মোহাম্মদ রফিকের লেখা শেষ কবিতা `আলেয়া, লৌকিক’
প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২৩
কবি মোহাম্মদ রফিক ইন্তেকাল করেছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে রোববার রাত ১০টার দিকে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বয়স হয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন এই কবি। নতুন কোনো কবিতা লিখলে পোস্ট করতেন তার ওয়ালে। সেখানে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকে তিনি বিভিন্ন তারিখে পোস্ট করেন আলেয়া, লৌকিক শিরোনামের পাঁচটি সিরিজ কবিতা। ধারণা করা হচ্ছে, এই কবিতাটিই তার লেখা শেষ কবিতা। ছাড়পত্রের পাঠকদের জন্য কবিতাটি তুলে দেয়া হলো:
১.
বাষ্পীয় ছত্রাক মেঘে চোখ;
একি আগুনের পাখা দু’টি,
তুমি, দেবপরি হয়ে গেলে;
ভস্মে গড়া বিবাগী পথিক
বাতাস, বাতাসে ঊর্ধ্বশ্বাস;
ছাই-ছাই মৃত হাহাকার
দেহকাণ্ড মাস্তুল ভুবনে,
সঙ্গ না হয় বা পারাবার,
পুষ্পপাপড়ি আড়ালে অগাধ;
স্বপ্নবষ্টি পোড়াকয়লাবৎ;
আগমন, তথা নির্গমণ;
সামুদ্রিক সুড়ঙ্গ অবধি!
২.
বিস্ফোরণ ঘটে কি ঘটে না;
নিউক্লিয়ার বরফ আবৃত
দিগ-দিগন্তর বেশুমার
উজিয়ে দু’টি পা মখমলে
পশুপ্রাণি প্রান্তিক ধরায়
নাক্ষত্রিক ডিঙি বায় নাইয়া;
খলবল হেসে ওঠে কোন
তুষারের গাঙে চেলা- পুঁটি
আকাশি আবর্তে মোহ্যমান
হিমদগ্ধ কান্নাস্বরে শিশু
কুটির দাওয়ায় গূঢ় শ্বাস;
হাওয়া-হাওয়া মাটির পিদিম
ম্রিয়মাণ, জ্বলে কি জ্বলে না!
৩.
সদাপ্রভু কহিলেন,
নিচদেশে, হল্লা- চেচামেচি কেন;
পারিষদ আনত মস্তকে,
হুজুর, উহারা সিংহাসন চায়
এবার গায়েবি কণ্ঠ বলে,
বৎসগণ উহাদের লেজে আগুন ধরিয়ে দাও!
কিছুকাল যেতে না-যেতেই,
ক্ষিপ্ত প্রায় মহাপ্রভু কন,
ফের কেন গোঙানি ক্রন্দন হাহারব;
হুজুর উহারা ভস্ম হয়ে যায় ছাই
বেশ হল, বলে, সদাপ্রভু মৃদু মুচকি হাসিলেন,
ধন্য ধন্য রব অন্তরীক্ষে!
৪.
শুনি হাঁক, বিপ্লব বিপ্লব; কে, কে ডাকে;
পরান পিদিম জীয়নের বাজি চিতচেতনা,
বিপ্লব, বন্ধু রে তুই উধাও হস সেই কবে
সতের শ’ ঊনআশি ঊনিশ সতের একাত্তর;
তোর মা, বেচারি কেঁদে-কেঁদে লুটোপুটি
খেয়ে ভিখ মাগে দ্বারে-দ্বারে শতছিন্ন শাড়ি
উদম শরীর হাড় জিরজিরে পড়ে আছে ড্রেনে
অয়থাই কে খোঁজে বা নপুংসের প্রমোদ উৎসবে
টেলিভিশনের পর্দীয় অক্ষরে বর্জিত লেখনির;
হঠাৎ কপাট হুটহাট দুর্বার বাতাসে মুক্ত প্রায়,
কে যায় কে বর্শার ফলায় মাথা গড়ায় কালসিটে;
তবে না বিপ্লব, খুন হয় কবে, সেই কোন কালে,
আজ আর জানার কি প্রয়োজন আছে, থাকে!
৫.
কথা চালাচালি, বেশ কিছুক্ষণ,
লোকটা মারাই গেল শেষমেষ,
ধোয়া হয় লাশ, কাফনেও মোড়া,
তবে গোর খোঁড়া হবে কই বা কোথায়,
লোকটাই বা কে, কোথাকার, ধাম গ্রাম
সাকিন নিবাস পরবাসী ঠাঁইহীন কাল
তাই ক্রমে দীর্ঘ হয় লাশের জনতা ছুঁই
অন্তলোক প্রতীক্ষায় কবে কোন সময়ের
নাক্ষত্রির ডিঙি নিয়ে ভাসান প্লাবন আঘাটায়
কী বিপুল আনন্দের সমারোহ ও ভাই রে
দাদা-দাদি বাবা ও মা পরদাদা তারও পর
স্বজনে-বিজনে কী কথার কাহিনি রচিত
পলেস্তরা খসে-পড়া চুন- সুরকি আচ্ছাদিত
চোখ-মুখ শরীরের খাঁজে-খাঁজে প্রবাহিত
নোনাজল স্রোত পলি জমে দৃষ্টির ওপর;
জাগি নি তো, গোর হয় কোন শূন্যের মাঝার,
ডুবস্রোতে ভাসমান আদ্যিকাল, পাথুরে পাথার!