর মিশমিশে কালো। শুধু লেজ আর গজ পাকা তরমুজের মতো লাল। শিং দু’টো খয়েরি রঙের; ধনুকের মতো বাঁকা। বাবা কাচের টুকরো দিয়ে ঘষছিল ষাঁড়ের শিং। ডান শিং ঘষা শেষ। সুইয়ের মতো চোখা শিং চকচক করছে। কেবলই বাঁ-শিংটা ধরেছে বাবা, ষাঁড়টিও বাবার খুবই অনুগত; ডান-শিং চাঁছা শেষ হলেই বাঁ-শিং মেলে দিয়েছে, বাবা তখনই বুকের বাঁ-দিকে ব্যথা অনুভব করে, তার দম বন্ধ হয়ে আসে; বাবা মাকে ডাক দেয়— ‘সন্ধ্যা, এদিকে একটু আসো তো...।’
মা রসুই ঘরে, উনুনে ভাতের পাতিল, বাবার অস্পষ্ট ডাক মার কানে যেতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মার চোখে-মুখে ভীষণ উদ্বেগ। ‘কী হলো তোমার...!’
বাবা ষাঁড়ের গায়ে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। ষাঁড় বাবার ভর নিজের শরীরে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে স্থাণুর মতো। মা এসে বাবাকে ধরতেই বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ‘জল, সন্ধ্যা, একটু জল’— কোনোমতে বললো বাবা। মা জলের ঘটি নিয়ে ফিরে আসার আগেই বাবা যমের সাথে ওপারবাড়ির পথ ধরে...।
মা সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেললো...। খালের ওপার বড়দার পৃথক বাড়ি। বউদিকে নিয়ে তার সংসার। দিদির বিয়ে হয়েছে। নেত্রকোণা। আমি, মেজদা, কমল, রাতুল— আমরা চারভাই বাড়িতে, তবুও একা হয়ে গেল মা...।
মা বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। দু’জনের বয়সের বিস্তর ব্যবধান। বাবা একবছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। বয়েস ষাটের কাছাকাছি। মা’র বয়স টেনে-টুনে পঁয়তালিশ হতে পারে। জোয়ান মানুষ। মাথার সব চুল কুচকুচে কালো। অথচ দেখো, বাবার মৃত্যুর পরদিনই মা’র মাথার সব চুল শনপাটের মতো পেকে গেছে। কী আশ্চর্য! একদিনের ব্যবধানে কারোও মাথার চুল পাকে...!
মা’র মাথার সব চুল একদিনের ব্যবধানেই পেকেছিল...। বড়দা আমাদের সৎ-ভাই। দাদার বয়স তখন দশ কি বারো, বড়মা একরাতে, অমাবশ্যার রাত ছিল সেটা, বাড়ির পেছনের শেওড়াগাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করে। বাবার পাশেই শুয়ে ছিল বড়মা। কখন উঠে গেছে, কখন গাছে উঠে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, বাবা কিছুই জানে না। ভোরবেলা বড়মার খোঁজ পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে শেওড়াগাছের ডালে ঝুলন্ত ও মৃত অবস্থায় আবি®কৃত হয়। তার সিঁথিতে নাকি সিঁদুর জ্বলজ্বল করছিল...।
বড়মা কেন আত্মহত্যা করেছিল আমরা কেউ জানি না। বড়দা জানে কিনা, তাও জানা নাই। বাবা বোধহয় জানে...। বড় দুই দাদা তখন কলেজে পড়ে। দিদি আর আমি হাইস্কুলে। দিদি নাইনে, সিক্সে আমি। কমল-রাতুল কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। বড়ো দুই দাদার জন্য পৃথক দোচালা ঘর। একঘরেই দু’টি চকি। আমরা বড়ো ঘরে থাকি। ঘরের মাঝখানে তড়জার বেড়া। একপাশে মা-বাবা, অন্যপাশে দিদি, আমি, কমল ও রাতুল। আমাদের রুমে দু’টো চকি। একটিতে দিদি আর রাতুল, অন্যটিতে আমি আর কমল ঘুমাই...।
হঠাৎ হঠাৎ কোনো রাতে মা’র গোঙানি শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি বাবা মাকে চাবুক দিয়ে পিটাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে ঘোড়া নাই, কিন্তু ঘোড়ার চাবুক আছে। মাকে পেটানোর জন্যই বোধহয় বাবা চাবুকটি কিনেছে। চাবুকটি কবে কিনেছে বাবা তা জানি না, হয়তো এই চাবুক দিয়ে বাবা বড়মাকেও পিটিয়েছে...। বাবার চাবুকের বাড়ি খেয়ে মা মাটিতে গড়াগড়ি করে, গোঙায়, কিন্তু চিৎকার বা শব্দ করে কাঁদে না। বাবা যখন চাবুক চালায় তখন তো সে খ্যাপা কুকুরের মতো। শান্ত হলে মা বলে— ‘দেখে নিও, আমিও একদিন বড়দি’র মতো গলায় দড়ি দেবো।’ মা যখন এই কথা বলে বাবা তখন আরও উন্মত্ত হয়ে উঠে। যেন চাবকাতে চাবকাতে মাকে মেরেই ফেলবে...।
বাবা মাকে পেটানো শুরু করলেই আমি কমলকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। দিদি রাতুলকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আমার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। জোর করে কান্না চেপে রাখি। দিদি বোধহয় বুঝতে পারে— আমি কেঁদে ফেলতে পারি। ‘কান্নাকাটি করিস না অমল, বাবা তাহলে আমাদেরও চাবুক মারবে...।’ বলে দিদি।
এমনিতে বাবা খুব ভালো মানুষ। আমাদের প্রতি, এমনকি মা’র প্রতিও ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নাই। আমাদের সব ভাই-বোনকে সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় কিনে দেয়া, লেখাপড়ার খরচ— কোথাও একটুও কার্পণ্য করে না। মা’র পরনের কাপড়, ঘরের কাপড়Ñ সবই দামি দামি। হাতে-কানে, গলায়-নাকে মায় কোমরে-পায়েও গহনার অভাব নাই। তাহলে? ঘটনা কী? বাবা মাকে এভাবে চাবুক মারে কেন? বাবার মাথায় কি গণ্ডগোল আছে? ভগবান জানে...।
একরাতে বাবা অসুর হয়ে উঠেছে। মাকে চাবুক দিয়ে পেটাচ্ছে। আমি টের পেলাম, আমাকে কে যেন অদৃশ্য থেকে ঠেলছে। দিদির বারণ শুনলাম না। দরজার খিল খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দাদাদের ঘরের সামনে গিয়ে বড়দাকে ডাক দিলাম, ‘বড়দা, এই বড়দা, ওঠোছে...।’
‘কে রে এতোরাতে...?’ ঘুমের ঘোরেই বড়দা বললো।
‘আমি অমল...।’ বললাম আমি।
‘অমল! এতো রাতে কী হয়েছে...?’
‘দাদা, তাড়াতাড়ি ওঠো। বাবা মাকে মেরে ফেললো...।’
দুই দাদাই উঠে এলো। বড়দা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘বাবা, দরজা খোল...।’
‘কে? চিৎকার করে কে...?’
‘আমি সুনীল...।’
‘সুনীল! তুই এখানে কেন...?’
‘আমি একা নই। নিখিলও আছে...।’
‘তোরা চলে যা। দরজা খুলবো না...।’
‘দরজা খুলবে না...?’
‘না...।’
বড়দা খুব জোরে, পায়ে যতোটুকু শক্তি আছে, সেই শক্তি খাটিয়ে দরজায় লাথি মারা শুরু করলো। তিন-চার লাথির মাথায়ই ভেঙে গেল দরজার খিল। বড়দা ঘরে ঢুকেই ক্ষিপ্র হাতে কেড়ে নিল বাবার হাতের চাবুক। তারপর বাবাকে চাবুক মারতে উদ্যত হতেই মা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে রা-রা করে উঠলো, ‘ছিঃ ছিঃ বাবা সুনীল! এ তুই কী করছিস? জন্মদাতা পিতার গায়ে হাত তুলতে আছে? হাতে যে কুষ্ঠ হবে...!’
বড়দা ঘরের মেঝের ওপর চাবুক দিয়ে কষে একটা বাড়ি মারলো। দাদা তখন রাগে কাঁপছিল। কাঁপতে কাঁপতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিখিলদা গেল তার পিছে পিছে...।
মা জীবনভর কষ্ট সহ্য করেছে। আমরা এতগুলো ভাইবোন। আমাদের যত্নআত্তি করে বড় করে তুলতে কম ধকল পোহাতে হয় নাই। বড়দা যে তার সৎ-ছেলে কেউ বোঝে নাই তা। আমাদেরও বুঝতে অনেকদিন লেগে গেছে, বড়দা আমাদের সৎ ভাই...।
সে যাক। বাবার মৃত্যুর পরই মা’র দুঃখ-কষ্ট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল...। আমি আর কমল মানুষ হই নাই। বড় দুই দাদা মানুষ হয়েছিল। দুজনই ওপারবাড়ি চলে গেছে। কিন্তু যখন তারা বেঁচে ছিল, এপারবাড়ির ঠিকানা ছিল; তারা কেউই মায়ের কাছে থাকতো না। বড়দা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিল। বউদিকে নিয়ে, ছেলেমেয়ে নিয়ে পৃথক বাড়িতে থাকতো। বাবা বেঁচে থাকতেই খালের ওপার বড়দাকে বাড়ি করে দিয়েছিল। পৌণে তিনবছর আগে একরাতে দাদা-বৌদি নিজেদের শোবার ঘরেই খুন হয়েছে। দাদা-বৌদির ছেলেমেয়ে বাড়িতে ছিল না। ছেলে কাঞ্চন বউ নিয়ে ঢাকা থাকে। দুজনেই ঢাকায় চাকরি করে। মেয়ে পুষ্পিতা লন্ডন-প্রবাসী...।
নিখিলদাও বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকতো। ইঞ্জিনিয়ার। বড়ো চাকরি করতো। মাকে দেখতে আসার সময় ছিল না। এ-নিয়ে মা অবশ্য দুঃখ করতো না। তার কথা, সবাই যার যার মতো ভালো থাকুক। ভগবান সবার মঙ্গল করুক। কিন্তু ভগবান কারোও কথা শোনে না। সে সবকিছু করে নিজের ইচ্ছে মতো। যখন যা খুশি তাই। বড়দা-বউদি খুন হওয়ার বছরখানেকের মাথায় নিখিলদারও ওপারবাড়ির ডাক এসে গেলো। তরতাজা মানুষ, রোগ নাই, ব্যাধি নাই; যম এসে স্ট্রোকের নাম করে তাকে নিয়ে গেল। হাসপাতালে নেয়ারও সুযোগ দিল না...।
রাতুলও মানুষ হয়েছে। সেও ইঞ্জিনিয়ার। নিখিলদার চেয়েও বড়ো ইঞ্জিনিয়ার। দাদা ডিপ্লোমা করেছিল। রাতুল বুয়েট থেকে বিএসসি করেছে। পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে চাকরি করে। ম্যালা টাকা নাকি বেতন। তারও মাকে দেখতে আসার ফুরসত মেলে না...। অথচ দেখো, রাতুলের বয়স যখন দশ, হুট করে বাবা মারা গেল, মা কী কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছে...।
আমি একা থাকতাম মায়ের কাছে। সেই আমিও ওপারবাড়ির পথ ধরেছি...। কমলও মায়ের কাছে থাকতো। ও এখন জেলে। বড়দা-বৌদির খুনের মামলার আসামী। পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। চার্জশিটে লিখেছে, ‘সুনীল দাশের সতালু ছোটভাই কমল দাশ তার পাঁচ বন্ধুকে সাথে নিয়ে সুনীল দাশ ও তার স্ত্রীকে বালিশচাপা দিয়ে দমবন্ধ করে খুন করেছে...।’ কী চমৎকার নাটক যে রচনা করতে পারে পুলিশ...!
কমল কবিতা লেখে। ওর কবিনাম, অর্ঘ কমল। কমলের কবিতার বইয়ের নাম ‘পৃথিবীতে এত আলো অথচ মানুষ কিছুই দেখে না।’ বইটি আমি পড়েছি। কবিতার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু পড়তে ভালো লেগেছে। কবিতার শব্দগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা হাহাকার! কী যেন আমাদের নাই, কী যেন আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কমলের একটা কবিতা আমার এত ভালো লেগেছে যে, কবিতাটি আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আপনাদের শোনাই— ‘পাখি বহু চেষ্টার পরও স্বপ্নে পাখা/মেলতে পারে না/কারণ পাখিরা উড়তে জানে/মানুষ স্বপ্নে উড়তে পারে/কারণ মানুষের ডানা নেই...।’
কবিরা কোমল স্বভাবের মানুষ। নরম প্রকৃতির মানুষ। তারা গভীর ভাবের মধ্যে বিচরণ করে সর্বক্ষণ। কবিরা কি মানুষ খুন করতে পারে? কমল কোন্ দুঃখে দাদা-বৌদিকে খুন করতে যাবে? পুলিশ চার্জশিটে লিখেছে— কমল দাদার কাছ থেকে জোর করে জমি লিখে নিতে চেয়েছিল। স্ট্যাম্প নিয়েই গেছিল। দাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে চায় নাই। আর তাতেই...!
যত্তোসব আজগুবি গল্প...! দুপুরের রোদ পড়েছে মা’র মুখে। শেষ এপ্রিলের কড়া রোদ। মার মুখমণ্ডল ঘেমে গেছে। ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে, কপোল বেয়ে। ঘাম আর চোখের জল একাকার। মা’র হাত আমার মাথায় কিন্তু কোনোদিকে তার খেয়াল নাই। গভীর চিন্তায় মগ্ন...। বড়দা আর বউদি যেদিন খুন হয়, মা দাদার মাথায় হাত রেখে বসে ছিল। দু’চোখ থেকে জল ঝরছিল অবিরাম। নিখিলদার লাশ বাড়িতে নিয়ে এলে সেদিনও জল-চোখে তার মাথায় হাত রেখে বসে ছিল মা। আজ যেমন আমার মাথায় হাত রেখে বসে আছে...।
মা কী ভাবছে তা কিন্তু আমি জানি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, আমি মা’র মন পড়তে পারি। কতোদিন যে মা’র মনের কথা বলে দিয়ে মাকে অবাক করে দিয়েছি! একদিনের ঘটনা বলি। দুপুরবেলা। সিসাগলা রোদ। বাইরে যাওয়ার জো নাই। গেলে শরীরে ফোস্কা পড়ে যাবে। গোয়ালঘরের কোণায় জামতলা ছায়ায় বসে কমলের জন্য ঘুড্ডি বানাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো, মা আমাকে ডাকছে। মন্দিরে যেতে বলবে...।
‘কমল, তুই একটু বোস, মা ডাকছে, আমি শুনে আসি...।’
‘মা ডাকছে! কই? আমি তো কিছুই শুনলাম না। মা রসুইঘরে। এখান থেকে কতোদূর! ডাকলে, চিৎকার করতে হবে...।’
‘মনে মনে ডাকছে...।’
‘বলো কী দাদা। মা মনে মনে ডাকছে, আর তাই তুমি শুনতে পাচ্ছ! তোমার কি মাথা-খারাপ হয়েছে, নাকি দেবতা হয়ে উঠছ? কেউ মনে মনে ডাকলে শোনা যায়, এ-কথা তো আগে কোনোদিন শুনি নাই...।’
কমল ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিনের চেয়ে কমল আমার মুখটা অন্যরকম দেখলো কি না, কে জানে! আমি ওকে কিছু বললাম না। রসুইঘরের সামনে গিয়ে মাকে বললাম, ‘মা, মন্দিরে যেতে হবে...?’
‘হ্যাঁ...।’
‘পুরোহিত মশাইকে নৈশভোজের নেমতন্ন করতে হবে...।’
‘হ্যাঁ। ভাবছিলাম, বিকালে তোকে বলবো। এখন তো গো-পোড়া রোদ। বিকালে গেলেই চলবে। কিন্তু তুই এখনই...!’
আমি মাকে কিছু না-বলে মুচকি হেসে জামতলা চলে এলাম। কমল তব্দা মেরে বসে আছে...। মা এখন ভাবছে, সুনীল গেছে, ওর বউ গেছে; নিখিলও গেল। অমল যাচ্ছে আজ। সবাই কেমন চলে যাচ্ছে, দেখো। অথচ আমি একটা ঘাটের মড়া, বুড়ো হতে হতে শকুন হয়ে গেছি, যম আমাকে চোখে দেখে না! ব্যাটার চোখে ছানি পড়লো নাকি...?
আহারে দুঃখিনী মা আমার! মা যে বলে, ভগবানের বিচার নাই, কথা তো একশ’ ভাগ খাঁটি। ভগবানের বিচার থাকলে তাকে কবেই ওপারবাড়ি নিয়ে যেতো...! দীর্ঘাঙ্গী শরীর-কাঠামোর মা দেখতে দেবী দুর্গার মতো সুন্দরী ছিল। পাকা গাবের মতো গায়ের রঙ। কী যে মনকাড়া বেদানার মতো বড়ো বড়ো চোখ। চোখের সরোবরে ভাসে কালোপদ্ম। সেই মা এখন একটা জড়পিণ্ড মাত্র! মা ঘুমে-জাগরণে সবসময় ভগবানকে ডাকে, ‘ভগবান, দয়া করো, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও’— ভগবান মা’র ডাক শোনে না। যম তাকে দেখে না। তার তরতাজা ছেলেরা পড়ে যমের চোখে...।
‘মা, তোমার মুখটা পুড়ে যাচ্ছে, তুমি ঘরে যাও...।’ আমি বললাম। বিস্ফারিত চোখে মা আমার দিকে তাকালো। চোখে যেন পুনের আগুনের মতো আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। মা বললো, ‘সারাজীবন তুই আমাকে জ্বালিয়েছিস, অমল। আজও জ্বালাবি...?’
‘মা...!’
‘আমি ঘরে গেলে তুই এই গা-পোড়া রোদের মধ্যে একা একা থাকবি কী করে...।’
‘একা কই মা? চারদিকে তো ম্যালা মানুষ দেখছি...।’
‘ওরা কি সব তোর মা? তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে...?’
দুই.
আমি মানুষ হই নাই। মোদ্দা কথা, আমার মধ্যে মানুষ হওয়ার কোনো চেষ্টাই ছিল না। নিজে চেষ্টা না-করলে ভগবান কি এগিয়ে আসে? কারো মাথার ওপর সহায়তার ছাতা ধরে? ধরে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তো বলেই দিয়েছেন, ‘তুমি বাড়ি থেকে বের হও, আমি পথ বলে দেব...।’ অমল দাশ বাড়ি থেকে বের হয় নাই, সে মানুষ হয় কী করে...?
আমি যে মানুষ হওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হই নাই, মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি নাই; আসলে আমি বাড়িতে ছিলাম কবে? পৃথিবীতে যে-ক’দিন ছিলাম, দিনগুলো তো পথে-পথেই কাটিয়ে দিয়েছি। নিজে মানুষ হই নাই বটে, মানুষ খুঁজে মরেছি...।
‘মানুষ কে? কাকে আমরা মানুষ বলবো...?’ সত্যকথা, আসলে কে যে প্রকৃত মানুষ, কে মানুষ না, আমি এই ধন্দের মধ্যে ছিলাম। সারা-জীবন চেষ্টা করেও এই ধন্দ আমি কাটিয়ে উঠতে পারি নাই। বড়ো দুই দাদা কি মানুষ হয়েছিল? রাতুল হয়েছে? যে-অর্থে আমি আর কমল মানুষ হই নাই; মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে এই অর্থের কার্যকারিতা থাকলে ওরা মানুষ হয়েছে। অন্তত বাবা তাই ভাবতো। মা তাই ভাবে। পাড়া-পড়শিরও মতামত তাই। বড়ো দুই দাদার মৃত্যুর পর আমি নিজের কানে শুনেছি, পড়শিরা রাস্তার পাশে পাকুরতলা বসে দুপুরের আড্ডা দিচ্ছে, আড্ডায় রাখাল কাকাই মুখর, আমি বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম; আমার কানে এলো— রাখাল কাকা বলছে— ‘ভগবানের কাণ্ড দেখো, আদিত্যর প্রথম পক্ষের ছেলে সুনীল, দ্বিতীয় পক্ষের বড়ো ছেলে নিখিল— দু’জনেই বিদ্বান ছিল, টাকাওয়ালা ছিল, সুনীল তো বাড়িতে আলিশান দালান তুলেছে, ওরাই চলে গেলো। রয়ে গেলো কারা? দুই অপদার্থ অমল আর কমল...।’
কে একজন বললো, ‘না, দাদা; রাতুল আছে। খোলা ঝারাটা। সে মানুষ হয়েছে...।’
আরেকজন বললো, ‘হ্যাঁ, রাখাল দা, রাতুলও ইঞ্জিনিয়ার। এই বয়সেই ম্যালা টাকার মালিক...।’
তাহলে কী বোঝা গেল? অমল দাশ মানুক বা না-মানুক— মানুষ হওয়ার জন্য বিদ্যা বা লেখাপড়া এবং টাকা, দুটোই অবধারিত। শুধু বিদ্যা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। বিত্তহীন বিদ্বান-লোককে কেউ মানুষ বলে না। শুধু বিদ্যার জোরে মানুষ হওয়া গেলে, আমরা আমজনতা যাকে মানুষ বলি, রাখাল কাকারা যাকে মানুষ বলে; কমল নিশ্চয়ই সে-রকম মানুষ হতে পারতো। এ-ধরনের মানুষ হতে কমলের কোনো বাধা ছিল না। কারণটাও বলার দরকার পড়ে না। কমল বিদ্বান ছেলে। ওর ঘর-ভর্তি বই আর বই...।
কমল বাড়িতে থাকতে কোনোদিনই ওর ঘরে যেতে পারি নাই। বাড়ির কারোরই অনুমতি ছিল না ওর ঘরে যাওয়ার। কদাচিৎ দেখেছি, ওর বন্ধুরা কেউ এসেছে, তারাই ঢুকতে পারতো ওর ঘরে। বাড়ি থেকে বেরুলেই ঘরের দরজায় তালা মেরে যেতো। কমল জেলে যাওয়ার পর দরজার তালা ভেঙে ওর ঘরে ঢুকি। ঘরের ভেতর অগুণতি বই। টেবিলে বই, চেয়ারে বই, তাকে বই, বিছানায় বই। ছোট ছোট বই। বড়ো বড়ো বই। বিছানার বইয়ের স্তূপে চোখ পড়তেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। গীতা, রামায়ণ, মহাভারত তো আছেই, খৃষ্ট-ধর্মের বাইবেল, মুসলমানদের কোরান শরিফও আছে। আমি দু’একটা বই নাড়াচাড়া করি। বইয়ের অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ এসে বোয়াল মাছের মতো ঘাই মারে আমার নাকে...।
কমলের কবিতার বইটাও আমি পড়েছি ও জেলে যাওয়ার পর...। এখন, মা প্রতিদিনই কমলের ঘরে গিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বইয়ের ধুলো ঝাড়ে। বইগুলো গুছিয়ে রাখে। বিছানা পরিষ্কার করে। কমল যদি হঠাৎ জামিন পেয়ে বাড়ি চলে আসে...! মা ভালোই লেখাপড়া জানে। নাইন পর্যন্ত পড়েছিল। তারপরই তো বিয়ের পিঁড়িতে বসে। মাও কমলের কবিতা পড়ে। কয়েকটি তো মুখস্তই করে ফেলেছে। হঠাৎ কোনোদিন আমাকে বাড়িতে পেলে বলতো— ‘অমল, আমার কাছে একটু বস্তো, কমলের একটা কবিতা পড়ে শোনাই...।’
তো, কমল মানুষ হলো না কেন? বিদ্যা তো ওর ছিল...।
ওই যে, কমলের শুধু বিদ্যাই ছিল। টাকা ছিল না। রোজগার ছিল না। কমল তাই মানুষ হয়ে উঠতে পারে নাই। বিদ্যার সাথে টাকাও থাকতে হবে, রোজগার থাকতে হবে, তবেই না মানুষ...! আমার কোনোটাই ছিল না। না বিদ্যা, না টাকা। তদুপোরি মানুষ হওয়ার কোনো চেষ্টা আমার আদৌ ছিল না, আগেই বলেছি; অর্থাৎ মানুষ না-হওয়ার পেছনে ভগবানের কোনো হাত নাই...।
সিক্সে মাস-ছয়েক পড়েছিলাম। তারপর থেকেই স্কুল-পালানো শুরু করি। কেন যেন পড়তে আমার ভালো লাগতো না। মনে হতো, ‘দাঁতখানি চাল/মসুরের ডাল/চিনিপাতা দই’— মুখস্থ করে লাভ কী? ক্লাসে ঢুকলেই মনে হতো, জেলখানায় ঢুকেছি। এরচে’ নদীর ধারে, বনবাদাড়ে বাটুল হাতে ঘুরে বেড়ানোতেই মহাসুখ। আর একটা-দুটো ঘুঘু মারতে পারলে তো সুখের সীমাই নাই...।
যা-হোক— একক্লাস করি তো পরের দু’ক্লাস ফাঁকি দিই। বইপুস্তক বেঞ্চের ওপর রেখেই পালাই। স্কুলের পেছনে, সামান্য দূরেই খাল। ঝিনাই নদীতে গিয়ে পড়েছে। আষাঢ় মাসে খালে বর্ষার জল আসে, মাস-তিনেক থাকে। কার্তিকেই খালের পেট শুকনো, খটখটে। খালপাড়ে প্রচুর ঝোপজঙ্গল। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে খালপাড়ের জঙ্গলে ঢুকে বিড়ি খাই। সেভেনের মতিন আমার সঙ্গী। বিড়ি খাওয়ার হাতেখড়ি ওর হাতেই। ওরও পড়তে ভালো লাগে না...। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিড়ি খাই; মার খাই বলাই স্যারের হাতে, জোড়া বেতের বাড়ি, হাতের তালু লাল টকটক করে; এটাই যেন আমার জন্য নিয়ম হয়ে ওঠে। প্রথম প্রথম হাতে খুব ব্যথা করতো, চোখে জল এসে যেতো, ক’দিন পর গা-সহ্য হয়ে গেল। দু’চারটে বেতের বাড়িই তো। মুখ বুজে সহ্য করতাম। হাত পেতেই বলাই স্যারকে বলতাম, ‘আর পালাবো না স্যার। আর বিড়ি খাবো না...।’
পরদিন আবার ঠিকই পালাতাম...। কী করে যেন এই খবর বাবার কানে এসেছে। এক শুক্রবার সকালে বাবা আমাকে ধরলো। হাতে সেই ঘোড়ার চাবুক। বুঝতে পারলাম— বাবা বন্ধের দিন বেছে নিয়েছে। আমার পিঠের ছাল আজ থাকবে না। শুধু যে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিড়ি খাই, তা তো না; আমার ওপর বাবার আরও রাগ আছে। সেটাই আসল রাগ। আমিই তো একরাতে, মাকে বাবা চাবুক-মারছিল, দাদাকে ডেকে এনেছিলাম। সেদিন কিছু বলে নাই। আজ...! এতোদিন ক্লাস ফাঁকি দিতাম, বাবার হাতে মার খাওয়ার পর স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দিলাম...।
ইস! বাবা আমাকে কী চাবকানোই না চাবকিয়েছিল! তেরো পর্যন্ত আমি নিজেই গুনে রেখেছিলাম। এরপর আর গুনতে পারি নাই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে মা’র মুখে শুনেছিলাম, অজ্ঞান হওয়ার পরও বাবা আমকে চাবকিয়েছিল। আদিত্য দাশের ছেলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঝোপজঙ্গলে বসে বিড়ি খাবে, তাই হয় নাকি...! আমি তখন, এর মধ্যে ছয়মাস কেটে গেছে, বনবাদাড়ে তো বটেই, বাড়ির কামলাদের সাথে ক্ষেত-খোলায়ও ঘুরে বেড়াই। কামলাদের সাথে ক্ষেতের আইলে বসে, গাঁয়ের চৌরাস্তার মোড়ে বটতলা বসে বিড়ি খাওয়ার যে সুখ তা অন্য কারো পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। বাবা ভেবেছিল— তার চাবকানি খেয়ে অমল সুবোধ বালক সেজে যাবে। আর কখনোই ক্লাস ফাঁকি দেবে না। বিড়ি খাবে না। তার বড়ো দুই ছেলে খুব ভাল ছাত্র ছিল, কমল-রাতুলও ব্রিলিয়ান্ট। অমল কেন বখে যাবে! নিশ্চয়ই বাজে সঙ্গ পেয়েছে। এবার ওই সঙ্গ ছাড়বে। কিন্তু বাবার হিসাবে ভুল ছিল...।
ছ’মাস পর, আমি স্কুলে যাই না, কামলাদের সাথে ঘুরে বেড়াই, এই খবরও গেলো বাবার কানে। এবার প্রথমে ধরলো মাকে। আমাকেও সাঁড়াশি দিয়ে ধরবে, জানি। বাবা বাঘের মতো গর্জে উঠলো, মাকে বললো— ‘অমল স্কুলে যায় না, তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমাকে এতোদিন বলোনি কেন...?’
মা কী উত্তর দিয়েছিল জানি না। আমি তার উত্তর শোনার অপেক্ষা করি নাই। বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। ওই বয়সেই আমার মনে হয়েছিল— বছরের পর বছর একই বাড়িতে, একই লোকজনের সাথে বসবাস, নিয়মিত স্কুলে যাওয়া, নিয়ম করে পড়তে বসা, বিধি মেনে খাওয়া-ঘুম; এতো নিয়ম-নিগড়ের মধ্যে যারা বড়ো হয়, বেঁচে থাকে, মানুষ হয়— তারা প্রকৃত অর্থে মনুষ্যজীবন ভোগ করতে পারে না। এ-জন্যে দরকার পাখির মতো জীবন; মুক্ত, বন্ধনহীন...।
বাড়িতে ফিরেছিলাম তিনবছর পর। তখন আমি অন্য মানুষ। যুবক হয়ে উঠেছি। কিন্তু যৌবনের সাধারণ-ধর্ম পালন করি না। সাধুসঙ্গ করি। দেশে দেশে প্রকৃত মানুষ খুঁজে বেড়াই। গুরু বলেছে, সংসারে থেকে, সংসার-ধর্ম-যাপন করে প্রকৃত মানুষের দেখা মেলে না...। কিছুদিন ধরেই মা’র মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি মা’র মুখে, আমার অন্য ভাই-বোনেরা দেখে কিনা জানি না, জোনাকির আলোর মতো আলো জ্বলতে দেখেছি। মোমবাতির আলো যেভাবে পতঙ্গকুলকে আকর্ষণ করে, মা’র মুখের সেই আলোই আমাকে, এতোদিন পর, কেন জানি, চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছিল। আমি গুরুকে বললাম, ‘বাবা, অপরাধ মার্জনা করবেন। মা’র মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে...।’
বাবার সিদ্ধির কলকের মাথায় আগুন জ্বলছে। বাবা হিমালয় পাহাড়ের মতো স্থির; অবিচল। চক্ষুমুদিত। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত দৃশ্যমান নাই। জানি, এখনই সময়, এখন বাবার কাছে কোনো প্রার্থনা করলে তা না-মঞ্জুর হবে না...। বাবা সিদ্ধির কলকে আমার হাতে দিয়ে চোখ বুজেই বললেন, ‘অমল, মা’র মুখ মনে পড়ছে...?’
‘হ্যাঁ, গুরুদেব...।’
‘মায়ের মুখের মতো সুন্দর-সুশ্রী-পবিত্র আর কিছু এই ভব-সংসারে নাই, বৎস্য। যা, অনুমতি দিলাম, মায়ের কাছে চলে যা। তবে একটা কথা, সাধুসঙ্গ ছাড়িস না...।’
‘গুরুবাক্য বেদবাক্য সমতুল্য, বাবা...।’
ভরদুপুর। মা উঠোনে ধান শুকাতে দিয়েছে। ধান নাড়তে-নাড়তেই দাঁত দিয়ে ধান কাটছে মা। পরীক্ষা করে দেখছে, আর কতক্ষণ ধান শুকাতে হবে। একটু যেন অন্যমনষ্কও। আমি ডাক দিলাম, ‘মা...।’
হঠাৎ মা ডাক শুনে কেঁপে উঠলো আমার জননী। ‘কে? কে...?’
‘মা, আমি তোমার অমল...।’
‘অমল! তুই অমল? এ-কী বেশবাস তোর। তোকে তো আমি চিনতেই পারছি না...।’
আমার মাথায় জটাচুল। মুখভর্তি দাড়ি-মোচ। পরনে গেরুয়া পোশাক। যুবক-সন্ন্যাসী মায়ের সামনে। চিনতে না-পারারই কথা। মা আমার মুখের দিকে অপলক-চোখে চেয়ে আছে। আমি মা’র পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। জলপ্লাবন মা’র চোখে...।
বাঁশ-কাটার শব্দ পাচ্ছি। গোর-কাটার কদ্দুর? কিছুদিন আগেই, বড়দা-মেজদা’র মৃত্যুর পর, মাকে আমি বলছিলাম— ‘মা, তোমার আগেই যদি আমার ওপারবাড়ির ডাক আসে, তুমি দেখো, আমার শব যেন দাহ না-করা হয়, আমাকে যেন গোর দেয়া হয়...।’
মা আমার কথা শুনে আমাকে ধমক মেরেছিল, ‘কী যা-তা বলিস, অমল! আমার আগেই তোদের সব ভাইয়ের ঘরে কেন ঢুকবে যম...?’
ক’দিন ধরেই আমার মন বলছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম— যে-কোনো মুহূর্তে আমার ওপারবাড়ির ডাক এসে যাবে। দুনিয়াটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছিল...।
কে যেন মাকে বললো— ‘ও কাকিমা, অমলের বউ-পোলাপান আসে নাই...?’
তাই তো! অনিতা এসেছে কী? আমার পুত্র-কন্যারা? ওরা সব কই? অনিতা আমার কাছে থাকে না, তা ঠিক। পুত্র-কন্যাদের নিয়ে তার পৃথক সংসার। টঙ্গি থাকে। কিন্তু, আমি তো ধর্মতঃ অনিতার স্বামী। শেষবারের মতো কি সে আমাকে দেখতে আসবে না? অনিতা আমাকে পরিত্যাগ করেছে, দূরে থাকে; তাই বলে আমার সন্তানেরাও কি আমাকে পরিত্যাগ করেছে...?
মা আমার মনের কথা আঁচ করেছে। বললো, ‘ওরা এসেছে, অমল। সবাই খুব কান্নাকাটি করছে। বউয়ের তো কাঁদতে কাঁদতে দাঁতকপাটি লেগেছে। ওকে নিয়েই এখন ব্যস্ত সবাই...।’
গুরুআজ্ঞা যেমন বেদবাক্যের মতো, মাতৃআজ্ঞা তেমনি অবশ্য-পালনীয়। মাতৃআজ্ঞা পালন করতে গিয়েই আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। অনিতা তো আমাকে বিয়ের দু’দিন পরই পরিত্যাগ করে নাই। আমি সংসারে থেকেও সংসারী নই। দেশে দেশে সাধুসঙ্গ করে বেড়াই। অনিতা তবুও মুখ বুজে সংসার করে। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে। আমি সীমা লংঘন করে ফেলেছিলাম...।
আমার ঘরে দু’টি কন্যা ও একটি পুত্র-সন্তান। কন্যা দু’টোই বড়ো। তখন ওরা তিনজনেই হাইস্কুলে পড়ে। বড়ো কন্যা ক্লাস টেনে, ছোটটি এইটে, পুত্র সিক্সে পড়ে। সবাই মেধাবী। ওরা স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় কেউ কোনোদিন সেকেন্ড হয় না। বরাবরই ফার্স্ট। গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে— অমল সাধুর পুত্রকন্যারা সকলেই একেকটা রত্ন। লোকের কথা শুনে গর্বে আমার বুক প্রসারিত হয়। কিন্তু আমি ওদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না। লেখাপড়ার খরচ দেবো কি, ওদের খেতে-পরতেই দিতে পারি না ঠিক মতো। আমাদের সেই বড়ো গেরস্তালি আর নাই। বাবা বেঁচে থাকতেই কী একটা শক্ত মামলায় পড়ে, মামলার খরচ চালাতে গিয়ে, চাকরির বেতনের টাকায় সংসার চালিয়ে মামলা চালাতে পারছিল না, চকের অনেকটা জমি বিক্রি করেছিল। বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করে যে-জমি আমি পেয়েছিলাম তাতে সংসার চলে না। তাও কিছু চলতো, যদি আমি নিজে সংসারী হতাম। আমি তো সংসার-বিবাগী...।
অনিতা মুখ খোলে। অনিতা মুখ খুলতেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। পাঁচদিন, সাতদিন, পনেরোদিন; কখনো বা দু’তিনমাস বাড়িতে ফিরি না। দেশের বিভিন্ন আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়াই...। একদিন এভাবে দেশ-দেশান্তর ঘুরে বাড়িতে ফিরে এসেছি। উঠানে পা রেখেই দেখি, ঘরের দাজায় তালা। মা নিজের ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে ছিল। মা বললো, ‘সাতদিন ধরে ঘরে তালা...।’
অনিতারা কোথায় গেছে, মা কিছুই জানে না। মাকে কিছু বলে যায় নাই ওরা। কমল ওর ঘরেই ছিল। সেও কিছু জানে না। নাগরপুর অনিতার বাবার বাড়ি। সেখানে খোঁজ নিলাম। না, সেখানেও যায় নাই। তারাও জানে না কিছুই। দিন-পনেরো পরে অনিতার চিঠি পেলাম। চিঠিতে কোনো সম্বোধন নাই, নিচে নামও লেখা নাই। খামের ওপরে প্রেরকের ঘরে অনিতার নাম না-থাকলে চিঠি পড়ার আগে বোঝা যেতো না এটা কার চিঠি! ডাকঘরের সিল এতো অস্পষ্ট যে, কোত্থেকে এসেছে এই চিঠি, বোঝার উপায় নাই। যা-হোক, সরাসরি লেখা, দুই বাক্যের চিঠি। ‘তোমাকে জীবনের তরে পরিত্যাগ করে পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চলে এসেছি। ভুল করেও আমাদের খুঁজতে বেরিও না...।’
অনিতার চিঠি পড়ে মনে হয়, সে সঠিক কাজটিই করেছে। ভুল কিছু করে নাই। যখন টঙ্গি-কোনাবাড়িতে অনিতাদের খুঁজে পেলাম, অনিতা একটা বড়ো দর্জিবাড়ি চাকরি করে, বড়ো কন্যার বিয়ে হয়েছে, কন্যা-কন্যাজামাইও দর্জিবাড়ির চাকুরে, ছোট কন্যা টেনে উঠেছে, আমাদের একমাত্র পুত্র অমিতাভ জেএসসি পরীক্ষার্থী...।
পুত্র-কন্যাদের কদাচিৎ বাড়িতে যাতায়াত ছিল। আমি রোগে-শোকে ভুগলে আমাকে ওরা দেখতে আসতো। দিদিমার খুব ভক্ত ছিল ওরা। মা’র অসুখ-বিসুখের খবর পেলেও ছুটে আসতো। কিন্তু অনিতা একদিনও আর আসে নাই...।
পাদটীকা
আমাদের পেছনবাড়িতে বিশাল বাঁশঝাড়। আমার খুব প্রিয় জায়গা। দুপুরে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় বসে সিদ্ধি খেতাম। এই বাঁশঝাড়ের উত্তর-পূর্বকোণে আমাকে গোর দেয়া হবে। গোর সজ্জিত। এখন আমাকে নিয়ে যাবে গোরবন্ধুরা। আমি মাকে বললাম, ‘যাই মা। আমার জন্য দুঃখ করো না। সবই ভগবানের খেলা...।’
মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ‘অমল, বাপ, তুই চলে যাচ্ছিস! আমি যে বড়ো একা হয়ে গেলাম...।’