মোহাম্মদ আল মাঘৌত

মোহাম্মদ আল মাঘৌত

মোহাম্মদ আল মাঘৌতের কবিতা ‘শব্দরা যখন পুড়ছে’

বাঙ্লায়ন: রথো রাফি

প্রকাশিত : এপ্রিল ২২, ২০২২

কবিতা, এই অমর কঙ্কাল, আমাকে ক্লান্ত করে।
জ্বলছে লেবানন আহত ঘোড়ার মতো লাফায় মরুর প্রান্তে
আর আমি এক মুটকি মেয়ের সন্ধান করে বেড়াই
ভ্যানের উপর তার সঙ্গে শরীর ঘষাঘষি করতে,
বেদুইন চেহারার মানুষটাকে আমি মুছে ফেলতে চাই।
অচল হয়ে পড়ার মুখে আমার দেশ
এক নগ্ন সিংহীর মতো কাঁপছে
আর আমি খুঁজে বেড়াই ওই সবুজ দুটি চোখ
আর সাগর পাড়ের সেই ক্যাফেটিরিয়াটি
প্রতারণা করতে খুঁজে বেড়াই সেই বেপরোয়া মেয়েটিকে।
কোনো অচেনা মেয়ে, কোনো মূক মাতৃভূমি
যে কিনা সবার সঙ্গেই খায়-শোয়
তার জন্য আমি যখন কবিতা গেয়ে চলি
মনে হয় কবিতার ঈশ্বরী সেসময়
ছুরির মতো আমার হৃদয় বিদ্ধ করে চলে।
আমার ওষ্ঠ থেকে যতক্ষণ রক্ত ফিনিক দেয় আমি হাসতে পারি।
আমি সেই বিষপুষ্প,
সেই নিঠুর ঈগল যে ঝাপিয়ে পড়ে শিকারের ঘাড়ে।
আর আরব ভূখন্ডতো
আবেগঅনুরাগের বিকশমান পাহাড়
অন্ধ বুলেটের মাঠ_ তুমি কি ফিলিস্তিন নিয়ে
রক্তপাত নিয়ে এবং
দেশ দখল নিয়ে কবিতা চাও।
আমি এক অচিন মানুষ, বৃষ্টিতে গড়া যার বুক
আর আমার উদাস চোখে
চার আহত দেশ তাদের নিহতদের খুঁজে বেড়ায়।
আমি নিজের বিছানায় একা আর ক্ষুধার্ত, একটি রেশম কীটের মতো তড়পাচ্ছি,
বিষাদের গান শুনছি,
তখনই প্রথম গুলিটার শব্দ শোনা গেল।
মরুভূমি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে!
এই রক্তিম হাত কার হাত,
আর কে সেতুর নিচে এতো সাবধানে ফুলগুলোর যত্ন নেয়?
এসব কাদের কবর, নক্ষত্রের নিচে এমন আনত হয়ে আছে?
পাতলা ঠোঁটের এক বীরপুরুষ ফিরে এলো গতকাল
এসব কর্কশ বুকের মাঝে,
এই বালির টিলায় যা ডেকে আনে
বাতাস আর যতো ভাঙা কামান
আর এভাবে আমাদের কারাগার কিংবা কবিতা
উপহার দেয় প্রতিটি বছর,
তার দীর্ঘ বর্শা দেখো খোলা ছুরির মতো চকচক করে।
তাকে একটা বুড়ো লোক, না হয় একটা ব্যাশ্যা উপহার দাও;
এসব নক্ষত্র দাও তাকে, আর ইহুদিদের সমস্ত মরুভূমি
যেখানকার পাহাড়ে বসে আমরা কাঁদি
আর হাই তুলি গোসলখানায়,
যেখান থেকে আমার অবিশ্বাসী চোখ সাগর পানে তাকায়।
এখানে
আমার এই কপালের মাঝখানে, যেখানে শত শব্দ মারা যাচ্ছে
বুলেটটাকেই আমি শেষ আমন্ত্রণ জানাই।
ভাই আমার,
আমি তোমার চোহারা ভুলে গেছি।
(ওইসব মাদকতাময় চোখ)
আমার বুকে ভীড় করে চার আহত মহাদেশ।
আমার কাব্যিক দৃষ্টি আর আমার সবুজ চোখ দিয়ে
একদিন এই বিশ্ব জয়ের আশা করতাম আমি।
লেবানন... জলের নীচে এক শুভ্র নারী;
বুক আর নখের পাহাড়।
চীৎকার করো, হে নিস্তব্ধ দেশ!
তোমার হাত উঁচু করো যেনো কাঁধ ফেড়ে যায়
আর অনুসরণ করো, হে ফাঁকা জাহাজ,
ঘণ্টাধ্বনির পেছনে পেছনে ছুটছে মরিয়া বাতাস।
মা আর প্রিয় নারীর মুখ
কবিতা আর ছন্দের শীতল ছাইয়ের ওপর
আমি এবার মধুর ঝর্ণা ছুটাবো,
লিখব গাছ কিংবা জুতা, গোলাপ কিংবা ছেলেদের নিয়ে।
দুঃখকে বিদায় নিতে বলবো
সুন্দর কুজোঁ বালকটিকে বলবো
আমার আঙুল সুইয়ের মতোই দীর্ঘ,
আহত দুই বীরপুরুষ আমার চোখ,
আর এ হলো কবিতার অন্তিম সময়।
লেবানন যেদিন ভেঙ্গে পড়বে আর ফুরিয়ে যাবে কবিতার ধীর বহমান রাত
নিজের কণ্ঠকেই বরং বুলেটবিদ্ধ করবো আমি।

কবি পরিচিতি: মোহাম্মদ আল মাঘৌত ১৯৩৪ সালের ৩ এপ্রিল সিরিয়ার হামা গভর্নরেটের সালামিয়াহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে আরবি মুক্ত শ্লোক কবিতার জনক বলা হয়। আরবি কবিতাকে ঐতিহ্যগত ফর্ম থেকে মুক্ত করে কবিতার কাঠামোতে তিনি বিপ্লব ঘটান। ১৮৫০ সালে কারাগারে থাকার সময়ে সিগারেটের কাগজে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই তিনি তার উজ্জ্বল কল্পনা, শব্দের সহজাত নিপুণতা এবং তার ভবিষ্যতের কাজে অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি নাটক, টিভি ও সিনেমার জন্য লিখেছেন। মাগুতের কাজ সামাজিক দুর্দশা ও অস্বস্তির বর্ণনার সাথে ব্যঙ্গাত্মক একত্রিত করে এবং এই অঞ্চলের শাসকদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় হিসাবে তিনি যা দেখেছিলেন। তার কিছু বিষয়ের মধ্যে অন্যায় ও সর্বগ্রাসী সরকারের সমস্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রান্তিকদের সংগ্রামই ছিল তার সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার প্রথম নাট্য প্রযোজনা দ্য হাঞ্চব্যাক বার্ড মূলত দীর্ঘ কবিতা, যা তিনি ছোট নিচু ছাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে লিখেছিলেন। কবিতাটির মধ্যে একটি সংলাপ আবির্ভূত হয়েছিল যা এটিকে তার প্রথম নাট্য প্রযোজনায় রূপান্তরিত করে। এরপরে প্রখ্যাত লেবানিজ অভিনেতা আন্তোইন কেরবাজ অভিনীত আরেকটি নাটক দ্য ক্লাউন। তিনি সিরিয়ার অভিনেতা ডুরেইদ লাহহাম ও নিহাদ কালির সাথে এই অঞ্চলের কিছু জনপ্রিয় ও প্রশংসিত নাট্যকর্ম তৈরি করতে সহযোগিতা করেছিলেন। যেমন: কাসাক ইয়া ওয়াতান (মাতৃভূমিতে টোস্ট) এবং ঘোরবেহ (এস্ট্রেঞ্জমেন্ট) এবং দায়াত তিশরিন (অক্টোবরের) গ্রাম)। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে ৭২ বছর বয়সে তিনি মারা যান।