যে সমাজ গড়েছি তা শিক্ষাঙ্গনকে ছাই করবে না, তা কী হয়
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : অক্টোবর ১২, ২০১৯
আপনি-আমি যে নিঠুর ও নির্যাতক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়েছি, তা অগ্নিবান হয়ে শিক্ষাঙ্গনকে ছাই করেবে না, তা কী করে হয়! তনু হত্যার সাথে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির সম্পর্ক নাই, কিন্তু ক্ষমতা-বলয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। দিনে-দুপুরে রিফাত হত্যার সাথে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির সম্পর্ক নাই, কিন্তু সম্পর্ক আছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির, ক্ষমতা-বলয়ের ভেতরে থাকা কতিপয়ের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের। বিশ্বজিতের খুনিদের অনেকেই বাইরে এখন! এই বাইরে থাকা অন্য অপরাধকামী ও সম্ভাব্য খুনিদের বর্ম হয়ে থাকে, তাদেরকে অন্যায়ের আরো প্ররোচনা দেয়, আরো দুর্বীনিত করে তোলে।
যে দেশে অন্যায়ের বিচার হয়, ন্যায়বিচারের দাবি সমাজে দৃশ্যমান থাকে, অন্যায়ের শাস্তির নজির থাকে, সেখানে অপরাধ কম হবারই কথা। যে প্রশাসন, বিচার-কাঠামো ও পুলিশ-ব্যবস্থা গড়েছি আমরা, তা কতটা সেবা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বহন করে, তাও অজ্ঞাত নয় কারো। আবরার হত্যার যে-দুটি কারণ দৃশ্যমান তার একটি ভারতের আধিপত্যবিরোধী লেখা ও অপরটি তার শিবির সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ। এ দুটির একটা কারণও কাউকে হত্যাযোগ্য করে না (অন্য কোনও কারণেও কাউকে এভাবে হত্যা করা যায় না)। গভীরভাবে ভাবতে গেলে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সামগ্রিকভাবে রাজনীতি না থাকবার কারণেই ঘটেছে।
হলগুলোয় যদি প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের থাকবার অধিকার থাকত, প্রতিটি সংগঠন বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা চালাতো, মাদার পার্টির অঙ্গ ও বশংবদ না হয়ে থাকতো, তবে ক্ষমতার ভারসাম্যের নীতি অনুসারেই সেখানে সুষ্ঠু, সুন্দর ও বিকাশ-উপযোগী পরিবেশ বিরাজ করত। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের ‘রাজনীতি’ অদ্যবধি সারাদেশ জুড়ে যে ‘রাজনীতি’ চলে তারই প্রতিচ্ছবি হয়েই আছে। যদিও শিক্ষায়তনগুলোই বল্কে বল্কে উঠে মাঝে মাঝেই জানান দেয় আমাদের কর্তব্য-কর্ম। কিশোর-আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন তার নজির। আর তাদের যতটুকু ‘ব্যর্থতা’ তা আসলে বৃহত্তর সমাজেরই ব্যর্থতা।
ছাত্রসমাজ যে শুধু বিদ্যমান সমাজ-রাজনীতির প্রচল ডিনামিক্সের প্রতিফলনই করে তা নয়, মাঝে মাঝেই সূত্র উল্টে দেবার ক্ষমতা তারা দেখায় এবং ইন্সাফের বয়ান নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু সেই হাজিরানাকে, সেই বয়ানকে কার্যকর ও বেগবান করতে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে যে বৃহৎ পাব্লিক পরিসর, তাতে যে-রাজনীতি থাকা দরকার, তা না থাকায় ছাত্রশক্তি নিজ গহ্বরেই গুমরে মরে, যেন অসহায়ভাবে ভ্রুকুটি করে আমাদেরই।
প্রতিটি আমলেই ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় যে-ছাত্র সংগঠন চলে, হানাহানি ও হত্যার রাজনীতি তারাই করে। রাজনীতি বলতেই এরা যেন বোঝে অপরকে আঘাত করে পার পেয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, অন্যায়ভাবে দখল করে টিকে থাকার ক্ষমতা ও অপরের উপর বলের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দায়মুক্ত থাকবার ক্ষমতাকে। কিন্তু রাজনীতিকে যদি বলা হয় ‘স্বমতে আনার শিল্প’ তবে এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক ও নানামাত্রিক মানবিক তৎপরতাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সেই কবে থেকে জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা-সংহতকরণে লাঠিয়াল বাহিনী ও গুণ্ডাতন্ত্রের কদর থাকায়, সেইফটি গার্ড হিসেবে এই ছাত্রসংগঠনগুলোকে পকেটে রাখেন ক্ষমতাসীনগণ!
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি একই সাথে জাতীয় রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির ছায়া হয়ে থাকে, একে অপরের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে তারা। ফলে স্বার্থ ও গদি রক্ষার তাগিদে এরা একে অপরকে টিকিয়ে রাখে, সহযোগী হয়ে। সে অর্থে বহুকাল থেকেই দেশে ছাত্ররাজনীতি নেই। যথার্থভাবে বলতে গেলে, ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠনই সত্যিকার ছাত্ররাজনীতির পথে বাধা স্বরূপ। সুতরাং, ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ক্ষমতাসীনদের উদরে থেকে যে রাজনীতি সেটাকে প্রশ্ন করতে হবে, যে রাজনীতি ‘বলপ্রয়োগ’, পেশিশক্তি ও অস্ত্রবলকেই রাজনীতি বুঝে তাকে নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু যে চিন্তা ও তৎপরতা দশের হয়ে ওঠে, যে তৎপরতা ও চিন্তা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও স্বশক্তি বিকাশে সহায়ক, সেই রাজনীতি থাকতেই হবে।
বলে রাখি, এ দেশে এখনো যারা রাজনীতি বিষয়ে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান তাদের অধিকাংশই ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা। তাদের প্রজ্ঞা থেকে আমরা যেন মাহরুম না হই। সেই সাথে, এত এত ডামাডোলের মধ্যে আবরার হত্যাকাণ্ড যেন ভুলে না যাই, ন্যায় বিচারের প্রসঙ্গ যেন শিকেয় তুলে না রাখি। রাজনীতিতে বিশেষ বিশেষ ঘটনার অশেষ মূল্য। আবরারের নৃসংশ হত্যাকাণ্ড যে সুপ্ত কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জেনেও যা আমরা না-জানার ভান করে আছি, সেই অসঙ্গত বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে, যা থেকে সমসময়ই মুক্তিকামী রাজনীতির জন্মের সম্ভাবনা থাকে।
লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষক