রহমান মুফিজের গদ্য ‘ভালবাসা পেনোয়া, ভালবাসা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪

কক্সবাজার শহরটার ওপর আমার বিশ্বাস প্রায় উঠে গিয়েছিল। কেন উঠে গিয়েছিলে, সে আলাপ আরেকদিন করবো। বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল সেটাই সত্য। কিন্তু এই ছেলেগুলো আমাকে আবার আমার শহরের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দিলো। এখন আমার মনে হচ্ছে, আমি যে শহর ফেলে এসেছি সে শহর খুব একটা অথর্ব হয়ে ওঠেনি এখনো। অন্তত এইসব ক্ষ্যাপাটে ছেলেগুলো— রুদ্র, ইয়াসির, রথিন, জিৎ, মং বা আরও অনেকে— এমন এক আবহ দিয়ে এখন এ শহরকে মুড়িয়ে রাখছে যে, এর আগে ঠিক এভাবে আর কেউ মুড়িয়ে রাখেনি।

আমি কী করে বোঝাবো, সমুদ্রের ঢেউ, তার স্বর, তার নোনা হাওয়া, হিমছড়ির ঝিরি-ঝর্ণা, চকরিয়া থেকে রামু, উখিয়া হয়ে টেকনাফে বিপুল-বিস্তৃত হরিৎ টিলা, হলদে মাটির পাহাড়ি রাস্তা, সুউচ্চ বৃক্ষের সারি সারি জীবনের মধ্যে কী যে সুর ঘনীভূত থাকে! কী যে বৌদ্ধিক কলস্বর প্রতিধ্বনিত হয়! আমরা তাকে বহু বহুদিন শুনি না। বহু বহুদিন অবজ্ঞায় যেন ঠেলে রেখেছি দূরত্বে। কিন্তু এরা— রুদ্র-ইয়াসির, রথিনরা, যাদের কাছে সুযোগ ছিল— ওই মফস্বল ছেড়ে, ওই আধা শহুরে মৃত্তিকা ও বনানীর গন্ধমাখা শরীর ছেড়ে মহানাগরিক হয়ে ওঠার।

সুযোগ ছিল অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়ে আরও উন্নত জীবনের লোভ পরিগ্রহ করার। কিন্তু ওরা ওই শহরেই পড়ে রইলো তার গন্ধ ভালবেসে। ওই শহরেই পড়ে রইলো গোটা জনপদের জীবন ও প্রকৃতির ঐশ্বর্য নিংড়ে নতুন নতুন গান, নতুন নতুন সুর জন্ম দেবে বলে। এরা যেন আদিতে ফিরে যেতে চাইছে। এরা যেন মাটি খুঁড়ে প্রত্নবিশারদের মতো তুলে আনতে চাইছে নিজেদের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয়। হলুদ মাটির গন্ধের মধ্যে, পাহাড়ি টিলা, সুউচ্চ বৃক্ষের সারবাঁধা ঐকতানের মধ্যে, পাতার মর্মর ধ্বনির মধ্যে এরা এমন এক সভ্যতার সুর খুঁজে নিতে চাইছে যা এ জনপদে এর আগে কেউ খোঁজেনি।

ওরা যে যাত্রা শুরু করেছে, যে গন্তব্যের দিকে যেতে উদগ্রীব তা তো তুমুল এক রোসাঙ্গ হৃদয়। যে হৃদয়ে বাস করেন মাগন ঠাকুর, দৌলৎ কাজী, মহাকবি আলাওল। হলুদ ফুলের দেশ, হলুদ মাটির দেশ এক বিস্তৃত আরাকান যেন আজ তাদের করপুটে সমুজ্জ্বল। রোসাঙ্গ প্রপিতার বুকের বিদীর্ণ হাহাকার যেন তাদের সুর ও বাণীতে জায়গা করে নিচ্ছে। কয়েকদিন আগেই তারা ইউটিউবে প্রকাশ করেছে ‘এ রুহের তলে’ শিরোনামের একটা গান। তার ভিডিওচিত্র ও সুরের ভেতরের আকুতি এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে যে, মনে হয়েছে বুদ্ধপাখি সত্যিই শিস দিয়ে গেছে অন্তরের ভেতর।

লোকশ্রুতি আছে এই জনপদে পদস্পর্শ আছে স্বয়ং বুদ্ধের। রোসাঙ্গ বনানীর হলুদ আলপথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। বদর আউলিয়ার পূণ্যস্মৃতি রয়েছে এই উপকূলে। তারও আগে মহাভারতের রাবণও হেঁটে গেছেন এই মানচিত্রের ওপর। তার স্মারক আদিনাথ মন্দির, সাক্ষী মৈনাকচূড়া। ইতিহাসে আছে, একসময় আরব বণিকের জাহাজ ভিড়েছে কক্সবাজারের বদরমোকাম ঘাটে। সুদূর ইউরোপ থেকেও এসেছে মসলাসন্ধানী শতশত আগ্রাসী বণিক। বৃটিশরাজের গভর্নর হিরাম কক্সের নাম নিয়ে থিতু হওয়া এই কলকলে উপকূল এমন সব ঐতিহাসিক ঐশ্বর্য ও পুরাণের মেলবন্ধন নিয়ে জেগে আছে যে, বিশ্বের তাবৎ সুর এর বাতাসে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হবার কথা। এতদিন হয়নি। কিন্তু এখন সম্ভবত হচ্ছে। হতে শুরু করেছে।

ইয়াসির, রুদ্র, রথিনদের হাত ধরে সে যাত্রাটা শুরু হলো। মোটাদাগে লোকধারা ও রকের মিশেলে ওরা যে সুরভজন শুরু করেছে তাতে পৃথিবীর সব সুর, সব আরাধনা এমন এক জমিন পেতে পারে যে, যে জমিন হয়তো বহুদিন কেউ  কর্ষণই করেনি। তাদের রিলিজ হওয়া দ্বিতীয় গান ‘রাতের সাঁতার’ শুনলে মনে হবে— অনাবাদী জমিনে নতুন কিছু ফলাবার আশায় কেউ কর্ষণ শুরু করে দিলো! পেনোয় এদের ব্যান্ডের নাম। পেনোয়া মানে হলুদ ফুলের দেশ। কক্সবাজারের আদিনাম। সে নামকে এরা, এই ছেলেগুলো এবার একটা নতুন উচ্চতা দিতে শুরু করলো। দেখা যাক কী কী তেলেসমাতি তারা দেখায়। আমি তাদের প্রতিটি গান শুনছি। নতুন কি গান আসছে তার অপেক্ষায় থাকছি।

এই জাদুকরদের সৃষ্টিসমূহকে শোনবার ও দেখবার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। আমন্ত্রণ জানাই এদের হৃদয় ও মগজকে উপলব্ধি করবার। ভালবাসা পেনোয়া ❤ ভালবাসা ❤

লেখক: কবি