রাজনৈতিক নাট্যের সারকথা
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০২০
নতুন চিন্তার মধ্যেই থাকে যে-কোনো পরিবর্তন বা বিপ্লবের বীজ। সমাজ পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক নাটক প্রচার চালায়, তেমনি বুর্জোয়ারা এ ব্যবস্থাকে ধরে রাখার জন্য আরো জোরেসোরে প্রচার চালাচ্ছে। বুর্জোয়া প্রচারের পক্ষে বহু নাট্যদল বা নাটক পাওয়া যাবে যারা বুর্জোয়া রাজনীতিই প্রচার করে চলেছে কিন্তু বুর্জোয়ারা সেটা স্বীকার করছে না। নিজেদের নাটকে রাজনীতি প্রচারের ব্যাপারটাকে তারা গোপন রাখতে চায়। সেজন্য তাদের রাজনীতি প্রচারের ধরনটাও আলাদা। বুর্জোয়ারা রাজনীতি প্রচার করে নীতিকথার মাধ্যমে। বুর্জোয়া নাট্যশালা তাই নীতি কথার মাধ্যমে শেখায় প্রচলিত রীতিনীতিকে মেনে চলতে, আইনকে শ্রদ্ধা করতে ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে। মানুষকে শেখায় মিথ্যা দেশপ্রেম। বুর্জোয়াদের কাছে সাধারণ জনগণের চেয়ে দেশ বড়, কারণ দেশ বলতে সেখানে বোঝায় সুবিধাভোগী মানুষ। নিজেদের রাজনীতির পক্ষেই এই ধরনের প্রচার চালায় তারা নিজেদের তৈরি সমাজ ব্যবস্থাটাকে ধরে রাখবার জন্য। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবকে ঠেকাবার জন্য। বুর্জোয়ারা চায় সুবোধ সুশীল ভদ্র বামন, যারা ধর্মগ্রন্থ পড়বে এবং ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করবে আর দেশপ্রেমের নামে শাসকদের নানা জুলুমকে মহিমান্বিত করবে। শাসকদের বিধিবিধানকে অগ্রাধিকার দেবে আর শাসকদের উন্নয়নের গল্প প্রচার করে বেড়াবে। বুর্জোয়া নাট্যকার বা সংস্কৃতিকর্মীরা সেটাই প্রচার করতে চায় নিজ স্বার্থে। মানুষের দৃষ্টিকে বর্তমান থেকে সবসময় অতীতের গৌরবের দিকে সরিয়ে রাখে। লক্ষ্য খুব স্পষ্ট, শাসকদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা বা চিরস্থায়ী করা। সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকে স্থিতাবস্থার অন্ধকারে আটকে রাখতে হবে সমাজের গতিকে, মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী নাট্যকার বা নাট্যকর্মীরা খুব সচেতনভাবেই তাই চায়।
মার্কসবাদী নাট্যচিন্তা বা রাজনৈতিক নাটক যে-ধরনের সমাজ পরিবর্তনের কথা বলছে সেটা যেমন একদিনে ঘটার ব্যাপার নয়, ঠিক তেমনি সেই পরিবর্তনের পথে রয়েছে নানা স্তর। মাঝখানের বিভিন্ন স্তরগুলোকে অতিক্রম করার পরেই যেহেতু সে স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হবে তাই প্রতিটি স্তর অতিক্রম করার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লড়াই। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তাবিদ বা কর্মীদের সেইসব লড়াইয়ে সফলতা লাভের জন্য নানাধরনের কৌশলও গ্রহণ করতে হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধু কথার কথা নয়, তার জন্য দরকার দীর্ঘ সংগ্রাম, সংগ্রামের আগে দরকার দীর্ঘ প্রস্তুতি। শ্রমিকশ্রেণীকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও মনে রাখতে হবে বুর্জোয়া শোষণের সঙ্গে মিশে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, মাতব্বর-জোতদারদের শোষণ, সম্প্রদায়গত শোষণ, ধর্মীয় শোষণ, আমলার শোষণ, গ্রাম্য পীর-পুরোহিতদের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ সহ নানা ধরনের সামাজিক শোষণ। সেইসব শোষণের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক নাটকে কথা বলতে হবে, জনগণকে সজাগ করতে হবে, তবে তার মূল লক্ষ্য থাকবে শ্রমিকশ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক নাটককে তাই একই সঙ্গে দ্বিমুখী-ত্রিমুখী লড়াই চালাতে হয়। বিভিন্ন প্রশ্নকে একই সঙ্গে সামনে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু বিষয়গুলিকে মোটেই শ্লোগান হিসেবে আনা যাবে না। নাটকীয় ঘটনা, নাটকীয় সংলাপ এবং নাটকীয় দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই শিল্পসম্মতভাবে তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। শিল্পমান তার এতোটাই উচ্চস্তরের এবং সংযত হতে হবে যেন দর্শক নিরানন্দভাবে নাটক না দেখেন।
সমাজতন্ত্র একটি বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, মানুষকে মানুষ হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়ার লড়াই। দীর্ঘদিনের মানুষের চিন্তার যে ইতিহাস, সেখানে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তা বহু বেশি অগ্রগামী, পুরানো চিন্তার নির্যাস থেকে যেহেতু তা উদ্ভুত। সেই চিন্তাকে মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়, সরাসরি সম্ভবও নয়। দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়ে মানুষের চিন্তা নানা কুসংস্কারে বাঁধা পড়ে আছে, সেখানে নতুন চিন্তাকে জায়গা দিতে হলে সেই সব পুরানো চিন্তাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। শত শত বছরের চিন্তাকে মানুষের ভিতর থেকে উৎপাটিত করতে দরকার সময় ও ধৈর্যের, দরকার সে যে পরিমণ্ডলে বাস করছে সেই পরিমণ্ডলকে অল্প অল্প করে পাল্টানো। মানুষ বহুবছর আগে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো তার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা বাসা বেঁধে আছে। বিশেষ করে পশ্চাদপদ দেশগুলোতে। এইসব দেশে বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রলোভন, প্রতিযোগী মনোভাব আর মধ্যযুগীয় কুসংস্কার; এমন এক জগাখিচুড়ির মধ্যে মানুষ বিরাজমান। মানব সমাজকে এক ধাক্কায় বহু শতাব্দী এগিয়ে দিয়েছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। তার মানে এ কথা বোঝায় না যে, শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতিও বুর্জোয়া যুগে উৎপাদনী শক্তির সঙ্গে তাল রেখে এগিয়ে গেছে। বুর্জোয়ারা বহুরকম প্রগতিশীল ভূমিকা রাখলেও মুনাফার স্বার্থে এক সময়ে এসে শিল্পকে করে তুলেছেন পণ্য। শিল্পের মধ্যে আমদানী করেছেন সস্তা বিনোদন। মার্কসবাদী সস্তা বিনোদনের জায়গায় উচ্চমান সম্পন্ন এবং বক্তব্য প্রধান শিল্পকে উপস্থিত করতে চান। সেটা খুব সহজসাধ্য নয়। যদি কেউ সত্যিকারভাবে শিল্পসম্মত নাটক মঞ্চস্থ করতে চান, তারজন্য দরকার অধ্যয়ন, চর্চা এবং নিরলস পরিশ্রম। গভীর পর্যবেক্ষণ দরকার, দরকার শিল্পকলার ইতিহাসটা জানা এবং বোঝা। এক লাফে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু বুর্জোয়ারা চাইছেন সস্তা বিনোদন; জীবন ঘনিষ্ট বিষয়বস্তুর পরিবর্তে হাস্য-কৌতুক এবং যৌনতার প্রদর্শন। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকে তাঁরা আর শিল্প-সাহিত্যে স্থান দিতে চাইছেন না নতুন কোনো বিপ্লবের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে।
বুর্জোয়ারা নিজ স্বার্থেই মানুষের পশ্চাদপদ বা সামন্তবাদী চিন্তাগুলোকে এখন আর দূর করতে চাইছেন না। ধর্ম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে বুর্জোয়াদের জন্ম, এখন তাঁরাই প্রমাণ করতে চান সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পায়ে মানুষ সমর্পিত জীবমাত্র। সেটা এইজন্য যে, সর্বশক্তি ও সমস্ত গুণ যদি ঈশ্বরে আরোপ করা যায়, মানুষকে তাহলে নির্জীব, ক্ষমতাহীন হিসাবে দেখানো যায়। মার্কসবাদীরা মনে করেন, বুর্জোয়ারা যদি মানুষের সামন্তবাদী চিন্তা বা কুসংস্কার দূর করার দায়িত্ব নিতো তাহলে মার্কসবাদীদের কাজ অনেকাংশে কমে যেতো। বুর্জোয়ারা তা করছেন না বলেই মার্কসবাদীদের এখন প্রথম কাজ হলো সামন্তবাদী চিন্তা থেকে মানুষের চিন্তার জগতকে বুর্জোয়া চিন্তার জগতে উত্তীর্ণ ঘটানো, বুর্জোয়া বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাথে তার চিন্তার মেলবন্ধন ঘটানো; গণতান্ত্রিক চিন্তার সাথে মানুষকে প্রথম পরিচিত করে তোলা। বুর্জোয়া দর্শন যদিও ইতিবাচক ও নেতিবাচকের জগাখিচুড়ি, তবুও তার প্রগতিশীল দিকটাকে অস্বীকার করা যায় না। উদীয়মান যুগে বুর্জোয়ারাই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিল ধর্মের ব্যাপারে, কারণ তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতিবৃদ্ধ সামন্ততন্ত্র। উৎপাদন ব্যবস্থাও ছিল সেদিন সামন্ততন্ত্রের করায়ত্ত আর চার্চ ছিল তাদের সহায়। যুক্তিবাদের প্রতি সমর্থন ও সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা ছিল বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের সেদিন মূল অস্ত্র। সেই নতুন চিন্তার পেছনে বুর্জোয়ারা সেদিন শোষিত সমাজকে সমাবেশিত করেছিল। পরে যখন দেখা গেল সেই শোষিতদের মধ্যে বিপ্লবের এমন বেগ সঞ্চারিত হয়েছে যা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেও চলে যেতে বসেছে, তখনি বিপ্লবী যুক্তিবাদের পতাকা ফেলে দিয়ে বুর্জোয়ারা গ্রহণ করলো চার্চের মতবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের উপর লেখা রয়েছে ঈশ্বরের প্রতি তাদের সকল আস্থা বা বিশ্বাস; এভাবেই চার্চের মাহাত্ম্যকে টিকিয়ে রাখা হলো। বুর্জোয়াশ্রেণী যখন ভীত হয়ে আপন শ্রেণীস্বার্থেই অর্ধপথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদের পতাকা ফেলে দিয়ে বিপ্লব অসমাপ্ত রেখেই সামন্ততন্ত্র ও পুরানো ধর্মব্যবস্থার সাথে সন্ধি করলো তখনো কিন্তু বুর্জোয়া বিপ্লবের বাস্তব অবস্থাটা ফুরিয়ে গেল না, রয়েই গেল।
যুক্তিবাদ হচ্ছে যে-কোনো আধুনিক সংগ্রামের পূর্বশর্ত যার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বুর্জোয়াদের হাতেই। কাজেই পশ্চাদপদ সংস্কারপূর্ণ চিন্তার জগতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। বুর্জোয়ারা এ আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত করেনি বলেই মার্কসবাদীরা মনে করে তাদের দায় সে আন্দোলন সমাপ্ত করা। সাম্যবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র অথবা শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার আগে সেটা একটা প্রধান জরুরী কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনই হচ্ছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক স্তর। সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার প্রস্তুতি পর্ব। সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে বুর্জোয়া সুবিধাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, মার্কসীয় বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেজন্য মার্কসবাদীরা মনে করে, রাজনৈতিক নাটক শুধুমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাই বলবে না, তার পূর্বের সবগুলো স্তরের ক্রমবিকাশের ধারা মেনে চলবে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক নাট্যকারের দায়িত্ব দ্বিবিধ। নাট্যকার-নির্দেশক উৎপল দত্তের ভাষায়, রাজনৈতিক নাট্য পশ্চাদপদ মানুষকে প্রথম বলবে যুক্তিবাদের কথা, মানবিকতার কথা এবং সেই একইসাথে সমাজতন্ত্র বা শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের ব্যাপারটিকেও লক্ষ্য হিসাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরবে। সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলবার আগে তার প্রস্তুতির বিষয়টিতেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অতীতের সমস্ত সশস্ত্র বিপ্লবের ঘটনাগুলো দর্শকদের চোখের সামনে তুলে ধরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাহাত্ম্য এবং এর বীরত্বের দিকগুলোর সাথে তাদের পরিচিত করে তুলতে হবে, যাতে প্রয়োজনের সময় সে এ পথ থেকে সরে না দাঁড়ায় বা শ্রমিকশ্রেণীর সশস্ত্র বিপ্লবকে সে ঘৃণার চোখে না দেখে। সশস্ত্র বিপ্লবের নানা ভুলভ্রান্তির সাথে যাতে দর্শক পরিচিত হতে পারে। সশস্ত্র বিপ্লবকে কখনই যাতে তার কাছে সন্ত্রাস মনে না হয়। সশস্ত্র বিপ্লবের সংগ্রামের প্রতি তার বিশ্বাসটাকে গড়ে তুলতে হবে মানবতাবাদের জয়গানের মধ্য দিয়েই। রাজনৈতিক নাটকের প্রথম পর্ব তাই কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষের কাছে যুক্তিবাদ ও মানবিকতার ছোঁয়া পৌঁছে দেয়া।
সবকালেই যে-কোনো ক্ষেত্রেই পরাধীন দেশগুলোকে স্বাধীনতার জন্য প্রথম লড়তে হয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সেজন্য সেসব ক্ষেত্রে মার্কসবাদী নাট্যাভিনয়ের লক্ষ্য থাকে উদারনৈতিকদের, মধ্যবিত্তদের সাথে নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক সরকারের চরিত্র এবং তার মুৎসুদ্দিদের চেহারাটা পরিষ্কার করে তোলাই সেখানে প্রাথমিক কর্তব্য। রাজনৈতিক নাট্য সেটা করে অবশ্যই সমাজবিজ্ঞান চেতনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। স্বাধীনতা লাভের পর যেমন তার আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় বুর্জোয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রাম প্রচার, তেমনি বুর্জোয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সকল উদারনৈতিকদের সাথে মিলে মিশে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা। পশ্চাদপদ বুর্জোয়া ব্যবস্থায় শুধু শ্রমিক শোষিত নয়, শোষিত কৃষক সম্প্রদায়, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তরাও। স্বৈরশাসনের দাপটের স্বীকার হয় সেখানে উচ্চবিত্তরাও। সেজন্য মার্কসবাদীরা জোট বাঁধে এদের সকলের সাথে। ফলে প্রাথমিক স্তরে মার্কসবাদী নাটকের লক্ষ্য থাকে শ্রেণীসংগ্রাম প্রচারের পাশাপাশি প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের পক্ষে স্থান-কালের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা প্রচার করা, বিজ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ সকলের সামনে হাজির করা। রাজনৈতিক নাটকের বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকে তাই কখনই সরে দাঁড়াবার সুযোগ নেই। রাজনীতি ও শিল্প সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, কোনো শিল্পীই তাঁর সময়কালের শ্রেণীসংগ্রাম উপেক্ষা করতে পারে না; সব শিল্পী সাহিত্যিক সচেতনভাবে হোক বা নিজের অজ্ঞাতসারেই হোক ঐ শ্রেণীসংগ্রামে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে বাধ্য এবং নিজের শিল্পকলা সৃষ্টিতে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তা প্রকাশ করেন।
সাম্রাজ্যবাদের নিগড়ে বাঁধা স্বাধীন রাষ্ট্রের বুর্জোয়া সরকারগুলো সর্বদাই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়। মধ্যবিত্ত ভাববাদীরা সেই সরকারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলেও তার মূল স্বরূপটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয় নিজেদের মানসিকতার জন্যই। যাঁরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত, বহু সময় দেখা যায় বুর্জোয়াদের ভীষণ প্রভাব তাঁদের ওপর রয়ে গেছে, অথচ তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না যে অবচেতনে তাঁরা বুর্জোয়া চিন্তাকেই প্রচার করে চলেছেন। বুর্জোয়া বিশ্বাসগুলো তাঁদের ওপর এমনভাবেই চাপানো থাকে যে নিজের অজান্তেই তাঁরা সেগুলোকে গ্রহণ করেন। মানুষের চিন্তার জগতে শাসকশ্রেণীর প্রভাব এভাবেই কাজ করে। সেক্ষেত্রে তাঁদের দ্বারা যে কাজটি হয় তাহলো ক্ষোভ আর ঘৃণার প্রকাশ, সেজন্য তাঁদের শিল্প-সাহিত্য বিজ্ঞানসম্মত কোনো দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে পারে না। ফলে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা যে ধরনের দর্শন তারা প্রচার করে থাকে তা মূলত বুর্জোয়াদের পক্ষেই চলে যায়। শ্রমিকশ্রেণী বা শোষিত জনগণ এর থেকে কোনো দিক নির্দেশনা লাভ করতে পারে না এবং সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাটকগুলোর এক্ষেত্রে কাজ হয়ে দাঁড়ায় সমস্ত ঘটমান রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে তুলে ধরে তার অভ্যন্তরীণ সত্যটি দর্শকদের দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসা। বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া দেশপ্রেম ও বুর্জোয়া উন্নয়নের মূল স্বরূপটি দেখিয়ে দেয়া। বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে ভাগ বাটোয়ারার লড়াই, প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করা। সেজন্যই রাজনৈতিক নাটককে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার হতাশা প্রচার করা তার কাজ নয়। রাজনৈতিক নাটককে রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে হবে কেন, কোন্ কোন্ কারণে এই সমাজ ব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণীসহ অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর ভাগ্য পাল্টাতে পারে না, কেমন করে বুর্জোয়া ব্যবস্থায় তাদের মধ্যকার গলা কাটাকাটি করার প্রতিযোগিতা সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে। বুর্জোয়া ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকটিকেই যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনি সমকালীন রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী থেকে মুখ লুকিয়ে থাকলেও সেটা রাজনৈতিক নাটক হবে না। রাজনীতি প্রচারই যেখানে মূল কথা, সেখানে রাজনীতি প্রচার সমকালীন বাস্তবতায় কার বিরুদ্ধে এবং জনগণের কোন্ অংশের পক্ষে সেটাও সরাসরি উপস্থাপন করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা প্রচারের স্বার্থে যাঁরা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন করবেন, সব কিছুর আগে তাঁদের জানতে হবে প্রধানত নাটকের দর্শক কারা; কী তাদের শ্রেণী অবস্থান এবং কী রকম তাদের সবার মন-মানসিকতা। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করতে হবে। কথাটা মাও সে তুংও বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
দর্শকদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিকতার লোক থাকবে। সেজন্য বিভিন্ন ধরনের দর্শকদের মানসিকতা বুঝেই নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে। শিক্ষিত-অগ্রণী দর্শক এবং একেবারেই অচেতন দর্শক, দুজনে সবসময়ই একই নাটক পছন্দ নাও করতে পারে; ভিন্ন ভিন্ন মানসিক অবস্থানের কারণে দুজনের কাছে একটি নাটক একইরকমভাবে বোধগম্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি। রাজনৈতিকভাবে সচেতন দর্শক এবং যার কোনোরকম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই, এই দু-ধরনের দর্শককে মাথায় রেখেই তাই বিপ্লবী নাটক রচনা করতে হবে। রাজনৈতিক নাটকের নামে ব্যক্তিগত বিপর্যয় কিংবা জাতীয় ক্ষোভ হতাশাকে চিহ্নিত করলেই হবে না, দরকার সংকটের স্বরূপ উন্মাচন ও উত্তরণের পথ খোঁজা। দর্শকদের তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। রাজনৈতিক নাটকে দু-ভাবে চলবে লড়াই বা বক্তব্য প্রচার। এক সমকালীন রাজনীতি নিয়ে নাটক রচনা ও বিশ্লেষণ, যা ক্রমাগত চলতেই থাকবে; পাশাপাশি শ্রেণীদ্বন্দ্বের সামগ্রিক চেহারাটাও তুলে ধরতে হবে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে। যুগের চেহারাটা যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি রাজনীতির চিরকালীন রূপটাও প্রকাশ পাবে। বিষয়টা যে খুব সহজ তা নয়। সেজন্য প্রায় একশো বছর ধরে রাজনৈতিক নাটকের পথযাত্রা শুরু হলেও, পৃথিবীর কোথাও সে আন্দোলন নিখুঁত ছিল না। সর্বত্রই সে নাটক যেমন বিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তেমনি নানারকম বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়েছে। সেজন্যই মার্কসবাদ কোনো মনগড়া আদর্শ নয়; বাস্তবের কঠিন কষ্টিপাথরে যাচাই হতে হয় আগে। রাজনৈতিক নাটকও তেমনি।
রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য যে শুধুমাত্র শোষণ দেখানো বা ধনী-দরিদ্র বা শোষক-শোষিতের লড়াই দেখানো তা কিন্তু নয়। নাট্যকারের কাজ হলো দর্শকদেরকে তথ্য দেয়া, যেন তাঁরা দেশ-কাল পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য ও সমাজ বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এঙ্গেলস বহুদিন আগেই বলে গেছেন, সমাজ বিবর্তনের নিয়মগুলি একবার সম্যক বুঝতে পারলেই মানুষ আর সে নিয়মের অন্ধ বলি হতে রাজি হবে না; সে লড়াই করবে। সেজন্য সমাজবিজ্ঞানের চেতনা মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দেয়াটাই হবে রাজনৈতিক নাটকের কাজ। বহু সময়ই রাজনৈতিক নাটকে এর ব্যত্যয় দেখা গেছে। বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে নাটক হয়ে উঠেছে শ্লোগান। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, নাট্যকর্মীদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও শিল্পকলা সম্পর্কে নান্দনিক চেতনার অভাব। নাট্যকর্মীদের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির অভাব যেমন দেখা যায়, তেমনি ছিল শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততার অভাব। স্তালিন দেখিয়েছেন যে, বিপ্লবী মতবাদের সাথে যদি বিপ্লবী কাজকর্মের যোগাযোগ না থাকে তা হয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীন; তখন অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়। বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ রেখে যদি মতবাদকে গড়ে তোলা হয়, তবে তা শ্রেণীসংগ্রামকে প্রচণ্ড শক্তিতে পরিণত করতে পারে। সেক্ষেত্রে অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখবার শক্তি যেমন আয়ত্ত করা যায়, তেমনি তা আশপাশের ঘটনাবলীর অন্তর্নিহিত সম্বন্ধ বুঝতেও সাহায্য করে।
রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় নাটকের কাজ সরাসরি সমাজ পাল্টানো নয়। সে দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। রাজনৈতিক নাটকের কাজ সমাজ পাল্টাবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে বোঝানো, সেজন্য মানুষকে প্রস্তুত করে তোলা। সমাজ পাল্টাবার মানুষগুলোকে তৈরি করা। সেজন্য নাটকে সরাসরি শ্রমিক কৃষকের কথা না বলা হলে নাটক বিপ্লবী হবে না, এমনও ভাববার কারণ নেই। সমাজ পরিবর্তনের নাটকের কাজ হলো বিপ্লবী-তত্ত্ব প্রচার করা। সেই বিপ্লবী-তত্ত্ব মানে এ নয় যে, কেবলমাত্র মালিককে আক্রমণ করতে উদ্দীপ্ত করা। মার্কসবাদীরা মনে করে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা মানুষের সব রকম সুস্থ চিন্তা করবার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে, তাকে করে রেখেছে ব্যক্তিত্বহীন উৎপাদনী এক যন্ত্রমাত্র। মার্কস দেখান যে, পুঁজিবাদী সমাজে বাঁচার জন্য মজুর নিজেকে সস্তায় বিক্রয় করেই শুধু প্রতিযোগিতা চালায় না, প্রতিযোগিতা করে একা পাঁচ-দশ-কুড়ি জনের কাজ করে। কাজের নিগড়ে সে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী নাটকেও দেখতে পাওয়া যায়, শ্রমিকরা কাজ করে করে তার মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলে কতগুলো সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন, ‘যন্ত্রের মত নিত্য কর্ম করতে করতে মানুষ প্রাণহীন যন্ত্র হয়ে যায়’। মার্কস তাই দেখিয়েছেন, যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক উপরে ওঠে না। নিঃস্ব অবস্থা আরো বেড়ে চলে জনসংখ্যা ও সম্পদ বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর তালে। মজুরি শ্রমিক শ্রম করে যেটুকু ভাগ পায় তাতে কেবল কোনোক্রমে নিজের অস্তিত্বটুকু চালিয়ে যাওয়া ও পুনরুৎপাদন করা চলে। যার ফলে শ্রমিক বাঁচে শুধু পুঁজি বাড়াবার জন্য। তাকে বাঁচতে হয় শাসকশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য যতোটা প্রয়োজন, ঠিক ততোখানি। মানুষ হয়ে যায় যন্ত্রের, উৎপাদনী প্রক্রিয়ার লেজুড়। তার কাছে শুধু দাবি করা হয় অতি সরল, একান্ত একঘেয়ে দক্ষতাটুকু। এভাবেই দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে তাদের করা হচ্ছে যন্ত্রের দাস। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর “মডার্ন টাইমস” চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন মানুষ কীভাবে যন্ত্রের দাসে পরিণত হচ্ছে। তিনি সেখানে বিধ্বস্ত মানুষের ছবি এঁকেছেন।
পুঁজিবাদী সমাজের মানুষ সম্পর্কে গোর্কির উচ্চারণ ছিল যে, ব্যক্তির সম্ভাব্য ক্ষমতা এবং তাকে যে কাজ দেয়া হয় দুয়ের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত শ্রমে মানুষের স্নায়ুগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। একপেশে ব্যবহারে বুদ্ধি ভারসাম্য হারিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের বোধ ও বিবেক ধ্বংস হয়ে গেছে। শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষেত্রে একথা যেমন সত্য তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে সত্য। পুজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে করে রাখে ব্যত্তিত্বহীন গোষ্ঠীবদ্ধ উৎপাদনী যন্ত্রমাত্র। সেখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে পিষ্ট ও চূর্ণ করা হয় প্রতিদিন। মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়া হয়। মানুষ আর পূর্ণাঙ্গ মানুষ থাকে না। উৎপাদনের সামগ্রী হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে তোলার মানসিকতায় সে হয়ে দাঁড়ায় অর্ধমানুষ। মার্কস দেখান, যন্ত্রপাতি ঠিক যে-হারে ব্যবহৃত হয় ঠিক সেই অনুপাতে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। উল্টোদিকে মানুষ যতো বাড়তি কাজ করে তার থেকে বেশি অনুপাতে সে ক্ষয় পায়। মার্কসের মতে, সময়ের পরিসরেই মানুষের বিকাশ ঘটে। যে মানুষের হাতে খুশিমতো অবসর কাটাবার নিরঙ্কুশ সময় নেই, ঘুম, খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি নিতান্ত দৈহিক ধরনের ছেদগুলো ছাড়া যার সমস্ত জীবনই পুঁজিপতির জন্য খাটতে হয়, সে ভারবাহী পশুরও অধম। দেহের দিক থেকে জীর্ণ ও মনের দিক থেকে পশুর স্তরে অধঃপতিত হয়ে সে হয় অপরের সমৃদ্ধি সৃষ্টির যন্ত্রমাত্র। সেখানে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে বিকশিত হবার সুযোগ নেই। সেইজন্য রাজনৈতিক নাটকে বিপ্লবী তত্ত্ব প্রচারের সাথে সাথে এই মানুষগুলোকে যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে তাদের কাছে বেশি বেশি মানবতার কথা বলতে হবে। বিধ্বস্ত মানুষরা যদি পূর্ণাঙ্গ মানুষ না হয়ে ওঠে তাহলে তারা বিপ্লবী তত্ত্বকে ধারণই করতে পারবে না। রাজনৈতিক নাটকের প্রথম ধাপ হবে তাই, ভাঙা মন জোড়া দেয়া। বিধ্বস্ত মানব গোষ্ঠীকে সুস্থ, উন্নত, সৃষ্টিশীল ও সংগ্রামী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার প্রথম অভিযান, আধখানা মানুষকে পুরো করার লড়াই। তারপর সেই পূর্ণ মানুষকে দিতে হবে শ্রেণীচেতনা। তাহলেই সে সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি হিসাবে দেখা দেবে।
মার্কস দেখান যে, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিটি মানুষ দেখতে চায়, শুনতে চায়, ঘ্রাণ নিতে চায়, কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, অনুভব করতে চায়, ভালোবাসতে চায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে এই সব ইন্দ্রিয় ও বৃত্তির বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে। সম্পত্তি, মূলধন, পুজি; মানুষের এসব বৃত্তিকে ভোঁতা করে দেয় এবং একটি মাত্র বৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে, তাহলো দখলের মনোবৃত্তি, সম্পদের ওপর অধিকার বিস্তারের বৃত্তি। দেউলিয়া এইসব মানুষকে একত্রিত করলে, সমষ্টিবদ্ধ করলে দেখা যায় কোনো একটি লক্ষ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেয়ে তারা নিজেদের মধ্যেই পাশবিক হানাহানি, দ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতায় লিপ্ত হয়। যার কারণ হলো মানসিক জগতে সে হয়ে পড়েছে রিক্ত, হতসর্বস্ব। মানুষ হিসাবে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য লোপ পেয়েছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্য ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় সে লিপ্ত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকেই সে পেয়েছে এই শিক্ষা। সে কারণে সমাজ পরিবর্তনের নাটকের দায়িত্ব হলো মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রচারের সাথে সাথে মানুষের মৃত স্বাতন্ত্র্যবোধকে জাগিয়ে তোলা। তার মানসিকতাকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করা। ব্যক্তি প্রতিভার নানা দিক সম্পর্কে তাকে জানতে দেয়া। মানুষের মনের গভীরতা, মানুষের আবেগ-অনুভূতির জটিলতা, মানুষ কতো বড়, কতো বিচিত্র নাটকের ঘটনার মধ্য দিয়ে তাকে তা বুঝতে সাহায্য করা। সেজন্য নব্য লেখকদের কাছে মার্কসের আবেদন ছিলো, শেক্সপিয়ার পড়ুন, আপনাদের রচনাকে শেক্সপিয়ারের মতো ধারালো করুন, মানবতাবাদী সাহিত্যকে এনে দিন মেহনতী মানুষের নাগালের মধ্যে। সেই জন্য স্তালিন কী করেছিলেন? শেক্সপিয়ার, বায়রন, শেলী, গ্যাটে, শিলার, পুশকিন, গোগোল, টলস্টয়, চেখভ ও হুগোর লক্ষলক্ষ বই ছাপিয়ে এবং তা প্রচার করে মার্কস-লেনিনের নির্দেশ পালন করেছিলেন। শিল্প-সাহিত্যের ওপর দলীয় মতবাদ প্রয়োগ করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। রাজনৈতিক নাটকের তাহলে আর একটি দায়িত্ব হলো, বিপ্লবী তত্ত্ব দেয়া বা মার্কসের শক্ত শক্ত দর্শন প্রচারের আগে নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের কাছে অফুরন্ত সম্ভাবনাময় জীবনের কথা বলা। বিক্ষিপ্ত, হতাশাগ্রস্ত এবং জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত মানুয়ের হৃদয় নানারকম দ্বান্দ্বিক প্রাণবন্ত অনুভূতিতে ভরিয়ে তোলা।
স্তালিন মনে করতেন শিল্প-সাহিত্যকে অবশ্যই সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাজ করতে হবে। সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাজ করা বলতে তাঁরা কেউ ঝাণ্ডাবাজি বোঝাতেন না। বিপ্লবীচেতনা বলতে তাঁরা বুঝতেন, মানুষকে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করা। কিছু মুখরোচক বিপ্লবী বুলি কপচানো নয়। যেমন রঁম্যা রলাঁ বলেছিলেন, যা দরকার তা হলো বুদ্ধিচর্চার মধ্য দিয়ে অথবা বুদ্ধিগত দিক থেকে জনগণের মানসিক উন্নতি, এবং তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশিক্ষণ। ইতিহাস তাদের শেখাবে কীভাবে নিজেদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। শত্রু বা মিত্র; প্রত্যেককে কীভাবে বুঝে নিতে হয়। তিনি আরো বলেছেন, নাট্যকর্মকে অবশ্যই শক্তির উৎস হতে হবে এবং জনগণকে অবশ্যই বিনোদন দিতে হবে। বিনোদন পরিবেশন করার সময় নাট্যভাবনায় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জনগণ যেন পরের দিন আরো ভালোভাবে কাজ করার মতো মানসিক শক্তি পায়। জনগণকে হতাশাগ্রস্ত করা চলবে না। রঁম্যা রলাঁ বলছেন, নাট্যকর্মকে জনগণের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে হবে। মানুষের বুদ্ধি আছে ক্ষুরধার, কিন্তু তা ছায়াচ্ছন্ন, সংকীর্ণ ভোঁতা হয়ে রয়েছে। সেই জমে থাকা ছায়াচ্ছন্নতাকে আলো দিয়ে ভাসিয়ে দেবে নাট্যাভিনয়।
মার্কসবাদীদের মতো রঁম্যা রলাঁও মনে করেছেন, মানুষের মন এই সমাজে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নাটকের মাধ্যমে মানুষের সেই বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় আনতে হবে শান্তি। জনগণকে যদি শুধু চিন্তাভাবনা করবার অবস্থায় আনা যায়, নাটকের মধ্য দিয়ে যদি জনগণকে শুধু সচেতন করাতে পারা যায় তাহলে সেটাই হবে অনেক। নিজেরাই তখন তারা নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। নাটককে অবশ্যই নীতিশিক্ষা আওড়াবার প্রবণতা এড়িয়ে চলতে হবে। তিনি বলছেন, জনগণের যাঁরা সত্যিকার বন্ধু তাঁরা অধিকাংশ সময়ই নীতিশিক্ষার পদ্ধতি গ্রহণ করে শিল্পকে জনগণের কাছে বিরক্তিকর করে তুলেছেন। নীতি শিক্ষার প্রবণতা যেমন নাটক থেকে বাদ দিতে হবে, তেমনি যেন-তেন প্রকারে প্রমোদ বিতরণ করার ব্যাপারটাকে এড়াতে হবে। সুতরাং নীতিবাক্য ছড়ানো এবং সস্তা বিনোদন কোনোটাই চলবে না। মানুষকে তাদের দৈনন্দিন ঘটনা থেকে সরিয়ে এনে চাঞ্চল্যকর অনুভূতিতে ভরপুর করে দিতে হবে। উদ্দেশ্য থেকে আবার সরে গেলে হবে না। সবকিছুর মেলবন্ধন ঘটাতে পারার জন্যই একজন রাজনৈতিক নাট্যকারের ভূমিকা একজন রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য সমাজবিজ্ঞান সচেতন একজন রাজনৈতিক নাট্যকর্মীই শুধু পারে এই কাজটি সফল করে তুলতে। রাজনৈতিক নাটকের কাজ তাহলে শুধু শ্রমিকশ্রেণীর কথা বলাই নয়, মানবিক প্রশ্নেরও অবতারণা করা। পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ নাট্যকাররাই তা করেছেন। মানুষের কথা নাটকে তাঁরাই সবচেয়ে সঠিকভাবে বলতে পেরেছেন, যাঁরা তা শিল্পসম্মতভাবে বলার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক নাটকও চায় শিল্পসম্মতভাবে মানুষের কথা বলতে এবং বিপ্লবের পথে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। শিল্পসম্মতভাবে নাট্য প্রযোজনায় পিসকাটর, ব্রেশ্ট ও উৎপল দত্ত প্রমুখ বিরাট উদাহরণ হয়ে রয়েছেন বিশ্ব নাট্য ইতিহাসে।