রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা: নানা বিভ্রান্তি
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ১০, ২০২০
গণনাট্যের নাটকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল, তাহলো নাটকগুলো বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে ও শুষ্ক। গণনাট্যের নাটকগুলো যে বৈচিত্র্যহীন ছিল সে অভিযোগ মিথ্যা নয়। রাজনৈতিক সংগ্রামটা মানুষের জীবনের যে বিপুল বিস্তার নিয়ে বৈচিত্র্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে, গণনাট্যের নাটকে তা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। হীরেন ভট্টাচার্য দেখান যে, নাট্যকাররা মার্কসবাদ প্রচার করেছে বলেই নাটকগুলো একঘেয়ে হয়নি। বরং নাট্যকাররা যথেষ্ট মার্কসবাদী ছিলেন না বলেই তাঁদের নাটকে সুবিপুল জীবন তার সমগ্র বৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিফলিত হতে পারেনি। মার্কসবাদী নাট্যকার হতে গেলে মার্কস-লেনিনের তত্ত্ব যেমন পড়া থাকা চাই, তেমনি নাটকে স্বকীয় বাস্তব অবস্থার সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষমতাও থাকা চাই। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাকে দেখতে শিখলে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল সমস্যার উপরই নাট্যকার আলোকপাত করতে পারবেন। নাটক তখন বৈচিত্র্যহীন হবে না। গণনাট্যের নাটকের বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ ছিল তা হলো চরিত্র সৃষ্টির ত্রুটি। চরিত্রগুলি ছিল নিষ্প্রাণ এবং ভালো-মন্দ দুভাগে বিভক্ত। জমিদার-জোতদার যেহেতু শোষক তাই তাদের সবকিছুই খারাপ, শ্রমিক যেহেতু বিপ্লবী তাই তার সবকিছু ভালো; মার্কসবাদ এটা স্বীকার করে না। মার্কসবাদ মনে করে, শ্রমিকরাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শক্তি কিন্তু তার স্বভাবে রয়েছে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি। যদি সেগুলো তাকে না জানানো হয়, যদি সেগুলো সম্পর্কে সে সচেতন না হয়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো দখল করে, তার ফলাফল ভালো হবে না; তার হাত দিয়ে তৈরি হবে নৈরাজ্য।
গণনাট্যগুলির নাটকে প্রায় দেখানো হতো, শোষিতরা নায়কের কয়েকটি কথা শুনেই সচেতন হয় এবং সচেতন হবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বিদ্রোহ করে এবং গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন হয় না। অথচ লেনিন বলেছিলেন, সহজে, যাদুর প্রভাবে, ভার্জিন মেরীর উপদেশে, শ্লোগানের ধাক্কায় শ্রমিকশ্রেণী তাদের কুসংস্কার মুক্ত হয় না। দীর্ঘস্থায়ী কঠোর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে তাদের কুসংস্কার দূর হয়। গুস্তাভ লা বোঁ দেখান যে, ফরাসী বিপ্লবের মতবাদ জনতার মনে দৃঢ় হতে এক শতাব্দীর বেশি সময় নিয়েছিল শুধু প্রস্তুতি পর্বে। জনতার মনে বদ্ধমূল হওয়ার পরেই তা দুর্দমনীয় রূপ লাভ করেছিল। ইতালীয় নাট্যকার আন্তনিও গ্রামশি বলেছিলেন, শ্রমিকশ্রেণী শুধু ব্যরিকেডে লড়াই করে জয়যুক্ত হবে না, তাকে লড়তে হবে চেতনার জগতেও। তবেই তার সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে। রাজনৈতিক নাট্যকার ব্রেশ্ট বলছেন, বিশেষ শ্রেণীর মানুষ হিসাবে নাট্য চরিত্রটির বিবরণ দেয়া অসম্ভব যদি না তাকে তার শ্রেণী ও যুগের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি হিসাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। ব্রেশ্ট মনে করেন, বৈজ্ঞানিক থিয়েটারের নাটকে চরিত্রকে কঠোরতম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগুতে হবে। চরিত্রগুলো দ্বন্দ্বসংকুল বাস্তবকে প্রতিফলিত করবে এবং তাকে অবশ্যই সংগ্রামজর্জর হতে হবে। তিনি কেন মার্কসবাদকে নাটক লেখার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়ে লিখছেন, ‘মার্কসবাদ এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে জগতকে দেখতে শেখায়। মার্কসবাদের দৃষ্টিকোণ বিশেষ পন্থার সূত্রপাত করে। বাস্তব চিন্তার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ এক সমন্বয় গড়ে তুলতে সাহায্য করে।’ তিনি আরো লিখছেন, ‘থিয়েটারে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আচরণ নিয়ে আমাদের অধিকাংশ কাজ কারবার এবং মার্কসবাদের মূল নীতিগুলি ব্যক্তির বিচারের ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করে।’ মানুষের সামাজিক জীবনের সব ঘটনা যার ব্যাখ্যা দরকার, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুসরণের মধ্য দিয়েই তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব বলে পিসকাটর ও ব্রেশ্ট মনে করতেন।
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শগত গণনাট্যগুলিতে সর্বত্র দেখা যায় নায়ক হচ্ছে খুব আদর্শবাদী একটি চরিত্র। তিনি সব ব্যাপারেই নির্ভুল আর দেবতাতুল্য মানুষ। সমাজের অন্যায়-অত্যাচার, সকল অনাচার বন্ধ করার জন্য সে দরিদ্র মানুষকে সংঘবদ্ধ করে। ধনীদের বিরুদ্ধে নায়কের ঘৃণা আর চূড়ান্ত যুদ্ধ ঘোষিত হয়। নায়কের মুখের কথায় সকলে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে শাসকদের উপর আক্রমণ চালাবার কথা ভাবে। শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা তাদের কাছে খুবই সহজ। স্বাধীনতার আগেপরে বাংলাদেশেও অবশ্য এরকম বহু নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়। কিছু মানুষ মিলিত হয়েই খলনায়কের বিরুদ্ধে জেহাদ আরম্ভ করে। মহামানব সমতূল্য নায়ক সকল আন্দোলনকারীদের পথ দেখায়। জনগণের মিলিতবাহিনীর আন্দোলনে নাটকের শেষদৃশ্যে খললনায়ক নিজের পরাজয় মেনে নেয়। নায়কের বিজয় ঘোষিত হয়।
যদিও মার্কসবাদ মানুষকে শেখায় মানুষ নায়ক বা খলনায়ক কোনোটাই নয়। মানুষ হচ্ছে মানুষ। একটা বিশেষ অবস্থায় সে নায়ক হয়, আবার একটা বিশেষ অবস্থায় সেই লোকটাই খলনায়ক হয়। জীবনে নায়ক বলে কিছু নেই, খলনায়ক বলে কিছু নেই। যাকে বর্তমান সময়ে হিরো বা নায়ক বলা হয়ে থাকে, এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্বে তার কোনো উল্লেখ নেই। নায়ক চরিত্র সম্বন্ধে ভাবনা পরবর্তীকালে উদ্ভূত। প্রাচীন গ্রীক নাটকে নায়ক-খলনায়ক বানাবার ধারা না থাকলেও বুর্জোয়া থিয়েটার পরবর্তীতে কাউকে নায়ক, কাউকে খলনায়ক বানাবার ধারা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এজিটপ্রপ বা গণনাট্য সংঘের নাটকে মানুষকে ভালো-মন্দ দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। চরিত্রগুলো সেখানে সূত্রবদ্ধ, নায়ক মানেই সাচ্চা কিংবা সৎ; খলনায়ক মানেই নিষ্ঠুর এবং কুটিল। সেখানে যেটা থাকে না তাহলো একজন মানুষ তার সকল দোষ-গুণ-দুর্বলতা-দ্বন্দ্ব সমেত একজন মানুষ; যে শাসক বা শোষিত কোনো একটি শ্রেণীর দিকে ঝুঁকে রয়েছে।।
মার্কসবাদী নাট্যকার ব্রেশ্ট সেই পরিপূর্ণ ভালো মানুষের ধারা ভেঙে একই মানুষকে দোষ ও গুণের আধার করে দেখিয়েছেন, কোনো মানুষই তাঁর কাছে সম্পূর্ণ ভালো বা খারাপ নয়, সকলেই দ্বন্দ্বপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী। গ্রীক নাটক, শেক্সপিয়রের নাটক বা চিরায়ত নাটকের চরিত্রগুলিও তািই। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে মহাভারত বা সকল চিরায়ত সাহিত্য বা মহাকাব্যগুলি। প্রত্যেক মানুষ বা বস্তুর মধ্যেই একটা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকের যে সামগ্রিক প্রকাশ সেটাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্বের শিক্ষা। রাজনৈতিক বা সমাজ পরিবর্তনের খুব জঙ্গী নাটকে দেখা যায়, বুর্জোয়া মহৎ নাট্যকারদের মতো তাঁরা চরিত্রগুলোকে যুক্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেননি। পরবর্তীকালে চরিত্রগুলোকে নায়ক খলনায়ক বানিয়ে ভালো-মন্দ দুভাগে বিভক্ত করে ফেলেছেন। নাটকে সেখানে থাকে ভালো আর মন্দের যুদ্ধ। নায়ক সেখানে ভালোর পক্ষে, সকল গুণে গুণান্বিত তার চরিত্রে সামান্য দোষ বা কলঙ্ক থাকে না । নায়ক হয়ে দাঁড়ায় পেশীশক্তিতে বিশ্বাসী বিরাট মানুষ, যে একাই নিজে হাতে সকল মন্দকে দমন করে সমাজে সুখশান্তি নিয়ে আসে। খলনায়ক ঠিক তার বিপরীত যার চরিত্রে সামান্য ইতিবাচক গুণাবলী নেই। নাটকের পুরো সময় ধরে খলনায়ক নানান রকম রাষ্ট্রবিরোধী বা সমাজবিরোধী কাজ করে বেড়ায়, সব শেষ দৃশ্যে নায়কের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তার পতন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষের নাটক বলে নয়, সস্তা চলচ্চিত্রের গল্প ঠিক প্রায় একই রকম। নাটকটা যদি বিভ্রান্তিকর রাজনীতি প্রচার করে বা বিভ্রান্তিকর বিপ্লবী ধাঁচের হয়, তাহলে দেখা যাবে নাটকের শেষদৃশ্যে জনগণ জোট বেঁধে নায়কের নেতৃত্বে অত্যাচারী শ্রেণীশত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে বিপ্লবের সমাপ্তি টেনেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চনাটকে বা পথনাটকে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মঞ্চনাটকে এমনকি সেখানকার গণনাট্যের নাটকেও বারবার এমন সব ঘটনা এবং চরিত্রের দেখা মিলবে। বিশেষ করে সেই ধরনের রাজনৈতিক নাট্য প্রচেষ্টাকে সমালোচনা করতে গিয়ে উৎপল দত্ত কলম ধরেছিলেন। সেখানে তিনি গণনাট্য সংঘের রাজনীতির গৎবাঁধা সূত্রবদ্ধ নাটকগুলোকে ব্যঙ্গ করে লিখছেন, ‘প্রথমে এক সাহেব বা এক জমিদার চাবুক নিয়ে বেধড়ক প্যাঁদায় একদল চাষীকে।...তারপর আসে কমিউনিস্ট; সকল গুণের আধার, সে সুশীল বালক, সকল পাঠ মন দিয়া পড়ে। তার না আছে কোনো দ্বিধা, না কোনো দুর্বলতা, না কোনো দ্বন্দ্ব। এহেন এক নিষ্পাপ সন্ন্যাসী এসে চাষীদের বোঝায়, আর বুঝেই তারা গিয়ে জমিদারকে পেটায়। যবনিকা, ইতি গণনাট্য সংঘস্য নবনাটকম্।’ উৎপল দত্ত আরো লিখছেন, এসব হচ্ছে পোস্টার-এ্যাণ্ড শ্লোগান স্টাইল, এতে বিপ্লবের ক্ষতি হয়, উপকার নয়। মাও সেতুঙ বলেন, বিজ্ঞানের মানদণ্ড অনুসারে এই সব রচনাকে সমালোচনা করা একান্ত প্রয়োজনীয় যাতে করে নিম্নমানের শিল্পকে ধীরে ধীরে উন্নততর মানে সমুন্নত করা সম্ভব হয় এবং রাজনৈতিক নাটকের লক্ষ্য সম্পর্কে নাট্যকার বা নাট্যদলগুলো স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। মার্কসবাদীরা তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশ বা বিছিন্ন আন্দোলনকে সমর্থন করে না, তারা শত্রুর ওপর সুসংগঠিত আক্রমণ চালাতে চায় শত্রুকে ভালোভাবে ঘায়েল করার জন্য। মার্কসবাদীদের কাছে প্রাণ দেয়া-নেয়াটাই বড় কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো উদ্দেশ্য সাধন করা। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সবকিছুকে দেখতে হবে। মার্কসবাদীদের প্রথম কাজ মানুষকে সমাজবিজ্ঞান সচেতন করা। যে-কোনো আক্রমণ করার আগে জানা কেন সে আক্রমণ করছে, তারপরের পরিণতিটি কী। পরবর্তী পদক্ষেপ, চূড়ান্ত পদক্ষেপ না জেনে মার্কসাবাদীরা কোনো আক্রমণ চালায় না। রাজনৈতিক নাটকও সে ধরনের উস্কানিকে প্রশ্রয় দেয় না। শ্রেণীসংগ্রাম হবে সুসংবদ্ধ, পরিকল্পিত। তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশের চেয়ে পরিকল্পিত আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে, চূড়ান্ত বিপ্লবের জন্যই লড়বে শ্রমিকশ্রেণী। তাৎক্ষণিক এইসব ক্ষোভ হঠকারী সিদ্ধান্তেরই নামান্তর, তা বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষতিই করে থাকে।
দর্শন চৌধুরী লিখেছিলেন, জীবনে যার প্রস্তুতি নেই, যে বিপ্লব সংঘটিত হতে সময় লাগবে, নাটকে সেটাকেই এতো সহজভাবে নিয়ে এলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। অতি-বিপ্লবীয়ানার ফানুস ব্যাপারটাকে একেবারে রূপকথার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সমাজসত্য থেকে সরিয়ে নিয়ে নাটকে শোষিতদের বিচ্ছিন্ন লড়াইকে মার্কসবাদীরা সমর্থন করেন না। মার্কসবাদীরা জানে সেটা কোনো চূড়ান্ত সফলতা দেয় না। কারণ সে ধরনের কোনো লড়াইয়ের জন্য শ্রমিকশ্রেণী বা শোষিতদের একত্র করে না। মার্কসের দান্দ্বিক বস্তুবাদী চিন্তার আগেই সমাজে এ ধরনের বহু লড়াইয়ে শ্রমিকদের অংশ নিতে মার্কস নিজেই দেখেছেন। মার্কস শ্রমিকদের সে লড়াইকে সমাজবিজ্ঞানের চেতনা দ্বারা পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন এবং সেটা বিচ্ছিন্নভাবে নয়, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলের অধীনে। রাজনৈতিক সংগঠন বাদ দিয়ে মার্কস এধরনের কোনো লড়াইয়ের কথা ভাবেননি। মার্কসীয় বিপ্লবে অংশ নেয়ার জন্য শ্রমিককে আগে সত্যিকার শ্রমিক হয়ে উঠতে হয়, যে-শ্রমিক সচেতন নয়, কার্ল মার্কস সে শ্রমিককে বিপ্লবী শ্রমিক মনে করেননি। লেনিন বলেছিলেন, সর্বহারাশ্রেণীর শক্তিকে তার সংখ্যা দিয়ে বিচার করা চলবে না। সর্বহারাশ্রেণীর ভূমিকায় নির্ধারক উপাদান তার সংখ্যাগত শক্তি নয়, বরং তার রাজনৈতিক শক্তি। নাট্যকার সমাজবিজ্ঞানের চেতনার দ্বারা দর্শককে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করবেন, সমাজসত্য বাদ দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত পছন্দের দ্বারা ঘটনাকে সাজাবেন না। কিছু নাট্যকার থাকেন যারা সমাজসত্য বাদ দিয়ে, দর্শকের সামনে সমাজসত্য তুলে ধরার চেয়ে দর্শকদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রেশ্ট বলছেন, মানব সমাজের হাজারো দুঃখ দুর্দশার মধ্য থেকে সংগ্রহ করতে হবে আসল বিষয়বস্তুকে। সেই সাথে শিল্পীরও স্বাধীনতা থাকবে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা বিস্তারের ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে মাথায় রেখে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই কল্পনার বিস্তার ঘটাতে হবে। নাট্যকারের স্বকীয়তা, রসবোধ, তার নিত্যনতুন আবিষ্কার তাঁর রচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রচনার উদ্দেশ্য যদি কোনও না কোনভাবে শুধুই দর্শকের উত্তেজনার খোরাক হয়, গভীর চিন্তার বাহন না হয়; তবে তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী যেমন শোষিতদের ওপর তাদের শ্রেণীশোষণ বজায় রাখে, তেমনি সাংস্কৃতিক জীবনে প্রাধান্যের দ্বারা শোষিত মানুষগুলিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। সেই ঘুম অকস্মাৎ ভাঙে না। মুখের এক বুলিতে তাই কোনো সংগ্রাম বা বিপ্লব সংঘটিত হয় না। মার্কসবাদীদের মতে তাই সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রধান কাজ হবে শোষকশ্রেণীর প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত করার বৈপ্লবিক চিন্তায় তাদের উদ্বুদ্ধ করা। সেজন্যই দরকার বৈজ্ঞানিকভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করা। মনগড়া কোনো তাৎক্ষণিক বিপ্লব নাটকে না ঘটিয়ে বরং কঠিন বাস্তবের রূঢ়তাকে তাদের কাছে প্রকাশ করা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যে-কোনো শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সফলতা লাভ করাটা যে কতোটা কঠিন সেটা দর্শকদের বুঝিয়ে দেয়া। শোষিতরা প্রায় ক্ষেত্রে শোষকদের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা কতোটা অন্ধ হয়ে আছে নাটকে সেটা দেখানো। সর্বোপরি ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে শোষিতদের মধ্যে লড়াইয়ের যে অনীহা তা ফুটিয়ে তোলা। শোষিতদের মধ্যকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দো-মনা স্বভাবসহ তাদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারার মধ্যেই রয়েছে মার্কসীয় নাট্যচিন্তার প্রতিফলন। শোষিতরা যখন নিজেদের চরিত্রের সে-সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখবে তখনি নিজেদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে, নিজেদেরকে চিনতে পারবে। বুঝতে পারবে তারা কীভাবে অবচেতনে সরকারি-যন্ত্রের সাথে, বর্তমান সমাজের শিক্ষা-দীক্ষা-রক্ষণশীলতা-কুসংস্কারের সাথে বাঁধা পড়ে আছে। সেগুলো দেখেই তারা সচেতন হবে। যদি নাটকে শোষিতদের খুব সংগ্রামী এবং ভালো মানুষ দেখানো হয়, তাহলে তো শোষিতরা নিজেদের ত্রুটি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হবে না এবং নিজেদের দোষগুলি কাটিয়ে সত্যিকার বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে পারবে না। ব্রেশটের “সমাধান” নাটকটি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে।
সংগ্রামশীলতা নিঃসন্দেহে সর্বহারাশ্রেণীর, শোষিতদের বৈশিষ্ট্য। তবে বাস্তব অবস্থার সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থিত না থাকলে চরিত্রগুলো নাট্যকারের ইচ্ছাকে বহন করার যন্ত্রস্বরূপ হয়ে পড়ে। সেজন্য সর্বহারাশ্রেণীর বা বৃহত্তর জনগণের জীবন নিয়ে আলেখ্য রচনা করলেই বা তাদের বর্তমান জীবনকে প্রতিফলিত করলেই বৈপ্লবিক সংস্কৃতি হয় না। শ্রেণীসমাজের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে দরিদ্রদের মধ্যেও হিংসা, দ্বেষ, ক্ষুদ্রতা, গোলামির মনোভাব সবই আছে। আছে নানারকম নীচতা, আছে নিজেদের মধ্যেই নানারকম স্বার্থের লড়াই। সমাজ বিশ্লেষণের মাধমে তাদের সেই চরিত্র নাটকে ফুটিয়ে তোলা দরকার বলেই মার্কসবাদীরা মনে করেন। রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে পিসকাটর ব্রেশটদের মতো মনীষীদের বক্তব্য দাঁড়ায় যে, শ্রেণীশোষণ বা শ্রেণীসংগ্রামের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর জায়গা থেকে মানুষ ও বিশ্বকে দেখতে হবে। হ্যাঁ, শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে, দরিদ্র মানুষকে নিয়েও নাটক হতে পারে এবং হচ্ছেও। ভবিষ্যতে যারা শাসন ক্ষমতায় আসবে বহু নাটকের তারাই হবে নায়ক। মার্কসবাদীদের এ নিয়েও কোনো আপত্তি বা নিষেধ নেই। কিন্তু এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, সর্বহারা চরিত্ররা খুব একটা চিত্তাকর্ষক এবং রংচঙে হয়েতো বিকশিত হয় না এই সমাজ ব্যবস্থায়। সে লিখতে পড়তে শেখেনি; সুতরাং মাঝে মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আউড়ে চৌকষ হয়ে উঠবে তার পথ বন্ধ। সারাদিন শ্রমক্লান্ত উদয়াস্ত মেশিনের তলায় বিধ্বস্ত, নিজবৃত্তি, নিজ চেতনা, অন্য মানুষ, সব থেকে বিচ্ছিন্ন শ্রমিক যখন রাজনীতির জগতে প্রবেশ করে, সে প্রথম প্রাণের স্পর্শ অন্তরে অনুভব করে। শ্রমিকের ঘরোয়া জীবনের কিছু কি বাকি রেখেছে পুঁজিপতি ও মেশিন, যে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে ট্র্যাজেডির নায়ক? চার্লি চ্যাপলিন কারখানার শ্রমিকদের জীবনের সেই কঠিন চিত্রটি এঁকেছেন তার “মডার্ন টাইমস” চলচ্চিত্রে।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এককালীন সাধারণ সম্পাদক গণনাট্যের কিছু কিছু নাটক সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেন, সমাজ পরিবর্তনের নেতাদের গণনাট্যের নাটকে এতো ভালো মানুষ হিসাবে দেখানো হয় যে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নাট্যকাররা শোষিত মানুষের পক্ষাবলম্বন করে নাটক রচনা করবেন ঠিকই, কিন্তু এই পক্ষাবলম্বনের অর্থ এই নয় যে নাট্যকার তাঁর মতামতের নিতান্ত তল্পিবাহক কিছু চরিত্র মঞ্চে এনে তর্ক-বিতর্কের দ্বারা নাট্যকারের মত ও উদ্দেশ্য অতি স্থূলভাবে দর্শকদের উপর চাপিয়ে দেবেন। হীরেন ভট্টাচার্য সেসব নাটক সম্পর্কে লিখেছিলেন, মোট সমস্যা হচ্ছে এই যে, ‘আমাদের নায়করা এতো ভালো মানুষ যে সে আর রক্তমাংসের, দোষগুণ মিশ্রিত, বৈপরীত্য সমন্বিত মানুষ হয়ে ওঠে না। এরা ভালো ভালো বৈপ্লবিক কথাবার্তা বলে, মঞ্চে বক্তৃতার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ঘটাতে চায়।’ এই সব নাটকে জমিদারদের নারীলোলুপ চেহারা, নারীর উপর বলাৎকার করার দৃশ্য যতো থাকে, শোষিতদের বেলায় তা আর থাকে না। শহরের সাধারণ বেশ্যালয়গুলো যে তৈরি হয় শ্রমিকদের জন্যই, নাটক লিখবার সময় বিপ্লবী এসব নাট্যকাররা তা অনেক সময়ই ভুলে যান। শোষকদের চরিত্রের কোনো ভালো গুণ যেমন এসব নাটকে নেই, তেমনি শোষিতদের চরিত্রের মধ্যেও বীরত্ব ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া কোনো ধরনের দোষ লক্ষ্য করা যায় না। এসব নাটকে শ্রমিক-কৃষক বা শোষিতদের চেহারা হয়ে ওঠে মহান। মূল সত্যিটা কী তাই? চাষী ঢের বেশি সংগ্রামী সন্দেহ নেই, লড়াইয়ে সে নির্মম, কিন্তু তার বাইরে কৃষক সংকীর্ণমনা, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, জমি-লোভী। সে নিজের সন্তান ও স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেয় নিজ ইচ্ছাকে। কৃষক চরিত্রের থাকে আরো নানাধরনের নীচতা। ক্ষমতাবানদের সে তোয়াজ করতে পছন্দ করে, সুযোগ নিতে পছন্দ করে। নানা কুসংস্কারে বিশ্বাস রাখে। শ্রমিকরাও একই রকম। যে শ্রমিক রাজনীতি সচেতন নয়, সে মোটেই মহান নয়। সে অনেক ব্যাপারে জঘন্য রকম পশ্চাদপদ। অথচ উল্লিখিত নাটকগুলোতে শ্রমিকদের চরিত্রের নানা দ্বন্দ্বগুলোকে নাট্যকাররা বাদ দিয়ে তাদের একপেশে ছবি এঁকেছেন।
শ্রমিক-কৃষক বলতে উল্লিখিত নাটকে দেখা যায় সংঘবদ্ধ কিছু মানুষকে, যারা নানাভাবে শোষিত এবং শেষ পর্যন্ত যারা বিদ্রোহ করে। দোদুল্যমান কোনো শ্রমিক-কৃষকের চেহারা এসব নাটকে নেই। যে-কোনো শ্রেণীসংগ্রামের নাটকে লড়াইটাই হতে পারে প্রধান বিষয়বস্তু। হয়তো সেটাই পটভূমিকা কিন্তু শুধু সেখানে ঘুরলেই চলবে না। দুই পক্ষের মানুষগুলোর যে দ্বিধা-সংশয় দ্বন্দ্বের মানসিক জগৎ, সেগুলোও তুলে ধরতে হবে। উৎপল দত্ত লিখছেন, ‘দুই শ্রেণীর সংঘর্ষ বা দুই জাতির সংঘর্ষ হচ্ছে বাস্তব স্থূল ঘটনা। নাট্যকার কি করেন? তিনি ঐ সংঘর্ষের পেছনে যে তীব্র ঘৃণা কাজ করছে, অর্থাৎ দুই পক্ষের মনের মধ্যে যে বিষ জমা হচ্ছে সেটাকে আশ্রয় করেন। তিনি তারপর একটা পক্ষ নেন।’ দুই পক্ষেরই দৃঢ় ও দোদুল্যমান চরিত্রগুলোর মানস, ঘটনার সাথে সাথে ফুটে উঠবে নাটকে। সেভাবেই তো নাটকে চরিত্র সৃষ্টি হবে; চরিত্রগুলো দর্শক টানবে, তার চিন্তার জগতে নাড়া দেবে। বিপ্লবী নাট্যকার কতগুলো বাঁধা বুলি দিয়ে তার নাটককে করে রাখবেন একটা সস্তা প্রবন্ধের মতো কিংবা চরিত্রগুলোকে একটা সূত্রের মধ্যে ফেলে শোষক আর শোষিতদের বোঝাতে চাইবেন, সেটা রাজনৈতিক নাটকের কাম্য নয়।
বহুজন আছেন যাঁরা নিয়মিত রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং তারপর এসে নাটক লেখেন। তবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বহুক্ষেত্রেই পাল্টায় না, দেখা যায় পাতিবুর্জোয়ার দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁরা নাটক লিখছেন। শ্রেণীসংগ্রামের নাটক লিখতে গেলে যেটা হওয়া দরকার তাহলো তাঁদের দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন। তাঁরা সর্বহারাশ্রেণীর দৃষ্টিকোণ মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিজের করে নেবেন। অনেক সময় তা হয় না। তাঁরা অনেক শ্রেণীসংগ্রাম, অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া সত্ত্বেও পাতিবুর্জোয়ার দৃষ্টিকোণটাকেই আশ্রয় করে বসে থাকেন এবং তাঁদের লেখায়, তাঁদের কাজকর্মে সেটাই প্রকাশ পায়। উৎপল দত্ত দেখাচ্ছেন যে, সমাজে যে ঘটনাগুলি ঘটছে তার প্রত্যেকটার যুক্তি, প্রত্যেকটার ব্যাখ্যা তো মার্কসবাদ-লেলিনবাদেই পাওয়া যাবে। নাট্যকাররা সেসব পড়ছেন না। না পড়েই বিপ্লবী নাটক লিখতে বসে যাচ্ছেন। তিনি বলছেন, কী রাজনীতি দিচ্ছি তার ওপরেই নির্ভর করে কোন্ কথাটা কীভাবে বলবো। অথচ যাঁরা রাজনৈতিক নাটক লিখছেন বা নাটক করছেন তাঁদের রাজনৈতিক মান অত্যন্ত নিম্নে রয়েছে। যাঁরা নাটক লিখছেন, পরিচালনা করছেন, প্রযোজনা করছেন, অথবা যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁদের নিজেদের রাজনীতিই ঠিক পরিষ্কার নয়। তাঁদের নিজেদেরই মার্কসবাদ-লেলিনবাদের ওপর দখল অত্যন্ত নগণ্য। সেইজন্যই সর্বত্র সূত্রবদ্ধ নাটক দেখতে পাওয়া যায়। নাট্যকার অথবা পরিচালকদের রাজনৈতিক চেতনাই তৈরি হয়নি, শোষণের নানাদিকও তাঁরা বোঝেন না। ফলে রাজনৈতিক চিন্তা এবং থিয়েটার সম্পর্কে না বুঝে, থিয়েটারের আঙ্গিক-অভিনয় দখলে না এনে যা তৈরি করেন তার দ্বারা শুধু বিভ্রান্তিই সৃষ্টি হয়।
মার্কসবাদী আন্দোলন এক দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপার, মার্কসবাদী নাটকের কাজ নয় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইকে উস্কে দেয়া, প্রথম কাজ শোষিত মানুষের চিন্তার জগৎটাকে গড়ে দেয়া। সারা পৃথিবীব্যাপী যে শোষণ চলছে সেটা কেন, তার সমস্ত নাড়ি-নক্ষত্র তাদেরকে চিনিয়ে দেয়া। যখন শোষিতরা সমাজবিজ্ঞানের গতিপথ আবিষ্কার করতে সমর্থ হবে, তখন সে নিজেই তার শ্রেণীর ভাগ্য পাল্টাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। সেজন্য মার্কসবাদী বা রাজনৈতিক নাটকের কাজ প্রথম লড়াইয়ের কথা বলা নয়, যাদের বিরুদ্ধে লড়বে বা যে-সমাজে তার বাস, সেই সমাজ এবং শত্রুর সত্যিকার পরিচয়টা পরিষ্কার করা। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের চেতনা ছাড়া সর্বহারারা প্রকৃত সর্বহারাশ্রেণী হয়ে উঠতে পারে না। সর্বহারাশ্রেণী প্রকৃত সর্বহারাশ্রেণী হয়ে ওঠার পরেই আসে শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নেয়ার প্রশ্ন। পৃথিবীতে কোনো বিদ্রোহই তাৎক্ষণিকভাবে সংঘটিত হয় না। দীর্ঘদিনের একটি প্রস্তুতি থাকে তার পশ্চাতে। মানুষের ক্রোধই শুধু বিদ্রোহের কারণ নয়। আরো নানান কারণ থাকে। আপোষহীন বা গোঁয়ার মনোভাবই যদি আন্দোলনকারীদের চরিত্রের প্রধানতম গুণ হয় তাহলে তার বৈপ্লবিক চেতনা বুদ্ধি নির্ভর না হয়ে পুরোটাই আবেগ নির্ভর হয়ে পড়ে। একটি মৃত্যুকে ঘিরে কখনও একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয় না, যদি সেই বিদ্রোহীদের মনে আগে থেকেই কোনো ঘৃণা জমে না থাকে।
বহু নাট্য-ব্যক্তিত্বই বলে গেছেন মোটা দাগের গল্প মানে নাটক নয়, সে গল্পে যতই বিপ্লবী বুলি থাক না কেন। আলবেয়ার কামু বলেছিলেন, মানুষের ভিতরে যে সত্য লুকানো থাকে, তার অন্তরে যে রহস্য থাকে, সে সম্বন্ধে যার ঔৎসুক্য আছে সে যেন থিয়েটারে আসে। বাস্তবের দুই শ্রেণীর লড়াইটা দেখালেই নাটক সত্যিকারের রাজনৈতিক নাটক হয়ে ওঠে না, সেই লড়াইয়ের প্রতিটি কানাগলিও সেখানে দেখিয়ে দিতে হয়। ব্যক্তিমানসের বিশ্লেষণ থাকতে হয়, মানব মনের জটিলতাগুলোকেও সেই সাথে স্থান দিতে হয়। নাট্যকার ব্রেশ্ট দেখাচ্ছেন, রাজনৈতিক থিয়েটার তৈরির জন্য একটি ঐতিহাসিক নাটককে যুগের সমগ্র বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে হবে এবং মঞ্চে তাকে জীবন্ত হয়ে উঠতে হবে। যুগের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা ঐতিহাসিক নাটকের অবশ্যই দায়িত্ব। যে-কোনো বিদ্রোহই একটি ঘটনাবহুল ব্যাপার। তার থাকে নানা দিক, নানা প্রসঙ্গ, নানা অনুসঙ্গ। বিদ্রোহের পাশাপাশি তার চারদিকের ঘটনাবলী, বিভিন্ন চরিত্রের দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বহুকিছুই ধরা পড়ে সে-সব নাটকে, বিদ্রোহের একটি পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। বিদ্রোহের পশ্চাতে যে রাজনৈতিক কারণ নিহিত আছে নাট্যকার তা পরিহার করে গেলে হবে না।
শ্রমিকদের, শোষিতদের সংঘটিত যে-কোনো বিদ্রোহকেই মার্কসবাদীরা গুরুত্ব দেয়। বিদ্রোহীরা যদি পরাজিত হয়, মার্কসবাদী তার কারণও ব্যাখ্যা করে। মার্কসবাদীরা যখন কোনো সত্য ঘটনাকে নাটকের কাহিনী হিসাবে বেছে নেয়, তখন তাদের মূল লক্ষ্য হয় শুধু তার মাহাত্ম্য প্রচার নয়, শুধু ঘটনার বিবরণ দেয়া নয়, ইতিহাসের দৃষ্টি থেকে নির্মোহভাবে তার মূল্যায়ন করা। ঘটনার সত্যতাই শুধু বড় কথা নয় বরং কীভাবে সেটাকে দর্শকদের মানসপটে তুলে ধরা হচ্ছে সেটাই বড় ব্যাপার। নাটকটিতে শুধু বিদ্রোহীদের মাহাত্ম্যই প্রচার করা হলে ভুল করা হবে, বিদ্রোহীদের বা বিদ্রোহের ভুলত্রুটিগুলোকে স্পষ্ট করতে হবে। মার্কসবাদীরা মনে করেন, জনগণের নিজেরও ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে যেগুলিকে জনগণের নিজেদের মধ্যেই সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে দূর করতে হবে এবং এ ধরনের সমালোচনা-আত্মসমালোচনায় রাজনৈতিক নাট্যেরও এগিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। জনসাধারণের ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা দরকার। কিন্তু এটা করার সময় যথার্থভাবে জনগণের পক্ষই অবলম্বন করতে হবে এবং জনগণকে রক্ষা করার ও শিক্ষিত করে তোলার একান্ত আন্তরিক আগ্রহ থেকেই কথা বলতে হবে। শোষিতদের প্রতি শত্রুর মতো আচরণ করার অর্থ হলো শত্রুর পক্ষ নেওয়া। মাও বলেন, মানব ইতিহাসের স্রষ্টা শ্রমিকশ্রেণীর আমরা জয়গান করবো না কেন? কিন্তু পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণীর জীবনের অন্ধকার দিকগুলিকেও তুলে ধরতে হবে এবং তাদের একজন বন্ধু হিসেবেই। বুর্জোয়া মহৎ নাট্যকারদের রচনার মধ্যে যতোই বুর্জোয়া ভাবধারা থাক, যতোই তাঁরা বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ববাদের জয়গান করুক, বুর্জোয়াশ্রেণীর জীবনের অন্ধকার দিকটিও তাঁদের রচনায় ভাস্বর। সেজন্যই নাটকগুলো বিশেষ যুগের না হয়ে চিরকালীন সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।
বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের বা পথনাটকের বিপ্লবীয়ানা চরিত্রটা দেখতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের তথাকথিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রদর্শিত সকল নাটকে এই ধারাই লক্ষ্য করা গিয়েছে। বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষকে সচেতন করার জন্য একধরনের নাটক মঞ্চায়ন করে থাকে। কোনো একটি গ্রামের বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে নাটকের পাত্রপাত্রীরাই বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দু-তিনদিনে নাটকটি রচনা ও মহড়ার কাজ সম্পন্ন করে। তারা বিশ্বাস করে, নাটক তৈরি করা তাদের কাছে খুবই সহজ কাজ; সামান্য কিছু আলাপচারিতার দরকার হয় তার জন্য। মুক্ত নাটকের নামে গ্রামে গিয়ে উন্নয়ন সংস্থার অর্থে বিভিন্ন সময় মঞ্চের কিছু নাট্যদলও এ ধরনের নাটক করেছে। দরিদ্র মানুষেরা একত্রে বসে নিজের গ্রামের ঘটনা নিয়ে মিলিতভাবে নাটক লেখাটাকে এই সব প্রতিষ্ঠান বিপ্লবী কাজ হিসাবেই প্রতিপন্ন করতে চান। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের কিছু ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন সংস্থার এসব নাটকের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিছু নাট্যব্যক্তিত্ব এবং একজন নাট্যশিক্ষক এধরনের নাটকের পক্ষে গ্রন্থ লিখেছেন। কিন্তু মার্কসবাদীদের কাছে এসব উদ্ভট চিন্তা। পৃথিবীর বড় বড় নাট্যকাররা কেউই উন্নয়ন সংস্থার মতো সামান্য কিছু তথ্য জোগাড় করে যৌথ উদ্যোগে নাটক লেখেননি। নাটক লেখার ব্যাপারে তাদের সবচেয়ে বড় উপাদান ছিলো মানুষ সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি। বিভিন্ন ধরনের অধ্যয়ন ও বছরের পর বছর দেখা নানা ঘটনা থেকে একজন নাট্যকার যে অভিজ্ঞতা লাভ করে, তিনদিনের সংগৃহীত তাৎক্ষণিক তথ্যের চেয়ে তার মূল্য বেশি। মহৎ নাটক লেখবার জন্য যা দরকার তা হলো ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা। শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, কিছু তথ্য জোগাড় করে দু-চারজন একসাথে বসে এবং যুক্তি-পরামর্শ-আলোচনা করে নাটক লেখা যায় না। পৃথিবীর কোনো মহৎ নাটকই সেভাবে লেখা হয়নি। কারণ নাটক লেখা কোনো করণিকের কাজ নয়। নাটক একটি শিল্প মাধ্যম। ভিতরে শিল্পবোধ না থাকলে, নাটক কী সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে শুধু কিছু তথ্য জোগাড় করে নাটক লেখা পাগলামির শামিল। পৃথিবীর সকল মহৎ নাট্যকাররা এককভাবেই নাটক লিখেছেন নিজেদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে। নাটক বা সাহিত্যচর্চা একটি সৃষ্টিশীল কাজ। ভিতরের তাড়নায় তা জন্ম নেয়। নাট্যকারের কিছু বলবার থাকলে ভিতর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা বেরিয়ে আসবে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দিয়ে এসব কাজ হয় না। শম্ভু মিত্র সঠিক কথাটাই বলেছেন।
দ্বান্দ্বিক বা শ্রেণীসংগ্রামের নাটক সম্পর্কে ব্রেশ্ট বলেছিলেন, নাটকের মাধ্যমে জীবন্ত বাস্তবকে এমন জীবন্তভাবে জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে যেন তারা কঠিন বাস্তবকে আয়ত্ত করতে পারে। বাস্তবকে জীবন্ত করে তুলে ধরার জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হলো সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা শিল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক জীবনের যথার্থ প্রতিফলন ঘটানো। নাটকের ঘটনা ও চরিত্রকে ঐতিহাসিক, পরিবর্তনশীল এবং দ্বন্দ্বসহ উপস্থিত করা। সমাজ পরিবর্তন করার শিক্ষা দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু কিছুতেই সেটা হবে না নৈতিক শিক্ষা, হবে সমাজবিজ্ঞানের সত্য দর্শকের সামনে উপস্থিত করা। দর্শক যেন নাট্যকারের বক্তব্যে পুরোমাত্রায় প্রভাবিত না হয়ে নিজের মতো ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্ব দ্বারা প্রতিদিনের ঘটনাকে ব্রেশ্ট তাঁর নাটকে আরো বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন। ঘটনার সম্প্রসারণ ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখছেন, ‘ধরুন, আপনারা একটা খুনের দৃশ্য সুন্দরভাবে দেখালেন। আমার সমালোচনার ঝোঁক হবে খুনটাকে ঘিরে এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যায়।’ ব্রেশ্ট খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যায় যেতে চান কেন? কারণ খুনের পেছনে খুনীর স্বার্থ কোথায় সেটা যেমন তিনি ব্যাখ্যা করতে চান, তেমনি এই খুনটির সাথে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সম্পর্কটিও তুলে ধরতে চান। তিনি চান দর্শকরা হয়ে উঠুক সাংসদের মতো। তিনি দর্শকদের বিচারকের আসনে বসিয়ে দিতে চান। দর্শকদের কাছে ব্রেশটের চাওয়া হলো, নাটকের সকল বিতর্কই তারা মন দিয়ে শুনুক এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করুক। তিনি বলেন, মার্কসবাদী চিন্তায় দর্শককে অভ্যস্ত করে তুলতে হলে দু-একজন ব্যক্তিকে খলনায়ক বানানোর চেয়ে পুঁজিবাদ-সৃষ্ট বীভৎসতার স্বরূপ উন্মোচন করাটা জরুরি এবং ব্যক্তির ভূমিকার বাইরে সমাজ ও অর্থনীতির ভূমিকা দর্শকের কাছে স্পষ্ট ও বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলাটা অধিকতর দরকার।
বর্তমান বিশ্বে যে-কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে সমাজবিজ্ঞান চেতনা তথা মার্কসবাদ লেনিনবাদের শিক্ষার যে কী গুরুত্ব সে ব্যপারে বহু মনীষীরাই তাদের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক নাট্যরচনা ও মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে এই সমাজবিজ্ঞানের চেতনা একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। মার্কসবাদী চেতনায় শিক্ষিত না হয়ে সেজন্য শ্রেণীসংগ্রামের নাটক করা যায় না। শ্রেণীসংগ্রামের নাটক করার জন্য মার্কসবাদের জ্ঞান কতোটা জরুরি সে ব্যাপারে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে তাদের মতামত দিয়ে গেছেন। মাও সেতুঙ তার ইয়েনানের ভাষণে শিল্পী সাহিত্যিকদের জন্য মার্কসবাদের শিক্ষা যে কতোটা দরকারি সে ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য রাখেন। মাও সেতুঙ বলেন, জ্ঞানের অভাব বলতে বোঝায় জনগণকে ভালোভাবে না বোঝা। লেখক ও শিল্পীদের সাহিত্য ও শিল্পকলা সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক কাজ হচ্ছে জনগণকে, যাদের জন্য শিল্প-সাহিত্য রচনা করবেন তাদেরকে ভালোভাবে জানা এবং বোঝা। জনগণকে বোঝা ও জানার জন্য মার্কসবাদের শিক্ষা অপরিহার্য। শিল্পী-সাহিত্যিক বা নাট্যকার যাঁরা বুদ্বিজীবী বা শিক্ষিতদের মধ্যে থেকে এসেছেন, যাঁরা মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে এসে শিল্প বা নাটকের চর্চা করতে চাচ্ছেন, তাঁরা যদি চান তাঁদের নাটক বা শিল্প জনগণের দ্বারা গৃহীত হোক তাহলে তাঁদেরকে অবশ্যই মধ্যবিত্ত মানসিকতা, ভাববাদী চিন্তাধারা ও অনুভূতির পরিবর্তন সাধন করতে হবে। নিজেদের পুনর্গঠন করতে হবে। চিন্তাধারা ও মানসিকতার এই পরিবর্তন ও পুনর্গঠন ছাড়া তারা জনগণের জন্য ভালো কিছুই সৃষ্টি করতে পারবেন না। চিন্তার সেই পরিবর্তন ও মানসিকতার পুনর্গঠনের জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষা অপরিহার্য।
মার্কসবাদ লেলিনবাদের শিক্ষার অভাব থেকেই যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির মধ্যে নানারকম সমস্যা দেখা দেয় মাও সেতুঙ সেটা নির্দিষ্ট করেই বলেছেন। তিনি লিখছেন, ‘সর্বশেষ সমস্যা হলো পড়াশুনার সমস্যা। এর দ্বারা আমি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে পড়াশুনা ও সমাজ সম্পর্কিত শিক্ষার কথা বলছি।’ মাও সেতুঙয়ের চিন্তার পক্ষে আরো অনেকেই তাঁদের মতামত জ্ঞাপন করেছেন। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় মার্কসবাদের গুরুত্ব যে কতো বেশি সেটা বোঝা যায় ব্রেশটের বক্তব্য থেকে। ইতিহাসে দেখা যায় রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ব্রেশ্ট কীভাবে মার্কসের দাস ক্যাপিটাল পাঠে ডুব দিয়েছিলেন। ব্রেশ্ট তো বিশ্বাসই করতেন, মার্কসবাদ না বুঝে আধুনিককালে নাটক লিখতে যাওয়া একটা বিড়ম্বনা মাত্র। তিনি আরো বলেছিলেন, শ্রেণীসংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ না নিলে আজকের দিনে আর অভিনেতা হওয়া যায় না। তিনি বলে গেছেন, যাঁরা নিরপেক্ষ, যাদের শ্রেণীসংগ্রামে কোনো আগ্রহ নেই, তারা যেন তাঁর নাটক মঞ্চায়নে হাত না দেন। মার্কসবাদের জ্ঞান ছাড়া শ্রেণী বিশ্লেষণ করা যায় না। আর শ্রেণী বিশ্লেষণ করতে না পারলে ব্রেশটের নাটকের অন্তর্নিহিত সত্যকে যেমন বোঝা যায় না তেমনি তা দর্শকের কাছে তুলে ধরাও যায় না। রাজনৈতিক নাট্যকার উৎপল দত্ত ব্রেশটের মতোই মনে করেন মার্কসবাদের জ্ঞান ছাড়া নাটককে জনগণের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের চরম বিকাশের কালে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান বাদ দিয়ে, সমাজ বিকাশের নিয়ম না জেনে নাটক বা শিল্প সৃষ্টি করতে গেলে শিল্পীর নিজের খেয়ালকেই শুধু প্রশ্রয় দেয়া হবে। মার্কসবাদ বলতে শুধু মার্কসের লেখা বইগুলি বুঝলে ভুল করা হবে। মার্কসবাদ মানে বিজ্ঞানমনস্কতা, ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান রপ্ত করা। মার্কস নিজে মার্কসের লেখা পাঠ করে মার্কস হননি, তিনি বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকেই নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করেছেন। নিজের জ্ঞানকে শানিত করার জন্য মার্কসের প্রিয় একটি বিষয় ছিল চিরায়ত নাটকগুলি পাঠ। তিনি বারবার নাটক পাঠ করতেন। প্রাচীন গ্রীসের নাটকগুলি মূল ভাষায় পড়বার জন্য তিনি গ্রীক ভাষা পর্যন্ত শিখেছিলেন। শেক্সপিয়রের প্রধান প্রধান নাটকের বেশিরভাগ সংলাপগুলি তাঁর মুখস্থ ছিল।
মার্কস বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বহু কিছু আহরণ করে নিয়ে তা নতুন করে আবার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলতে চেয়েছেন তাহলো, যা আমি বলে যাচ্ছি বা লিখে রেখে যাচ্ছি, তা কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার আর বাস্তব জগতকে পর্যবেক্ষণ করে যা লিখে গেছি তা চিরকালীন সত্য নয়, মানুষের নতুন জ্ঞান তাকে নতুনভাবে সমৃদ্ধ করবে। বাতিল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে তার চিন্তা। যেন তাই কেউ বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া অন্ধের মতো তা অনুসরণ না করে। মার্কসের আগে সকলে মনে করতেন তাঁর চিন্তাই শ্রেষ্ঠ, তিনিই যেন সত্যের শেষটা দেখতে পেয়েছেন। ধর্মগ্রন্থের মতো মার্কস নিজের চিন্তাকে ঐশ্বরিক মনে করতেন না। তিনি যে কথাটা বলেছেন, জ্ঞানের জগতে তিনি ধ্রুব সত্য নন, জ্ঞানের জগতে শেষকথা বলে কিছু নেই; মার্কসের এই আবিষ্কারটাই হলো মার্কসবাদ। তিনি যা লিখে রেখে গেছেন তা মাটি ফুঁড়ে বের করা নয়। ইতিহাসের বিবর্তনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার আবিষ্কৃত নানা চিন্তাগুলিকে তিনি নিজের চিন্তা সহযোগে সাজিয়েছেন শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে লড়াই করবার জন্য। সকলেই কেন এই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অধ্যয়নের ওপর এতো গুরুত্ব দিয়েছেন? কারণ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে রাজনৈতিক অনুশীলনেরই একটি প্রক্রিয়া। বিপ্লবীই হোক বা প্রতিবিপ্লবীই হোক, রাজনীতি হচ্ছে দুটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর সংগ্রাম, কয়েকজন ব্যক্তি বিশেষের কাণ্ডকারখানা নয়। তার জন্য অনুশীলন অপরিহার্য। সামাজিক অঙ্গীকারাবদ্ধ নাট্যকর্মী মানে শুধু নাটকের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ কর্মীকে বোঝায় না। ইনি এমন একজন কর্মী যিনি সামাজিক দায়িত্ববোধ অনুভব করবেন প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং নাটককে যিনি অনেক গভীরভাবে দেখতে চান, বুঝতে চান ও বোঝাতে চান। নাটককে যিনি সমাজ বিকাশের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সেইজন্য নাট্যকর্মীর দায়িত্ব অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মীদের চাইতে অনেক বেশি কঠিন। তাঁদের একই সঙ্গে নাটক বুঝতে হয়, বুঝতে হয় সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস ও মানুষকে। সেই জন্য নাট্যকর্মীর দরকার হয় দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও রাজনৈতিক পড়াশুনার। রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি ভালো করে আত্মস্থ করতে হয় তাঁকে। সেই প্রস্তুতি ব্যতিরেকে কোনোভাবেই তিনি রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের কর্মী হয়ে উঠতে পারেন না; রাজনৈতিক নাটককে সেবা করতে পারেন না। সেই জ্ঞানের অভাব থেকেই নাট্য রচনা ও মঞ্চায়নের নানা ভুল-ভ্রান্তির জন্ম দেন, কিছু গণ্ডিবদ্ধ শোষক শোষিতদের চরিত্র নিয়ে রচিত হয় নাটকগুলো ।
বিভিন্ন দলগুলো তাদের নাটকে শ্রেণীসংগ্রাম প্রচারের কথা বললেও, তাদের নাটক দেখার পর এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, শ্রেণীসংগ্রাম সম্পর্কে তাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। চরিত্রদের মুখে সংগ্রামী সংলাপ দিয়ে নাটক শেষ করার ঝোঁক যতো প্রবল, নাটকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সেই হারে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তো থাকে না বললেই চলে। তাদের ঘোষণাগুলি ছিল কেবল ঘোষণাই মাত্র, কার্যক্ষেত্রে যার কোনো গুরুত্ব তারা প্রদান করেনি। বক্তব্যের চেয়ে রূপরীতি, নাটকের চেয়ে নাট্যদলের প্রচার সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। নাটকের বক্তব্য প্রমাণ করেছে মধ্যবিত্তশ্রেণীর নাট্যকর্মীদের বৃহত্তম অংশের শ্রেণীসচেতনতা বিপজ্জনকভাবেই দুর্বল। নাট্য সমালোচক অরুণ মুখোপাধ্যায় তাই আক্ষেপ করে বলছেন, যাঁরা মার্কসবাদে বিশ্বাসী নন, যাঁরা শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাসী নন, যাঁরা ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী নন বা ব্যাপারাটা বোঝেন না, তারাও রাজনৈতিক নাটক লিখতে যান এবং নিজেদের নাটককে রাজনৈতিক নাটক বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক থিয়েটার কী, বা তা কী হওয়া উচিৎ এই বোধ এই শিক্ষাটাই এইসব নাট্যকর্মীদের মধ্যে ভীষণ কম। ফলে তাঁদের নাটকে না পাওয়া যায় কোনো মানবিক চিত্র, না হয়ে ওঠে সেগুলো শ্রেণীসংগ্রামের দলিল। রাজনৈতিক নাটক যে কখনই মানবতার বিপক্ষে যায় না, এই ব্যাপারটাও এখন পর্যন্ত তাঁদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে তো মানবতাবাদী দৃষ্টিকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। সেজন্য শোষককে আক্রমণ করাটাকেই তাঁরা নাটকে প্রাধান্য দিয়েছেন, সমাজ বিশ্লেষণকে নয়।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাজনৈতিক নাট্যকার সবদেশে সমকালের রাজনৈতিক সংকট অনুধাবনে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ব্যাখ্যা আত্মস্থ করতে চেয়েছেন। তাঁদের অনিষ্ট থিয়েটারের উদ্দেশ্য ছিল সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করার নিরন্তর প্রচেষ্টা; কি সমাজ বীক্ষণে, কি থিয়েটারের দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনে। কিন্তু যে থিয়েটার রাজনৈতিক সামাজিক প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে বাদ দিয়ে শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করে তার মধ্যে থাকে মধ্যবিত্তসুলভ ঝোঁক। রাজনীতি বাদ দিয়ে প্রতিবাদটাই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে কিংবা শ্রেণীবিদ্বেষহীন ক্ষোভই তাতে প্রকাশ পায়; যার প্রধান কারণ নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব। সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণার অভাব থেকেই এটা হয়ে থাকে। মার্কসবাদী নাটকের কাজ সমাজ-বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা এবং বাস্তবের সম্প্রসারণ ঘটানো। বাস্তবতার সম্প্রসারণ হলো সমাজ বিকাশের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা শিল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক জীবনের যথার্থ প্রতিফলন ঘটানো, তথ্যবহুলতার দ্বারা কল্পনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। ইতিহাসের গতির দিকে চোখ রেখে সেখানে নাট্যকার কল্পনাকে সাজাবেন। ঘটনা ও চরিত্রকে পরিবর্তনশীল ও দ্বন্দ্বসহ উপস্থিত করতে হবে, যেখানে দেখতে পাওয়া যাবে মানুষই মানুষের ভাগ্যের নিয়ামক। মানুষকে হতাশার মধ্যে ঠেলে না দেয়ার জন্যই বাস্তবের সম্প্রসারণ ঘটা দরকার। উৎপল দত্তের জপেনদার ভাষায়, ‘যাহা বাস্তবে ঘটে কেবল তাহাই নাটকের বিষয় নহে, যাহা ঘটিবে, ঘটা উচিৎ তাহাও বাস্তব, সুতরাং তাহাও নাটকের বিষয়।’ এই সম্প্রসারিত বাস্তবতাই বিপ্লবী নাটকের ভিত্তি কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জোর করে নাটকের মধ্যে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া। মার্কসবাদীরা বাস্তবের এই সম্প্রসারণকেই সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় নিয়ে যেতে চান যা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক নিয়মকে তুলে ধরতে হবে। মানুষের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যে সামাজিক সম্পর্কগুলো সম্পর্কিত সেই বাস্তবতার প্রেক্ষিত থেকেই ঘটনাকে বুঝতে হবে, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে দেখতে হবে। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা মানে সমাজের কার্যকারণ সম্বন্ধীয় তথ্যকে উন্মুক্ত করে তুলে ধরা। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা ঘটনার মধ্যে থেকে সেইসব সত্য বের করে আনতে চায় যা শোষিতদের চোখ খুলে দেবে, সুন্দর একটি সমাজের জন্য তাকে সচেতন সংগ্রামী মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে। দু-একটি বা ততোধিক পরাজয়ে হতাশায় মুহ্যমান হবে না। বরং বিশ্ব একদিন শোষিত মানুষের দখলে আসবে সেই বিশ্বাস আরো দৃঢ়তর হবে।
মহৎ নাটকের কাজ বাস্তবকে সামনে নিয়ে যাওয়া, বাস্তবোত্তরে পৌঁছানো। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তার একটা সম্পর্ক থাকে। সেই সামগ্রিক সময়টাকে, সেই সম্পূর্ণ যুগটাকে বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনকে তুলে ধরা যায় না। জীবন মানে সেই সময়ের সমগ্র ব্যবস্থাটার সাথেই তার দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বটাই সেখানে প্রধান। সে দ্বন্দ্ব শুধু বাইরের দ্বন্দ্ব নয়, সমাজ অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রের সাথে সমাজ ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব। বিপ্লবটা নাটকীয়ভাবে রাতারাতি ঘটবে না। সেজন্য দরকার দীর্ঘ প্রস্তুতি। যাঁরা ব্যক্তিবাদের পূজারী তাঁরা ব্যক্তিকে দিয়েই রাতারাতি বিপ্লব ঘটাবার স্বপ্ন দেখেন। পিসকাটর বলেছিলেন, রাজনীতিতেই মানুষ সবচেয়ে পরিস্ফুট, রাজনীতির মধ্যেই মানুষ যথার্থ মানুষ। কিন্তু বিশ্ববিপ্লবের কালে কোন্ দৃষ্টিতে মানুষকে দেখা সমীচীন সেটাই প্রশ্ন। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ববাদের যা অবশিষ্ট ছিল, প্রতিযোগিতার মাঠে নেমে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানুষ এখন পরিচয়হীন। পুঁজিবাদ সত্যিই মানুষকে নামগোত্রহীন সৈনিক করে দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকে দেখা যায়, মানুষের পরিচয় সংখ্যায় রূপ পেয়েছে। নাটকে এই বৃহৎ ঐতিহাসিক চিত্রের পটভূমিকায় মানুষকে দেখতে হবে। বিজ্ঞানের যুগে নাটক লিখতে হলে তাই মানুষ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন; পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে দেখাতে হবে মানুষকে। নাট্যকারের সঙ্গে তাঁর রচিত চরিত্রগুলির সম্পর্ক নৈর্ব্যক্তিক এবং যুক্তি নির্ভর হতে হবে। তাহলেই নাট্যকার চরিত্রগুলির তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। নাটক সর্বদাই হবে নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর কিন্তু নাটকীয়তার কারণে যেন মূল বিষয়বস্তু হারিয়ে না যায় সেটাও নাট্যকারের লক্ষ্য রাখবার ব্যাপার। নাটকে যতোই নাটকীয়তা থাক, যদি তা দর্শককে উন্নততর চিন্তার সাথে পরিচয় না করিয়ে দিতে পারে তাহলে নাটকীয়তা তৈরির ফল হয়ে দাঁড়ায় শূন্য। ফলে তখন যে বাস্তবকে তিনি নাটকে ধরতে চান তা বাস্তবেই থেকে যায়, বাস্তবোত্তর হয়ে উঠতে পারে না। বাস্তবের সম্প্রসারণ সেখানে দেখতে পাওয়া যায় না।