রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা: নানা বিভ্রান্তি

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০২০

সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্ব
রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পন্ন হবার পর তা নিরঙ্কুশ ছিল না। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পুঁজিবাদী দেশগুলো ভীত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে যে-কোনো সময় তাদের দেশের ক্ষমতাও শ্রমিকদের হাতে চলে যেতে পারে। শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বুর্জোয়ারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, রুমানিয়া প্রভৃতি চোদ্দটি দেশ একযোগে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীকে ধ্বংস করার জন্য প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য পাঠায়। উনিশশো সতের থেকে বিশ সাল পর্যন্ত চলে তাদের আক্রমণ। বাইরের শত্রুর তীব্র আক্রমণের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকশ্রেণী এবং লালফৌজ শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের লালফৌজের সামনে শত্রু সৈন্যরা কেউ টিকতে পারে না। যেসব দেশ সৈন্য পাঠিয়েছিলো তাদের শ্রমিকরাও সরকারের কাছে দাবি জানাতে থাকে রুশ দেশ থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করার জন্য। মহাযুদ্ধের পর সেসব দেশের সৈন্যরাও ছিলো ক্লান্ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই তাদের ছিলো না। এসব কারণে পুঁজিবাদী দেশগুলো পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভিন্নভাবে তারা শ্রমিকশ্রেণীকে জব্দ করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে মালপত্র কেনাবেচা, ধার দেওয়া সহ সকল ধরনের সম্পর্ক বন্ধ রাখে। এই ঘটনায় সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়াকে ভীষণ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।

বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের তখন বাইরের আক্রমণের ভয় তো ছিলই, ছিল ভিতর থেকেও অভ্যুত্থানের ভয়। ভ্লাদিমির লেনিন তাই বলেছিলেন, ‘বিপ্লব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। জারতন্ত্র যেমন বিপ্লবকে পরাজিত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী আর নয় তেমনি বিপ্লবও এখন পর্যন্ত জারতন্ত্রকে পরাজিত করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেনি’। বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য, জ্বালানী ও অন্যান্য দ্রব্যের খুবই অভাব ও নানারকম অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। বিপ্লবী দল সে সবের সমাধান করা নিয়ে ছিল বেশি ব্যস্ত। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের পরপরই সোভিয়েত দেশে নাট্যকর্ম বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য কী রকম হবে তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের ঝড় ওঠে এই সময়। বিভিন্ন শ্রেণীর লোক নাট্যশিল্পকে বিপ্লবের পক্ষে কাজে লাগাবার জন্য এগিয়ে আসে। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিনের বক্তব্য ছিল, বুর্জোয়া ধ্যান ধারণার বৈপরীত্যে, বুর্জোয়া ব্যবসায়ী চিন্তার বৈপরীত্যে, বুর্জোয়া পেশাদারি মনোভাবের বৈপরীত্যে এবং ‘ব্যক্তি কেন্দ্রিক উচ্ছৃঙ্খলতার’ বিরুদ্ধে সর্বহারাকে দলীয় সাহিত্যের নীতি অনুসরণ করতে হবে; সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচারই হবে যার মূল লক্ষ্য। সর্বহারার স্বার্থ ছাড়া আর কোনো স্বার্থ সেখানে বিচার্য নয়। বিপ্লবের পর লেনিন মনে করতেন, শিল্প-সাহিত্য প্রলেতারিয়েত স্বার্থকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ হতে পারে না।

বিপ্লবের পর সোভিয়েত দেশে শুধু সমাজতন্ত্রের পক্ষে নাটক মঞ্চায়নই বড় কথা ছিল না, নাটক যে রাজনীতি প্রচারের বিরাট হাতিয়ার হিসাবে গড়ে উঠতে পারে সেই বিশ্বাসও দৃঢ় হয়। লেনিন এবং স্তালিন দুজনেই নাটকের প্রচারের ক্ষমতাকে স্বীকার করে নেন এবং নিজেদের রাজনীতির পক্ষে তাকে ব্যবহার করার কথা ভাবেন। লেনিন একবার লুনাচারস্কিকে বলেছিলেন, ‘শিল্প ইতিহাস কী অপূর্ব ক্ষেত্র। মার্কসবাদীদের পক্ষে এখানে করবার কতো কী-ই না রয়েছে’। তিনি আরো বলেছিলেন যে, শিল্পকে প্রচারের মাধ্যম হিসাবে এগিয়ে দিতে হবে। লেনিনের আগ্রহ ছিল সেই সংস্কৃতি নিয়ে যা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি লাভের জন্য, রাজনৈতিক বিজয়ের সংহতির জন্য এবং সোভিয়েত দেশের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সফল নির্মাণের জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করবে। সোভিয়েত সরকার সচেতন উদ্যোগ নিলো নাটককে রাজনীতির পক্ষে ব্যবহারের জন্য। রাষ্ট্র ও সমাজের সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের চিন্তায় নতুন নাট্যরীতি সৃষ্টির উদ্যোগে সোভিয়েত সরকার উনিশশো সতের সালেই এক শিক্ষামূলক সরকারি পরিষদ গঠন করে তার ওপর সমস্ত নাট্যশালার দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছিল। নাট্যশালাগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য আইন মাফিক প্রেক্ষাগৃহ, পোষাক, দৃশ্যসজ্জার উপকরণ সবকিছু জাতীয় সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। উনিশশো উনিশ সালে সে আইনে স্বাক্ষর করেন স্বয়ং লেনিন, যার লক্ষ্য ছিল জনগণের কাছে নাটকের মাধ্যমে রাজনৈতিক আদর্শ পৌঁছে দেয়া। ফরাসী বিপ্লবের পরেও এরকম উদ্যোগ নিতে দেখা গিয়েছিল।

বিপ্লববের পর সোভিয়েত নাট্যজগতের আর একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব বলা যায়, সারা দেশে ব্যাপকভাবে গণনাট্যের জাগরণকে; যার লক্ষ্য ছিল জনগণের ব্যাপকতম অংশের কাছে সংস্কৃতি বা শিল্পকে পৌঁছে দেয়া। নাটক যে চেতনা বিকাশে সাহায্য করে সেই বিশ্বাস থেকেই এটা করা হয়েছিল। সোভিয়েত দেশে গড়ে ওঠা এইসব গণনাট্য, যাকে ‘এ্যাজিটপ্রপ’ বা গণজাগরণের নাটক বলা হতো তার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার উন্মেষ ঘটে। গণজাগরণের এই নাট্যধারার মধ্যেই রাজনৈতিক নাট্যের বীজ লুকিয়ে ছিল। মূলত এ্যাজিটেশন ও প্রোপাগা-া এই দুই শব্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এই নাট্যধারা। বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব খুব সহজে সাফল্য অর্জন করেনি। অক্টোবর বিপ্লবের ঠিক পরপরই নবীন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে বিপ্লবের সাফল্যগুলো রক্ষার কাজে ভিতরের ও বাইরের শত্রুদের মোকাবেলা করার লড়াইয়ে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের সম্মুখ সমরে হাজার হাজার শ্রমিক-কৃষককে ছুটে যেতে হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতেই গণজাগরণের নাট্যধারার জন্ম। নাটকগুলো ছিল মূলত প্রচারণামূলক ও মানুষকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। নাটকগুলি সাধারণত সমসাময়িক ঘটনাবলী বা সমস্যা নিয়ে লেখা হতো, কীভাবে সে সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা করতে হবে নাটকে তারও নির্দেশ থাকতো। সোভিয়েত সরকার নতুন যেসব আইনকানুন প্রচলিত করেছিলেন তার ব্যাখ্যাও দেয়া হতো নাটকগুলোতে।

নাটকগুলি সহজবোধ্য ছিল এবং যে-কোনো অবস্থায় যে-কোনো দল কর্তৃক অভিনীত হতে পারে সেভাবেই লেখা হতো। দাবানলের মতো এই নাটকগুলো সোভিয়েত দেশের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘লাল উড়ালের জন্য সংগ্রাম’, ‘লাল পতাকার নীচে’, ‘মুক্ত শ্রমিক গাথা’, ‘বিপ্লবের জয়গান’ নাটকগুলো প্রচণ্ড জনসমর্থন লাভ করে। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের মধ্যে গণজাগরণের নাটকগুলির রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। বিপ্লবের সাফল্যকে রক্ষা এবং গৃহযুদ্ধে জয়ী হতে এই নাটকগুলো অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ারের কাজ করেছিল। ঠিক সেই সময়ে “ক্ষোভ প্রকাশের বিচারালয়” নামক আর এক ধরনের ভ্রাম্যমান রাজনৈতিক নাট্যপ্রচেষ্টা ব্যাপক প্রচারের উৎস হয়ে উঠলো। কোনো কোনো ঘটনার অথবা বাস্তব বা কাল্পনিক বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিচার অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ হতো, দর্শকদের সুযোগ দেওয়া হতো তর্ক-বিতর্কের, অভিনয়ে অংশগ্রহণকারী চরিত্রগুলিকে সমর্থন বা ধিক্কার জানাতে। বিপ্লবের পর এই ধরনের নাট্যপ্রচেষ্টা রাজনৈতিক শত্রুদের মুখোশ খুলে ধরতো, মাস্তান বা দলত্যাগীদের শাস্তি দিতো। কিন্তু এই নাট্যপ্রচেষ্টাগুলো কোনো পূর্ণাঙ্গ নাট্যকর্ম ছিল না। সাধারণত এইগুলো ছিল মুক্তাঙ্গনের নাটক ও ক্ষৃদ্রাকৃতির, যার মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনীতি প্রচার। সেই প্রচারণা ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে, সেখান কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল না। সরাসরি সেগুলো সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে উত্তেজিত করতো। লেনিন মনে করতেন, শুধু উত্তেজনা সৃষ্টি করা রাজনৈতিক নাটকের কাজ নয়, রাজনৈতিক নাটকের কাজ হবে শ্রমিক-কৃষক এবং সাধারণ মানুষকে সমাজ-বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে দেয়া।

শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে লেনিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উক্তি ছিল, ‘শিল্প সম্বন্ধে আমরা কী ভাবছি, সেটা বড়ো কথা নয়। কোটিকোটি জনগণের মধ্যে কয়েকশো অথবা এমনকি কয়েক হাজার মানুষ শিল্প থেকে কী পেল সেটাও জরুরি নয়। শিল্প জনগণের সম্পদ। ব্যাপকতম মেহনতি জনের ঠিক গভীরেই তার শেকড় যাওয়া দরকার।’ “শিল্প-সাহিত্য জনগণের সম্পত্তি” এইরকম একটি উক্তি শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুধু সোভিয়েত দেশেই নয়, বিশ্বের সমস্ত সাম্যবাদী দলের মূলমন্ত্র হয়ে উঠলো। শিল্প-সাহিত্য জনগণের সম্পত্তি, সেই শিল্প-সাহিত্যের যে অমূল্য সম্পদ শোষকশ্রেণীর কুক্ষিগত ছিল তাকে শ্রমিকশ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে; লেনিনের এই মন্ত্যব্যের প্রেক্ষিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের বিনামূল্যে নাট্যশালায় প্রবেশের অধিকার দেয়া হয়। সরকার নাট্যশালার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে লালফৌজের জন্য গৃহীত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাটক করার নির্দেশ প্রদান করে। নতুন লক্ষ্য পূরণের দাবি পড়ে নাট্যশালার ওপর। বলা হলো সকল সাধারণের জন্য নাট্যশালার দ্বার খুলে দিতে হবে। যে কোটিকোটি মানুষ এতকাল সাংস্কৃতিক কর্মের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে নাট্য-মঞ্চ। এইভাবে বিপ্লব-উত্তর যুগে সোভিয়েত দেশের নাট্যশালায় নতুন দর্শকের সমাগম শুরু হয়, যা বিপ্লবের পূর্বে ছিল কল্পনাতীত। শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং গ্রামাঞ্চলে নাটককে ছড়িয়ে দেয়া হয়। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘থিয়েটার ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের’।

বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়ার যেসব অঞ্চলে নাট্য কী বস্তু লোকে জানতো না, বিপ্লবের পরে সেইসব অঞ্চলেও নাট্যকলা বিস্তার লাভ করে। বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ায় সব জাতির নাট্যকলা ছিল না। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত নাট্যশিল্প এক ব্যাপক জাতীয় রূপ নেয় আর তার চরিত্র বদলে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, মধ্য এশিয়ার উজবেক, কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, তুর্কমেনিয়া প্রভৃতি স্থানে পূর্বে নাট্যকর্মের নিদর্শনই ছিল না। কাজাখ প্রজাতন্ত্রের আয়তন ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ। বলশোভিক বিপ্লবের আগে যেখানে কোনো নাট্যশালার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় না, বিপ্লবের পর সেখানেও নাট্যকর্ম পৌঁছে দেয়া হয়। এ সকল কিছুর পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল নাটককে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে তোলা, রাজনীতির পক্ষে প্রচার চালানো। লেনিন দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত হয়ে এবং সর্বহারা একনায়কত্বের যুগে তাদের জীবনের অবস্থা ও সংগ্রামের প্রতি দৃষ্টি রেখে সংস্কৃতি উন্নত করতে হবে। এভাবেই নাট্যশিল্প রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে সোভিয়েত দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর। সেখানে গোড়াতেই যে সমস্যাটা দেখা দেয় তাহলো রাজনৈতিক নাট্যপ্রচেষ্টা বা মার্কসবাদী নাট্যচিন্তা ব্যাপারটা আসলে কী সেটা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই স্পষ্ট ছিল না।

মার্কসবাদী নাট্যপ্রচেষ্টার কী রূপ, কী তার মূল লক্ষ্য সব ব্যাপারেই দেখা দেয় অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিন মতামত রাখলেও তার স্বরূপটি কী হবে সে ব্যাপারে তাঁর বিস্তারিত কিছু বলার সুযোগ ছিল না। তিনি যেটুকু নির্দেশনা রেখেছিলেন একটি বিপ্লবী নাট্যধারা গড়ে উঠবার জন্য তা ছিল সামান্য। সেজন্য সোভিয়েত নাট্য আন্দোলনে বিপ্লবের পর অনেক কালাপাহাড়ি কাণ্ডও ঘটে। রাশিয়াতে আসলে বিপ্লবের পূর্বে এবং পরবর্তী সময় এতো ধরনের রাজনৈতিক বিভক্তি ছিল, বিভিন্ন ধরনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জনগণ ছিল বিভ্রান্ত, তাদের পক্ষে আসলে বোঝা সম্ভব ছিল না কে যে তাদের শক্র আর কে তাদের প্রকৃত বন্ধু। বিপ্লবী পার্টির মধ্যেই তীব্র মতপার্থক্য ছিল, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সে মতপার্থক্য তৈরি হয়। বিপ্লবী আবেগের আতিশয্য স্তিমিত হবার পরই বিপ্লবী সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা নেয়া হলো। শিল্প-সাহিত্যের জগৎটাকে যে শ্রমিকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে সেটা অনেকেই বুঝেছিলেন। কীভাবে আনবেন সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলসের কোনো লেখা ছিল না। মার্কস-এঙ্গেলস এ ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দেশই দিয়ে যেতে পারেননি। সেজন্য বিপ্লব পরবর্তী শিল্প-সাহিত্য বা প্রলেতারীয় শিল্প-সাহিত্য কী হবে সে সম্পর্কে প্রায় কারোরই কোনো ধারণা ছিল না। শিল্প-সাহিত্য প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্যিই নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ালো। বিপ্লবী চিন্তার বিরুদ্ধে প্রোলেটকুল্টরা যা করছিল তা নিয়ে বহুজনের মধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হলো। রাজনৈতিক বা সমাজতান্ত্রিক নাটকের নামে যতোসব আজগুবি চিন্তার আমদানী হলো, উদ্ভট সব নাট্য প্রয়োজিত হলো। মায়ারহোল্ড ছিলেন এসবের নেতৃত্বে। [বিষয়টি নিয়ে আগে ফেসবুকে লিখেছি। থিয়েটার পত্রিকার গত সংখ্যায় তা পুনর্মূদ্রণ করেছে। শিল্পকলা একাডেমীর ‘শিল্পকলা’ পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখা গেছে বহু বছর আগে। ফলে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে না।]

নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া বিপ্লবের নামে শিল্পের ক্ষেত্রে প্রোলেটকুল্টদের আধুনিকতা ও বিকৃতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, মায়ারহোল্ড প্রমুখের এই নানাধরনের বিমূর্ত ভঙ্গি আদৌ প্রোলেতারীয় কি না। সাম্যবাদী দলই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেয় যে, প্রোলেটকুল্টদের মতামত মূলত বুর্জোয়াপন্থী এবং তা অতিবিপ্লবী আর বিভ্রান্ত। শারীরিক কসরত দেখানো বা সার্কাস ভঙ্গির নাট্যকলা বা অন্যান্য ভঙ্গিগুলোর কোনোটাই সর্বহারার নাট্যভঙ্গি হতে পারে না। সর্বহারার নাট্যশালার কাজ হবে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা, শিল্পের সেই শিক্ষা মোটেই শ্লোগানধর্মী হবে না; হবে সচেতনতামূলক। নীতি শিক্ষার পরিবর্তে মানুষের ব্যক্তিত্বকেই তা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। নতুন নাট্যপ্রচেষ্টা মানুষের চিন্তাকে গড়ে তুলবার কাজে দিক নির্দেশনা দেবে, চিন্তাকে বিভ্রান্ত করবে না। শিক্ষা-সম্মেলনে লেনিন বললেন, শিল্প-সাহিত্য এবং দলের পুরো প্রচারকার্য এমনভাবে করতে হবে যেন শ্রমিক কৃষকরা তা বুঝতে পারে। মায়ারহোল্ডের দুর্বোধ্য নাট্য-আঙ্গিক তা পারছিল না। দেখা গেলো দর্শকরা খুব শীঘ্রই এইসব সার্কাস ভঙ্গির নাট্যশালায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকরা প্রোলেটকুল্টদের দুর্বোধ্য মহাবিপ্লবী নাটকগুলিকে বর্জন করলো আর কাতারে কাতারে এসে উপস্থিত হলো স্তানিস্লাভস্কির “মস্কো আর্ট থিয়েটার”-এ। শ্রমিক-কৃষকদের ভীড়ে পূর্ণ হলো মস্কো আর্ট থিয়েটার। কিন্তু স্থান সংকুলান হয় না বলে সরকারীভাবে মাঝে মাঝে বিশাল সোলোদোভনিকভ থিয়েটার-এ মস্কো আর্ট থিয়েটার-এর নাট্য প্রযোজনাগুলোর অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হলো। শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে মস্কো আর্ট থিয়েটার-এর সংযোগ ঘটিয়ে দিয়ে সোভিয়েত সরকার এবং সাম্যবাদী দল স্তানিস্লাভস্কিকে নিজের পথ ধরে বিপ্লবী চেতনার দিকে এগুতে দিলেন। লুনাচারস্কিও অবশেষে বুঝতে পারলেন, প্রোলেটকুল্টরা বিপ্লবের সুবিধা নেবার জন্যই বেশি বেশি বিপ্লবী সাজছিল। ভ্লাদিমির লেনিন নিজে তাই ঘোষণা দিয়েছিলেন, সাবেকী শিল্পের ন্যূনধিক ভালো জিনিসগুলো সবই রক্ষা করতে হবে। কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন, প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতির মধ্যেই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বীজ নিহিত আছে, কারণ প্রত্যেক জাতির মধ্যেই শোষিত ও অত্যাচারিত মানুষ রয়েছে।

স্তালিনও পরবর্তীকালে একই কথা বলেছিলেন, সর্বহারার সংস্কৃতি জাতীয় সংস্কৃতিকে বাতিল করে না বরং তাকে পূর্ণতা দেয়। স্তালিন বলেছেন, মানুষের যা মহৎ সৃষ্টি যা নিজ যুগকে প্রতিফলিত করে তা সর্বকালের হয়, তা উৎপাদন সম্পর্ককে অতিক্রম করে। সেইসব শিল্প জনতার হৃদয়ে স্থান করে নেয়। মহৎ শিল্পীরা সবাই মার্কসবাদী কি না সেটা বিচার্য নয়, বিচার্য নিজকালের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কী দিয়ে গেলেন। লাল বই পড়ে সবাই শিল্পী হবে না। সমাজের ভিৎ পাল্টালেই হোমার, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে পরিত্যক্ত হন না, বরং আরো ব্যাপক অর্থে সত্য হয়ে ওঠেন। কারণ আগে যেখানে তাঁরা তিন কি চার জনের দখলে ছিলেন এখন শতকরা নিরানব্বই জনের নাগালের মধ্যে তাঁদের এনে ফেলা হবে। জগতের যা কিছু সুন্দর তা আগের সমাজে ভোগ করতো শুধু শোষক। সমাজতন্ত্রে তা হবে সকলের, শ্রমিকশ্রেণীও হবে তার উত্তরাধিকারী। আগেকার সমাজে শ্রমিক-কৃষকদের নিরক্ষর করে রাখা হয়েছিল, সান্ধ্য ভদকার সংগে পায়ের ওপর পা তুলে টলস্টয় পড়ার অবসর, সুযোগ ও সম্ভাবনা শ্রমিক-কৃষকের ছিল না। জনতাকে দেয়া হয়নি তার দেশের শ্রেষ্ঠ কাব্যে অধিকার। সামন্ত ও বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক থাকে শোষণে এমন পিষ্ট যে সংস্কৃতির নাগাল সে কখনো পায় না। শ্রমশক্তি বেচে যাকে খেতে হয়েছে, সে পায়নি অবসর, পায়নি শিক্ষা, পায়নি তার দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পড়ার সুযোগ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শ্রমিকদের জন্য সে সুযোগ এসে গেল।

লিও টলস্টয় বিপ্লবের বহু পূর্বে লিখেছিলেন, মানবজাতির দু তৃতীয়াংশ সর্ব্বোচ্চ শিল্পের কিছুমাত্র জ্ঞান লাভ না করে বাঁচে এবং মরে। শিল্পকলা বলে কথিত বস্তুটির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে খুব কম লোক। শতকরা নিরানব্বই জন মানুষ বংশানুক্রমে শ্রমপীড়িত হয়ে উচ্চতর শিল্পের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ পায় না। উপরন্তু সে শিল্পের প্রকৃতি এমনই যে উপভোগের সুযোগ পেলেও তারা সে শিল্পের মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। যে শিল্প তাদের কোনো কাজে আসে না, সে শিল্প সৃষ্টির জন্যও তাদের শ্রমের বহু পরিমান অংশ ব্যয়িত হয়। টলস্টয় অবশ্য এমন এক সমাজ ব্যবস্থা উদ্ভবের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ন্যয্য বণ্টনের মাধ্যমে শ্রমিকদের শ্রমের কিছুটা লাঘব হবে। তিনি মনে করতেন, কিছু লোক সবসময় শ্রমদানে ব্যস্ত থাকবে ভবিষ্যত সমাজে হয়তো এমনটি দরকার হবে না। বরং দেখা যাবে তখন মানুষ দিনের কয়েক ঘণ্টা কাজে ব্যাপৃত থাকবে এবং অবসর মুহূর্তগুলি শিল্পের আনন্দ উপভোগ করে কাটাবে। টলস্টয়ের সেই স্বপ্ন কমবেশি পুরণ করেছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। শ্রমজীবীরা শিল্পের আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করলো। বিপ্লবের আগে তাঁরা সর্বক্ষণ কাজের নিগড়ে বাঁধা পড়ে থাকতেন। বিপ্লবের পর তাঁদের জন্য অবসর মিললো এবং কাজের অবসরে তাঁদের জন্য শিল্প-সাহিত্য উপভোগের সুযোগ করে দিলো বিপ্লবী সরকার।

বিপ্লবের পূর্বে রুশ শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতো জার ও বুর্জোয়ারা, সেই শ্রেণীর ভাবাদর্শই প্রতিফলিত হতো। বিপ্লবের পর রাতারাতি সেই চিন্তার পরিবর্তন ঘটা সম্ভব ছিল না। যাঁরা এক রাতের মধ্যেই সংস্কৃতির এই অবস্থাকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন উগ্র মতবাদের ধারক, বাস্তবচিন্তা বর্জিত। যাঁরা ভেবেছিলেন বুঝিবা যেন এক পিস্তল থেকে এক মুহূর্তেই প্রলেতারীয় সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা যায়। লেনিন মনে করতেন, কোনো সংস্কৃতি হঠাৎ করে গজিয়ে উঠতে পারে না, সবকিছুর থাকে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্রের শিকড় গড়ে উঠছে দুনিয়া জুড়ে তারই মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে মার্কসীয় শিল্প ভাবনার সূত্রগুলি, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের চেতনা। সমাজতান্ত্রিক শিল্প সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, এটা ভুঁইফোড়দের ব্যাপার নয়; কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবনও নয়। মানব জাতির বিকাশের ধারা বেয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, মানব সমাজ যে জ্ঞানভাণ্ডার সঞ্চিত করেছে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতি হবে তারই স্বাভাবিক বিকাশের পরিণতি, তাকেই আমাদের পুনরায় প্রয়োগ করতে শিখতে হবে। যারা বুর্জোয়া সভ্যতার সমস্ত সাহিত্য সম্ভারগুলিকে উৎপাটিত করতে চেয়েছিল নতুন সৃষ্টির তাগিদে, লেনিন তাদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এই বলে যে, কোনরকম কূপমণ্ডূকতা বা গোড়ামি সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি হতে পারে না। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠবে মার্কসীয় চিন্তায়, কোনো গোঁড়ামি বা পাতিবুর্জোয়া সুলভ একগুঁয়েমি দিয়ে নয়। সংস্কৃতির সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। দুই সংগ্রামের লক্ষ্য সমাজটাকে পাল্টানো, যে সমাজ সৃষ্টি করবে নতুন মানুষ, নতুন মানবিকতা। নাট্যকলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতকে অবশ্যই চাপ দিতে হবে বিপ্লবের নতুন চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু তা জোরপূর্বক বা মূলগতভাবে নয়। পুরানো মহৎ চিন্তাকে বাদ দিলে চলবে না। মানবিকতাকে বাদ দেয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। সকল ধ্রুপদী শিল্প-সাহিত্যকে রক্ষা করতে হবে। পুরানো সকল মহৎ সৃষ্টির কিছু না কিছু সংগ্রামী দিক আছে। লেনিন বিশ্বাস করতেন, বুর্জোয়া জ্ঞান ভাণ্ডার ও তার প্রযুক্তি থেকে তেমন সবকিছুই নিষ্কাশন করে নিতে হবে, যা বুর্জোয়ার উচ্ছেদের সংগ্রামে এবং বিপ্লবীদের নিজস্ব জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে কাজ দেবে।

মূলত সোভিয়েতের বিপ্লবী সরকার গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয়শক্তি সংহত করার কাজে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হন। বিপ্লবের পরপর সত্যিকার মার্কসবাদী শিল্প-সাহিত্য বা নাটক কী হবে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত ও সামগ্রিক মতামত রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সেটার দিকে বিশেষ নজর দেয়ার মতো পরিবেশও পাওয়া যায়নি। সর্বহারার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয় ক্ষমতা দখলের কাজে, সেই ক্ষমতাকে সংগঠিত করতে। সেখানে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে সঠিক চিন্তা করবার উপায়ও ছিল না। ট্রটস্কি লিখেছিলেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কেবলমাত্র ধ্বংসাত্মক কাজের চাপে মানুষের মূল কতোগুলি চাহিদা; চাল, ডাল, নুন, তেল, লাকড়ির সমস্যা নিয়েই জর্জরিত, সেখানে সাংস্কৃতিক চিন্তায় নতুন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব অসম্ভব। ট্রটস্কি আরো লিখলেন, বিপ্লব নতুন ধরনের এক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর। তবে সেটা করা হয় পুরানো সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা, শ্রেণীসংঘর্ষ, হিংসা, ভাঙন আর ধ্বংসের দ্বারা। প্রলেতারীয় বিপ্লব যদি না ঘটতো, মানব জাতি নিজের দ্বন্দ্বে নিজেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়তো। বিপ্লব সমাজ ও সংস্কৃতিকে এই আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচালো ঠিকই কিন্তু নিষ্ঠুর ব্যবচ্ছেদের সাহায্যে। সর্বহারার একনায়কত্ব আসলে নতুন সমাজব্যবস্থার সংস্কৃতি-চিন্তার সংগঠন নয়, ঐ সংস্কৃতি পাবার এক বিপ্লবী ও সামরিক শাসন।

ট্রটস্কির মতে বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি বলছেন, যেহেতু বিপ্লবটা শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লব, সেহেতু বিপ্লব ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে নজর দেবার মতো কর্মোদ্যম সর্বহারার কমই অবশিষ্ট থাকে। তিনি ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে দেখালেন যে ফরাসী বিপ্লবের সময় যে সমস্ত মহান শিল্প সৃষ্টিতে এই বিপ্লবের চেহারা প্রতিফলিত হয়েছিল তা সৃষ্টি হয়েছিল ফরাসী শিল্পীদের দ্বারা নয়, তা করেছিল জার্মান, ইংরেজ ও অন্যান্যরা। ফরাসী বিপ্লবে বুর্জোয়ারা প্রত্যক্ষভাবে এর নেতৃত্বে থাকার জন্য সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো ক্ষেত্রে সেই বিপ্লবের চেহারার ছাপ রেখে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ বা উদ্যম কোনোটাই দেখাতে সক্ষম হয়নি, সর্বহারার ক্ষেত্রে এ কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। কারণ সর্বহারারা সংস্কৃতির ব্যাপারে পূর্ব থেকেই অনেক বেশি রিক্ততায় ভুগতে থাকে। ট্রটস্কি যেমন বলেছিলেন সাম্যবাদী দলের পক্ষে রাজনীতির বাইরে সময় দেয়া সম্ভব নয়, রাশিয়াতে তাই ঘটেছিল। লেনিন নতুন সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন সত্যি তবে তার ওপর নজরদারি করার সময় তাঁর ছিল না। ট্রটস্কির আর একটি কথাও সত্য প্রমাণিত হয়, ফরাসী বিপ্লবের মতোই রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধারা গড়ে না উঠলেও, সেই ধারা গড়ে উঠেছিল জার্মানীতে, পিসকাটর ও ব্রেশটের মাধ্যমে এবং প্রথম মহাযুদ্ধের প্রভাবে। পরের কোনো পর্বে পিসকাটর আর ব্রেশটের নাট্যচিন্তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। চলবে