মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর প্রবন্ধ ‘সাম্প্রদায়িক ও দেশীয় জীবন’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৮, ২০২৪
সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার বাঁশদহ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত ‘সাম্প্রদায়িক ও দেশীয় জীবন’ প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
মানুষ স্বভাবতই পরের ওপর দোষ চাপিয়ে খুশি থাকতে চায়। জীবনে যত গ্রন্থি এসে তার গতিকে ব্যাহত, তার ছন্দকে পতিত, তার লক্ষ্যপথকে কণ্টকাকীর্ণ করে, তার প্রায় সবটার মূলেই দেখতে পাই মানুষের ইচ্ছাকৃত বা অজ্ঞানজাত এই ধরনের আত্ম প্রতারণা।
আমাদের স্বাদেশিক জীবনে যে প্রশ্নটি সাম্প্রদায়িক সমস্যা নামে পরিচিত হয়ে সমাধানের সকল চেষ্টাকে আজ পর্যন্ত উপহাস করেই চলেছে, তারও তলদেশে চোখ ফেরালে নজরে পড়ে এদেশবাসীর এই রকমের একটা নির্বোধ আত্মসন্তুষ্টি, যা আমাদের মুক্তি-কামনাকে নির্মম বঞ্চনা হেনে দেশের ভাগ্যকে সমাচ্ছন্ন করছে।
আমাদের সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটি প্রধানত হিন্দু-মুসলিম সমস্যা। এর জন্যে রাজনৈতিক ‘তৃতীয় পক্ষের’ স্কন্ধে সমস্ত দোষ আরোপ করাই আজকার সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে তাদের বক্তব্যে এটাই মনে হয় যে, হিন্দু-মুসলিম সমস্যার একমাত্র মূলীভূত কারণ বৃটিশ শাসনের অবলম্বিত ভেদনীতি। এই কথাটি এমন জোরালো ভাষায় এতবার এবং এতখানি ব্যাপকভাবে বলা হচ্ছে যে, তা শুনলে মনে হয় যেন বৃটিশ শাসনের সর্তক প্ররোচনা ছাড়া এদেশে হিন্দু-মুসলিমে পরস্পরের প্রতি বিরুদ্ধতার অন্য কোনো কারণই নেই।
আমার বিবেচনায় কথাটা সত্যিই যদি এই হয়, তাহলে এর ভেতর যথেষ্ট ফাঁকি রয়েছে; এবং রয়েছে বলেই যারা বৃটিশের অবলম্বিত ভেদ-নীতি সম্বন্ধে আজকার দিনে সম্পূর্ণরূপে সচেতন, তারাও হিন্দুকে মুসলিমের এবং মুসলিমকে হিন্দুর আরো কাছে টেনে আনতে পারছেন না। এদেশে যারা জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত হতে শ্লাঘা বোধ করেন, তাদের এই অশক্তির কারণ বিস্তৃত ও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। তা না করে শুধু শুধু বৃটিশের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে, বাজে কথার উপর রং ফলিয়ে আসর সরগরম করে রাখতে চাইলে দেশের অদৃষ্ট প্রসন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায় না।
হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শুধু বৃটিশ শাসনের দুষ্টনীতির দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করলেই চলবে না, আমাদের নিজেদের দুর্বলতা ও ভ্রান্তি কোথায় কতখানি পরিব্যাপ্ত হয়েছে, তাও পরিষ্কার খোলা চোখে দেখতে হবে। না দেখলে সহস্রবার মাথা কুটলেও হিন্দু ও মুসলিমকে কখনই একই অবস্থানে দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। এটা সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, বৃটিশের ভেদনীতি হিন্দু-মুসলিম উভয়ের ওপরেই ভীষণ রকমে সার্থক হয়েছে। কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, তাদের এই দুষ্টনীতি এতখানি সাফল্য লাভের পথ কোন্ দিকে কোনখানে পেল, সেইটাই আমাদের দেখতে হবে। তা না দেখে শুধু সেই নীতির উদ্দেশ্যে কটূক্তি বর্ষণ করলে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের কোনো লাভ হবে না।
আমার বিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক জীবনে হিন্দু ও মুসলিমের ভেতর পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিক বিরুদ্ধতা অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। ধর্মই এদেশে সাম্প্রদায়িক জীবনের ভিত্তি। সাম্প্রদায়িক সমাজকে এখানে গড়ে তুলেছে ধর্ম; সেই সমাজের অঙ্গ হিসেবে প্রত্যেকটি ব্যক্তির মন, চিত্ত ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে ধর্ম। কিন্তু ধর্ম হিন্দুর এক, মুসলিমের অন্য এবং তাদের পার্থক্যটা পরস্পরের প্রতি একান্তই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, হিন্দু যাকে ধর্ম ভেবে বিশ্বাস করেন, কর্মে আচরণ করেন, মুসলিম তাকে মনে করেন ধর্মঘাতী পাপ। আবার মুসলিম যাকে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মকার্য ভেবে পোষণ ও পালন করেন, হিন্দু তাকে মনে করেন অধর্ম। মোটামুটি ক’টি দৃষ্টান্ত দিই। একালের ব্রাহ্মণ্য (হিন্দু) ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলতে বোঝায় এইগুলো: (১) সাকারবাদ ও পৌত্তলিকতা; (২) জাতিভেদ, অর্থাৎ এক বর্ণের মানুষের ওপর অন্য বর্ণের মানুষের স্বাভাবিক শ্রেষ্ঠতার স্বীকৃতি; (৩) নারী জাতিকে পুরুষের অধীন প্রাণী হিসাবে সমাজে হীনতর স্থান দান; (৪) বিবাহে নারীকে পুরুষের দান গ্রহণের বস্তু হিসেবে সম্প্রদান; এবং (৫) ইতর প্রাণী গোরুকে উপাস্য দেবতার স্থান দিয়ে তাকে অবধ্য এবং তার মাংসকে নিষিদ্ধ ভক্ষ্য ভেবে অন্য আহার্য নির্বাচন।
পক্ষান্তরে ইসলামের বৈশিষ্ট্য বলতে বোঝায় এইগুলো: (১) বিশুদ্ধ নিরাকার একেশ্বরবাদ, এবং পৌত্তলিকতার সামান্যতম আভাষকেও মহাপাপজ্ঞান; (২) সামাজিক সাম্য, যার ভেতর মানুষ হিসেবে কারুর থেকে কারুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ মহাপাপ; (৩) নারীকে পুরুষের সম-মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার স্বাধীন অস্বিত্বের স্বীকৃতি; (৪) বিবাহে নারীকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে সেচ্ছায় সম্মতি বা অসম্মতি জ্ঞাপনের অধিকার দান; এবং (৫) গোরুকে অন্যান্য ইতর প্রাণীর স্থান দিয়ে তার মাংস-ভক্ষণে ধার্মিককে অনুমতি-দান। এছাড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ইসলামের ভেতর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্য এই যে, প্রথমোক্ত ধর্মে নরকে (মানুষেকে) নারায়ণের প্রতিমূর্তি বা মূর্ত প্রতীক ভাবতে আদেশ বা অনুমতি দেওয়া হয়েছে; পক্ষান্তরে ইসলামের বিধানে মানুষ কোন অবস্থাতেই আল্লার প্রতিমা বা প্রতীক নয়, সে আল্লাহ্র খলিফা বা প্রতিনিধি মাত্র। এমন দু’টি ধর্মকে শুধু পৃথক ভাবা চলে না, কেন না এরা উপরোক্ত মৌলিক বিষয়গুলোতে পরস্পরের প্রতি সম্পূর্ণরূপে বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন।
এই মূল কথাটি মনে রেখে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে আমাদের সব কথাই বিবেচনা করা দরকার, কেন না ধর্ম নিয়েই আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে সম্প্রদায় এবং ধর্মের জন্যেই এক সম্প্রদায় থেকে অন্য সম্প্রাদায় বিভিন্ন, এক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মানুষ থেকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ বিচ্ছিন্ন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের পরকীয় শাসন যে ভেদনীতি চালিয়ে এদেশে কায়েম মোকাম হতে পেরেছে, সেটা আমাদের এই বিচ্ছিন্নতার ছিদ্র দিয়েই সার্থক হওয়ার পথ পেয়েছে। এই সহজ মার্গ না পেলে তার সাফল্য এতখানি দ্রুত বা ব্যাপক হতে পারতো না এবং আজ যে আমরা ভারতের সহস্র সহস্র সন্তান পরদেশীর চালিত ভেদনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ হয়েও হিন্দু-মুসলিম দু’টি সম্প্রদায়কে পরস্পরের সঙ্গে মেলানোর পথ পাচ্ছিনে, তারও কারণ মূলত তাদের পরস্পররের ধর্মের অন্তর্নিহিত সাংঘাতিক বিরুদ্ধতাপূর্ণ এই গরমিল। এমনতরো গরমিলের ভেতর মিলনের বাণী সার্থক হওয়া কত কঠিন! এটা না বুঝে খামখা এ ওকে দুষতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না কিম্বা শুধু পরদেশীর ভেদনীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করেও কোনো লাভ নেই। লাভ থাকলে এতদিনে সেটা আমরা পেয়ে যেতাম, কেননা একালে আমরা ঢের ঢের লোকে বিদেশীর ঐ নীতিটা স্পষ্ট ধরতে পেরেছি।
এখানে প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, তাহলে হিন্দু মুসলিম এক হয়ে একই ক্ষেত্রে— একই অবস্থানে এসে দাঁড়ানো কি কোনোক্রমেই সম্ভব নয়? প্রশ্নটা এমনই করুণ যে, যেকোন সহৃদয় উৎসাহী ব্যক্তি এর উত্তরে বলতে চাইবেন, কেন সম্ভব নয়? নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু আমার ধারণা যে, এই উত্তরটা আমরা এতকাল যেমন বাস্তব জীবনে সত্যি হতে দেখলাম না, তেমনি ভবিষ্যতেও কখনো দেখবো না; মানে, আমরা হিন্দু ও মুসলিমরূপে কোনোদিনই মিলে যেতে পারবো না। মিলতে গেলে হয় হিন্দুকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-ত্যাগ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে, নয় তো মুসলিমকে ইসলাম ত্যাগ করে— হিন্দুরা রাজিহলে— হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পরিধির ভেতর এসে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু এটা করতে আমরা হিন্দু বা মুসলিম কেউই সম্মত নই; সুতরাং হিন্দু-মুসলিম মিলন অসম্ভব।
আমি পরিষ্কার অনুভব করতে পারছি যে, আমার এই মন্তব্যে জাতীয়তাবাদী বন্ধুরা ভীষণ রুষ্ট হয়ে উঠবেন; কিন্তু তাদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, তারা যা চান, আমিও ঠিক তাই চাই; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে চাই যে, এক একটা ধার্মিক বা ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুর সঙ্গে মুসলিমের মিলন আদতেই সম্ভবপর নয়। সম্ভবপর হতো যদি আমাদের সম্প্রদায়গুলো ধর্ম ছাড়া অন্য-কিছুকে কেন্দ্র বা আশ্রয় করে গড়ে উঠতো। কিন্তু তা তো ওঠে নি! তবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ধর্মকে অবলম্বন করেও হিন্দু মুসলিমের কিংবা মুসলিম হিন্দুর সঙ্গে মিলবে কেমন করে?
এ প্রশ্নে রেগে যাওয়া নিরর্থক। আমরা বক্তব্য শুধু এইটুকু যে, ধার্মিক বা ধর্মসম্প্রদায়ের অন্তর্গত ব্যক্তিরূপে আমাদের দেশবাসীরা মিলে যেতে পারে না। মানে, সাম্প্রদায়িক জীবনের পরিধির ভেতরে দাঁড়িয়ে দেশের বাসিন্দারা পরস্পরকে আত্মীয় ভাবতে পারে না। সেটা তাদের পক্ষে ভাবা সম্ভব শুধু দেশীয় জীবনে এবং তার চাইতেও বৃহত্তর মানবতার ক্ষেত্রে। এবং এটাও সম্ভব শুধু তখনই, যখন আমরা আমাদের সাম্প্রদায়িক সত্তাকে আমাদের দেশীয় সত্তা বা মানব-সত্তার সঙ্গে সমপরিধি বা সমায়তন ভাববার কদভ্যাস ত্যাগ করতে শিখবো। আমার সাম্প্রদায়িক সত্তার ক্ষুদ্রতর সীমানাকে টেনে নিয়ে আমার দেশীয় সত্তার বা মানব-সত্তার পরিধির সঙ্গে মেলাতে গেলেই বিপদ। এই বিপদ আমরা স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ডেকে এনেছি এবং এখনো আরো ডাকতে চাচ্ছি। এজন্যে পরদেশীকে দোষ দিতে যাওয়া বৃথা। কথাটা দেশ-কল্যাণের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং আরো পরিষ্কার হওয়া দরকার।
দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরুন বাংলার কথা। বাংলার বাসিন্দারূপে আমরা হিন্দু-মুসলিম সবাই একই অবস্থানে এসে দাঁড়াতে পারি, একসঙ্গে মিলে দেশের কাজ করতে পারি; কিন্তু আমাদের হিন্দু ও মুসলিম সত্তা সেখানে নীরব নিস্তব্ধ এবং অনুদ্যত থাকতে না চাইলে তা পারি না। মানে, আমার সম্প্রদায়ের পরিধির ভেতরেই আমার ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা ইসলাম চরিতার্থ হতে চাইতে পারে, তার বাইরে তাকে নিষ্ক্রিয় থাকতে হবে। যেখানে দেশের বাসিন্দারূপে আমার আত্মপ্রকাশ, কিম্বা যেখানে একজন মানবরূপেই আমার পরিচয়, সেখানে আমি বিশেষভাবে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা ইসলামের সেবক নই; সেখানে আমি শুধু একজন বাঙালি বিংবা একজন মানুষ মাত্র। সেখানে আমার আচরণ, আমার অনুষ্ঠান, আমার কর্মপ্রণালী, আমার সর্ববিধ সাধনার প্রবৃত্তি ধর্মনিরপেক্ষ দেশবাসী বা মানুষের মতো হবে, হিন্দু বা মুসলিমের মতো নয়। যেখানে আমি দেশের — দেশের সকল সম্প্রদায়ের সেবা করতে যাবো, সেখানে আমার ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতির কোনো উদ্যোগই থাকবে না। যেখানে আমি কোনো বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণীর স্বার্থের সাধনায় নামবো, সেখানে আমার হিন্দুয়ানী বা ইসলাম কোনো ভাবেই সার্থক হতে চাইবে না। যেখানে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্প প্রভৃতির উন্নতি বা সংগঠন-চেষ্টায় প্রবৃত্ত হবো, সেখানে সাম্প্রদায়িক ধর্মের বা ধর্মীয় সংস্কৃতির কোন চিন্তাই আমার মনে আসবে না। যেখানে আমি বিশ্বমানবের কল্যাণ-সাধনায় কোনো আন্তর্জতিক কর্ম-প্রয়াসে নেমে পড়বো, সেখানে হিন্দুয়ানী বা ইসলাম বিশেষভাবে আমার আনুগত্য দাবী করতে পারবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মনোভাব এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে রাজী না হওয়া পর্যন্ত দেশীয় জীবনে কিম্বা মানবতা চর্চায় হিন্দু ও মুসলিমের পক্ষে সম্মিলিত হওয়া অসম্ভব।
এটা আমরা বুঝতে চাইনা ব’লেই হিন্দু-মুসলিমে ঐক্য-চেষ্টা এযাবৎ ব্যর্থ হ’য়ে এসেছে।
আমরা আমাদের সাম্প্রদায়িক ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সাম্প্রদায়িক জীবনের চাইতে বৃহত্তর যে দেশীয় জীবন, সেখানেও উদ্যত ও প্রসারিত করতে ইচ্ছা করি; সেখানেও তাকে প্রাধান্যের আসন দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সত্তাকে জয়ী করবার গোপন বাসনা হৃদয়ে পোষণ করি। তাই আমাদের দেশে দেশসেবার মন্ত্রে ‘দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী’র বন্দনা উচ্চারিত হয়; তাই এখানে শিক্ষামন্দির ‘বাগদেবী বীণাপানি’র পূজা অনুষ্ঠিত হয়; তাই একজন শ্রেষ্ঠ মনীষীর পরিকল্পিত পল্লীকৃষির উন্নয়ন-চেষ্টায় বৈদিক স্তব দিয়ে হলকর্ষণ-উৎসব আরম্ভ করা হয়; কৃষক বা শ্রমিকের স্বার্থ-সাধনার ক্ষেত্রে হিন্দুর পৌত্তলিক পূজানুষ্ঠান সমারোহে সম্পাদিত হয়, অসংখ্য জনসভায় — সমগ্র দেশের নাম — হিন্দু প্রথায় মাঙ্গলিক উচ্চারণ, শঙ্খধ্বনি এবং মাননীয় অতিথিকে তিলকচন্দনে চর্চা করা হয়। তাই এখানে সকল সম্প্রদায়ের দেশমাতৃকার যে ভৌগোলিক সত্তা, তার আত্মাকে ‘শ্রী শ্রীকালীমাতা’ বা ‘শ্রী দুর্গা’র পৌত্তলিক রূপ দিয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আত্মপ্রকাশ করতে চায়।
একে আমরা কি বলবো? নির্বোধ গোঁড়ামি, না দুরভিসন্ধিমূলক শয়তানী? পৌত্তলিক দেবার্চনার রীতিতে দেশমাতৃকার বন্দনা গান রচনা ক’রে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মী হিন্দু যখন তাঁর দেশপ্রেমকে উদ্বুদ্ধ করতে চান, সেই দেশপ্রেমে নিরাকার-একেশ্বরবাদী দেশবাসী অংশগ্রহণ না করলে তাঁদেরকে দেশাত্মবোধহীন মনে করবার মানেটা সত্যিই কি? এটা কি একটা অমার্জনীয় মূঢ়তা নয়? এবং হিন্দুর সাম্প্রদায়িক সত্তার ভেতর সমগ্র দেশীয় জীবনকে গ্রাস করবার ষড়যন্ত্রই কি এতে প্রমাণিত হয় না?
আমি বারবার বলতে চাই যে, আমাদের দেশীয় জীবনে ঐক্য-সাধনা এই মূঢ়তায় প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছে; এই ষড়যন্ত্রে ব্যাহত হ’য়ে জগতের উপহাস লাভ করছে। এর জন্যে শুধু বিদেশীর অনুসৃত ভেদনীতির ওপর দোষ চাপিয়ে কিম্বা মুসলিমের ঔদাসীন্যকে ধিক্কার দিয়ে খুশী থাকতে চাওয়া পরিষ্কার মূর্খতা।
আমাদের ব্রহ্মণ্য-ধর্মী পৌত্তলিক দেশবাসীদের এর থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্ট করার সময় এসেছে। পৌত্তলিক হিন্দুয়ানী এবং পৌত্তলিক হিন্দু সংস্কৃতি হিন্দুর সাম্প্রদায়িক সীমার ভেতরেই চরিতার্থ হ’তে পারে; বৃহত্তর দেশজীবনে তার আগমন অনধিকার-প্রবেশ এবং নিষিদ্ধ। ইসলাম এবং ইসলামী সংস্কৃতি সম্বন্ধেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। আজ হিন্দুকে এটা মানতে হ’বে এবং দেশজীবনের সমস্ত কর্মপ্রয়াস ও চিন্তা-সাধনাকে সেইভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। মুসলিমকেও এটা বুঝতে হবে, এবং সেইভাবে নিজেকে সংযত ক’রে চলতে হবে। হিন্দু-মুসলিম উভয়েই যদি এতে সম্মত না হন; মানে, ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির আস্ফোটকে ধর্ম-সম্প্রদায়ের বৃত্তের ভেতর সীমাবদ্ধ রেখে দেশজীবনকে অসাম্প্রদায়িক স্বাদেশিকতার যোগ্য অধিবাসরূপে গ’ড়ে তুলতে রাজী না হন, দেশীয়-জীবন কোনদিনই দ্বন্দ্বহীন হবে না, বরং দু’টি সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ভেতর মূলত এবং স্বভাবত পরস্পরের প্রতি যে বিরুদ্ধতা আছে, সেইটাই সেখানে অনিবার্যরূপে প্রতিফলিত হবে। বিধাতারও বুঝি সাধ্য নেই যে, তা নিবারণ করেন!
সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র একথা উপলব্ধি করেন নি ব’লেই যে আমাদের তা মানতে দোষ আছে, এ সত্যি নয়। পণ্ডিত মদন-মোহন মালবীয়ের মতো ধর্মস্বর্বস্ব কংগ্রেসীরা এটা বুঝতে পারেন নি ব’লেই যে আমাদেরও তা না বুঝলে চলবে, এমন কথা নয়। আজ আমাদের সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক কর্মী ও চিন্তকদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে সনাতন পথ ত্যাগ করে নতুন পথে চলবার সময় এসেছে। এই কর্তব্যে যদি তাঁরা উদ্বুদ্ধ না হন, দেশের ভাগ্যবিধাতা কখনই তাঁদেরে ক্ষমা করবেন না, দেশাত্মার অভিশাপ থেকে কখনই তারা রেহাই পাবেন না।
আমার মনে হয়, মহাত্মা গান্ধী ধীরে ধীরে এটা উপলব্ধি করছেন। খিলাফৎ আন্দোলনের ধর্মভাবকে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন দেশমুক্তির আন্দোলনে কাজে লাগাতে গিয়ে তিনি বাংলার বঙ্কিমচন্দ্রের ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এটা বুঝে তাঁর মনের মোড় ফেরাতে এতো বৎসর কেটে গেলো। এখন তিনি গ্রামের দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করছেন; হিন্দু-মুসলিমকে সমানভাবে জানতে ও বুঝতে কর্মীদের আদেশ দিচ্ছেন; আর আমাদের স্বাধীনতাকে কিষাণ ও মজদুররাজরূপে চিত্রিত ক’রে দেশীয় জীবনের প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক রূপ উদঘাটন করছেন। কিষাণ-মজদুর পরস্পরকে হিন্দু ও মুসলিমরূপে বুঝবে শুধু পরস্পরকে সমীহ ক’রে চলতে শেখার জন্যে; কিন্তু তারা শক্তি অর্জন করবে শুধু দেশীয় জীবনেই, যেখানে তারা একান্তভাবে কিষাণ ও মজদুর; বিশেষভাবে হিন্দু বা মুসলিম নয়। সেখানে একের উপর অন্যের সাংস্কৃতিক অভিযানের (পঁষঃঁৎধষ রহাধংরড়হ এর) প্রশ্ন আসবে না; শিক্ষা, সাহিত্য, কৃষি, শিল্প প্রভৃতি সব-কিছুই সেখানে গ্রহণ করবে জীবনের দেশীয় রূপ, হয়তো তার চাইতেও বড়ো মানবীয় রূপ।
গান্ধীজীর এই দৃষ্টি, মনোভাব ও অন্তরের অভিলাষ চরিতার্থ করবার ইচ্ছা যাঁদের নেই, দেশজীবনের সর্ববিধ চর্চা থেকে তাঁদের প্রসন্ন মনে; বিদায় গ্রহণ করা উচিত — কেননা তাতে দেশমাতৃকার কল্যাণ হবে; কেননা তাতে আমাদের এই প্রাচীন মাতৃভূমি হিন্দুস্তান বা পাকিস্তান কিছুই হবে না, ভারতবর্ষই থাকবে।
উৎস: বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড