রহমান মুফিজ

রহমান মুফিজ

রহমান মুফিজের কবিতা ‘অতশী, আর পারছি না’

প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২১

এই পর্বে তুমি মারা যাবে অতশী; এই পর্বে আমি খুনি
ধেয়ে আসা বুলেটটা গিলে ফ্যালো, শেষ সঙ্গমের
স্মৃতিটুকু মনে করো, ভাবো কী দারুণ ছিল সেই সুর—
শীৎকারে প্রলুব্ধ হচ্ছিল আমার কান, আমার চেতনা।

না, তুমি এগোবে না এইদিকে। একরাত ঘুমের জন্য
এতটা ঝুঁকি নিতে পারবো না আমি। গন্ধকাঙাল বিষ্ণু
তোমার বুক ছোঁবে না, ছোঁবে আতঙ্ক; আলগা করে ধরবে না
তোমার স্তন; পর্বতের ঐশ্বর্য নিয়ে সে নিজের অপবাদ হবে।
 
সভ্যতার জন্য প্রেম নয়, সংঘাতকেই আরাধ্য করেছে
যে অনামি কাল, আমি তারই আততায়ী। আমাকে
শিখিয়ে দেয়া হয়েছে খুনের কলাকৌশল, তোমাকে
ভালবাসতে বাসতে হন্তারক হবার বাসনা পুষেছি মনে
তোমাকে খুনের পর স্রেফ একটা রাত পাব ঘুমের জন্য;
একটা বিছানা পাব গড়াবার জন্য— যেমনটা একশো খুনের পর
নিজেকে জন্ম দেবার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম একদিন।
জন্ম নিয়েই দেখেছিলাম, মা কাঁদছে আমার ভাগের দুধ নেই বলে।

অতশী, গিলে ফ্যালো বুলেটের গর্জন। চোখে রাখো চোখ
ট্রিগারে বাজতে দাও কোলাহল। এছাড়া জাগতিক দৈন্য
উন্মুল হবে না। আমাকে ফেঁসে যেতে দাও, আমি ছাড়া
পরম্পরা থেকে ওঠে আসবে কে মহৎ খুনি হয়ে?

বাঁচতে চাও তো মরো, এইখানে মরো, আমার হাতে
নয় তো ওরা তোমার শবকে বানাবে প্রতীক, তোমার নগ্ন দেহে
সেঁটে দেবে চেতনার ম্যানিফেস্টো। ভোট ছাড়া ওদের
কোনো সঙ্গম নেই, সংবিধান ছাড়া কোনো রক্ষাকবচ নেই।

দ্যাখো, কাদের মুখে উঠে আসছে মহাত্মার নাম
অনতিদীর্ঘ কপালে কারা লিখে চলেছে জেলখানার অভিজ্ঞান?
যে পতাকা দীর্ঘায়ু কবর, যে গান বিবমিশার যাপন, যে নাম
পতনমুখীতাকে দেয় অপত্য চিহ্ন, তাকে বুকে পুষে
কে কাকে দেবে পুরস্কার? কার জন্য এ চাতুরিপূর্ণ পরিচয়?

অথচ আমিও জেনেছিলাম, মুহূর্ত এক দরকারি জীবন
সুলভ গার্হস্থ্য থেকে যারা এখনো বুঝতে শেখেনি আয়ত
সুখ-তাপ, তাদের সংঘে প্রতিদিন বিকশিত হয় মহামারি
আনন্দ ওরা পেয়েছে স্খলন থেকে; মূঢ়তার বৈভবকে জেনেছে
পরম জ্ঞানসৌর্য। আমি জেনেছিলাম মানুষ এক বিস্ময়;
মানুষ কেবলই আনন্দের সন্তান। ওরা বলেছে মানুষ বিপজ্জনক।

অতশী, তোমার বিছানায় কোনো মানবশিশু ঘুমাবে না আর
কোনো বিদীর্ণ বুক তৃষ্ণার বাংকার থেকে তুলবে না দীর্ঘশ্বাস
হৃদয়ের প্রগলভা আগুন কী কথা বলে তা তো লেখা থাকে না
সংবিধানে। সংবিধান কারা লেখে জানো? পতিত ব্রাহ্মণেরা
তারা জানে কসাইখানার নাম কীভাবে দিতে হয় রাষ্ট্র!
আর যারা বিষ্ঠা খেয়ে বাঁচে তারা জানে নিরঙ্কুশ আনুগত্য।

দ্যাখো, শিশুদের ঘুমের মতো কলকলে পার্বন চুরমার হয়ে যায়;
সর্বত্র ছড়িয়ে যায় ষড়যন্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্রই এখন নাগরিক মর্যাদা
আমি কেউ নই, আমি কেউ নই, আর তুমি বিবর্জিতা...
তোমাকে খুন করবার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে অতশী
আমি একটা বিপন্ন চরিত্র, একটা বুলেট খরচ করবার মতো
স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে আমাকে, চুম্বনের জন্য নয়।

আমার কর্তব্য চাউর হয়ে যাচ্ছে বাতাসে। দ্যাখো চারদিকে
সাদা পোশাকের দাদাগিরি। গুমনামা উঠে আসছে কাগজে
সবার নামে একটা গোপন গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে বাড়ির সামনে
জিহ্বার কর্তৃত্ব ছেঁটে নিতে চোয়ালের কাছে ঠেসে ধরছে আইন
আমাদের সব গোপন হরণ করে খিল্লি করছে শুয়োরের বাচ্চারা।
এই অপমান নিয়ে কে বাঁচবে? তুমি নাকি আমি?

বলো, বন্ধুর মুখের চেয়ে পবিত্র কোনো দেশ আছে কিনা
নিরাপদ কোনো ঠিকানা আছে কিনা গভীর আলিঙ্গন ছাড়া

অতশী, বন্ধু আমার, এই পর্বে তুমিই বরং আমাকে হত্যা করো
একটা নিপাট বিছানা দাও, দাও ষড়যন্ত্ররহিত একটা নিঃশব্দ ঘুম...
তোমাকে হত্যা করলে আমার শিশুরোদ জাগবে না কিংশুকে
বরং তুমিই বাঁচো ক্ষোভ হয়ে, আমার সগর্ব চিৎকার হয়ে...

১২ মার্চ ২০২১
শনির আখাড়া, ঢাকা