যৌনতার ট্যাবু এবং বাঙালি সমাজ
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০২০
যৌনতা নিয়ে আমাদের বাঙালি সমাজে কিছু ট্যাবু আছে। কিছু সংস্কার আছে। কিছু কুসংস্কার আছে। আছে কিছু ধর্মীয় বিধিনিষেধ। সবমিলিয়ে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের শরীরে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো যৌনতাও যে একটা অধিকার, সেটা আমরা মনে মনে স্বীকার করলেও জনসমক্ষে স্বীকার করি না।
যৌনতার ট্যাবু অনেক সমাজ উৎরে গেলেও আমারা পারিনি। এখনো প্রকাশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো নিয়ে আমরা পরিবারের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারি না। এমনকি সদ্য গর্ভবতী নারীও তার গর্ভ নিয়ে সঙ্কোচে থাকে। এ সমাজে যৌন স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। একজন বিধবা কিম্বা বিপত্নীক অথবা ডিভোর্সি কিংবা অনূঢ়-অনূঢ়া নারী-পুরুষ তার যৌন আকাঙ্খা অনবদমিত করে রাখে। অক্ষম পুরুষ বা নারী যদি বিবাহিত হয়, তবে তার সঙ্গীটি আমৃত্যু যৌনসুখ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। সন্তানদানে ব্যর্থ নারী-পুরুষও তার সঙ্গীকে আজীবন নিঃসন্তান রেখে রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে গর্ব করে।
সামাজিক শৃঙ্খলার নামে চাপিয়ে দেয়া বিধিনিষেধ আমাদের সমাজে এক ভয়ংকর ব্যাধির সৃষ্টি করেছে। বালককে রমণ সুখ বোঝানো যায় না সত্য, কিন্তু যারা এ সুখে সুখি তারাও অপরের ক্ষেত্রে সেটি বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না। বোঝার ইচ্ছাও তাদের থাকে না। কিংবা বলতে হয় অন্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার শক্তিটুকুও এ সমাজের বেশিরভাগ ব্যক্তির থাকে না।
আমরা বিয়ে করার সময় অক্ষত নারী-পুরুষ চাই। বিয়ে করার পর সে নারী-পুরুষ আমাদের সম্পত্তি হয়ে যায়। দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির অস্তিত্বে আমরা ভীত, রাগান্বিত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি। আমরা একমুখী থাকতে বদ্ধপরিকর। দ্বিমুখিতা বা দ্বিচারিতা কিংবা বহুগামিতা আমাদের সমাজে ভয়ংকরভাবে নিষিদ্ধ।
এই বাধানিষেধের বেড়াজাল ডিঙিয়ে যে দু`একটা প্রাণ এদিক ওদিক লাফিয়ে চলে যায়, তারা চোরের মতো তাদের অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি করে। প্রকাশ্য সমাজে তাদের ঠাই নেই। এমনকি চোর ধরার মতো তাদেরকে সমাজের মানুষ মাঝে মাঝে ধরেও থাকে। অথচ দুটি নারী-পুরুষের সম্মতিতে, একান্ত ইচ্ছায় তারা কাছাকাছি আসলে সভ্য সমাজের কিছু বলার থাকে না। কিন্তু আমাদের সমাজে বলার থাকে। আমরা বড় নিষ্ঠুর ও আত্মপ্রবঞ্চক।
একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, সে নারী হোক বা পুরুষ, সে যেভাবেই নিঃসঙ্গ হোক না কেন, তার একজন সঙ্গী স্পষ্ট করে বললে যৌন সঙ্গী প্রয়োজন। আমাদের সমাজ সেটা মানবে না। বলবে তোমরা বিয়ে করে নাও। বলবে তোমরা সংসারী হও। বা তোমরা সংযমী হও। সমাজকে ভয় করো। পরকালকে ভয় পাও। হায়! এই উপদেশদাতারা একবার ভেবেও দেখে না, বিয়ে চাইলেই করা যায় না। সংযমী হওয়াটা কতটা প্রয়োজন? আর বিয়েও একটি সামাজিক শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই নয়। বিয়েতো দুজন নারী-পুরুষের একসাথে থাকার একটি সমাজ সৃষ্ট বৌধ চুক্তি ভিন্ন আর কিছুই নয়।
নারী-পুরুষ মন থেকে যখন কাছাকাছি আসে তখনই সেটা সুন্দর। যদি ভালোবেসে তারা কাছাকাছি থাকতে চাই সেটা আরও সুন্দর। বিয়ে একটা ভনিতা মাত্র। বিয়ের ট্যাগ মাথায় লেগে বহু মানুষ শৃঙ্খলিত হয়ে যায়। এই শৃঙ্খল ভেঙে বিচ্ছেদ হলে তখন তাদের মর্যাদা কমে যায়। সমাজ সেসব বিচ্ছেদ সম্পন্ন নারী-পুরুষকে বাঁকা চোখে দেখে। অনেক সময় তাদের জীবনটিই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, একথা স্বীকার করতেই হয়, বিয়ের কিছু সুবিধা আছে। আত্মনিয়ন্ত্রণ বা যৌননিয়ন্ত্রণেরও কিছু সুবিধা আছে। তেমনি কিছু অসুবিধাও আছে। আমরা শুধু সুবিধাগুলোকে বড় করে দেখি। অসুবিধাগুলোকে আমলে নিই না। সেটাই আমাদের সমাজের সীমাবদ্ধতা। সেটাই আমাদের কূপমণ্ডুকতা। আমরা যদিও নিজের ক্ষেত্রে কিছুটা মডারেট হতে চাই, কিন্তু সঙ্গীকে রাখতে চাই চোখে চোখে। সঙ্গীটি কিছু ব্যতিক্রম হলে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলি। এমনকি আদালত পর্যন্ত যায়।
আমরা আমাদের মনের বিশুদ্ধতা নিয়ে অতটা ভাবি না। মনের তল তো খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে দেহের বিশুদ্ধতা নিয়ে খুব ভবি। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, দূষিত হলে মনটাই হয়, দেহ কখনো হয় না। শরীরের বিশুদ্ধতার ধারণা একটি পরিপূর্ণ ট্যাবু ছাড়া আর কিছুই নয়। আদিম সমাজে দেহের বিশুদ্ধতা বলে কিছু ছিল না। আমাদের মানুষ্যসমাজের পূর্বপুরুষেরা বা আদিপুরুষেরা দেহের বিশুদ্ধতা নিয়ে ভাবতো না বা ভাবতে হবে সেটা বুঝতোও না। সেখানে নারী ছিল প্রধান। নারীর পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হতো। পিতা ছিল গৌণ।
এখনো তো সেটাই হওয়া উচিত। সন্তানের পিতা আসলেই কে, সেটা মাতা ছাড়া জোর দিয়ে আর কে বলতে পারে? তবে কেন পুরুষ বা পিতার পরিচয়টা মুখ্য হয়ে যায়? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা বোঝা এটা। পিতার পিতৃত্ব আচরণগত। মাতার মাতৃত্ব জন্মগত। মা যার কাছ থেকেই শুক্রাণু সংগ্রহ করুক না কেন, মাতৃজঠরে তাকে দীর্ঘদিন লালন পালন করে। সন্তান ভূমিষ্ঠ করবার দায়িত্বও তারই। পিতার দশ মিনিটের কাজটা সেকারণে মোটেই মুখ্য হয় না। তবুও আমাদের সমাজ সেটাকেই মুখ্য করতে উদগ্রীব। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষত্ব বজায় রাখার একটি কৌশলমাত্র।
তবে বেশিদিন দেরি নেই যখন সিঙ্গেল মাদার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। নারী স্বাধীনতা ও নারী নেতৃত্বের বিকাশ কিংবা সাবলম্বী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পুরুষের এই কর্তৃত্ববাদ অচিরেই খর্ব হবে। সেটা ভালো হবে না মন্দ হবে তা ইতিহাস বলবে। কিন্তু হবেই। বহু বছর ধরে আমারা নারীদেরকে বঞ্চিত করেছি। ক্ষেত্রে বিশেষে সে বঞ্চনার আগুনে পুরুষও ঝলসে গেছে। তবে আর যাবে না। পৃথিবী নারীদের হবে। পৃথিবী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য স্বাধীন হবে। সব সমাজে, সর্বত্র।
ডি এইচ লরেন্সের `লেডি চ্যাটার্লির প্রেম` সেই শিকল ভাঙারই গল্প। কলকাতার আনন্দ প্রকাশনের সিগনেট প্রেস থেকে এটি প্রকাশিত। অনুবাদক নীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দত্ত মহাশয় খুব সুন্দর অনুবাদ করেছেন। কোনও জড়তা নেই। অস্পষ্টতা নেই। বইটি যৌনতা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখাবে। নিঃসঙ্গ মানুষের মন বুঝতে সাহায্য করবে। আমাদের আরেকটু মানবিক করতে সাহায্য করবে। ট্যাবুর বেড়াজাল ভেদ করে মনে নতুন সূর্যের আলো আসবে। সে আলোর প্রত্যাশায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক