ব্রেশট
রাজনৈতিক নাট্যকার এবং নির্দেশক ব্রেশট
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০২০
বিশ শতকে আমরা যে রাজনৈতিক নাটকের পথযাত্রা দেখতে পাই মূলত পিসকাটরই হচ্ছেন তার স্রষ্টা। যদিও তাঁর সমকালীন ব্রেশ্টের নাট্যখ্যাতি পিসকাটরকে ছাপিয়ে উঠেছে তবুও পিসকাটরের নাট্যকীর্তির ছাঁচে এবং আদর্শেই পরবর্তীকালে গঠিত হয়েছে প্রচার নাটক। ব্রেশ্ট তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এবং আরো বেশি পরিচিত করে তোলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক নাট্যজগতে বেরটল্ট ব্রেশ্টই সর্বাপেক্ষা প্রভাব সৃষ্টিকারী নাট্যকার ও তাত্ত্বিক রূপে পরিগণিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন পিসকাটরের ছাত্র ও সহকর্মী, সে কারণে তাঁর নাট্যচিন্তা পিসকাটরের প্রভাবে পরিপুষ্ট। নাট্য প্রযোজনা নিয়ে তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত পদ্ধতিতে পিসকাটর ও ব্রেশ্টের মধ্যে চিন্তার ফারাক থাকলেও মূল জায়গায় উভয়েই ছিলেন এক। ব্রেশ্টের রাজনীতিতে হাতে খড়ি পিসকাটরের কাছে। শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রথম দিকে তাঁর কাজ ছিল পিসকাটরের নাটকগুলির পাণ্ডুলিপি সংশোধন করে দেয়া। বিনিময়ে পিসকাটর ব্রেশ্টের ভরণপোষণ জোগাতেন। পিসকাটরের আরো দুজন ছাত্র হলেন ফ্রিডরীশ ভোলফ ও ভানগেন হাইম। ব্রেশ্ট, ভোলফ এবং ভানগেন হাইম ত্রিশ দশকের এই তিনজন বিপ্লবী নাট্যকারের মধ্যে শিল্পগত কিছু পার্থক্য থাকলেও নীতিগতভাবে তাঁরা ছিলেন একই পথের পথিক; মার্কসবাদী রাজনৈতিক নাট্যকার। পিসকাটরের মতো এঁরাও শ্রমিকশ্রেণীর জন্য নাটক করার কথা ভাবেন। শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য তাঁরা সমস্ত রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে নাট্যকর্মের নতুন দিক উন্মোচন করলেন। ব্রেশ্ট ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী এবং সফল নাট্যকার ও পরিচালক। ব্রেশ্টের নাটকগুলোতেই শ্রেণীসংগ্রাম চরম শৈল্পিক উৎকর্ষ নিয়ে হাজির হয়েছিল।
নাট্যজীবনের শুরুতেই ব্রেশট মার্কসবাদী ছিলেন না। উনিশশো বিশ সালের বারো সেপ্টেম্বর ব্রেশ্ট তাঁর দিনলেখমালায় লিখছেন, ‘এখন আমি বলশেভিকদের ঘোর বিরোধী। সেখানে এখন সকলের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা, খাদ্য বিতরণে নিয়ন্ত্রণ এবং বিধি নিষেধের ছড়াছড়ি।’ পিসকাটরের মতো ব্রেশ্টকেও প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। সেই থেকে সামরিকজান্তার প্রতি ব্রেশ্টের ঘৃণার কারণে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা তাঁর মনঃপূত হয়নি এবং গণতন্ত্রী ব্রেশ্ট বলশেভিকদের বিধি নিষেধের বাড়াবাড়িকে সমর্থন করতে পারেননি। যদিও এর অনেক পরে ব্রেশ্ট উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, সেই সময় তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল লজ্জাজনকভাবেই স্বল্প। পশ্চিমের গোয়েন্দা ছবি দেখে ব্রেশট তখন মুগ্ধ হতেন, নিজেও চিত্রনাট্য লেখার চেষ্টা করেন। পরে তিনি চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফেরান এবং চোখ রাখেন মঞ্চে। উনিশশো চোদ্দ সালে ষোল বছর বয়সে তিনি ‘বাইবেল’ নামে একটি নাটিকা লিখেছিলেন, যা কখনো মঞ্চস্থ হয়নি। মহাযুদ্ধের পর তাঁর প্রথম নাটক “বাআল”, দ্বিতীয় নাটক “ড্রাম ইন দ্য নাইট” বা রাত্রির দামামা। দুটোই ছিল বেশ আলোচিত।
জার্মানীর যুদ্ধ, বিপ্লব ও অর্থনৈতিক পতনের চিত্রই বাআল নাটকে ফুটে ওঠে। বে-আইনী কার্যকলাপ, খুন, ধর্ষণ, মাতলামি, বেশ্যাবৃত্তি, চরম হিংসাত্মক কার্যকলাপ সবই নাটকের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। ব্রেশ্ট সমাজের মানুষের নীচতা, ক্রুরতা ও স্বার্থপরতাকে প্রবল শক্তিতে এ নাটকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বাআল একজন গীতিকবি। বিশ শতকের শুরুতে নীতিবাগীশদের আস্তানায় বাআলের প্রথম আবির্ভাব। প্রথম পর্যায়ে বাআলকে দেখা যাবে সবদিক থেকে গঠনশীল এবং শোনা যাবে স্বীয়কন্ঠে গাওয়া তার বিখ্যাত গান “প্রতিভাবান বাআল-এর স্তোত্র”। নাটকে কিন্তু একটি “আমি” নিজেকে একটি জগতের অন্যায় দাবি এবং নিরুৎসাহের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, যে-জগৎ সৃজন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে না বরং তাকে লুঠ করে। বাআল তার নিজের প্রতিভার যে মূল্যায়ন করতো তা বলবার জন্য এই নাটক নয়। নাটকে দেখানো হয়েছে বাআল তার বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে তার নিজের বীভৎস পরিণতি তাকে বিস্মিত করে। নাটকটির শুরুতেই বলা হয়, ‘বাআল গোগ্রাসে গেলে! বাআল নাচে! বাআল নিজেকে মহিমান্বিত করে!’। বাআল সুড়িখানায় মদ্যপান করে, গান গায় কিন্তু নিজের শ্রোতা সম্পর্কে উদাসীন। বাআল নাটকটিতে ব্রেশট স্বার্থপর অর্থশাসিত পৃথিবীতে কবির আত্মাহুতি দানের ভাববিলাসকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ এবং কষাঘাত করেছেন। বিশ শতকের দুনিয়ায় বাআল নিজেকে অস্বাভাবিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে। মানবতাবাদী বাআল শেষ পর্যন্ত তা পারে না। নাটকটি একাধিক উপাখ্যানের কাহিনী নয়, একটি জীবনের কাহিনী। ব্রেশট দেখান বিশ শতকের শুরুর একজন গীতিকবির করুণ পরিণতি। বাআল নাটকটি আসলে বর্তমান সমাজে শিল্পী সাহিত্যেকদের ভূমিকা কী হবে, সে ব্যাপারে একটি সমালোচনা। নাটকটিতে দর্শক বাআলের নগ্ন অহমিকাকে মহিমান্বিত করা ছাড়া প্রায় অন্য কিছু লক্ষ্য করবে না। নাটকটি সম্পর্কে বলা যায়, নাট্যকার খুব খুঁটিয়ে চিন্তা করে সমাজের এক প্রবণতা বার করেছেন; ‘দাম দিতে চাইলে প্রাপ্য বস্তু পাওয়া সম্ভব। যদি দামটা শুধু দেওয়া হয়।’ নাট্যকার বুর্জোয়া সমাজের চেহারাকে সেভাবেই দেখেছেন। সবকিছু সেখানে কেনাবেচার বস্তু, টাকা আছে তো সব সুবিধা ভোগের উপায় আছে।
রাত্রির দামামা নাটকটিও বুর্জোয়া সমাজকে আক্রমণ করে লেখা। নাটকের এন্ড্রিয়াস ক্র্যাগলার প্রথম মহাযুদ্ধের পর এক বন্দী শিবির থেকে বার্লিনে ফিরে এসে দেখে যে, তার বাগদত্তা আনা মুনাফাখোর ব্যবসায়ী মার্কের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ক্র্যাগলার ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায়, পাগলের মতো মদ্যপান করে। সে সময় স্পার্টাকুস সাম্যবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, ক্র্যাগলারও সে অভ্যুত্থানে যোগ দিয়ে ফেলে। ক্রাগলারকে তখন মনে হয় বিত্তহীন এক বিপ্লবী। আর সকাল বেলা যখন প্রেমিকা আনা ওর কাছে ফিরে আসে, ক্র্যাগলার বিপ্লবকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বুর্জোয়া নিরাপত্তার প্রলোভনে আনাকেই বেছে নেয়। বহুজন হতাশা থেকে যে বিপ্লবের পথে পা বাড়ায় ব্রেশট তাকে সঠিক মনে করেননি। তিনি মনে করেন সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে বিপ্লবের পথে পা রাখতে হবে, বিপ্লব হতাশাগ্রস্ত মধ্যবিত্তের বিলাস নয়। এই নাটকে নাট্যকার সচেতনভাবে মধ্যবিত্তের বুর্জোয়া নিরাপত্তাভিলাষকে আক্রমণ করেছেন। ব্রেশটের প্রথমদিকে লেখা নাটকগুলির মধ্যে রাত্রির দামামা-য় ঘাত-প্রতিঘাত সবচেয়ে বেশি। সাম্যবাদী সংগ্রামের প্রবর্তক ছিল বিত্তহীনরা কিন্তু ক্রাগলার ছিল সুবিধাবাদী। সুবিধাবাদী হিসেবে বিপ্লবে যোগদানের জন্য তাকে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি, কোনো ক্ষতির স্বীকার হতেও হয়নি। নাটকের সত্যিকার বিত্তহীনরা ছিল বিয়োগান্ত চরিত্র, কিন্তু ক্রাগলার হলো ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্র।
ক্রাগলারের কাছে বিপ্লব হচ্ছে ভাব-বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ক্রাগলার হচ্ছে হুজুগে চরিত্র, তার মধ্যে কোনোরকম রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব বোধ নেই, নিজের পথ সম্বন্ধেও সে স্পষ্ট জানে না। যে-বিপ্লব বা প্রগতির মধ্যে দিয়ে তার ভাগ্য পাল্টাবে সেখানে সে থাকতে চেষ্টা করে না। কিন্তু নিজের চাওয়াটা সে বোঝে। ক্রাগলার এ নাটকের নায়ক সে নিয়ে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। ব্রেশট নিজেই মন্তব্য করছেন, ‘এটি একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক নাটক সেকথা আজ কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারে না।’ যুদ্ধের পর জার্মানীতে যে বিপ্লবের সম্ভবনা দেখা দিয়েছিল, সে বিপ্লব ব্যর্থ হয়। ব্রেশট বলতে চান, ক্রাগলারদের মতো সুবিধাবাদীরা হচ্ছে এর মূলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-দিকটি ব্রেশট নাটকে ইঙ্গিত করেছেন তাহলো, সুবিধাবাদী রক্ষণশীল এই ক্রাগলারদের মতো লোকদের চিনে রাখা দরকার। ক্রাগলার হচ্ছে মারাত্মক ধরনের অতিবিপ্লবী, যে বিপ্লবকে অন্তর্ঘাতী কাজের মাধ্যমে বানচাল হতে দেয়। চেনা পরিচিত বুর্জোয়াদের বদলে লেনিন যাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে সংগ্রাম করেছেন এবং রুশ বিপ্লবের আগে যাদের চিনিয়ে দিয়ে জনগণকে সাবধান থাকতে বলেছেন, তারা হলো ক্রাগলারদের মতো সুবিধাবাদী বিপ্লবী। রাতের দামামা নাটকে ব্রেশট সেই কাজটিই করতে চেয়েছিলেন। ব্রেশট লিখেছিলেন, রাত্রির দামামা নাটক লিখবার সময় বিয়োজন কৌশল তার আয়ত্বে ছিল না। তিনি এ কথাও লিখেছেন, ‘বিত্তহীনদের আন্দোলনের গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার ছিল না বলেই মনে হয়।’
বাআল ও রাত্রির দামামা দুটি নাটকেই তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নগ্ন সত্য তুলে ধরেন। বহুজনই বলেছেন ব্রেশ্ট তখনও মার্কসবাদী হয়ে ওঠেননি। ব্রেশ্ট সে-অর্থে মার্কসবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেন উনিশশো পঁচিশ সাল থেকে যখন বার্লিনে এসে পিসকাটরের সাথে পরিচিত হন। পিসকাটরকে ঘিরে তাঁর সাম্যবাদী দলের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়, বিয়েও করেন সাম্যবাদী দলের এক সদস্য হেলেন ভাইগেলকে। ব্রেশ্টের মার্কসবাদী চিন্তার প্রথম উন্মেষ ঘটে ফ্লাইশহ্যাকার নাটক লিখতে গিয়ে। পিসকাটর-ব্যুহনে ভাইৎজেন বা গম নামে একটি নাটক প্রযোজনা করে। গম নাটকের প্রচারপত্রের সাথে ব্রেশটের ‘ফাইশহাকার’ নামে নাটকটির আগাম প্রচার শুরু হয়েছিল। শস্যের বাজার ছিল এই নাটকটির উপজীব্য এবং ব্রেশট এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ব্রেশট লিখছেন, ‘নাটকের পশ্চাৎপট হিসাবে আমি শিকাগো শস্য বিনিময় কেন্দ্রকে বেছে নিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এই বিশেষ ক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষজ্ঞ এবং কর্মরত তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলেই সব জেনে নেওয়া যাবে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো অন্যরকম। বার্লিন থেকে ভিয়েনা আমি চষে বেড়িয়েছি, অথচ অর্থনীতির বিখ্যাত লেখক থেকে শুরু করে ব্যবসাদার যাঁরা সারাজীবন ব্যবসা করে গেলেন তাঁরা কেউই আমাকে বলতে পারলেন না শস্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে কী ঘটে চলেছে। পরে আমার ধারণা হলো, ওখানে যা ঘটে চলেছে তা অসঙ্গত এবং দুর্বোধ্য। কীভাবে শস্য সারা বিশ্বে বণ্টিত হয় সেটা বোঝা অসাধ্য। যে কোনো দিক থেকেই শুধুমাত্র কয়েকজন ফাটকাবাজ বাদ দিয়ে এই শস্য বিনিময়ের ব্যাপারটা ছিল একটা অগম্য জলাভূমি; যা জটিল জাল বিস্তার করে রয়েছে। পরিকল্পিত নাটকটি কখনো লেখা হয়নি, পরিবর্তে আমি মার্কস পড়তে শুরু করলাম। হ্যাঁ এখন আমার বিক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা এবং অনুভবগুলি জীবন্ত বাস্তবভূমি স্পর্শ করেছে।’ সত্যিকার অর্থে তখন পর্যন্ত ব্রেশ্ট নিজে ছিলেন একজন ভোগবাদী কিন্তু বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ।
বার্লিনে এসে তিনি লিখতে শুরু করেন ‘গেলি গে’ নামে একটি নাটক। বহু কাঁটাছেঁড়ার পর সে নাটকের নাম রাখা হয় মান ইস্ট মান বা মানুষ মানুষই। মানুষ মানুষই নাটকটি লেখা শেষ হবার কিছুদিন আগে ব্রেশ্ট এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘মানুষ মানুষই’ বা ‘মানুষ সমান মানুষ’ নামে তিনি একটি মিলনান্তক নাটক লিখছেন। এই নাটক হবে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একটি মানুষের উপর অপর একটি মানুষের কার্যকলাপকে ভিত্তি করে রচিত এবং প্রত্যেকেই এ নাটক দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। সাক্ষাৎগ্রহণকারী প্রশ্নকর্তা তখন জানতে চান, পরিশেষে কি মানুষকে আদর্শ এবং মহৎ মানুষ রূপেই চিহ্নিত করা হবে? ব্রেশ্ট জবাব দেন, অবশ্যই না। ব্রেশট রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের সৃষ্টি ‘ব্যারাক রুম ব্যালাড’-এর উপর ভিত্তি করে এ নাটকটি রচনা করেন। নাটকটি প্রথমবার রচিত হবার পর ব্রেশ্ট পরবর্তীকালে আরো দশবার তা সংশোধন করেন। ব্রেশ্ট এ নাটকে মানুষকে দেখেছেন দুভাবে। প্রথমত: সব মানুষই সমান। মানুষের চরিত্রের ভিন্নতা বলতে যা বোঝায় তা মানুষের জন্মগত নয়। এই জগতের ভিতর নানারকম ঘটনা ও দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে মানুষের চরিত্র সৃষ্টি হয়। একই মানুষ হয়ে ওঠে ভিন্ন মানুষ। দ্বিতীয়ত: কোনো মানুষ একা চলতে পারে না। ব্যাষ্টিক মানুষের ধারণা মিথ্যা তাঁর কাছে। ব্রেশ্ট মনে করেন একজন মানুষ একটি সমষ্টির অংশ মাত্র। ফলে কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বলে একজন মানুষ সত্যিকার অর্থে কোনো মানুষই নয়। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিহিত তার সমাজের সমষ্টির মধ্যেই।
মান ইস্ট মান বা মানুষ মানুষই নাটকেও তিনি সরাসরি পুঁজিবাদকে আক্রমণ করেন। মানুষ মানুষই নাটকের ভিতর দিয়ে ব্রেশট মূলত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আর তাহলো, একজন মানুষকে কীভাবে দেখা হবে। নাটকটিতে মানুষের প্রতিকৃতি হিসেবে তাই গেলিগে নামের একজন কুলির চরিত্রকে চমৎকারভাবে উল্টেপাল্টে দেখানো হয়। এই গেলিগেকে কখনো মনে হয় সহজ সরল ভালো মানুষ আবার একটু পরেই ধরা পড়ে তার ধুরন্ধর চেহারা। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার চরিত্রের নানাদিক ফুটে উঠতে থাকে। প্রথম দৃশ্যে যাকে মনে হয় শান্ত, নিরীহ বোকা মানুষ, সৈনিক হিসেবে শেষ দৃশ্যে সে হয়ে ওঠে চালাক এবং ভীষণ নিষ্ঠুর। নাটকের ঘটনার গোড়াতেই আছে যুদ্ধ। কিলকোয়াতে মহারানীর সৈন্যবাহিনীকে জড়ো করা হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। চারদিক থেকে সৈন্যরা কিলকোয়াতে জড়ো হচ্ছে, তারা এখনো জানে না যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে। একজন সৈনিকের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘যদি তুলোর দরকার হয় তাহলে যুদ্ধ হবে তিব্বতের বিরুদ্ধে আর যদি পশমের দরকার হয় যুদ্ধ হবে পামিরের বিরুদ্ধে।’ সহজ করে ব্রেশ্ট বুঝিয়ে দেন, মহারানীর সৈন্যবাহিনীকে জড়ো করা হয়েছে সাম্রাজ্যশক্তির কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণগুলির একটা ছিল কাঁচামাল সংগ্রহের প্রচেষ্টা। দর্শকের সামনে নাটকের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের সেই চেহারা স্পষ্ট করা হলো। তাঁর পুঁজিবাদকে আক্রমণের পেছনে মূল কারণ কী ছিল? যখন ব্রেশ্টকে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিতে হয়, সে সময়ে তিনি ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্র। পিসকাটরের মতো তাঁর মধ্যেও যুদ্ধ নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে। তিনি মনে করতেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে যুদ্ধের বীজ। সেজন্যই তিনি প্রথম থেকেই পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক, হিংসাত্মক দিকটাকেই তার নাটকে ফুটিয়ে তোলেন।
বিশ শতকের চব্বিশ, পঁচিশ ও ছাব্বিশ সালে ব্রেশ্ট আর পিসকাটরের নাটক চলাকালীন নাট্যশালায় যে কতো দাঙ্গা লেগেছিল তার হিসাব নেই। সরকারি মহলের তথাকথিত দেশরক্ষা আর দেশপ্রেমিক যুদ্ধের শ্রাদ্ধ করেছিলেন ব্রেশ্ট। তাঁর প্রথম তিনটি নাটকে তো বটেই পরেরও বেশ কয়েকটি নাটকের পটভূমি বা বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের তিনি কেবল নিন্দা করেই ক্ষান্ত হননি, যুদ্ধের মূল কারণ যে কী সে ব্যাপারেও আলোক সম্পাতের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতেন যুদ্ধটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, পুঁজিতন্ত্রের স্বাভাবিক বিষক্রিয়া। মার্কসের চিন্তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে। তিনি তখন মার্কসবাদী ছিলেন না। পরবর্তীকালে একজন মার্কসবাদী হয়ে উঠেছিলেন; যদিও প্রথম থেকেই তিনি নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রচিত এসব নাটকে তাঁর ক্রোধ প্রকাশ পেলেও মার্কসবাদ অধ্যয়নের আগ পর্যন্ত তিনি বুঝে উঠতে পারেননি পুঁজিবাদের শেষ কোথায়। মান ইস্ট মান নাটক লেখার পর থেকেই তাঁর চিন্তার জগতে নানা পরিবর্তন আরম্ভ হয়। নাটক রচনা ও প্রযোজনা সম্পর্কে তার মনে নতুন সব প্রশ্ন দেখা দেয়। জগত ও মানুষ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে জানার জন্য তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন।
উনিশশো সাতাশ সালের মে মাসে সমাজতাত্ত্বিক ফিৎস স্টার্নবার্গের সঙ্গে সখ্যসূত্রে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি আরো স্বচ্ছ ধারণা লাভ করলেন। স্টার্নবার্গের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ব্রেশ্ট উপকৃত হলেন বহুবিধভাবে। নতুন শিল্পরীতি অন্বেষণেরত ছিলেন ব্রেশ্ট। নাটকের পুরানো ধারা ভেঙে কী করে নতুন রীতি গড়ে তোলা যায় ব্রেশটকে তা বোঝালেন স্টার্নবার্গ, ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে ঐতিহাসিক চাহিদা পুরণে সমকালীন পাশ্চাত্য নাট্যকলা ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি ব্রেশটকে বুঝিয়ে দিলেন ব্যক্তিবাদের পতন হয়েছে, সেখানে অভ্যুত্থান ঘটেছে সমষ্টির। ব্যক্তি কীভাবে সমষ্টির প্রতিনিধি হতে পারে সে প্রশ্নটি সামনে এসে গেল। স্বাভাবিকবাদীরা মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব ব্যতিরেকেই ব্যক্তিত্ববাদের বিরুদ্ধে যেভাবে মতাদর্শগত বিদ্বেষ পোষণ করছিল, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে ব্রেশট তাকেই নতুন শক্ত জমির উপর দাঁড় করালেন। মার্কসবাদীরা যথেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল “আমি” সর্বস্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে যেমন নিন্দা করে, সমষ্টির প্রতি ব্যষ্টির দায়িত্বকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনি তারা মনে করে তাদের আদর্শ সমষ্টি কিন্তু ব্যক্তিত্বের বিনাশের উপর স্থাপিত নয়; ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের উপর স্থাপিত। মার্কসবাদ এই ক্ষেত্রে সমষ্টির সঙ্গে ব্যষ্টি বিরোধকে সমাধানযোগ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখে, এই দ্বন্দ্বে একপক্ষের বিনাশ দ্বারা অপরপক্ষের সার্থকতা সম্ভব বলে মনে করে না। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিনাশকে মার্কসবাদ সমর্থন করে না।
মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিনের রচনাবলী ব্রেশ্ট গভীর নিষ্ঠার সাথে অধ্যায়ন করেছিলেন। প্রতিবছর প্রচুর নাটক লিখছিলেন এবং মঞ্চস্থ করছিলেন। সে কারণেই নিরন্তর কর্মপ্রণালীর মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিলো ব্রেশটকে এবং তাঁর সহযোগীদের। কিন্তু পাশাপাশি মার্কসবাদের অধ্যয়ন ঠিকই চালিয়ে গেছেন। মার্কসবাদ পড়েছেন। কী কী বই পড়ে ফেলা দরকার তার তালিকা তৈরি করেছেন। উনিশশো সাতাশ সালের জুলাই মাসে হেলেন ভাইগেলকে চিঠি লিখে তিনি আনিয়ে নিয়েছেন মার্কসের যাবতীয় রচনাবলী এবং সদ্য প্রকাশিত বিপ্লবের কালানুক্রমিক ইতিহাস। এর পরপরই তিনি গভীরভাবে মার্কসবাদ অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি শ্রমিকদের স্কুলে হেরমান ডুংকের পরিচালিত মার্কসবাদের ক্লাশগুলিতেও অংশ নেন। মার্কসবাদে দীক্ষা নেয়ার আগে তাঁর মধ্যে কিছুটা নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। মার্কসবাদ তাঁর নৈরাজ্যমূলক প্রবণতাগুলিকে খানিকটা শোধরায়। চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর বিরক্তি খানিকটা দূর করে তাঁর মধ্যে একটা মানসিক নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করে।
মার্কসবাদ অধ্যয়নের পরই তিনি সাম্যবাদী আন্দোলনের দিকে ফিরলেন। উনিশশো আটাশ সালের পরে তাঁকে পাওয়া যায় এক সাম্যবাদী শিক্ষক হিসাবে, যিনি শিক্ষামূলক নাটক লিখছেন এবং নাটককে তুলে ধরলেন এক নতুন দর্শককুলের কাছে। সেই দর্শক হলো সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী। মার্কসবাদ থেকে লব্ধ জ্ঞানই তাঁর চিন্তার জগতকে পূর্বের তুলনায় আরো ধারালো করে তোলে। সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পরই তিনি রচনা করেন থ্রি পেনি অপেরা বা তিন পয়সার পালা। তিন পয়সার পালা নাটকটি মূলত তাঁর কোনো মৌলিক রচনা নয়, বেগারস অপেরা অবলম্বনে তিনি তিন পয়সার পালা রচনা করেন। সেখানে প্রথমবার তিনি মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটান, যা পুঁজিবাদী সভ্যতার ভয়ংকর দিকগুলি তুলে ধরে। নাটকটিতে কোনো ভাবাবেগ সৃষ্টির প্রয়াস নেই। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সত্যিকার চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয় এই নাটকে। তথাকথিত আইন শৃঙ্খলার রক্ষকদের সঙ্গে দুষ্কর্মকারীদের যোগাযোগই হচ্ছে নাটকের মূল সুর। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যে শোষকশ্রেণীর এবং দুস্কৃতিকারীদের রক্ষক এবং তাদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত, সেটা ব্রেশটই এই নাটকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন।
তিন পয়সার পালা নাটকে সমাজবিরোধীদের বস্তী এলাকার পরিবেশ দেখানো হয়, যে জায়গা দুশো বছর আগের এবং তখনও দরিদ্রতম। দরিদ্রতম হলেও সেটাই লন্ডনের ‘সর্বদা-ভালোমানুষ-নয়’; এমন লোকদের আশ্রয়স্থল। যোনাথন পীচাম বস্তীর সেই দুর্দশার মধ্য থেকে অর্থ উপার্জন করে। সুস্থ মানুষদের কৃত্রিম উপায়ে পঙ্গু সাজায় এবং স্বচ্ছল সম্প্রদায়ের করুণা উদ্রেক করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ভিক্ষা করতে পাঠায়। জন্মগত বা সহজাত অসৎ প্রবৃত্তির বশে সে তা করে না। টিকে থাকার বা বাঁচার লড়াই এটা তার কাছে। পীচাম বলে, ‘এই দুনিয়ায় আমি আত্মরক্ষায় ব্যস্ত’, এই হচ্ছে তার মূল কথা। বস্তীর জগতকে যে অপরাধীরা বেছে নেয় নিজেদের চক্রজাল বিস্তারে, দরিদ্র মানুষগুলিকে বেঁচে থাকার লোভ দেখিয়ে যে নিজেদের চক্রজালে জড়িয়ে ফেলে; ব্রেশট বহু বছর আগে এই সত্যটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। স্বাভাবিকবাদীরা বস্তীর জীবনে শুধুমাত্র দেখেছেন দারিদ্র, ব্রেশট সেখানে দেখলেন জীবন সংগ্রামে তাদের বহুজনকে অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াকে। স্বাভাবিকবাদীদের সঙ্গে ব্রেশটের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এখানেই। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ঘটনার আরো গভীরে তাকায় আর নতুন কিছু আবিষ্কার করে। বস্তীর জীবনকে ঘিরেই পীচান নিজের অপরাধের ঘাঁটি সাজিয়েছে। লন্ডনের অপরাধ জগতে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দস্যু সর্দার ম্যাকহীথ। বেশ কিছু দুশ্চরিত্র লোক এবং তাদের কার্যকলাপ পরপর দেখানো হয় এ নাটকে। নাটকের দস্যু সর্দার শেষ পর্যন্ত ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে একটি ব্যাংক বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সেটা হবে আইনসঙ্গত ডাকাতি। পুলিশ তাহলে আর তার পিছু নিতে পারবে না। তিন পয়সার পালাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যাংক সম্পর্কে এই হচ্ছে ব্রেশটের মনোভাব। নতুনভাবে ব্যাংকের চরিত্র উদ্ঘাটন করেন মার্কসবাদী ব্রেশট। সকলকে বুঝিয়ে দিলেন, ব্যাংক হচ্ছে আইনগতভাবে সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনের জায়গা। নাটকটি পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত হতে থাকে। তিন পয়সার পালা বার্লিনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। প্রথমবার একাদিক্রমে চারশো রাত্রি এই নাটকের অভিনয় হয়। জার্মানী ও ইউরোপের অন্যান্য অংশে অসংখ্য মঞ্চে অসংখ্য রাত্রি ধরে এর অভিনয় চলে। নাটকটি ব্রেশ্টকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। নাটকটি লক্ষলক্ষ টাকার ব্যবসায়িক সাফল্যও লাভ করেছিল।
মার্কসবাদের সাথে পরিচয় ব্রেশ্টকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। মার্কসবাদ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এক বিচারশীল দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদ থেকে জ্ঞানলাভের পর ব্রেশ্ট নিজেই লিখেছেন, মার্কসবাদ নিয়ে গভীর অধ্যয়ন ছাড়া আধুনিককালে নাটক লিখতে যাওয়াই বিড়ম্বনা। নাট্যকার হিসাবে ইতিহাস সম্বন্ধে মার্কসের ধ্যান-ধারণা না পড়ে উপায় নেই। মার্কসবাদ পাঠ করবার আগ পর্যন্ত তিনি শুধু পুঁজিবাদের বিরোধিতাই করেছেন। মার্কসবাদ অধ্যয়নের পর তাঁর মধ্যে এলো বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার চিন্তা। তিনি সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠলেন মনেপ্রাণে। মার্কসবাদ অধ্যয়নের পরই সমাজ বদল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। ব্রেশ্টের উদ্দেশ্য তাই সমকালীন অন্যান্য মার্কসবাদী নাট্যকারের চেয়ে অনেক ব্যাপক। মার্কসবাদ অধ্যয়নের পর তিনি বিরামহীনভাবে মার্কসবাদের শিক্ষাকে কাজে লাগান এবং শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে নাটকের সংযোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে জোর দেন। তিনি মনে করতেন নাটকের কাজ হচ্ছে সোজাসুজি রাজনীতি প্রচার করা। শিল্পকে যদি সাধারণের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সে শিল্প শাসকশ্রেণীর হাতিয়ারে পরিণত হয়। সেইজন্য নাটককে হতে হবে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গী। প্যারি কমিউন থেকে শুরু করে উনিশশো পাঁচ সালের রুশ বিপ্লব, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, হিটলারের অভ্যুত্থান, চীনের বিপ্লব, ফ্রান্সের নাৎসী বিরোধী পার্টিজান যুদ্ধ, স্তালিনের বিপুল কর্মযজ্ঞ, ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস কর্র্তৃক বাংলার মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি একের পর এক সব এসেছে তাঁর নাটকের পটভূমিকা হিসাবে। ছুরির ফলার মতন তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টি চলে গেছে সমাজবদলের প্রয়োজনে পুঁজিবাদের ব্যবচ্ছেদ করতে।
তিনি উনিশশো উনত্রিশ সালে রচনা করেন “দি রাইজ এন্ড ফল অব দি সিটি মাহাগনি” বা মোহনগরীর উত্থান পতন। নাটকটির কাহিনী হলো পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসা বেগবিক এবং তার অনুগামীরা মাহাগনি শহরকে ব্যবসার স্বর্গভূমিরূপে আবিষ্কার করলো। নানারকম বাধানিষেধ উপস্থিত হওয়ায় ব্যবসার রমরমার মন্দা দেখা দিয়েছিল। ইতিমধ্যে শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে আলাস্কার কাঠুরে পল। তার মত নিষেধাজ্ঞা না মানার মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতা। ফলে নিয়ম দাঁড়ালো একটাই; খাওদাও, ফুর্তি করো, ভালোবাসো, পান করো লড়াই করো আমৃত্যু। পলের জীবনে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য চলে যাবার পর, পলকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত বলে রায় দেয়া হলো। কারণ টাকা কড়ি না থাকাটা এ পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় অপরাধ। গোলমাল গোলযোগের মধ্যে শহরে আগুন লাগে। শহরের বাসিন্দারা দেখে তাদের সুখ-স্বচ্ছন্দ্য, নৈতিকতা, সভ্যতা সব যা কিছু অর্থের উপরেই দাঁড়িয়েছিলো; তা আসল সময়ে কোনো কাজেই লাগলো না। ব্রেশ্ট এই নাটকে পুঁজিবাদী ভোগবাদী সমাজের অন্তঃসারশূন্যতাকেই রূপ দেন।
ধনতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, মানুষের মনুষ্যত্ব অপহরণের বিরুদ্ধে, মনুষ্যত্বের বিনাশের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই ছিলেন খড়গহস্ত। নাট্যকর্মকে তিনি সেভাবেই দেখেছেন। নাট্যকে হতে হবে দুনিয়া বদলের মাধ্যম। নাট্যনির্মাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, নাট্য প্রযোজনাগুলো মার্কসবাদের অনুসরণে সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমরূপে কাজ করবে। নাট্যশালা তখনই শুধু স্বাধীন ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবে যখন যারা সমাজের বিরাট পরিবর্তন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে অধীর তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। তিনি নিজ যুগে বসে দেখে গেছেন যুদ্ধ, হিংসা, মানুষের অশেষ দুঃখ, বুভুক্ষা, বেকারত্ব, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ, বিপ্লব। দেখেছেন দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ, আবার যুদ্ধ ও যুদ্ধান্তে ঠান্ডা লড়াই। এর মধ্যেই তিনি দেখেছিলেন এক পরিবর্তনশীল জগৎ আর মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনা। তিনি হতাশ না হয়ে তাই জগতটাকে পাল্টাবার জন্য, নতুন এক সমাজের জন্য শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে গেছেন, দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেই তিনি শুধু ক্ষান্ত ছিলেন না। নাটকের পর নাটকে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের সরব প্রচারক, অস্ত্রের উপাসক।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদীদের মতোই ব্রেশটের বিশ্বাস ছিল যে মানব সমাজ নিরন্তর পরিবর্তনশীল এবং প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে ধাবমান। তিনি বিশ্বাস করতেন সবকিছুরই পরিবর্তন সম্ভব, দর্শককে সেই পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে, যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তা শাণিত হবে। ব্রেশ্ট নাট্যশালাকে সমাজ বিপ্লব আন্দোলনের একটি রণাঙ্গন করে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে এসে দর্শক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা পাবে। যেহেতু তিনি ছিলেন বিপ্লবী চিন্তাবিদ, নাট্যশালাকে তিনি করে তুলেছিলেন তার সমাজদর্শন প্রকাশের ও প্রচারের মাধ্যম; যার ভিতর দিয়ে নাট্যকর্মকে মার্কসবাদী এক চিন্তার রাজ্যে পরিণত করে তোলাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সমাজ বদলানোর স্বার্থেই তাঁর সব নাটকের মূল প্রতিপাদ্য ছিল মানুষ ও তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। সমাজ বদলের স্বার্থেই তিনি তাঁর বক্তব্য দাঁড় করিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তির ওপরে আর নাটককে তিনি ব্যবহার করেছেন সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির পক্ষে। মার্কসবাদী হিসেবে তিনি নাট্যশালাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন সারাবিশ্ব জুড়ে একটি বিপ্লব ঘটাবার স্বার্থে। যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী শোষকরা উৎখাত হবে এবং শ্রমিকশ্রেণী বা জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে।
তিনি এই সত্য অনুধাবন করলেন যে, চলমান নাট্যশালাগুলো শাসকশ্রেণীর হাতে উৎপাদনের শক্তি সমূহের মতো তার শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার এক যন্ত্র। যে নাট্যকার সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চান তিনি প্রথাবদ্ধ নাট্যকলা সম্পর্কে নীরব থাকতে পারেন না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থ কায়েমী করে রাখে এমন কোনো কিছুর পক্ষেই তিনি রায় দিতে পারেন না। তিনি হবেন অবশ্যই নতুন পথের সন্ধানী, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক দুই ক্ষেত্রেই। সেই দিনগুলোতে পুরানো জার্মান নাট্যশালায় ব্রেশ্ট দেখেছিলেন আবেগের ব্যবসা। বুর্জোয়াদের সেই আবেগ জাগানো নাট্যকৌশল নাৎসীদের হাতে একটা বীভৎস হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছিল বিশের দশকের শেষ দিকে। তিনি সেই বুর্জোয়া নাট্যশালার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজস্ব ধারা ও তত্ত্ব নির্মাণের মধ্য দিয়ে এমন এক নাট্যশালা সৃষ্টি করতে তৎপর হলেন, যেখানে নাট্যকর্ম যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জনগণকে শ্রেণীসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে। ব্রেশ্ট বুঝেছিলেন প্রথাগত নাট্যরীতির খোলনলচে না পাল্টালে কিছু করা যাবে না। বিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই তাই ব্রেশ্ট বুর্জোয়া নাট্যরীতিকে নতুন আঙ্গিক ও বুর্জোয়া মতাদর্শের বৈপরীত্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় ঢেলে সাজালেন। নিজেই তাঁর নামকরণ করলেন ‘মহাকাব্যিক নাট্যরীতি’। যদিও এই ‘মহাকাব্যিক নাট্যরীতি’ ধারণাটি ব্রেশ্টের একার নয়।
পিসকাটরের স্ত্রী মারিয়া লে পিসকাটর দাবি করেন, মহাকাব্যিক নাট্যরীতির জন্ম বিশের দশকের বিক্ষুব্ধ বার্লিনের কঠোর বাস্তবভূমিতে। সক্রেটিস, দিদেরো কিংবা শিলার তো নয়ই, মার্কসকেও মহাকাব্যিক নাট্যরীতির সৃষ্টিকর্তা বলা চলে না। মারিয়া লে পিসকাটর বোঝাতে চান, মহাকাব্যিক নাট্যরীতি কারো একার সৃষ্টি নয়। মহাকাব্যিক নাট্যরীতির স্রষ্টা গোটা একটি প্রজন্ম। মহাযুদ্ধের পরবর্তী বিশের দশকের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে মহাকাব্যিক নাট্যরীতির জন্ম। একক কোনো প্রচেষ্টায় নয়, যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল মহাকাব্যিক নাট্যরীতি। সামিল হয়েছিলেন নাট্য পরিচালক পিসকাটর, কবি ব্রেশ্ট, বার্লিনের নাট্য ব্যক্তিত্ব গেওর্গ গ্রোসৎজ, ভাল্টার মেহরিং, নাট্যকার এর্নস্ট টলার এবং মঞ্চ নির্মাতা ভাল্টার গ্রোপিউস। যুদ্ধের আঘাতে যেমন এঁরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন, তেমনিই এই যুদ্ধই আবার তাঁদের শিল্প সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল। শুধু রাজনীতিগত দিক থেকেই নয়; নৈতিক, সামাজিক এবং সৌন্দর্য্যচেতনায়ও বিদ্রোহ সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু এঁরা শুধু বিদ্রোহী ছিলেন না, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সেক্ষেত্রে ব্রেশ্ট ছিলেন অগ্রগণ্য এবং তাঁর প্রতিভা সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
পুরানো নাট্যচিন্তার বিরুদ্ধে ব্রেশ্ট কেন তাঁর নাট্যরীতিকে মহাকাব্যিক বললেন? মহাকাব্য বহু ঘটনাকে এক সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় উপস্থিত করে ঘটনাকে ইতিহাসের ব্যাপ্তি আর দর্শনশাস্ত্রের গভীরতা দিতে পারে। মহাকাব্যিক নাট্যরীতির দাবি নাটককে শুধু সমাজের দর্পণ হয়ে থাকলেই চলবে না, সমাজের বিশাল ভাঙাগড়ার ব্যাখ্যাকারও হতে হবে। শ্রেণীসংগ্রামের জটিল বিষয়গুলিকে রূপ দিতে হবে, সবরকম দ্বন্দ্বের স্বরূপ খুলে ধরতে হবে দর্শকদের সামনে। দর্শককে তার নিজের জগৎ সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই হবে মহাকাব্যিক নাট্যরীতির মূল কাজ, যাতে জগৎকে পরিবর্তন করার কাজে সে হাত লাগায়। তিনি বাস্তববাদী নাট্যধারার বিপরীতে তাঁর মহাকাব্যিক নাট্যভাবনাকে দাঁড় করান। তাঁর মতে বাস্তববাদী নাটক সমাজের সমস্যাগুলোকে চিত্রায়িত করলেও পরিবর্তনশীল দুনিয়া ও তার দ্বন্দ্বগুলিকে ধরতে পারে না, কারণ সে নাটক মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মহাকাব্যিক নাট্যরীতি প্রচলিত নাট্যরীতির বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র ধারা এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আরেকটি শক্তিশালী পদ্ধতি। নাট্যকলার ইতিহাসে মহাকাব্যিক নাট্যরীতি হলো বুদ্ধিনির্ভর বিশ্লেষণী ভঙ্গির নাট্যপ্রচেষ্টা, যেখানে মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগই হবে প্রধান বিষয়। যুক্তির শান্ত পরিবেশনে যেমন মার্কসবাদী তাঁর বিপ্লবের তত্ত্ব পৌঁছে দেন শ্রমিকশ্রেণীর কাছে, নাট্যকারও তেমনি বিশ্লেষণী কৌশলে দর্শককে বোঝাবেন সমাজ বিবর্তনের ধারা, সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা। দর্শনের জায়গা দখল করবে নাটক ঠিক হেগেল যেভাবে বলেছিলেন, মহাকাব্যিক পদ্ধতিতে শিল্পকলা উন্নততর হতে হতে দর্শনে রূপান্তরিত হবে। চিন্তার রাজ্যে উন্নীত হয়ে যাবে। মার্কস যদিও বিষয়টাকে দেখেছেন ঠিক উল্টো দিক থেকে। মার্কসের মতে দর্শনই যাবে লুপ্ত হয়ে। শিল্পই থাকবে, দর্শন নয়।
সন্দেহ নেই যে, ব্রেশ্ট একজন বিপ্লবী নাট্যকার। তিনি নিরপেক্ষ নন, প্রতি মুহূর্তে তিনি শ্রেণীসংগ্রামের বিশ্লেষক ও প্রচারক। নিজস্ব মতামত বা উদ্দেশ্য ব্যতীত যেহেতু কিছুরই শিল্পরূপ দেয়া যায় না, সেজন্য কোনো নাট্যকারই নিরপেক্ষ নন, কোনো না কোনো পক্ষে তিনি থেকেই যান। যুদ্ধমান দুই শ্রেণীর বাইরে তাঁরা কেউ যেতে পারেন না, কোনো না কোনো পক্ষের হয়ে তাঁরা মতামত দিয়ে ফেলেন। যাঁরা বিপ্লবী তাঁরা নিজের পক্ষে সচেতনভাবে এবং সাহসের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে যান, দোদুল্যমানতায় ভোগেন না। সে বিচারে ব্রেশ্ট বিপ্লবী নাট্যকার তো বটেই একই সাথে মার্কসবাদী নাট্যকার। তিনি তাঁর সব নাটকেই নানাদিক থেকে বুর্জোয়া সমাজকে আঘাত করেছেন, সমাজতন্ত্রের পক্ষেই তাঁর প্রচার কিন্তু নৈর্ব্যাক্তিকভাবে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘আপনি যদি নিরপেক্ষ হন, শ্রেণীসংগ্রামে যদি আপনার আগ্রহ না থাকে, তবে আমার নাটক স্পর্শ করবেন না।’ মার্কসীয় দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি সব সময় শ্রেণীসংগ্রামের নাটক লিখে গেছেন। তাঁর নাটক প্রচারধর্মী হলেও তা সস্তা কচকচানি নয়। পৃথিবীর যে-কোনো বড় নাট্যকারের মতোই তার নাটকের রস, চরিত্র সৃষ্টি বহুগুণে সমৃদ্ধ। তিনি বলেছিলেন যে, সমালোচকরা যদি আমার নাট্য দর্শন নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে নাট্য প্রযোজনাগুলো দেখতে আসতেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে সবশেষে এটা একটা নাট্যকর্মই, যে নাট্যকর্মে কল্পনা আছে, রসকিতা আছে, এবং যার একটা অর্থ আছে।
বিশেষ করে চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছেন। মান ইস্ট মান বা মানুষ মানুষই নাটকটি লেখার সময়ই তিনি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তাহলো মানুষকে কীভাবে দেখা হবে। তাঁর চোখে সম্পূর্ণ ভালো, সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ বলে কিছু নেই। সব মানুষই দোষ এবং গুণ দুয়েরই অধিকারী। সব নাটকেই তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। দ্বান্দ্বিকতার ভিতর দিয়ে প্রতিটি মানুষের চরিত্রের বৈপরীত্যকে তিনি হাজির করেন তাঁর নাটকগুলোতে। তাঁর নাটকের চরিত্ররা তাই নির্মমভাবে বাস্তব ও দ্বন্দ্বজর্জর। সেখানে প্রতি মুহূর্তে মানুষের নানা বৃত্তিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে শ্রেণীর ভিত্তিতে। বিশুদ্ধ কোনো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর নাটকে। বিশুদ্ধ প্রেমও নয়। নারী-পুরুষ সম্পর্ক চিত্রায়ণে বিশুদ্ধ প্রেম, নিষ্পাপ আবেগ আর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ প্রভৃতি মিথ্যাকে কোনো আমল দিতেই রাজি হননি তিনি। তাঁর মতে বুর্জোয়া সমাজে প্রেম হলো লেনদেনের একটা সম্পর্ক। এ সমাজে মানুষ তার সুকুমার বৃত্তি থেকে বিয়োজিত। তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা টাকার ক্লেদাক্ত স্পর্শে কলুষিত। সেজন্য ব্রেশ্টের নাটকে আছে অবহেলিত মানুষের ছবি। নানা লোকঠকানো বৃত্তির মানুষ এবং নানা প্রকার উঞ্ছবৃত্তির মানুষ। নিজস্ব বৈপরীত্য নিয়ে এসব চরিত্ররা হাজির হয়েছে। বুর্জোয়া কিছু প্রথাগত নাট্যের মতো এরা কেউ ছাঁচে ঢালা নয়। বুর্জোয়া নাট্যচিন্তায় সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিই বড় হয়ে দেখা দেয়। সেখানে নাটকের চরিত্রগুলোকে দেখানো হয় এমন অনড় যেন বিভিন্ন বা সব পরিস্থিতিতেই তারা রূপান্তরহীন, পরিস্থিতিবিহীনভাবেও যেন বা তারা অস্তিত্বময়।
বুর্জোয়া নাট্য উপস্থাপনা রীতিতে সমাজের দ্বন্দ্ব বিরোধগুলোকে মুছে ফেলা হয়, গল্প বলার ঢং দর্শককে শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়, ঘটনাবলীকে হাজির করা হয় এমনভাবে যেন সে-সব কেবল ওভাবেই ঘটতে পারে, আর কোনোভাবে নয়। বুর্জোয়ারা সমাজের ব্যক্তি মানুষটাকে যেভাবে দেখাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে তার আসল রূপটা কী, সেটাকেই ব্রেশ্ট দেখাতে চেয়েছেন তাঁর সব নাটকে। তাঁর চরিত্ররা বিপ্লবী কি অবিপ্লবী সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু প্রায় সকলেই কেন নানারকম আপোস, চুরি, জালিয়াতি, অসাধু কার্যকলাপে জীবন কাটায়; এ নিয়ে সমালোচক মহলে বহু বাদানুবাদের ঝড় উঠেছে। বলা বাহুল্য এ ক্ষেত্রেও তিনি মার্কসবাদী হিসেবে বুর্জোয়া নাট্যধারার মহানায়কদের আস্ফালন অগ্রাহ্য করে মূর্তিমান অনিয়মের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, প্রত্যেক মানুষ যদি মানব সমাজের ইতিহাস হয় তাহলে মানুষের বিশ্লেষণে ইতিহাসের প্রভাব, নানা চিন্তা ও ঐতিহ্যের প্রভাব অস্বীকার করলে মানুষের বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত হতে বাধ্য। ব্যক্তিগতকে তাই তিনি ঐতিহাসিকে পর্যবসিত করেন, যেখানে ব্যক্তির ইতিহাসের মধ্যে সমাজের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ধরা পড়বে। ব্রেশ্টের কাছে শিল্পোন্নত সমাজে ব্যক্তি হলো এক ক্ষুদ্র অণুর মতো বা বিরাট মেশিনের নাট-বল্টুর মতো। কথাটার ব্যাখ্যা হলো মানুষের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি মানুষ হচ্ছে বিশ্বমানব সত্তার একটি অংশ। ব্যক্তি মানুষ হচ্ছে সমগ্র মানব জাতির খণ্ডিত সত্তা। কিন্তু তার মানে এ নয় যে ব্যক্তিসত্ত্বা কখনো পরিবর্তনীয় নয়। সমাজ এবং মানুষ যে পাল্টায় এটাই বরং তার নাটকের প্রধান দিক। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পেছনের কারণটি দ্বান্দ্বিক। মার্কসবাদী দর্শন বিশ্বের প্রতি খণ্ডের সঙ্গে অন্যান্য খণ্ডের অপরিহার্য সংযোগ ও ক্রিয়াশীল সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের সচেতন রাখে; অংশের বিচারে সমগ্রের কথা স্মরণ করায়। সমগ্রের বিচারে অংশের সম্বন্ধে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যজ্ঞানের দাবি করে এবং জগতে পরিবর্তনের নিরন্তর ধারা সম্বন্ধে আমাদের অবহিত রাখে।
মার্কসবাদের আলোকে ব্রেশ্ট মনে করতেন, বুর্জোয়া নাটকের প্রবক্তারা ইতিহাস ও সমাজকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি মানুষকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে, বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটি খণ্ডিত মানুষেরই ছবি আঁকছেন মাত্র। তিনি বলছেন, খণ্ডিত জীবনের চিত্র এঁকে মোহ সৃষ্টি করা নাট্যকর্মের উদ্দেশ্য নয়; দর্শকদের মোহমুক্তি ঘটিয়ে চূড়ান্ত সত্যের দিকে নিয়ে যাওয়াই নাট্য প্রযোজনার লক্ষ্য। পূর্ণ মানুষের ছবি চাই সেখানে। মানুষের শ্রেণীচরিত্র, ব্যক্তিগত গুণাগুণ, মহত্ব ও নীচতা সব মিলিয়ে তার আস্ত একটি ছবি আঁকতে চেয়েছেন তিনি। “মাদার কারেজ” বা সাহসী জননী নাটকে তাই স্নেহশীল মাতার পাশাপাশি বিরাজ করে মুনাফালোভী, অর্থগৃধ্নু মা, যিনি মুনাফার স্বার্থে নিজের ছেলেকে চিনতে অস্বীকার করেন। গ্যালিলিওর মতো মহান বিজ্ঞানীও সুস্বাদু খাবার এবং পানীয়র প্রতি বিশেষভাবে লালায়িত। তিনি তাঁর গবেষণা বাধাগ্রস্ত হবে বলে প্লেগের মতো মহামারীকে অগ্রাহ্য করেন আবার চার্চের ভয়ে কাপুরুষের মতো আচরণ করেন। তিনি ভিন্ন বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার নিজের নামে চালাতেও দ্বিধা করেন না, আবার বিজ্ঞানের স্বার্থেই নিজেকে উৎসর্গ করেন। সমাজের ঘটনাবলীর সাথেই তার চরিত্র বাঁধা পড়ে থাকে। সেজন্য হিটলারের ছবি আঁকতে গিয়ে ব্রেশ্ট শুধু হিটলারের ঘাড়েই সব দোষ চাপান না, ফ্যাসীবাদের সব দায়িত্ব বিশেষ ব্যক্তির গলায় ঝোলান না। তিনি দেখিয়ে দেন কেন, কাদের উদ্দেশ্যে, কীভাবে ফ্যাসীবাদ জাতি বৈষম্যের ঘৃণ্য কদর্যতা কার্যকরী করে। ব্যক্তি সেখানে উপলক্ষ মাত্র। তিনি মনে করতেন, বর্বরতা বর্বরতার জন্ম দেয় না বরং পুঁজিবাদী সমাজে তা আসে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে। বর্বরতা ছাড়া ব্যবসায়িক পেশা টিকতেই পারে না। পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বার্থপরতাই ফ্যাসীবাদের জন্ম দেয়। ব্যক্তি সেখানে নিজস্ব ভূমিকা রাখলেও বিরাট ইতিহাসের সে ক্রীড়নক মাত্র। ব্যক্তির বিচার হবে তাই ইতিহাসের আলোকেই। ব্রেশ্টের নাটকের কোনো চরিত্র তাই সমাজ বিচ্ছিন্ন, রাজনীতি বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়। মহাকাব্যের মতো এক বিরাট পরিধির মধ্যে তার বিচরণ। চলবে