রাজনৈতিক নাট্যের সারকথা

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২০

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও নাট্যকর্মের একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিধি রয়েছে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার দুই পথিকৃত পিসকাটর ও ব্রেশ্টকে ঘিরেই মূলত রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার সূত্রপাত। রাজনৈতিক নাট্য নিয়ে আরো বহুজন চিন্তাভাবনা করেছেন। দুজনেই রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে নানা মন্তব্য করে গেছেন। দুজনের নাট্য প্রয়োগরীতির মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকলেও পিসকাটর ও ব্রেশটের রচনা পড়ে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়, রাজনৈতিক নাটক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষ নেবে। তাঁদের মতে নাটকের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিপ্লবের প্রস্তুতি, দর্শকের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা সৃষ্টি। নাটকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তা ঘটবে। কিন্তু তাঁদের আগে বিভিন্ন সময়ে যে-সকল জনপ্রিয় এবং চিরায়ত নাটক রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে সেগুলিতেও নানাভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য এসেছে। কখনো কখনো খুব জোরালোভাবেই এসেছে। সে-সব নাটককে রাজনৈতিক নাটক বলা যাবে কি না বা সে-সব নাটকের সাথে তাঁদের রাজনীতির পার্থক্য কী; সে সম্পর্কে তাঁরা দুজনেই কিছু বলে যাননি। এতে করে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং বহুজন মনে করতে পারেন, পিসকাটর ব্রেশটের নাটকের আগে রাজনৈতিক নাটক ছিল না।

পিসকাটর ও ব্রেশ্টের পর অন্য যাঁরা রাজনৈতিক নাটক নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন, তাঁদের রচনাতেও রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে বিস্তারিত বা পূর্ণাঙ্গ কোনো আলোচনা নেই। মারিয়া লে পিসকাটর, আউগুস্ত বোয়াল, দারিও ফো বা অন্যান্যরা সকলেই ভাসাভাসা কথা বলেছেন। বরং সে ব্যাপারে ভারতের উৎপল দত্তের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক স্বচ্ছ ছিল; তিনি রাজনৈতিক নাট্য প্রসঙ্গে অনেক চিন্তার জট খুলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোনো তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করেননি। দত্তের বিভিন্ন রচনা পাঠ করে রাজনেতিক নাটক সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এবং উপকৃত হওয়া যায়। পিসকাটর ও ব্রেশট রাজনৈতিক নাটক পরিচালনা ও রচনায় এবং নতুন মহাকাব্যিক নাট্যরীতিকে মঞ্চে তুলে ধরতে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে ঠাণ্ডা মাথায় বসে গ্রন্থ লিখবার সময় এবং সুযোগ তাঁদের ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার-নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা উৎপল দত্ত তাঁদের পরে জন্মেছেন, তাঁদের কাজগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন; শুধু তাই নয়, পিসকাটর ও ব্রেশ্টকে নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার সম্মুখিন হয়েছেন। জনগণের প্রতি নিবেদিত নাটকর্মী হিসেবে সে কারণে তিনি সে-সব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন। বহুকিছু লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু তিনিও একটি গ্রন্থের মধ্যে রাজনৈতিক নাটক কী সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাননি কিংবা ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবর্তন থেকে সেগুলোকে আলোচনা করেননি, যদিও খণ্ডিতভাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছেন।

ইউরোপে নাটক নিয়ে প্রথম তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন য়্যারিস্টটল। য়্যারিস্টটলের পর বহুশত বছর নানা ধরনের নাটক মঞ্চায়ন করা হলেও ইউরোপে নাটক নিয়ে মতাদর্শগত দিক থেকে বিশ শতকের আগে আর সারাজাগানো নতুন তাত্ত্বিক রচনা বা চিন্তা পাওয়া যায় না। য়্যারিস্টটলের পর পিসকাটর ও ব্রেশ্টই নাট্যতত্ত্ব নিয়ে সারাজাগানো চিন্তার সূত্রপাত ঘটান। শুধু তাই নয়, ব্রেশ্ট সুনির্দিষ্টভাবে য়্যারিস্টটলের নাট্যচিন্তার বিরোধী মত প্রকাশ করেন, য়্যারিস্টটলের কাবতত্ত্বের নানা সমালোচনা করেন। রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবার জন্য তাই খ্রিষ্টপূর্ব সময়কার য়্যারিস্টটল থেকেই পড়াশুনা আরম্ভ করা দরকার হয়ে পড়ে। যাঁরা রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে চান, য়্যারিস্টটল বা পিসকাটর কিংবা ব্রেশ্ট অথবা উৎপল দত্ত; এঁদের কোনো একজনের রচনা পাঠ করে সেটা পরিপূর্ণভাবে জানা সম্ভব নয়। নাট্যপ্রযোজনা সম্পর্কে উল্লিখিত সকলের বিভিন্ন রচনা পাঠ করার পাশাপাশি পৃথিবীর জনপ্রিয় শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি পাঠ করার পরই রাজনৈতিক নাটকের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নাটক বুঝতে গেলে. মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহার সহ বিভিন্ন কিছু লেখা পাঠ করা দরকার। দরকার প্লেখানভ, লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুং সহ রঁম্যা রল্যাঁ দারিও ফো, আউগুস্তো বোয়াল প্রমুখের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। খুব বিস্তারিত এবং গভীরভাবে রেনেসাঁ, ফরাসী বিপ্লব, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং প্রথম মহাযুদ্ধের ইতিহাস অধ্যায়ন করা।

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার মূল প্রসঙ্গে যারার আগে শুরুতেই বলে রাখা দরকার, রাজনীতির বিভিন্ন ধারা আছে। প্রগতিশীল রাজনীতি যেমন রয়েছে তেমনি আছে প্রতিক্রিয়াশীল এবং রক্ষণশীল রাজনীতি। পিসকাটর ও ব্রেশ্টের দ্বারা যখন রাজনৈতিক নাটকের সূত্রপাত হয়, তখন তা প্রগতিশীল রাজনীতির ধারণাকেই সামনে নিয়ে আসে। পিসকাটর এবং ব্রেশ্টের জায়গা থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা অবশ্যই একটি প্রগতিশীল ধারা। উৎপল দত্ত সহ আরো অনেকে সেই চিন্তার ধারক-বাহক। এই প্রগতিশীল ধারণায় রাজনৈতিক নাট্যচিন্তকরা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করতে চান কিংবা শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলের পক্ষে কথা বলতে চান। সহজ কথায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পক্ষে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে তাঁরা উদগ্রীব। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা তাই কোনো নিষ্ক্রিয় ব্যাপার নয়, শুধু রাজনীতির জন্য রাজনীতি নয়; এর একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে বৃহত্তর জনতার স্বার্থে ক্ষমতা দখল করা, ক্ষমতা দখলের জন্য এবং সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের জন্য সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা সেই লক্ষের প্রধান দিক।

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা কোনো নৈরাজ্যবাদী পথের ধারক-বাহক নয়। রাষ্ট্রকে তারা দমন পীড়নের যন্ত্র মনে করলেও, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজনৈতিক নাট্যকাররা এ ব্যাপারে কোনো অন্ধ ধারণার বশবর্তী নন এবং জঙ্গী মনোভাবাপন্নও নন। সমাজ বাস্তবতার কারণেই তাঁরা বৃহত্তর মানুষের স্বার্থের পূজারী এবং গঠনমূলক সংগ্রাম বা সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা যে ক্ষমতা দখল করতে চান সেখানে বিশৃঙ্খলার কোনো জায়গা নেই। মারদাঙ্গা করে যে-কোনো মূল্যে বা যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতা দখলের আগে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য দরকার সমাজবিজ্ঞানের চেতনা লাভ। সমাজবিজ্ঞানের এই চেতনা পৌঁছে দেওয়াটাই রাজনৈতিক নাটকের প্রধান কাজ। তাই রাজনৈতিক নাটকের কাজ নয় হঠাৎ করে ক্ষমতা দখলের ডাক দেয়া কিংবা একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করা। রাজনৈতিক নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও নাট্যকুশীলবরা হবেন বিপ্লবী মানসিকতার, সমাজকে যাঁরা কোনো বদ্ধ প্রাকারের মধ্যে আটকে রাখতে চান না। বৃহত্তর মানুষের স্বার্থে যাঁরা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। নাটককে তাঁরা অস্ত্র মনে করেন তবে সেটা শুধু শ্লোগান নয়; ধারালো উন্নতমানের শিল্পকলা হিসেবে নাটককে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে চান। শিল্প হিসাবে নাটককে সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তুলতে চান।

রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে তাহলে কী দেখতে পাওয়া গেল? এটা একটা উদ্যোগ, স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক নাট্যের সংজ্ঞা সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেই নাট্য যা রাজনীতি প্রচার করবে। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় রাজনীতি বলতে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগত, ব্যক্তিগত সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যাই হোক না কেন, রাজনীতি হচ্ছে শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর সংগ্রাম, তা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির কার্যকলাপ নয়। মতাদর্শ ও শিল্পগত ক্ষেত্রের সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামের অধীন থাকতে হয় এইজন্য যে, একমাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়েই শ্রেণী ও জনগণের প্রয়োজন কেন্দ্রীভূত আকারে প্রকাশ পায়। রাজনৈতিক নাটকও তাই শ্রেণীর প্রশ্নটিকে কিছুতেই বাদ দিতে পারে না। রাজনৈতিক নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রভাতকুমার গোস্বামী বলেছেন, ‘সাধারণত সেই নাটককেই রাজনৈতিক নাটক বলবো, যা নাট্যকারের দিক থেকে দর্শকের মধ্যে সচেতন রাজনৈতিক বোধ জাগ্রত করা বা রাজনৈতিক শিক্ষাদানের জন্য রচিত।’ গোস্বামী সরলভাবে রাজনৈতিক নাটকের একটি সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন, যদিও রাজনৈতিক নাটকের বিষয়টি বহুগুণ বিস্তৃত। সামান্য কয়েক পংক্তির মধ্যে রাজনৈতিক নাটক কী তা বোঝানো সম্ভব নয়। যেহেতু রাজনীতি কথাটিই খুব ব্যাপক অর্থের, রাজনৈতিক নাট্যও তাই। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে-কোনো ধরনের বিতর্কের সূত্রপাত করতে হলে প্রাথমিকভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু মতামত প্রদান এবং পূর্ণ আলোচনার আগে একটি সংক্ষিপ্ত গণ্ডি টানা দরকার।

রাজনৈতিক নাটকের প্রথম একটি কাজ দর্শককে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা। শিক্ষা বলতে এখানে সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। সমাজের দ্বান্দ্বিক দিকগুলো সম্পর্কে জানতে না পারলে ব্যক্তির পক্ষে সমাজ সচেতন হওয়া দূরহ। রাজনৈতিক নাটকে তাই প্রধানত সমাজের দ্বান্দ্বিক নিয়মগুলিকে তুলে ধরতে হবে নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে। পিসকাটর ব্রেশ্ট সেই চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে নাটক পাঠশালা নয়, নাটকের মাধ্যমে যে শিক্ষা দান করা হবে তা হতে হবে শৈল্পিকভাবে এবং বিনোদনের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক নাটকে রাজনীতি শিক্ষার বিশেষ কতগুলো দিকই গুরুত্ব পায়। মূলগতভাবে সেগুলো হলো; একটি দেশের নিজস্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা এবং শাসক শ্রেণীর জনগণকে শোষণ করার প্রক্রিয়া, রাজনীতি-অর্থনীতির আন্তর্জাতিক সমস্যা ও সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ, সভ্যতা ও শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, শ্রেণী বিন্যাস ও উৎপাদন সম্পর্ক, সভ্যতার দ্বাদ্বিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক সংগ্রাম বা আন্দোলনের পদ্ধতি। রাজনৈতিক সংগ্রাম বা আন্দোলনের পদ্ধতি এই বিষয়টিতে শুধু শিক্ষা নয়, দীক্ষা নেয়ার ব্যাপারও রয়েছে। দেখা যাক রাজনীতির সঙ্গে নাট্যক্রিয়ার কী ধরনের সাযুজ্য ঘটলে অথবা নাটকে রাজনীতির কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হলে যথার্থ রাজনৈতিক নাটকের জন্ম হতে পারে।

যথার্থ রাজনীতি বলতে স্বভাবতই বিপ্লবী বা প্রগতিশীল রাজনীতি বোঝানো হচ্ছে যা বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। বিপ্লবী রাজনীতির লক্ষ্য সমাজে অনুসৃত অর্থনৈতিক প্রশাসনিক ধারাকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে সমাজকে নতুনতর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। সমাজের বর্তমান কাঠামোকে উন্নততর অবস্থান দেওয়া। রাজনীতি আসলে মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রক্রিয়া। প্রকৃতিগতভাবে যে বিবর্তন ঘটবে রাজনীতি এক অর্থে সেই বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে তোলে। সমাজের বিবর্তনে নতুনতর অবস্থা গড়ে তুলতে রাজনীতি অনিবার্য। সেক্ষেত্রে পরস্পর বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক ধারণার সংঘাতে অপেক্ষাকৃত শ্রেয় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরি হয়। আর তা করা হয়ে থাকে মানুষের জন্যই, ঠিক আবার মানুষই তাকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে। মানুষকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির অনুবর্তন। নাট্য নামক শিল্পটিরও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সেই মানুষ। মানুষকে নিয়ে মানুষের জন্যে রাজনীতি; আবার মানুষের জন্যে, মানুষকে নিয়ে নাট্যকারের যতো মাথা ব্যথা। সেই অর্থে নাট্যকার সত্যের অনুসন্ধানে ক্রিয়াশীল। সুতরাং নাট্যকার, রাজনৈতিক ঘটনাবলীর নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন। দেখা যাচ্ছে, নাট্যকার যখন কোনো রাজনৈতিক বিষয়কে তাঁর উপজীব্য করেন তখন তিনি আসলে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মূল্যায়ন করেন। আর এই মূল্যায়নে নাট্যকারকে সতত এক ধরনের নিরাসক্তি অবলম্বন করতে হয়। প্রচার নাটক যেখানে সাময়িক স্বার্থকে দেখে রাজনৈতিক নাটক সেখানে চিরকালীন সত্যকে উদ্ঘাটিত করে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, ‘রথের রশি’ কোনো দলীয় তাৎক্ষণিক দলিলের সমর্থন না করেও সমাজের অসাম্যকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে এবং নতুন এক সমাজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে।

রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের পূর্বেও নাটকে রাজনীতি ছিল এবং সেটা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের সহায়ক হলেও, রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাকে বলা যাবে না। কারণ সচেতনভাবে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সেটা পরিচালিত হয়নি। নাট্যকার সমাজের প্রতি দায়দায়িত্ব থেকে নাটকে রাজনীতি এনেছিলেন, তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন কিন্তু সমাজবিজ্ঞান সচেতন নন। শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রশ্নটি তাঁদের মাথায় ছিল না। সমাজসচেতন নাটক ও রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের মধ্যেও একটা সীমারেখা তাৎক্ষণিকভাবে টানা যেতে পারে। যে নাট্যরচনায় সমাজব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে, রাজনীতি প্রচার করা হয়েছে সেটাও একধরনের রাজনৈতিক নাটক। কিন্তু রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা সেটাকে তখনই বলা হবে যখন সমাজ পাল্টাবার জন্য নাট্যকার বা নাট্যকর্মীরা সেখানে সক্রিয়, সমাজ পরিবর্তনের বৃহত্তর লক্ষ্যেই যখন তাঁরা নাটক রচনা কিংবা তা মঞ্চায়ন করেন। স্মরণ রাখতে হবে, রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন শুধু নাটক মঞ্চায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনেও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মাও সেতুঙ যে কথা বলেন, ‘পৃথিবীতে সকল সংস্কৃতি, সকল সাহিত্য ও সকল শিল্পই বিশেষ শ্রেণীর সম্পত্তি এবং বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করাই তার কাজ। শিল্পের জন্য শিল্প, শ্রেণী-স্বার্থের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বা রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন ও স্বাধীন শিল্প বলে আসলে কিছু নেই।’ মাওয়ের মতে, প্রলেতারীয় শিল্প হচ্ছে সমগ্র প্রলেতারীয় বিপ্লবী লক্ষ্যের অধীন। রাজনৈতিক নাট্য তাই সুনির্দিষ্টভাবে প্রলেতারীয় শ্রেণীর পক্ষে দাঁড়াবে। মার্কসের জন্মের আগে একথা চিন্তাই করা যেতো না।

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একথাও স্মরণ রাখতে হবে, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা চালু হবার পর শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব যেমন মার্কস-এঙ্গেলসের দৃষ্টিকে খুলে দিয়েছিল, তেমনি মার্কসবাদের সাথে পরিচিত না হয়েও পুঁজিবাদের সংকট ও দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় বহু বড় বড় নাট্যকার। যেমন মার্লো, শেক্সপিয়ার, শিলার, ইবসেন সহ আরো অনেকে যাঁদের নাটকে সমকালীন সমাজের দ্বন্দ্ব চমৎকারভাবে ধরা পড়েছে। মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হবার আগেই বা পরিচয় ব্যতিরেকেই বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে তাঁদের লেখনী সরব হয়েছে। উল্লিখিত নাট্যকারদের প্রত্যেকর নাটকেই পুঁজিবাদের চেহারা ফুটে উঠেছিল, সমাজের চমৎকার বিশ্লেষণও ছিল। তবে পুঁজিবাদী সমাজ থেকে উত্তরণের জন্য তাঁরা যেমন কোনো পথ বাতলাতে পারেননি, তেমনি শ্রেণীসংগ্রামের প্রশ্ন তোলেননি। সেজন্য তাঁদের নাটকে রাজনীতি থাকলেও, সমাজের নানা দ্বন্দ্ব থাকলেও সেই সংকটের উৎস কোথায় কিংবা উত্তরণ কীভাবে সম্ভব, তা তাঁরা বলে যাননি; আধুনিক রাজনীতির দিক থেকে যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদী নাট্যকর্মের আগে কেউই সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলাননি। বাতলানো সম্ভবও ছিল না। সেখানে উত্তর না জেনেই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। শোষণের কথা জানানো হয়েছে, কীভাবে শোষণ হচ্ছে সেটা না বলেও।

বিশ শতকের রাজনৈতিক নাট্যকর্মের সাথে তাই তাঁদের মূল পার্থক্য হলো, মার্কসবাদ বুর্জোয়া সমাজ থেকে উত্তরণের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর যে একনায়কত্বের কথা বলেছিল তা তাঁদের কারো নাটকে ধরা পড়েনি। বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তাঁদের অনাস্থা তৈরি হলেও, বিপ্লবের প্রশ্ন না তুলে তাঁরা শুধু কিছু সংস্কারের দিকে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। যেখানে বিপ্লব সামান্য উঁকি দিয়েছিল, সেখানেও শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। তবুও সেসব নাটক মার্কস-এঙ্গেলসের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল, তাঁদের প্রশংসা অর্জন করেছিল। মানবতাবাদী শিল্প-সাহিত্য হিসাবেই তা পরিচিত। স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিশ শতকে সে-সকল নাট্যকার ও তাঁদের নাটকগুলোকে কোন্ চোখে দেখা হবে। মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা সেগুলিকে রাজনৈতিক নাটকের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। মানবতাবাদী সকল নাটক তাই বিশ শতকে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তারই অংশ। মার্কসবাদী চিন্তানায়করা বুঝেছিলেন বিপ্লবের জন্য যেমন শিল্প-সাহিত্যে শ্রেণীসংগ্রাম দরকার, তেমনি পুরানো মহৎ শিল্পকেও দরকার মানুষের চিন্তার জগৎকে গড়ে তোলার জন্য। শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, শিলার যদি মার্কস এঙ্গেলসের চিন্তার জগৎকে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে আজকের বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য না করবারও কিছু নেই। ফলে সেই সব চিন্তা, সেই সব মহান রচনাও রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে শুধু একারণেই যে, যুগে যুগে তাঁরা মানুষের মুক্তির কথাই বলেছেন। সমাজ ও মানুষকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। সেজন্য রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার সাথে তার মূলগত কোনো বিরোধ নেই।

পিসকাটর যে কথা বলেন, যে-কোনো বুর্জোয়া নাটকও যদি বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়কে চিত্রিত করে, অথবা যদি সেটা পুঁজিবাদী নীতিটাকে স্পষ্ট মেলে ধরে, তাহলে তা শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকেই শক্তিশালী করবে এবং সে সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সাহায্য করবে। শিল্পীকে বিপ্লবী মতাদর্শের শরিক হতেই হবে এমন নিদান মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন দেননি। শিল্পীর মহত্ত্বের মাপকাঠি হলো তাঁকে অবশ্যই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। জীবন সম্পর্কে নির্মোহ প্রকৃত তথ্য হাজির করতে হবে। লেনিন বলেছেন, যে-কোনো মহৎ শিল্পীর কাছে আমাদের দাবি জীবনের সত্যনিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি। ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, য়্যারিস্তফেনিস, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, শিলার, ইবসেন, চেখভ, বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি, প্রমুখ নাট্যকাররা তাঁর সময়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, দর্শককে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন। শেক্সপিয়ার, ডিকেন্স, থ্যাকারে, গ্যাটে, পুশকিন, বালজাক প্রমুখ প্রসিদ্ধ রচয়িতাদের বিষয় উল্লেখ করে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন, সমাজ জীবনের বাস্তব প্রতিফলন তাঁদের লেখায় পাওয়া যায়। শুধু সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়, জীবন ও সমাজের ভিতরকার মানসচিত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জটিল সমস্যার নানা অলিগলিতে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে বিশ্লেষণমূলক নাটক-উপন্যাস সৃষ্টিই তাঁদের রচনার বৈশিষ্ট্য। একটা বিশেষ যুগের সমাজ-জীবনের বিভিন্ন সমস্যার এক একটি দিকের প্রতিফলন যেমন পাওয়া যায় তাঁদের রচনায়, তেমনি আবার বহুমুখি নানা চরিত্রের সৃষ্টি সে রচনাকে আরো উজ্জ্বল করে। গোটা সমাজের নানা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছবি পাওয়া যায় এঁদের রচনায়। সেইসব রচনা পাঠ করে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন বহু রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী।

মার্কস-এঙ্গেলস মনে করতেন, সত্য কারো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রকাশিত হবে না। তাকে নিজ গুণেই প্রকাশিত হতে হবে। এই কারণেই এঙ্গেলসের কাছে রাজতন্ত্রের সমর্থক বালজাক মহান কথাকার। কেন না বালজাক সেদিনের ফ্রান্সের জীবনকে সততার সঙ্গে এঁকেছিলেন, সে ছবি তাঁর শ্রেণীর বিপক্ষে গেলেও তিনি তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। শেক্সপিয়ারের নাটকের আলোচনা করলে দেখা যায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিজাত, উদার মানসিকতাসম্পন্ন এবং সামগ্রিকভাবে মানবতাবাদী। সে যুগের শ্রমজীবী সম্পর্কে তাঁর সহানুভূতি থাক বা নাই থাক, শেকসপিয়ারকে প্রতিক্রিয়াশীল হাতের ক্রীড়নক গণ্য করা হবে সরলীকরণ। মার্কস-এঙ্গেলস সেজন্য বালজাক ও শেক্সপিয়ারকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁদের রক্ষণশীল মানসিকতা সত্ত্বেও তাঁরা দুজনেই নিজ নিজ সামাজিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সমাজ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেন। শেক্সপিয়ারের নাটক দর্শককে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাদান করে না, জীবনকে জানতে সাহায্য করে; মানব মনের যতো সব রহস্য বৈচিত্র্যসমেত উপস্থিত করে। পিসকাটরের নাটককে মহাকাব্যিক আখ্যা দেয়া হয় কারণ মহাকাব্যের মতো বহুকিছুকে একসাথে নাটকে স্থান দেওয়া হয়। এর ফলে নাট্যাভিনয়ের বাহ্যিক আকারের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। নাট্য পরিচালনার প্রচলিত ধারার ভাঙন ধরে এবং সুদূর প্রসারিত ভাবান্তরের সৃষ্টি হয়। নাট্যাভিনয় সহ পরবর্তীতে এই ভাবান্তরের আরো সম্প্রসারণ ঘটান ব্রেশ্ট।

যাঁরা নাট্য রচনায় শ্রেণীসংগ্রামের সৎ বিবরণ দেন না, যাঁরা বিপ্লবের বা শ্রমিক-কৃষকদের দোষ-ত্রুটি দেখতে পান না, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে বিপ্লবকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলেন, তাঁদের রচনা মার্কসবাদী রচনা নয়। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের প্রতিটি স্তর, নানা সংকট এবং অন্তর্দ্বন্দ্বগুলি না দেখানো হলে সেখানে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা অনুপস্থিত। ইতিহাসের তথ্য উপস্থাপনও শিল্পকীর্তি নয়, সেই তথ্যগুলি শ্রমিকশ্রেণীর প্রগতির নৈতিকতার নিরিখে বিচার করতে হবে। সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ সমাজের অগ্রণী বাহিনীর সাথে জনগণের যোগসূত্র তৈরি করবে। লেনিন বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে শাশ্বত বলে ছাপ মেরে দেয়া যায় না, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকেও অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে বারবার যাচাই করতে হবে। বারবার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। আর এই নিরন্তর পরীক্ষার মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ ত্রুটিহীন দর্শনের পথে পা বাড়াবে। তখনই নির্দ্বিধায় ঘোষণা করা যাবে সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদ যুগের নানান অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, গ্রহণীয়কে গ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক নাটক কখনই তিন ঘণ্টা ধরে মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের আবৃত্তি হতে পারে না। নাটকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ তখনই ঘটবে যখন নান্দনিকভাবে এবং শিল্পের নিজের ভঙ্গিতে রাজনীতির কঠিন সমস্যাগুলিকে দর্শকের সামনে সহজভাবে তুলে ধরা হবে। মার্কস-এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ধীরে ধীরে মার্কসীয় শিল্পতত্ত্বের বা দ্বান্দ্বিক নাট্যধারার বিকাশ। কিন্তু শুধু ফরমান জারি করে বা কোনো সূত্র দিয়ে গবেষণাগার থেকে মার্কসবাদী নাটক তৈরি করা যায় না। কারখানার উৎপাদন আর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে পার্থক্য আছে, মার্কসবাদীরা সবসময় তা স্বীকার করেন। মার্কসবাদের নামে যা কিছু একটা শ্লোগান আর শ্রমিকদের বিজয় দেখালেই তা রাজনৈতিক নাটক হবে না। নাটক হিসাবে তার শিল্পমান বজায় রাখতে হবে। পিসকাটরের দেয়া বক্তব্যকে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা ভুল বুঝেছিলেন, পিসকাটরের দেয়া বক্তব্যের বাড়াবাড়ির জন্যই। কারণ শিল্প বাদ দিয়ে নাটককে শুধু প্রচারপত্র বানালে তাতে দর্শক পাওয়া যাবে না এবং বিপ্লবের লক্ষ্যও পূরণ হবে না। নাটকের মধ্য দিয়ে কোনো বক্তব্য প্রচার করায় দোষ নেই বরং সেটাই তার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কিন্তু সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার তা হতে হবে নাটকের শিল্পমান বজায় রেখে।

রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা বা রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাই কোনো গণ্ডিবদ্ধ ব্যাপার নয়, নিসন্দেহে কোনো সংকীর্ণ ব্যাপার নয়। সমাজ পরিবর্তনে নতুন জগৎ নির্মাণে যা কিছু মানুষের চিন্তাকে সাহায্য করবে তার সবই রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনে স্থান পাবে। শুধুমাত্র খেয়াল রাখতে হবে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় তা চূড়ান্তভাবে সাহায্য করছে কি না। বিশ শতকের যে রাজনৈতিক নাটক তার সাথে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাই মূলকথা, প্রধান প্রশ্ন। যাঁর মধ্যে এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে তিনি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক নাট্যকর্মের লোক নন। রাজনৈতিক নাট্যাভিনয় কোনো সখ নয়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য এক ধরনের দায়বদ্ধতা। সমাজ পরিবর্তন কথার অর্থও এই নয় যে, তাদের নিজেদের সুবিধা মতন সমাজ পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তনটুকু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে থেমে পড়া। সমাজ পরিবর্তন ইতিহাসের একটি অনিবার্য ব্যাপার, সেই পরিবর্তনকে কখনই থামানোর চেষ্টা চলবে না। সমাজতন্ত্র এমনকি সাম্যবাদ আসার পরেও নয়। মার্কসবাদী চিন্তাই হচ্ছে পরিবর্তনকে চিরন্তন হিসাবে দেখতে পারা। ইতিহাসে পিছনে ফিরবার কোনো উপায় নেই। ইতিহাস অনিবার্যভাবে সামনের দিকে ঠেলছে মানুষকে। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী পরিবর্তন যেখানে অনিবার্য, সেখানে পরিবর্তন তো আসবেই। রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন তাহলে সেখানে কোন্ দায়িত্বটি পালন করছে? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বের বিশেষত্ব এখানেই, মার্কস-এঙ্গেলস কোনো কিছুকেই স্বয়ম্ভু মনে করছেন না। সেখানে সকলেই সকলের ওপর নির্ভরশীল, পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মার্কস ও এঙ্গেলস তাই মনে করেন, ইতিহাস যেমন মানুষকে পরিচালিত করে, মানুষের চিন্তা এবং কাজের প্রভাবও পড়ে তেমনি ইতিহাসের ওপর। ইতিহাসের বাইরে যেতে পারে না মানুষ, আবার ভিন্নার্থে ইতিহাস মানুষকে ঠেলে দেয় ইতিহাসের বাইরে, সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য তাই পৃথিবীর পরিবর্তনের ইতিহাসের গতির ওপর প্রভাব ফেলা। যে পরিবর্তন অনিবার্য তাকে এগিয়ে আনা।

মার্কসের মতে সমাজ পরিবর্তন অনিবার্য, তাই বুর্জোয়া ব্যবস্থা ভেঙ্গে একদিন শ্রমিকের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবেই। মানুষ শোষণমুক্ত হবে তার মধ্য দিয়ে। সেটা কবে ঘটবে? কতো বছর কতো যুগ পর? যতোদিন সেটা না ঘটবে ততোদিন কি তাহলে মানুষ চোখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে যাবে এই কথা ভেবে যে পরিবর্তন অনিবার্য? মার্কসবাদীরা মনে করেন ব্যাপারটা তা নয়। সেটা হবে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হলো রাশিয়া তখন অনেক পশ্চাদপদ দেশ। পুঁজিবাদ বিকশিত হলে সমাজতন্ত্র বিকশিত হবে এই ছিল মার্কসের মতবাদ। লেনিন মানলেন না। লেনিন দেখলেন সেটা মানতে গেলে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীকে আরো বহু বহু বছর ধরে নির্যাতিত হতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে মানুষের নিজেরও ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকা সম্পর্কে মানুষকে যেমন সচেতন করবে রাজনীতি, দর্শন, রাজনৈতিক বক্তৃতা, লেখা-লেখনী, তেমনি রাজনৈতিক নাটকও সেই একই কাজ করবে। প্রথম মহাযুদ্ধ যদি না ঘটতো, যদি মহাযুদ্ধের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষের তথা ইউরোপের জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণা তৈরি না হতো; তাহলে হয়তো লেনিনের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়া এবং তা সার্থক করা সম্ভব হতো না।

মহাযুদ্ধের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। প্রশ্ন আসতে পারে, বিপ্লবের প্রয়োজনে রাজনীতি প্রচারের কাজ করবে রাজনৈতিক দল বা দলের কর্মীরা, নাটক বা শিল্পের সেখানে প্রয়োজন কোথায়? বিপ্লবের সাথে বিপ্লবী রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক বোঝার জন্য প্রথমেই এ বিষয়টি বোঝা দরকার যে, বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রাম ও বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগ্রাম যদি সমান্তরালভাবে গঠিত না হয় ও চলমান না থাকে তাহলে কোনো সমাজেই বিপ্লব সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব যে নয় তার কারণ; বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রধান দিক হলো মূলত সাংগঠনিক দিক, বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রধান দিক হলো তার মতাদর্শগত দিক। রাজনৈতিক কর্মীরা যখন দৈনন্দিন রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য প্রাণপাত করবে, মতাদর্শের কর্মীরা তখন তাদের সাহায্য করবেন জনতার দৃষ্টি ভবিষ্যতের বিশাল সংগ্রামের দিকে চালনা করতে; অর্থাৎ দৈনন্দিন সংগ্রামের চাপে যেন ভবিষ্যতের বৃহত্তর সংগ্রাম হারিয়ে না যায়। সংস্কৃতির সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয়, দুই সংগ্রামের লক্ষ্য এক; সমাজটাকে পাল্টানো। শিল্প মানুষের আবেগকে সংগঠিত রূপ দান করে, মানুষের প্রকৃতিকে পরিবর্তনশীল বস্তুজগতের সঙ্গে অন্বিত করে এবং নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। চলবে