রহমান মুফিজ
রহমান মুফিজের তিনটি কবিতা
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
পা এক গৌরব
মুখের যতটা যত্ন নিচ্ছ, তারচে বেশি যত্ন নাও পায়ের।
পা তোমারে বয়ে নিয়ে চলে আজীবন, তোমারে দাঁড় করায় রাখে মুহুর্মুহু। দাঁড়ায়া থাকাটাই যে তোমার অস্তিত্বের স্বগৌরব সৌন্দর্য আর অহংকার তা তুমি বুঝতে পারবা তখন, যখন কোনো ঝড় তোমারে আঘাত করবে। দুর্দিনে দাঁড়ায় থাকতে না পারলে মানুষরে মুখ দেখাবা ক্যামনে? পা নাই তো মুখও নাই। পা কখনো কারো মুখাপেক্ষী হয় না। মুখই বারবার পায়ের কাছে গিয়ে বলে, চলো, দাঁড়াও, দৌড়াও, এই মুখরক্ষা করো। পা মুখের কথা শোনে বৈকি, কিন্তু বড্ড করুণা করে শোনে। পা করুণা না করেও শোনে। পা তার অভ্যসবশত শোনে। পা তার কর্তব্য ভোলে না কখনো।
কিন্তু মুখ? পৃথিবীর সব মুখ বিশ্বস্ত নয়, কিন্তু সব পা-ই বিশ্বস্ত। আসলে পা বহুরূপী নয়, ঠিক যতটা বহুরূপী মানুষের মুখ। তাই পায়ের ওপর আস্থা রাখো। পা তোমারে দেবে নিদানকালের আশ্রয়। মনে রাইখো, পা-ই দিয়েছে সর্বান্তকরণে তার সব। অথচ পা`কেই পৃথিবীর সবথেকে বেশি অবজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়! পা`কেই নিষ্পেষিত হতে হয় সর্বহারার মতো, গোটা জীবন। পা মূলত শ্রমিক শ্রেণি। আর মুখ বারবার বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে বুর্জোয়া আভিজাত্যের। পায়ের প্রতি অবহেলা একদম মাইনা নিতে পারি না। শ্রমিকশ্রেণির কথা বলতে যাইয়া আমি বারবার পায়ের দিকে তাকায়া ভাবি, ওর শ্রমের ওপর কী দম্ভ নিয়া দাঁড়ায় থাকি আমি, কখনো জিজ্ঞাসা করিনি, ও পা, তোমার কি ক্লান্তি নাই? দুঃখ নাই? তোমার কি কখনো মনে হয় না, একদিন এই সুবর্ণ মুখের আভিজাত্য গুঁড়াইয়া দিয়া পায়ের পৃথিবী গড়ে তুলবা?
জিজ্ঞাসা করলে পা নিশ্চয়ই বলবে, পৃথিবী তো আমারই। বরং যারা কেবলই মুখের পৃথিবী গড়ে তুলতেছে তারা মুখের সংঘাত ছাড়া কিছুই ডেকে আনতেছে না। সব মুখই অপস্মৃত হয়ে যাবে একদিন, রয়ে যাবে শুধু অগণিত পায়ের ছাপ। সেই ছাপ দেখেই লিখবে মানুষ মানুষের ইতিহাস।
নিজের কাছে লিখি
আমাদের দেখা হয়নি কোনোদিন, মুখোমুখি বসেও ছোঁয়া হয়নি পরস্পর রোদ। দুজনে দুজনকে ডেকে তুলি ছাদে, আকাশ দেখাই; নিজেদের গচ্ছিত শূন্যতা দেখাই না কাউকে।
একই গ্রহে আমাদের মুখ কখনো দূর কখনো নিকটের প্রতিচ্ছবি; বিছানা গুছাই, জগে ঢালি পানি, একই গ্রহে আমরা এখনো বাসন কোসন মাজি; আমাদের এই হা করে থাকা একেকটা দিন প্রবল তৃষ্ণার কথা লেখে; আমরা কেউ কাউকে কোথাও লিখতে পারিনি কখনো।
আমাদের চোখ চেনেনি বিহার, পুঁতে রাখা বুক তার মুখ গুঁজে রয়ে গেছে দৃশ্যের এই পারে। ওইপারে
কালশিটে দাগ, ধোঁয়ার বলক ওঠা পাকঘরের মতো কালিঝুলি আত্মা। ওইপারে কে যাবে! শীতের বিকাল দিয়েছে আলস্য, প্রেমের মতো অবকাশ, ট্রেনের শিস শুনে ঝরে পড়া নেশার বাকল। আমি আমাদের কেউ কি না— বিরাট প্রশ্ন, বিরাট জঞ্জাল চোখের পরিধিতে।
এই অতল শহরে গাদাগাদি মন, একসঙ্গে আমরা দুজন হাঁটি, একই কবির কবিতা পড়ি, একই ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ভাবি— আমরা কারা? এখনো রোজ নিয়ম করে পরস্পরকে `তুমি` বলে ডাকি!
প্রতিলিপি
মিজান সুমনকে
ওই রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে রোজ একটা করে সাঁকো দেখতে পেতাম। এমন নয় যে, একটা সাঁকোকেই বারবার নতুন করে দেখেছি। বরং প্রতিদিন নতুন একেকটা সাঁকোই আমার ভরিয়ে দিয়েছে মন। সাঁকোগুলোকে আমার ইর্ষা হতো, সাঁকোগুলোর সুখ দেখে ভাবতাম—পৃথিবীর বুকে এতটা গর্ব নিয়ে কীভাবে হাসতে পারে কোনো মামুলি বাঁশের মাচা!
বয়স বাড়তে শুরু করেছে কবে ঠিক মনে পড়ে না, কিন্তু সাঁকোগুলো যে হারিয়ে ফেলেছি তা বুঝতে পারি তখন, যখন কোনো মাছরাঙা এসে বলে না— চল্ ডুব দিই শ্যাওলা-সায়রে, চল্ মাছেদের রঙ চুরি করে ঢুকে পড়ি বাঁকখালির জলে। বুঝতে পারি, সর্বস্ব হারাতে হারাতে আমি এক অথর্ব শহরে পরিণত হয়েছি। আমার গায়ে কোনো জলগন্ধী লোম অবশিষ্ট নেই। কোনো কাঁচাচোখ কিশোরীর হলুদাভ চুল ছাপা নেই বুকে। বুঝতে পারি— দিন দিন প্রেমেরও অযোগ্য হয়ে উঠেছি আমি।
এই যে প্রেম প্রেম বলে স্যাঁতসেতে চিৎকার করে মন, এটা মূলত সাঁকোরই দোষ; মাছরাঙাটার দোষ; বেহেশতের নিগুঢ় চিহ্ন এঁকে দেওয়া সে ছোট্ট নদীটার দোষ। ওরা আমার হাতের তালুতে রুয়ে দিয়েছিল অগুন্তি রেখা—যেগুলো সুযোগ পেলেই নদী হয়ে ওঠে, নদীতে সাঁকো হয়ে ওঠে। সাঁকো থেকে লাফ দিয়েই একটা কোমল সূর্য বলে ওঠে— আমি ডুব দিই, আমাকে ধর...
আমি কাউকে ধরতে পারিনি কখনো। আলাভোলা বোকা বোকা মানুষেরা কখনো কোনো ইঙ্গিত বুঝে না; না বাস্তবে, না স্বপ্নে।