মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২১

পরদিন ঘুম থেকে ওঠে রেডি হতে হতেই বাবা অফিসে চলে যায়। চট করে নাশতা করে শিলা যখন সজীবকে নিয়ে স্কুলে যাবে তখনো চাচাকে ঘুমাতে দেখে ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি আয়নাল। গত রাতে শিলার আচরণে সে কেমন যেন হয়ে আছে। এরপর দেখা হলে শিলা কি স্বাভাবিক হতে পারবে? মনে মনে ঠিক করে শিলার মনে যাতে কোন সংকোচ না হয় সেজন্য এসব কিছুকে দূরে ঠেলে রাখবে। কিন্ত্ব ভাইজির যে অবস্থা তাতে ওকে সতর্ক না করলে যে কোন ধরনের ভুল করে বসতে পারে। এসব ভেবেই ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি।

সবাই বাসা ছেড়ে গেলে হামিদা আয়নালের কাছে যায়। আস্তে করে বলে অনেক বেলা হয়েছে, এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি? আর কত ঘুমাবে, এবার ওঠো, নাশতা করো। আয়নাল কোন সাড়া দেয়না। হামিদা এসে আয়নালের পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি  দিয়ে বলে ওঠো, তোমার পছন্দের খিচুড়ি রান্না করেছি, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভাল লাগবে না। সবাই খেয়েদেয়ে চলে গেল, ওঠো খাই। ঘুম ঘুম ভাব করেই হামিদার হাত ধরে টান দেয় আয়নাল। হামিদা একটু ঝুকে পড়ে। আয়নাল কোমড়ে হাত পেচিয়ে ধরে হামিদার। একি করছো, হাত সরাও ওঠো। থাকোনা কিছুক্ষণ, কেউ তো নেই।

হামিদার পেটে আয়নালের হাতের পরশ তাকে যেন অবশ করে ফেলেছে। বেশ ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে কাটুক না সময়, কিন্তু আয়নালের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বিছানা ছেড়ে উঠবার তাড়া দিয়ে চলে যায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে ভাবীর সাথে নাশতা সারে আয়নাল। হামিদা রান্নাঘরে বাসন কোসন পরিষ্কার করতে যায়। চা এর পানি চড়িয়ে দিয়ে কাপ ধুয়ে নিচ্ছে। সরমাখা দুধ কাপে ঢালে। সবে জলে গরম ভাপ আসতে শুরু করেছে। নিবিষ্ট মনে বাস্পের উড়ে যাওয়া দেখে নিজের ভেতরও একটা উত্তাপ অনুভব করেছে হামিদা। টগবগ করে জল ফুটছে।

পেছনে এসে দাঁড়ানো আয়নালের উপস্থিতিও টের পাচ্ছে না। ভাবীর কাধে দু’হাত রেখে গা ঘেষে দাঁড়ায় আয়নাল। হামিদা চমকে ওঠে। একি তুমি। একটু বসো, চা নিয়ে আসছি বলেই ফুটন্ত জল কাপে ঢালে। নিজের জন্য রঙ চা আর আয়নালের জন্য মালাই চা নিয়ে টেবিলে আসে হামিদা। চায়ে চুমুক দিয়েই আয়নাল বলে আহ! কতদিন পর তোমার হাতে চা খাচ্ছি। নিজের এমন প্রশংসা শুনে হামিদা বেশ খুশি হয়। তোমার ভাইয়ের ডায়াবেটিক। দুধ-চিনি বিহীন চায়ে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু তোমার জন্য তো আর দুধ চা ছাড়া চলে না। ঠিক বলেছ, দুধ ছাড়া আমার চলেই না।

একথা শুনে হামিদা মুচকি হাসে। আয়নাল ভাবীর মশকরা বুঝতে পারে, কিছুটা লজ্জাও পায়। আয়নাল বলতে থাকে আমাদের ছেড়ে এসে বেশ ভালোই আছো। সেই যে এলে, আর তো একবারের জন্য্ও বাড়ি গেলে না। বাড়ি তো যেতামই। তুমিইতো যাবার ব্যবস্থা করতে পারলে না। ভেবেছিলাম তোমার বিয়েতে যাব, আর তো খবরই দিলে না। আমার কথা না হয় বাদই দিলে, আব্বা-আম্মার বয়স হয়েছে। তাদের দেখতেও তো যেতে পারতে। এবার তো বাড়ির কাছেই যাচ্ছি। তখন ঘন ঘন যাবো। চা শেষ করে হামিদা বলে তুমি এসেছ বেশ ভাল লাগছে।

পাশের বাসার ওরা চলে যাবার পর থেকে বেশ একা লাগছিল। তোমার সাথে খুব ভাল সময় কাটবে। আমারও, বলেই অপলক হামিদার দিকে চেয়ে থাকে আয়নাল। হামিদা ওঠে দাঁড়ায়। চায়ের কাপ গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। গ্রাম ছেড়ে এসে ভাবীর সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেছে। হামিদা রান্নাঘর থেকে ফিরে এলে আয়নাল বলে তুমি কিন্তু আরও সুন্দর হয়ে গেছো। হামিদা হেসে বলে এখানে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে আমি নাকি মুটিয়ে যাচ্ছি। তোমার ভাইয়ের এমন কথায় তো মনে হতো আমি ফুড়িয়ে গেছি। আমার কিন্ত্ব তা মনে হচ্ছেনা। ভাইয়ের কাছে এসে... কথা শেষ না করতেই হামিদা বলে তোমার ভাইয়ের কাছে এসেও খুব একটা কাছে পাই না।

হামিদার চোখে বিষদের ছায়া। এছাড়া ভুলেই গিয়েছিলাম আমার মাঝে তোমার ভাই আর কোন আনন্দ পাই কিনা। সংসারের প্রয়োজন তিনি মনে রাখেন। সংসারের দরকারে আমার খেয়াল সে ঠিকই রাখে। কিন্তু আমার মনের খবর নেয়ার সময় নেই তার, হামিদার কন্ঠে এক অভিমানের চাপা আফসোস লক্ষ্য করে আয়নাল। ভাবীকে সান্ত্বনা দিয়ে আয়নাল বলে বড় ভাই অনেক সাংসারিক মানুষ, তিনি দায়িত্ব নিয়ে সবার দিকেই খেয়াল রাখেন। একটু সহজ সরল। তোমার মনের ভেতরের কোন কিছু যদি তুমি চেপে রাখো তিনি তা বুঝতে পারবেন না। তোমাকে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে হবে। তোমার স্বামীর কাছে তোমার মনের কথা বলবে। তোমার চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা যদি তুমি না বলো তবে তো তিনি তা আমলেই আনতে পারবেন না। কি যে বলো তুমি, বিয়ের এত বছর পর একসাথে থাকার সুযোগ পেলাম, শুধুই কি রান্না করে খাওয়াবার জন্য? ভাত-কাপড়ের জন্য? আদর ভালবাসা কি পেতে ইচ্ছে করে না আমার? আশ-পাশের ভাবীদের মুখে তাদের স্বামীদের কথা শুনলে ভেতরে ভেতরে কান্না পায়।

আয়নাল বুঝতে পারে ভাবী কি বুঝাতে চেয়েছে। ভাবীর প্রতি তার ভাল লাগা আছে, ভাবীকে মনে মনে সে অনেকবার চেয়েছে। কিন্তু কখনোই ভাবীর কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। আজ কি ভাবী সাড়া দিবে? ভাবীকে নিয়ে এমন কিছু ভাবতে নিজের মনে নানা দ্বিধা কাজ করছে। হামিদা বেশ কিছুদিন ধরেই ওসমানের শীতলতা অনুভব করছে। ডায়াবেটিক বেড়ে যাওয়াতে ওসমান হয়তো শারীরিকভাবে কোন টান অনুভব করেনা। বয়সও বেড়েছে। কিন্তু ওসমানের বয়সী অন্যদের বৌদের গল্পে মনে হয় তাদের স্বামীরা যেন অনেক তরুণ। পাশের ভবনের মোটাসোটা ভাবীতো তার স্বামীর চাহিদাকে রীতিমতো অত্যাচার মনে করে।

অনেক দিন ধরেই নানা রোগে ভুগা হাপানী রোগী সাদিয়ার মাও মুখ বুজে কষ্ট মেনে নিয়ে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে। তার ধারণা, পুরুষ মানুষ যদি বিছানায় বৌকে মনের মতো না পায় তবে তো অন্য নারীর কাছে যাবে। এসব ভেবে হামিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে একেই বলে কপাল। ওদের মন চায় না আর আমি এতো চেয়েও পাইনা। গত রাতেও ওসমানকে কাছে টানতে চেয়েছি কিন্ত্ ও সরে গিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়েছে। সারা রাত নির্ঘুম কাটলেও ওসমানের তা জানার সুযোগ নেই। আজ আয়নালের কাছে নিজের সোন্দর্যের প্রশংসায় তার ভেতরে কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে। নিজের ভেতর কেমন যেন ভাঙচুর হচ্ছে।

আয়নায় নিজেকে দেখে হামিদা। চোখের নিচে কালো ছায়ার মতো হয়ে আছে। শরীরে এর ছাপ নেই। দুই সন্তানের মা হলেও হামিদার উন্নত স্তন নুয়ে পড়েনি। প্রচণ্ড অভিমান হচ্ছে ওসমানের ওপর। গ্রাম ছেড়ে যখন এসেছিল তখন তার মনে হয়েছিল স্বামী সঙ্গ বঞ্চনার অবসান হবে। ওসমানের ভালবাসায় প্রতিটা রাত মধুরাত হবে। আজ মনে পড়ছে পছন্দসই পাত্রী সম্পর্কে জানতে চাইলে আয়নাল বলেছিল আমার মতো এমন কাউকে পেলে ও একবাক্যে রাজি হয়ে যেত। সেকথা বলে আয়নাল সেদিন কি বোঝাতে চেয়েছিল? আজও আয়নালের অপলক দৃষ্টি, রান্নাঘরে কাধ ছুঁয়ে দাঁড়ানো এসব কি তবে তার ঘনিষ্টতা পাবার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ? হামিদা ঠিক করে আয়নাল চাইলে সে নিজেকে আর বঞ্চিত করবে না। চলবে