রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা: নানা বিভ্রান্তি
পর্ব ২
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২০
যুক্তরাষ্ট্র পর্ব
বাংলাদেশে গ্রুপ-থিয়েটার আন্দোলন বলে একটা কথা কয়েক দশক চালু ছিল। কথাটা বাংলাদেশে আমদানী হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বহুজনেরই জানা নেই, মূলত ‘গ্রুপ থিয়েটার’ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি নাট্যদলের নাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপকে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সেসব সমস্যা থেকে দূরে ছিল। কিন্তু উনিশশো উনত্রিশ সালের অক্টোবর মাসে সেখানকার শেয়ার বাজারে ধ্বস নামলো। নিউইয়র্কের শেয়ার বাজারে এর কারণে যে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় তা এ তাবৎকালের ধনতন্ত্রের সবচেয়ে চরম ও স্থায়ী সংকট হিসাবে গণ্য। বাণিজ্য মন্দায় অন্যান্য দেশগুলির যে দুর্গতি চলছিল যুক্তরাষ্ট্রও এবার সে দলে ভিড়লো। যে মন্দা চলছিল ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্রও তার শিকার হওয়ায় সেটা এবার রূপ নিল মহাসংকটে। দেখতে দেখতে পৃথিবীময় মহাসংকট ছড়িয়ে পড়লো। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমেই নিম্নের দিকে ধাবিত হলো। সে সময়কার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় সারা পৃথিবীতে উনত্রিশ সালের প্রথম তিন মাসের আমদানি-রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল দশলক্ষ সোনার ডলারের হিসাবে পনের হাজার দুইশো উননব্বই। অথচ তেত্রিশ সালের প্রথম তিন মাসে তা নেমে দাঁড়ালো দশলক্ষ সোনার ডলারের হিসাবে পাঁচশত তিনশো একান্ন। ব্যাংক আর কারবারে টাকা রেখে লাভ নেই মনে করে লোকে টাকা তুলে এনে ঘরে জমাতে লাগলো। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার ব্যাংক বসে গেল। ব্রিটেনের মহাজনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং যোগ্যতম ব্যাক্তিদের একজন মন্টেগু নরম্যান, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর। বিশ্বব্যাপী মহাসংকট সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বললেন যে, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তার বিশ্লেষণ করা আমার শক্তির বাইরে। যেসব বিঘ্নবিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে তার পরিমাণ এত বিপুল, এমন অভিনব এবং এমন অভূতপূর্ব যে, এর আলোচনা আমাকে করতে হবে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা এবং অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে।’
সংকটের কারণ ছিল পণ্যের অভাব নয়, পণ্যের বাহুল্য। প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবীদ হেন্রী স্ট্রাকোশ-এর মতে বাণিজ্য সংকটের দ্বিতীয় বছরেও পৃথিবীর বাজারে এতো মালপত্র মজুত ছিল যে তার দ্বারা পৃথিবী শুদ্ধ মানুষকে তিনমাস কাল খাইয়ে পরিয়ে রাখা যেতো। অথচ চরম অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ এতবেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছিল যে, তারা নিজেরাই যা উৎপাদন করেছিল তাও কেনার সামর্থ তাদের ছিল না। বিশ্বের এই অর্থনৈতিক সংকটে দেখা গেল ক্ষুধায় মানুষ না খেয়ে মরছে। বেকারত্বের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। ইউরোপ আর আমেরিকা মিলে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল তিন কোটি। এর মধ্যে বৃটেনে বিশ লক্ষ, আর যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ। বিশ্বব্যাপী এই মহাসংকট, বিশ্বযুদ্ধের মতোই এর ভয়াবহতা। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই না খেয়ে মানুষ মারা গেল এই ঘটনায়।
মহামন্দার করাল গ্রাস যখন সারা পৃথিবী জুড়ে ধনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল, সেই ভাবনায় মার্কসবাদীরা নতুন করে দিক নির্দেশনা দিতে এগিয়ে এলো। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে থাকলো না। মার্কসবাদ সেখানকার মানুষের চিন্তাকেও নতুনভাবে নাড়া দিলো। প্রথম মহাযুদ্ধের পরিণতিতে তারা বুঝতে পারলো, পুঁজিবাদী সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ হয়, লক্ষলক্ষ মানুষকে মরতে হয়, তেমনি তা দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ। সে সময়কার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শিক্ষিত সচেতন মানুষ জগৎ-জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে। নতুন চিন্তা-ভাবনায় তারা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটেই মার্কসবাদের আলোকে শুরু হলো ধনতন্ত্রবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। জনগণতন্ত্রের মূল্যায়নে আর সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগে ঘনীভূত হলো মতাদর্শগত বিরোধ।
মানুষ তখন সংকট থেকে মুক্তি খুঁজছে। অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ চেয়েছিলেন এ রহস্যের উৎসে পৌঁছুতে। সেজন্য তাঁদের কাজকর্ম চিন্তায় বামপন্থী ঝোঁক লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পাশাপাশি সেই একই অভিঘাতে জেগে উঠলো শ্রমিকশ্রেণী। কমিউনিস্ট পার্টিও সক্রিয় হয়ে উঠলো। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়কার নাটকেও এইসব ঘটনার ছায়া পড়তে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়ার পর রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে বেশকিছু নাট্যকর্মী, এবং পুরানো নাট্যধারাকে অস্বীকার করতে থাকে। পুরানো নাট্যধারাকে তারা বর্জনীয় বলেও ঘোষণা দেয়। যুগদ্বন্দ্বের এই সন্ধিক্ষণে আমেরিকায় নতুন নতুন থিয়েটার আন্দোলন দানা বাঁধে। বিশৃঙ্খল এই বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বহু নাট্যদল যেমন পলায়নপর মনোবৃত্তি গ্রহণ করেছিল, ধনতান্ত্রিক যুগের সমস্যাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ছিলো আত্মমগ্ন, তেমনি আবার নাটককে ব্যবহার করা হলো ধনতান্ত্রিক সংকটের বিরুদ্ধে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে প্রচারে। সংগঠিত হলো শ্রমিক নাট্যদল।
নিউইয়র্কেই কারখানা শ্রমিকদের অনেক দল তখন নাটক করতে আরম্ভ চলেছে। বিশের দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রের এই বামপন্থী থিয়েটার আন্দোলনের জন্মই হয়েছিল শ্রমিকদের দ্বারা শ্রমিকদের কথা বলার জন্য শ্রমিকদেরই একটা প্রচেষ্টা হিসাবে, যা ছিল শ্রেণীসংগ্রামের থিয়েটার। তারা নাটক করতো কোনো সভা সমাবেশে, যারা আন্দোলনে সংগ্রামে জড়িত তাদের জন্য। বিশের দশকের শেষে পার্টি ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর এরকম প্রলেতারিয়েত নাট্য সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছিল। নাটকে পূর্ব-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকজন ছাড়াই তারা নাটক করতো। প্রলেতারিয়েত নাট্যকর্মীরা সাম্যবাদের পক্ষে লেখা জোগাড় করাটা নিজেদের দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছিল; যার লক্ষ্য ছিল সেইসব লোকদের নিয়ে সেই ধরনের নাটকই মঞ্চায়ন করা যা ধর্মঘটী শ্রমিকদের উৎসাহিত করবে, বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়ে শ্রমিকদের মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে। শ্রমিক অভিনেতারা ছিলেন খণ্ডকালীন নাট্যকর্মী। নিজেদের অবসর সময়টাকে তারা বিসর্জন দিয়েছিলেন নাটকের মধ্য দিয়ে সহকর্মীদের শ্রেণী সচেতন করে তোলার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল থিয়েটার, লিভিং নিউজ পেপার থিয়েটার, ওয়ার্কার্স ড্রামা লীগ, নিউ প্লেরাইটস থিয়েটার, এ্যাজিটপ্রপ ট্রুপ, ব্লু ব্লাউজ ট্রুপ, লীগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, থিয়েটার ইউনিয়ন, থিয়েটার গিল্ড, লেবার স্টেজ; প্রভৃতি বামপন্থী থিয়েটারগুলি পিসকাটরা আর ব্রেশটের এপিক থিয়েটার বা জার্মানী এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এ্যাজিটপ্রপগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্ট হয়েছিল। বামপন্থী এই থিয়েটারগুলি যেসব নাটক মঞ্চস্থ করতো তাকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ইউরোপীয় নাট্যকারদের নাটক, যার অধিকাংশই এক্সপ্রেশনিস্ট, অ্যাকটিভিস্ট ও লিভিং নিউজপেপার। এ্যাজিটেশন-প্রোপাগান্ডার নাটক, এতে ইউরোপীয় এবং রাশিয়ান দু ধারারই প্রভাব ছিল। আর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যকারদের লেখা নাটক, যেখানে সামাজিক সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। এর অধিকাংশই ছিল ফ্যাসি-বিরোধী নাটক। ‘রেইন ফ্রম হেভেন’, ‘দ্য অ্যাডিং মেশিন’, ‘উই দ্য পিপল’ নাটক তিনটি ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিবাদ।
মিলিতভাবে কাজ করার জন্য উনিশশো উনত্রিশ সালে ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটারের উদ্যোগে শ্রমিকদের প্রায় বারোটি দল “ওয়ার্কার্স ড্রামাটিক কাউন্সিল”-এ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ড্রামাটিক কাউন্সিল-এর সচিবের মতে দলগুলো পুরোদমে নাটক মঞ্চায়ন করছিল। নিজস্ব মঞ্চ না থাকায় তারা নাটক করতো বিভিন্ন সমাবেশে, বাইরের দর্শকরা যার খবরাখবর পেতো না। নাট্যদলগুলোর বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল সাম্যবাদী দলের তৃতীয় স্তরের বৈপ্লবিক নীতিকে এগিয়ে নেওয়া। উনিশশো উনত্রিশ সালে কমিনটার্ন বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ঘোষণা করেছিল যে, উনিশশো সাতাশ সালে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার পর অবক্ষয়ের বছর। সাম্যবাদী দলের কর্মনীতি অনুসারে তৃতীয় স্তর ছিল আসন্ন বিপ্লবের প্রস্তুতির কাল। যুক্তরাষ্ট্রে ও অন্যান্য দেশে মহামন্দার ক্ষতিকর প্রভাব পুঁজিবাদ বিরোধী বক্তব্য সমূহকে যথার্থতা দান করেছিল। তৃতীয় স্তরে পার্টির সকল কাজকর্মের মূলে ছিল ট্রেড ইউনিয়ন লীগের ‘শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী’ মতবাদটি। স্তালিনবাদে বিশ্বাসের দৃঢ়তা থেকে শ্রেণীসংগ্রামকে এরা খুব কট্টরভাবেই গ্রহণ করেছিল।
পূর্বে উল্লেখিত ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটার ছিল এই নতুন নাট্যান্দোলনের সর্বজন স্বীকৃত পুরোধা। দলের প্রতিষ্ঠাদের মধ্যে আলবার্ট প্রেন্টিস, লুই ডিস্যানেন্টস এবং ফ্লোরেন্স রাউ সহ বেশ কয়েকজন উনিশশো ছাব্বিশ সালে পুরানো ‘ওয়ার্কার্স থিয়েটারে’ কাজ করেছিলেন এবং তা বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটারে। গোল্ডের ‘স্ট্রাইক’ নাটকটি ছিল স্বল্পায়ূ ওয়ার্কার্স থিয়েটার কর্তৃক প্রথম এ্যাজিটপ্রপ নাটক সম্ভবত যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম লিখিত ও মঞ্চায়িত। নাটকটির বিষয়বস্তু ছিল প্রাধান্যের জন্য শাসক ও শাসিতশ্রেণীর মধ্যকার চিরন্তন সংগ্রাম। গোল্ডের লেখা ছিল সবসময় প্রকাশ্যভাবে সাম্যবাদী দলের পক্ষে। ওয়ার্কার্স ল্যাবরেটরি থিয়েটার-এর পুরোধারা ছিলেন প্রথম থেকেই বিপ্লবী চিন্তার অধিকারী যাদের উদ্যোগে শ্রমিকশ্রেণীর নাট্যদলগুলো সারা নিউইয়র্ক ও নিউইয়র্কের বাইরে গঠিত হতে থাকে। প্রথম দিকে এই নাট্যদলগুলোর লক্ষ্য ছিলো মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলা। নাটকগুলো তাই বেশিরভাগ সময় হয়ে পড়তো শ্লোগানধর্মী। শ্রমিকদেরকে শ্রেণীসচেতন করে তোলার পাশাপাশি এদের নাটকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা থাকতো। আমেরিকার এই বামপন্থী থিয়েটারগুলোর নামডাকের বহরই ছিলো আলাদা। পিটারসন লিখেছিলেন যে, শ্রমিক দর্শককুল আর সবার চেয়ে এমন এক নাটকের উত্তেজনা দেখতে চাইতো যে পথ হবে পরিষ্কার, তীক্ষ্ণ আর স্পষ্টভাষী এবং যে পথে স্বচ্ছতা থাকবে।
ভাসার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের প্রধান হ্যালি ফ্ল্যানাগান ‘থিয়েটার আর্টস মান্থলি’তে শ্রমিকদের একটি প্রযোজনা সম্পর্কে আলোচনায় কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করায় ল্যাবরেটরি থিয়েটারের প্রেন্টিস ক্ষুদ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের নাটকে নাকি পুনরুক্তি আছে; অবশ্যই, যদিও তা বুর্জোয়া থিয়েটারের বেডরুমের দৃশ্যগুলোর মতো ন্যাক্কারজনক নয়। আমরা অবশ্যই পুনরুক্তি করবো শ্রমিকদের হৃদয়ে আমাদের ঐক্যের কথা পৌঁছে দেয়ার জন্য।’ ‘শ্রমিকদের হৃদয়ে আমাদের ঐক্যের কথা পৌঁছে দেয়া’ প্রেন্টিসের এই শব্দগুচ্ছই ছিল থার্ড পিরিয়ডের মর্মবাণী। তবে খুব শীঘ্রই তারা নিজেদের কট্টর মনোভাব ত্যাগ করলো। পার্টির নির্দেশেই তিন বছরের মধ্যে শ্রমিকদের নাট্যদলগুলো সংকীর্ণতা থেকে নিজেদের মুক্ত করলো। সে সংকীর্র্ণতা মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা হলো প্রথমে তারা শ্রমিকশ্রেণী ছাড়া অন্যদেরকে নিজেদের দলভুক্ত বা সংগ্রামের সাথী মনে করতো না। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের পক্ষে এটা অনুধাবন করা সম্ভব হলো যে, কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কহীন কোনো কোনো দলও রাজনৈতিক সামাজিক নাটকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ব্রডওয়ের একজন প্রযোজকও কখনও কখনও এমন নাটক উপহার দিতে পারেন যা বামপন্থীদের মনোযোগ লাভের যোগ্য। পার্টির এই সহনশীল মনোভাব বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী দলগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কমিন্টার্নের ক্রমপরিবর্তিত নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বের প্রেরণাতেই অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিম্নস্বরেও জনতার হৃদয়ে পৌঁছানো যায় এবং বিপ্লবের জন্য হৈ চৈ বিহীন শিক্ষামূলক নাটকও যথেষ্ট কাজ দেয়। বেশির ভাগ এ্যাজিটপ্রপের নাটকগুলোই ছিল শ্লোগানসর্বস্ব, অবশ্য ধীরে ধীরে দলগুলো উপযুক্ত নাট্যপদ্ধতি খুঁজে পেয়েছিল। ফ্রীডরিশ ভোলফ ইন্টারন্যাশনাল লিটারেচার-এ লিখেছিলেন, ‘নিউইয়র্কের থিয়েটার হলো সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলির বামপন্থী থিয়েটারের মধ্যে যথেষ্ট শক্ত এক ঘাঁটি।’ কিন্তু সেখানের নাটক হতো উচ্চকিতভাবে বিপ্লবের পক্ষে আর তা ছিল যথেষ্টরকম শ্লোগানধর্মী।
যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটার ইউনিয়ন ছিল ওয়ার্কার্স ল্যবরেটরি থিয়েটারের মতোই আর একটি নাট্যদল। উনিশশো তেত্রিশ সালে থিয়েটার ইউনিয়নের জন্ম শ্রমিকদের নিয়ে মার্কসবাদী সংগ্রামী নাটক করার জন্য। লীগের সহযোগিতা ও সাম্যবাদী দলের সাথে সংশ্রব ছাড়াই থিয়েটার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিনা বেতনের স্বেচ্ছাব্রত সদস্যদের নিয়ে এই থিয়েটার ইউনিয়ন গঠিত ছিল। থিয়েটার ইউনিয়ন হলো নিউইয়র্ক সিটির প্রথম পেশাদার থিয়েটার; এই দলের মূলমন্ত্র ছিল সেই মার্কসীয় শ্লোগান, ‘থিয়েটার হচ্ছে হাতিয়ার’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের নাটক মঞ্চস্থ করা, যে নাটক লেখা হয়েছে শ্রমিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উনিশশো চৌত্রিশ সালে এই দলটি মঞ্চস্থ করে মল্টৎজ স্ক্লা-র যুদ্ধ-বিরোধী নাটক ‘পিস অফ আর্থ’। থিয়েটার ইউনিয়নের প্রথম সফল প্রযোজনা ছিল ‘সেইলর্স অফ কট্টরো’। অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের কট্টরো উপসাগরে অষ্ট্রিয় নৌ-বাহিনীর বিদ্রোহের বাস্তব ঘটনাই ছিল ওই নাটকের উপাদান। নাটকটি যেমন নাট্যগুণ সমৃদ্ধ ছিল, তেমন এখানে কখনই শ্লোগানধর্মিতা বড় হয়ে ওঠেনি। বিদ্রোহের ব্যর্থতার তুলনায় বিদ্রোহের সাহসিকতার দিকটিকেই এ নাটকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল এবং নাটকটির অভাবনীয় সাফল্যের পিছনেও মূল কারণ ছিল এগুলিই। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে থিয়েটার ইউনিয়ন প্রযোজনা করে ব্রেশ্টের ‘মাদার’। থিয়েটার ইউনিয়নের শেষ দুটি প্রযোজনা ছিল ভিক্টর উলফসমের ‘বিটার স্ট্রীম’ এবং জন হাওয়ার্ড লসনের ‘মার্চিং সঙ’।
থিয়েটার ইউনিয়ন উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে এটা বড় গলায় বলতে পারতো যে ইউনিয়নের আগের চারটি প্রযোজনা পাঁচ লাখ লোক দেখেছে। তার মধ্যে পঁচাত্তর ভাগ মানুষই ছিল শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগ আবার এর আগে কোনো নাটক দেখেনি। থিয়েটার ইউনিয়ন ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন এক সংগঠন। স্বল্প মূল্যের টিকেটে দর্শকদের নাটক দেখানো ছিল এই দলের লক্ষ্য। মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিক দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে আসা। পেশাদার মঞ্চে বামপন্থী নাটক মঞ্চায়ন করার জন্য দুটো দলের নাম সবার আগে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি থিয়েটার ইউনিয়ন ও দ্বিতীয়টি গ্রুপ থিয়েটার। থিয়েটার ইউনিয়নের আগেই গ্রুপ থিয়েটার-এর জন্ম। থিয়েটার ইউনিয়ন যেমন মার্কসবাদী নাটক মঞ্চায়ন করবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল গ্রুপ থিয়েটার-এর লক্ষ্য তা ছিল না। গ্রুপ থিয়েটারের জন্মের প্রেক্ষাপটটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন শ্রমিকশ্রেণীর এ্যাজিটপ্রপগুলো প্রচারণামূলক শ্লোগানসর্বস্ব নাটক মঞ্চায়ন করছিল, সেই সময় পেশাদার মঞ্চে জন্ম নেয় নতুন এক নাট্যদল; এই নাট্যদলের নামই ‘গ্রুপ থিয়েটার’। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যুগে আমেরিকার নিউইয়র্কে হ্যারল্ড ক্লারম্যান, লী স্ট্রাসবার্গ, চেরিল ক্রফোর্ড, ক্লিফোর্ড ওডেটস প্রমুখ কয়েকজন তরুণ নাট্যকর্মী মূলত আমেরিকার ব্রডওয়ে থিয়েটারের বিরোধিতায় গ্রুপ থিয়েটার নাম দিয়ে একটি নাট্যদল গঠন করেন। বিশ শতকের বিশের দশকে যারা থিয়েটার গিল্ডের প্রযোজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যেই কয়েকজন স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই গ্রুপ থিয়েটার দলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। থিয়েটার গিল্ডের আওতার মধ্যে থেকেই তারা প্রথম উনিশশো উনত্রিশ সালে ‘রেড রাস্ট’ নাটকটি অভিনয় করেন। রুশ বিপ্লবের গোড়ার দিকের বিষয় নিয়ে রচিত নাটক রেড রাস্ট, সেই সময় খুব সাড়া জাগিয়েছিল নাটকটি। পরের বছর তারা মঞ্চস্থ করে রুশ নাট্যকার তেত্রিয়াকভের ‘রোর চায়না’। উনিশশো একত্রিশ সালে মঞ্চস্থ করে পল গ্রীনের লেখা ‘হাউস অব কনেলি’। পল গ্রীনের লেখা হাউস অব কনোলি নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার নিউইয়র্কের নাট্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। গ্রুপ থিয়েটার দর্শকের সামনে হাজির হলো সম্পূর্ণ নতুন ধারার নাটক নিয়ে। সেখানে শিল্প ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মেলবন্ধন ঘটাবার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
গ্রুপ থিয়েটার একটা বিশেষ নাট্যদলের নাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। যারা উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের ক্লিফোর্ড এর লেখা ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার পর বামপন্থী সংস্থা হিসাবে পরিচিত হলো। নাটকটি সে সময় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। নাটকটি নিউইয়র্ক শহরের অবহেলিত ট্যাক্সি চালকদের অবস্থা নিয়ে রচিত। হ্যারল্ড ক্লারমানের ভাষায় নাটকটি ছিল তিরিশের দশকের প্রসব বেদনা। যুব সমাজ এর মধ্যে নিজেদের খুঁজে পেয়েছিল। বস্তুত এ-নাটকে অভিনেতা এবং দর্শক মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন সমালোচকরা। নিউইয়র্কের বাকভঙ্গি ওডেট্সের ভালোভাবে আয়ত্তে থাকায় ট্যাক্সি চালকদেরকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন, পূর্বের কোনো এ্যাজিটপ্রপে যা দেখা যায়নি। ঘটনাস্থল শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সভা, মালিক পক্ষের একটি লোক ইউনিয়নের মুখপাত্র হয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট না করার পরামর্শ দিচ্ছে। শ্রমিকরা তার যুক্তি মেনে নিতে পারছে না। মঞ্চে ঘটনাসমূহ বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হলেও সামগ্রিকভাবে তা এ্যাজিটপ্রপ-এর রীতি অনুযায়ী শোষক ও শোষিতশ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দেরই প্রকাশ। পরিশেষে শোষিতদের ঐক্য ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নাটকটির যবনিকাপাত হয়। ওডেটস কিছুকাল পার্টির সদস্য ছিলেন সে কারণে পার্টির চিন্তার সাথে তার নাটকের যথেষ্ট সামঞ্জস্য ছিল। লেফটি নাটকে ধর্মঘটকে সমর্থন করা হয়, পার্টির প্রশংসা করা হয়, তবে তাতে সোভিয়েতপন্থী শ্লোগান বা সশস্ত্রবিপ্লবের ডাক ছিল না।
উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের জুন মাসে ওয়েটিং ফর লেফটির পূর্বে দ্য লিগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার এলিয়া কাজান ও আর্ট স্মিথ রচিত ‘ডিমিত্রফ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে, যা ছিল খুবই সাহসী প্রযোজনা। নাটকটির মূল বক্তব্য ছিল হিটলারের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে। ডিমিত্রফ লেখা হয়েছিল উনিশশো তেত্রিশ সালে রাইখস্টাগে অগ্নিসংযোগে জড়িত বলে অভিযুক্ত জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান আর্নস্ট থেলমান ও আর্নস্ট টগলারের মুক্তির দাবিতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য। পরবর্তী সময় প্রমাণিত হয়েছিল কমিউনিস্টরা কেউ ঐ অগ্নিকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। হিটলারের লোকরাই সে অগ্নিসংযোগ করেছিল। মাত্র বিশ মিনিটের এ নাটকটি দর্শকদের বেশ আলোড়িত করেছিল। শ্রেণীসংগ্রামের ব্যাপারটি এ নাটকে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। নাটকটি ছিল মূলত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। নাটকে ডিমিত্রফের একটি সংলাপ ছিল, বিপ্লবী জনতার দাবির কারণে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু টগলার এখনও কারাগারে এবং থেলমান শৃঙ্খলাবদ্ধ। আমাদের থামলে চলবে না। অনমনীয় শক্তি ও সাহসের সাথে আমাদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কমরেডদের মুক্ত করতেই হবে। নাটক হিসাবে ডিমিত্রফ যে খুব উন্নত মানের ছিল তা নয় কিন্তু নাটকটির বক্তব্য ছিল জোরালো। ডিমিত্রফ নাটকটিই ওয়েটিং ফর লেফটির জন্য রাস্তা তৈরি করে দেয়। ওয়েটিং ফর লেফটির ত্বরিৎ সাফল্যের প্রধান একটি কারণই হলো ওডেটস মধ্যবিত্তশ্রেণীর সমস্যার কথা মনে রেখে নাটকটি লিখেছিলেন। সুতরাং ব্রডওয়ের দর্শকগণ এমন চরিত্রদের মধ্যে বিদ্রোহ গড়ে উঠতে দেখলেন যাঁদের সঙ্গে তাঁরা নিজেদের মিল খুঁজে পেলেন।
ডিমিত্রফের সমস্যাটি ছিল বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ও আন্তর্জাতিক। পার্টির শ্রমিকদের কাছে এ নাটকের সামান্য মূল্য থাকলেও, পার্টি বহির্ভূত মধ্যবিত্তদের কাছে এর কোনো আবেদন ছিল না। তার প্রধান কারণ ছিল, মহামন্দার কালে আমেরিকানদের প্রধান সমস্যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সমর্থন বা হিটলারের নিন্দাবাদ নয়, সে সময় জীবিকা অর্জনের কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছিলো। সেজন্য ওয়েটিং ফর লেফটির আবেদন ছিল অনেক বেশি। গ্রুপ থিয়েটার সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এড়াতে না পেরে বামপন্থী নাটক করলেও দলটি ছিল মধ্যবিত্তদেরই। শ্রমিকশ্রেণীর এ্যাজিটপ্রপগুলো তখন যে নাট্যধারার জন্ম দিয়েছিল, বিদ্রোহী কোনো নাট্যদলের পক্ষেই তার বাইরে থাকা সম্ভব ছিল না। গ্রুপ থিয়েটারকে তাই বামপন্থী নাটকের পথেই পা বাড়াতে হয়। যদিও এই দলটি ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাটকে সোচ্চার বক্তব্য রাখে তবুও এই দল গঠনের পিছনে একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে স্টার সিস্টেম চালু হয়েছিল অর্থাৎ থিয়েটারের যেসব বড় বড় স্টার ছিলেন তাঁরা থিয়েটারের ওপর চেপে বসেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দ্য গ্রুপ থিয়েটার বিদ্রোহ করেছিল।
যখন পেশাদার মঞ্চে তারকাদের দেখিয়েই অর্থোপার্জন করা, বাণিজ্য চালানো রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল; তখন গ্রুপ থিয়েটার ছিল তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আবেগধর্মী এক প্রতিবাদ। তারকা নির্ভর পেশাদার মঞ্চে প্রযোজনার মান রক্ষা করার দিকে নজর ছিল না। গ্রুপ থিয়েটারের স্রষ্টারা স্টার সিস্টেমের বিরুদ্ধে টিম ওয়ার্ক তৈরি করার জন্য দলের নাম গ্রুপ থিয়েটার দিয়েছিলেন। স্তানিশ্লাভস্কি নির্দেশিত গ্রুপ অ্যাকটিং বা দলীয় অভিনয় অনুসরণ করতেন বলেই এ দলের নাম হয়েছিল গ্রুপ থিয়েটার। যার অর্থ নাট্যশালায় বিশেষ কেউকেটাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না কিংবা দু-একজন বিশেষ অভিনেতা অভিনেত্রীর আস্ফালনের আখড়া হয়ে উঠবে না। ব্যক্তিপূজা তখন স্বৈরাচারের নামান্তর। ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে মানুষ তখন সরব। নাটকে যখন ব্যক্তিপূজা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলো এবং ব্যক্তিপূজার নামে নাটক আর নাটকই থাকছিল না, ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে পরিণত হয়েছিল, সেই সময় গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা ছিল তার বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদ। যুগের সন্ধিক্ষণেই সেদিন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টির চিন্তা তখন সচেতন মানুষদের মধ্যে প্রসারিত হতে আরম্ভ করেছিল। শুধুমাত্র গ্রুপ থিয়েটার নয়, সে সময়কার বিভিন্ন স্বাধীন থিয়েটারগুলোতেও এই সত্য লক্ষ্য করা যাবে। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে জায়গা ছেড়ে দিতে থিয়েটার তখন রাজি নয়। সেজন্য গ্রুপ থিয়েটার-এর নাটকে সমষ্টিবদ্ধভাবে সাংগঠনিক পদ্ধতিতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। গ্রুপ থিয়েটার-এ কোনো ব্যক্তিবিশেষের মূল্য নেই, সবটাই সেখানে দলগত। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দ প্রচলনের সার্থকতা এখানেই।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ থিয়েটার নাট্য প্রযোজনায় যথেষ্ট বামপন্থী ভূমিকা রাখলেও সংগঠনটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মানসম্পন্ন প্রযোজনা তৈরি করা এবং অন্যদিকে গোষ্ঠীবদ্ধ অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো। দলটি ছিল সম্পূর্ণ পেশাদার তবুও তাদের কতোগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল যা বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবেই ঘোষিত হয়েছিল। বাণিজ্যিক থিয়েটারে বাণিজ্য বা মুনাফা লাভই ছিল বড় কথা। প্রযোজনার মান নিয়ে তারা ভাবতো না। তাদের লক্ষ্য ছিল দর্শকদের মনোরঞ্জন করা এবং অর্থোপার্জন। বাণিজ্যিক থিয়েটারের নাট্যকাররা স্বাধীন ছিলেন না, মালিকের কিংবা নাট্যদলের চাহিদা মতো তাঁকে নাটক লিখতে হতো। নাট্যকার ছিলেন সেখানে পুঁজির দাস। গ্রুপ থিয়েটার-এর কোনো মালিকানা ছিল না। কোনো পুঁজি বিনিয়োগকারী ছিল না। বেশ কয়েকজনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গ্রুপ থিয়েটার পরিচালিত হতো। গ্রুপ থিয়েটারের ঘোষণাপত্রের মধ্যেই বলা ছিল, বাণিজ্যিকভাবে তারা নাটক করবে না। সে দেশি বা বিদেশি নাটক যাই হোক না কেন। সেজন্য সেখানে নাট্যকারের স্বাধীন চিন্তা বা মতামতের মূল্য ছিল। বাণিজ্যিক থিয়েটারের মতো নাটককে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেয়ার দায়দায়িত্ব নাট্যকারের ছিল না। নাট্যকাররা নিজেদের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিকে সেখানে প্রকাশ করতে পারতেন বলেই ক্লিফোর্ড ওডেটসের মতো বামপন্থী চিন্তার নাট্যকার নাটক লিখে দ্রুত সাফল্য লাভ করেছিলেন।
ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’ ও ‘টিল দা ডে আই ডাই’ মার্কিন নাটকের ইতিহাসে স্মরণীয় দুটি নাম। দুটি নাটকই লেখা হয়েছিল ধনবাদের বিরুদ্ধে। মনে রাখার ব্যাপার হলো, গ্রুপ থিয়েটার-এর ঘোষণার কোথাও ধনবাদের বিরুদ্ধে নাটক মঞ্চায়ন করা বা কার বিরুদ্ধে কী ধরনের নাটক মঞ্চায়ন করবে তার কিছুই বলা ছিল না। মূল লক্ষ্যটি ছিল শুধুমাত্র দলগতভাবে নাটক মঞ্চায়ন করা। ঘটনাস্রোতই তাদেরকে ধনবাদের বিরুদ্ধে নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী করে। নাটক যেহেতু সমাজের দর্পণ, সেজন্য সমকালীন ঘটনাস্রোত থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে সার্থক নাটক লেখা যায় না। যে-কালে, যে-জনমণ্ডলীর মধ্যে মানুষ বাস করে তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও সংগ্রামকে ব্যক্ত না করলে নাটক বৃহত্তর জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। সেজন্যই গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম নাটকগুলো দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, যদিও প্রযোজনার গুণে তা খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিল বুদ্ধিজীবী মহলে। প্রথমদিকে নাটকগুলোর দর্শক সাফল্য না থাকার কারণে গ্রুপ থিয়েটার আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই দিক থেকে বামচিন্তার নাটক ওয়েটিং ফর লেফটি তাকে যেমন সুনাম এনে দেয় তেমনি এনে দেয় আর্থিক সাফল্য। স্বভাবতই গ্রুপ থিয়েটার পরের প্রযোজনাগুলিতে আরো বেশি বামপন্থী চিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সরকারের রোষানলেও তাকে পড়তে হয়। ওয়েটিং ফর লেফটি ধনবাদী সমাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা ছিল এক ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ। ধনবাদী ব্যবস্থার তারা শুধু সমালোচনা করেছে তবে সেই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য ছিল না।
ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর ওয়েটিং ফর লেফটি যখন মঞ্চস্থ হয় ব্রেশ্ট তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি এ নাটক দেখে লিখেছিলেন যে, ওয়েটিং ফর লেফটি নাটককে তিনি যথেষ্ট মূল্য দেন তবে কোথাও যেন একটা গোলমাল রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি এ নাটককে বামপন্থী খেয়ালিপনা হিসাবেই দেখেছিলেন এবং তিনি সমালোচক জেরোমকে সেই খেয়ালিপনা শুধরে দেয়ার জন্য নিয়মিত লিখতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। গ্রুপ থিয়েটার মার্কসবাদী ধারায় সমাজ পরিবর্তন চায়নি আবার সেদিনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেও অস্বীকার করতে পারেনি। পিসকাটরের স্ত্রী মারিয়া লে পিসকাটর গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশংসা করলেও তিনি দলটিকে খুব বিপ্লবী বলে মনে করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের এই গ্রুপ থিয়েটার খুবই সুনাম অর্জন করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সে খ্যাতি ছিল প্রায় আকাশচুম্বি।
লন্ডনেও উনিশশো তেত্রিশ সাল থেকে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নাম নিয়ে আর একটি দল বেশ কিছুকাল নাটক করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ঋত্বিক ঘটকও ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যদল গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। চল্লিশের দশকে উত্তর ভারতে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিল। নাট্য আন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি এখন বহুল ব্যবহৃত। তবে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ নামের যে খ্যাতি বা গ্রহণযোগ্যতা তা এসেছিল অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের নাট্য সংস্থাটি থেকেই। সে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে, মার্কিন দেশজাত গ্রুপ থিয়েটার সেখানে যে ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছে তার সাথে মার্কসীয় রাজনীতি কিংবা গণ আন্দোলনের কতোটা সম্পর্ক ছিল তা যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নাটকে গ্রুপ থিয়েটার শব্দ দুটি অবশ্যই তাদের মূলগত উত্তরাধিকার নিয়ে প্রযুক্ত হয়নি। গ্রুপ থিয়েটার শব্দটি প্রথম যে লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল পরে আর সে লক্ষ্যে স্থির থাকেনি। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শব্দের অর্থ ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। বাংলার নাট্য আন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটার সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা। যুক্তরাষ্ট্রে যে স্টার সিস্টেম বা তারকা প্রথার বিরুদ্ধে গ্রুপ থিয়েটার-এর জন্ম, গ্রুপ থিয়েটারের অধিকাংশরাই পরবর্তীতে সেই ‘স্টার’ বা ‘তারকা’ হয়েই দেখা দেয়। আর প্রতিষ্ঠা লাভের পর এঁরা আর গ্রুপ থিয়েটার-এর সাথে সম্পর্কিত না থেকে ব্রডওয়ের অন্য থিয়েটার ও হলিউডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। মার্লেন ব্রান্ডো পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের ‘সুপার স্টার’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এলিয়া কাজানও ‘স্টার’ হিসাবে স্বীকৃতি পান। তবে ক্লিফোর্ড ওডেটস-এর অভ্যুত্থানও যেমন আকস্মিক, পতনও তেমনি দ্রুত। সেই সময় বামপন্থী নাট্যকারদের মধ্যে ক্লিফোর্ড ওডেটস ছিলেন সবচেয়ে বেশি সফল ও সর্বজনস্বীকৃত। নাটক লেখা একরকম ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী জীবনে তিনি হয়েছিলেন হলিউডের চিত্রনাট্য লেখক। শেষ দিকে এসে তিনি মার্কসবাদেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। মধ্যবিত্তর বিপ্লব প্রচেষ্টা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনই হয়। নানা বিভ্রান্তি সেখানে লক্ষ্য করা যায়, সঠিকভাবে মার্কসবাদ আত্মস্থ না করার ফলে। বিভিন্ন নাট্য আন্দোলনে বারবার সেটা লক্ষ্য করা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রে উনিশশো ত্রিশ সালে তৈরি হয় প্রলেতারিয়েত মঞ্চ। রক্ষণশীল সমালোচকদের চোখে এরা ছিল বিপ্লবী এবং খুবই ক্ষমতাশালী। জার্মানী এবং রাশিয়া থেকে এরা এ্যাজিটপ্রপ ভাবনা আহরণ করেছিল। প্রায় প্রস্তুতিহীন নাটকগুলিতে দর্শকরা কখনই শিল্প খুঁজে পেতো না, পেতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক-ন্যায়বিচারের সোচ্চার দাবি। কখনও কখনও রাজনীতিও দূরে সরে যেতো। তবে নাটকগুলো সর্বদাই অফুরন্ত ভাবাবেগে বোঝাই হয়ে থাকতো। সুরুচিসম্পন্ন চানিন থিয়েটারে যে কেউ দেখতে পেতো মুষ্টিবদ্ধ উত্তেজিত হাত, ধনাঢ্য হেকশচার থিয়েটারে শোনা যেতো মানবপ্রেম-বিরোধী আন্দোলনের ঝড়, সমৃদ্ধশালী সাট্টোন থিয়েটারে বেসরকারি মালিকানার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার ঝড় উঠতো এবং নিউ স্কুল ফর সোস্যাল রিসার্চে প্রগতিশীল বিবাদ-বিতর্কের তুফান ছুটতো। চার বছর ধরে প্রলেতারিয়েত মঞ্চে সৌখিন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে এমন সব নাটক অভিনয় করা হয় যার বিষয়বস্তু ছিলো মহামন্দা বা নিউইয়র্কের তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। চড়া গলায় চটকদার ভঙ্গীতে লড়াইয়ের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে শুরু হয়েছিল এই জঙ্গী থিয়েটার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক থিয়েটার তো নয়ই, তৎকালীন সামাজিক থিয়েটার গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথাও সেখানে উহ্য থেকেছে। রাজনৈতিক থিয়েটার কী, কেন তার প্রয়োজন, কারা সেই নাটকের লক্ষ্য; এরকম বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাদের চিন্তাভাবনা স্বচ্ছ ছিল না। সময়ের বাস্তবতায় কিছুটা আবেগ নিয়ে, কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে নাট্যচর্চাকে সামান্য পড়াশুনা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই বিপ্লবী করে তুলতে চেয়েছিলেন, যা শেষ বিচারে কখনো কখনো বিপ্লবের বিরুদ্ধেই চলে যায়।
সাম্যবাদী দল থেকে উনিশশো তেত্রিশ সালে সরাসরি পরামর্শ দেয়া হলো যে, থিয়েটারের সদস্যগণকে ব্যক্তি এবং বিভিন্ন শ্রমিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর যথাযথ উপস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিপ্লবী থিয়েটারকে অবশ্যই নরমান থমাস, সোশালিস্ট পার্টি বা আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার-এর লোকদের নিয়ে স্থূল ক্যারিকেচার ও নিছক গালাগালি করে নাটক করা বন্ধ করতে হবে। বিপ্লবী থিয়েটারের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য এটা অতি আবশ্যক। দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে প্রসারিত হওয়ার ফলে পেশাদার অনেক নাট্যকর্মীকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত করা সম্ভব হলো। সোভিয়েতপন্থী শ্লোগানগুলো বাদ দিয়ে প্রোলেতারীয় নাট্যচিন্তায় পরবর্তী সময় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেল তা হলো যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, নিষেধাজ্ঞা ও সাধারণ মানুষের বাঁচার দাবি। বিশেষ করে আমেরিকান নাট্যকারদের লেখা নতুন নাটকগুলো ছিল ভিন্ন প্রকৃতির, সেখানে সামাজিক সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। মানুষের বাঁচার দাবিটাই নাটকের সামনে এসে গেল। নাট্যদলগুলো এই দাবির প্রেক্ষিতে পার্টির পরিচালনায় লীগ অব ওয়ার্কার্স থিয়েটার-এর অধীনে একত্রিত হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো ব্যাপক দলকে এর সাথে যুক্ত করার জন্য উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে লীগ তার নাম থেকে ওয়ার্কার্স শব্দটি বাদ দেয়। উনিশশো পঁয়ত্রিশ সাল থেকে লীগের অধীনস্থ দলগুলো যখন কট্টর বাম চরিত্র সম্পূর্ণ পরিহার করলো, নাটকের বিষয়বস্তুও বদলানো শুরু হলো। পার্টির নেতৃবৃন্দ সহনশীলতা দেখানোর সাথে সাথে উদারনৈতিক বুর্জোয়া লেখকগণ তাদের নাট্যান্দোলনে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। সমাজের দারিদ্র্য, অস্থিতিশীলতা ও দুঃখ-দুর্দশায় আলোড়িত নাট্যকারগণ এ্যাজিটপ্রপের প্রতি যথেষ্ট আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করলেন। নিজেরা যেমন এতে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি নতুন নাট্য আঙ্গিক পেলেন, শ্রমিকদের দলগুলোকেও তাদের সাথে পেয়ে উৎসাহিত হলেন। নাটকে তখনো শ্লোগানধর্মিতা বিদ্যমান ছিলো, তবুও এ্যাজিটপ্রপের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়ে সুসংগঠিত চরিত্র ও সুসংহত সংলাপের আবির্ভাব ঘটলো। প্রোলেতারীয়, মধ্যবিত্ত, পেশাদার ও সখের নাট্যদলগুলোর মধ্যে এই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় নাটক পূর্ব গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্রডওয়ের বিশাল প্রাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়লো। ব্রডওয়ের পেশাদার মঞ্চেও শ্রেণীসংগ্রামের নাটক বা এ্যাজিটপ্রপ মঞ্চস্থ হতে শুরু করলো। শ্রেণীসংগ্রামের শ্লোগানসর্বস্বতাও এর কারণে অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলো। রাজনীতি পূর্বের চেয়ে গভীরতা লাভ করলো।
মারিয়া লে-পিসকাটর লিখেছিলেন, জার্মানীর মুদ্রাস্ফীতির সময়কার বিদ্রোহী থিয়েটারের সঙ্গে এই সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটারের তুলনা করলে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটার যুদ্ধের আহ্বান জানালেও যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গী থিয়েটার আদৌ জঙ্গী ছিল না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে তা ছিল মধ্যবিত্তের থিয়েটার। রাজনীতি নিয়ে কিংবা সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নে তাদের নাটকে কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না। অধিকাংশ বামপন্থী নাটকই রাজনৈতিক নাটক তো নয়ই, আদৌ ভালো নাটকই হয়ে উঠতে পারেনি। নাট্যকারদের বিপুল উদ্দীপনা ও প্রাণশক্তি থাকলেও বড় মাপের প্রতিভা ছিল না। তাঁরা সচেতন সাহিত্যিকও ছিলেন না। তিনি আরো লিখছেন, কী করছে কেন করছে সেসব না বুঝেই থিয়েটার গিল্ড এবং এই রকম আরো কয়েকটি দক্ষিণপন্থী থিয়েটার সাফল্যের সঙ্গেই বেশ কিছু বামপন্থী থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মার্কসবাদী সাহিত্যিকদের রচিত বেশ কয়েকটি নাটকও তারা করে। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানের চেতনা বা শ্রেণীচেতনা তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের এই থিয়েটার মার্কসবাদী হয়ে উঠতে চাইলেও সত্যিকার অর্থে মার্কসবাদী ছিল না। মার্কসবাদ আত্মস্থ করার জন্য যে ধরনের পড়াশুনা বা ধৈর্য বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার ছিল তার অভাব থেকেই এটা ঘটেছিল। তা সত্ত্বেও মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্র বা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতি যে তখন সারা পৃথিবীর মতো যুক্তরাষ্ট্রেও প্রভাব ফেলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় শ্রমিকশ্রেণীর নাট্য আন্দোলনগুলোতে। স্মরণ রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বছর পর্যন্তই যুক্তরাষ্ট্রে এই বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থিয়েটারে বজায় ছিল।
মূলত ত্রিশ দশকের সেই অর্থনৈতিক মন্দা কেটে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যদলগুলো মার্কসবাদ সম্পর্কে শীঘ্রই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থী চিন্তাকে ঘিরে গ্রুপ থিয়েটার তথা স্বাধীন থিয়েটারগুলোতে মার্কসবাদী চিন্তা উঁকি দিয়েছিল বটে, তবে স্বাধীন থিয়েটারগুলোর মধ্যে যে বামধারা জন্ম নিয়েছিল, সেগুলোর রাজনৈতিক পটভূমি থাকলেও সেটা সত্যিকার অর্থে কোনো শ্রেণীসংগ্রামের পথ ধরে আসেনি। সে পথে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ এবং পরে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে সে সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ও আবেগে যে নাট্যান্দোলন জন্ম নিয়েছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে সে আন্দোলনের প্রয়োজন তখন ফুরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশ। স্বভাবতই বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন থিয়েটারগুলোর প্রয়োজন সেভাবে আর দেখা গেল না। চলবে