মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’
পর্ব ১
প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০২১
হাবিলদার ওসমান তখন রাজশাহী সেনানিবাসের কোয়ার্টারে বাসা পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সপরিবারে থাকার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ওসমান। সামরিক জীবনে সবসময় পরিবারের সাথে বসবাসের সুযোগ নানা কারণেই হয়ে ওঠেনি তার। শিলার মায়ের শখ নিজের মতো করে গুছিয়ে সংসার করবে, স্বামীর সাথে থাকবে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করাবে। গ্রামের বাড়িতে এত কাজের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে সব সময়ই স্বামীকে চিঠি লিখতো বাসা করে যেন তাদের নিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। গ্রামের পরিবেশ ভালো নেই। ওদের ভালো লেখাপড়ার জন্যই ওসমান যেনতেন প্রকারে একটা বাসা পাবার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা তদবির বিফলে যায়নি। বাসা পেয়ে যায় ওসমান। এরপর দ্রুতই তালা থেকে পরিবার নিয়ে আসে রাজশাহীতে। শিলার বেড়ে ওঠা সাতক্ষীরার তালায়। অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা শেষেই দাদাবাড়ি ছেড়ে শিলাকে বাবার কাছে রাজশাহী চলে যেতে হয়।
শীতের সময় তালা ছেড়ে রাজশাহী এসে শিলার খুব একটা ভালো লাগেনি। বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুল ছুটি হয়েছে মাত্র। তখনই তাদের গ্রাম ছেড়ে রাজশাহী যাবার তাড়া। শিলারা বছরের এই সময়টায় পরীক্ষা শেষেই নানাবাড়ি বেড়াতে যেত। মামাতো ভাইবোনদের সাথে খেলাধূলা, মামা-মামির আদর আর নানার সাথে গঞ্জে গিয়ে দর্জির দোকানে নতুন জামা-কাপড় বানিয়ে নেবার মজাটা এবার আর হলো না। খুব মনে পড়ছে মামাতো ভাই সুমনের কথা। নতুন জামা পাবার জন্য ওর ছটফট ভাবটা শিলার কিশোরী মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এই শীতে শিলার জন্য লাল সুয়েটার বুনে দেয়ার কথা ছিল মামির। মামি কি সুয়েটার বুনেছে? সুয়েটার আর নতুন জামার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না শিলা। এখানে যা শীত পড়েছে! দাদাবাড়িতে এমন শীত কখনো হয় না, এসব ভেবে তার ভালো লাগছিল না। মন খারাপ দেখে মা বুঝতে পারে নতুন জায়গায় এসে ঘরবন্দি থাকা শিলার ভালো লাগছে না। পড়ন্ত বিকেলে বাসার সামনের ছোট মাঠে ছেলেমেয়েদের খেলতে দেখে শিলাকে নিয়ে বাইরে আসেন মা। বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেতে বললেও শিলা যায়নি। সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসে।
হামিদা বেগমের ষোল বছরের সংসার জীবনে ওসমানকে তো বছরে মাত্র মাস দুয়েকের জন্য পেয়েছে। বছরের বাকিটা সময় শুধুই চিঠিপত্রে যোগাযোগ। ওসমানের চিঠি জুড়েই থাকতো সংসারের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার খতিয়ান। এসব পড়ে স্বামীকে পরিবারের প্রতি অনেক যত্নশীল মনে হলেও স্ত্রীর প্রতি ততটাই নির্বিকার মনে হয়েছে। বান্ধবীদের কাছে স্বামীর ভালোবাসার গল্প শুনে হামিদা কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়তো। বান্ধবীদের মাঝে হামিদার রূপের প্রশংসা ছিল, এসব নিয়ে ভেতরে ভেতরে তার কিছুটা অহঙ্কারও ছিল। এখন বান্ধবীদের স্বামীর প্রশংসা আর ভালোবাসার গল্প শুনে নিজের ওপর খুব রাগ হয় তার। এত খাটুনির পরও রাতে ঘুম হয় না। ভাসুর জয়নাল আর দেবর আয়নালের নানা ছলে কাছে আসার বিষয়টি তাকে ভাবায়। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে নানাভাবে অসুখী জয়নালের টানাপোড়েন বুঝতে অসুবিধা হয় না হামিদার। স্বামীকে কাছে না পাবার যন্ত্রণা দিয়ে ভাসুরের বেদনা অনুভব করতে পারে সে। গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না তখন সে টের পায়, জয়নালের গলা। মনে হয় তার ঘরের চারপাশে পায়চারী করছে। মাঝে মাঝে বাঁশির সুর তোলে। মনে হয়, হামিদাকে কাছে ডাকছে। হামিদাও অস্থির হয়ে ওঠে। জয়নালের কাছে ছুটে যেতে মন চায়। কিন্তু পরক্ষণেই কেমন যেন শামুকের মতো গুটিয়ে যায়।
আয়নালের বিয়ের ব্যাপারে কিছুটা তোড়জোড় হলেও পছন্দমতো পাত্রী না পাওয়ায় তা হয়ে উঠছে না। রূপে-গুণে হামিদার চেয়ে কম কাউকেই বৌ করে আনতে রাজি নয় বাড়ির কেউ। হামিদা তার এক মামাতো বোনকে আয়নালের পছন্দ কিনা জানতে চাইলে আয়নাল বলেছিল তোমার মতো হলেতো এক কথায় রাজি হয়ে যেতাম। তোমাকে দেখতে দেখতে হয়তো কাউকেই আর ভাল লাগে না। আয়নালও কি তবে তার সান্নিধ্য পেতে চায়? এসব ভাবতে ভাবতেই হামিদার রাত কেটে যায়। তালা ছেড়ে এসে শিলার শুধুই বান্ধবীদের কথা মনে পড়ছে তা নয়, দাদাকেও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছে না। দাদার আদুরে ডাক, বাঘবন্দি খেলা আর মাঠে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই ওর চোখ জলে ভিজে আসে। শিলার কষ্টের অনুভূতি হামিদা বেগমের কাছে কিছুটা খারাপ লাগলেও এখানে এসে তার খুব ভালো লাগছে। গ্রামের বাড়িতে এত মানুষের জন্য লাকড়ির চুলায় রান্না, উঠান, ঘরদোর গুছিয়ে রাখা বড় কষ্টের। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলেছে। স্বামীকে কাছে পাচ্ছে, নিজের জন্য একান্ত সময় বের করতে পারছে। নিজেকে আর সেবাদাসী মনে হচ্ছে না।
কোয়ার্টারে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। তাদের সাথে কথাবার্তা হয়। পরিচয় হয়। হামিদার প্রতিবেশী বিউটিদের গ্রামের বাড়ি ভৈরবে। তার একমাত্র মেয়ে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়ছে। বয়সে সজীবের চেয়েও ছোট। বিউটি ভাবির কাছেই জানতে পারে, পাশের ভবনে একজন থাকেন তাদের বাড়ি যশোরে। যশোরের কথা শুনেই হামিদার চোখে আনন্দের আভা দেখা যায়। বিউটির চোখে তা সহজেই ধরা পড়ে। কাল বিকেলে আপনাকে নিয়ে যাব, আমার মনে হয় যশোরের ভাবিও আপনাকে পেলে খুশি হবেন। বিউটির এমন আন্তরিকতায় বেশ সহজ হয়ে ওঠে হামিদা। দুজনের মাঝে সখ্য তৈরি হয়। বিউটি বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সাথে থাকছে। সেনানিবাসের কোয়ার্টারে থাকার সুযোগ সবসময় হয়নি। এর আগে সেনানিবাসের বাইরে ভাড়াও থেকেছে। তার শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলি, দামপাড়ায়। বর্ষাকালে যেন জলে ভাসা বাড়িঘর। নৌকা করে চলতে হয়। বিদ্যুৎ নেই। ওখানে থাকা আমার জন্য কষ্টের ছিল। আনিস তা বুঝতে পেরেছে। এজন্যই সবসময় আমাকে সাথে রেখেছে। বিউটির কথা শুনে হামিদার খুব ভাল লাগে। মনে মনে ভাবে, বিউটির স্বামী তার প্রতি কত যত্নশীল, তাকে কত সুখে রেখেছে।
সন্ধ্যায় বাজার থেকে কিছু ফল আর শীতের জামাকাপড় নিয়ে বাসায় আসে ওসমান। হামিদার জন্য এনেছে কাশ্মিরী শাল। কালোর ওপর লাল ফুলের কাজ করা শালটা বেশ পছন্দ হয়েছে তার। শিলার জন্য লাল সুয়েটার আর সজীবের জন্য জ্যাকেট। লাল সুয়েটার আর জ্যাকেট নিয়ে ভাইবোনের বেশ মজা হয়। শিলার মুখের কোণে হাসি দেখে হামিদার বেশ আনন্দ হয়। এই কয়দিন মেয়েটার মনমরা ভাবটা দেখে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পাচ্ছিল হামিদা। নিজের শালটাও শিলার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বলে, আমার মেয়েটার শীত এবার পালাবে। সুয়েটারের সাথে এই শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলে তোকে বেশ ভালো লাগবে শিলা। মায়ের গা ঘেঁষে শিলা বলে, আমার জন্য শাল লাগবে না, এটা তোমার। ওসমান বলে, শিলার জন্য আরেকটা শাল না হয় কিনে দেব, এটা তোমাকেই বেশ ভালো লাগবে।
বিউটির কাছ থেকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে অনেক কিছুই জেনে নিয়েছে হামিদা। রাতে খাবার সময় শিলা আর সজীবের স্কুলে ভর্তি নিয়ে কথা হয়। ওসমানও খোঁজ নিয়েছে, সব কিছুই সময়মতো করতে হবে। জন্ম সনদ এবং আগের স্কুলের ফলাফলও লাগবে। বাড়িতে চিঠি লিখে সবকিছু জোগাড় করতে ছোট ভাই আয়নালকে জানিয়েছে ওসমান। স্কুল শিক্ষক হবার কারণে আয়নালও এসব বিষয় জানে। তাই চিঠি পেয়েই সবকিছু ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে জেনেছে ওসমান। দুয়েকদিনের মধ্যেই কাগজ চলে আসবে। হামিদার ধারণা ছিল, ওসমানের এসব বিষয়ে খেয়াল নেই। কিন্তু সব শুনে তার মনে হয়েছে, ওসমান ভেতরে ভেতরে অনেক যত্নশীল হলেও বাইরে হয়তো এর প্রকাশ নেই।
ব্যারাকে কাটিয়ে দেয়া জীবনের বাইরে এই প্রথম পারিবারিক পরিবেশে থাকার বিষয়টি ভালো লাগছে ওসমানের। নিজের পছন্দমতো খাবার খেতে পারছে। ধরাবাঁধা একই খাবার একই রান্নার স্বাদের বাইরে এক নতুন স্বাদ পাচ্ছে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে হামিদার চলে আসাতে ওর বয়স্ক বাবার কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও ওসমানের চিন্তা হয়। এখানে আসার পর হামিদার মুখে গ্রামের বাড়ির কথা একবারও শোনেনি ওসমান। নিজের ভালো থাকার মাঝেই ও তার সুখ খুঁজে পেয়েছে, এটা ওসমানের চোখে পড়ে। কিন্তু হামিদার ওপর খুব একটা রাগ করতে পারে না ওসমান। মনের মাঝে এক দ্বিধা কাজ করে। নিজের সামান্য সুখের জন্য জন্মদাতা মা-বাবার যত্নের ব্যবস্থায় টান পড়েছে।
আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই প্রবাসী। বছরের পর বছর বাইরে থাকছে। তাদের বৌরা সংসার সামলাচ্ছে। তাদের অনেকেই ওসমানের ওপর রাগ করবে। রোমেনা ভাবির কথাটা এখনো কানে বাজছে, শোন ওসমান ভাই, বৌয়ের কথায় নাইচো না। বাড়িতে বুড়া বাপ-মায়ের যত্ন করা এখনকার বৌরা চায় না। ওরা শুধু নিজের সুখ চায়। সবাইকে নিয়ে থাকার মাঝেও যে সুখ আছে সেটা তারা মনেই করে না। কই, আমরাতো কখনো শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে বাড়িতে রাইখা বাপের বাড়ি গিয়া দুইদিনও থাকি না। ওসমানকে চুপ থাকতে দেখে রোমেনা বলতে থাকে, এখন দিনকালও ভালো না। স্বামী ছাড়া থাকলে বৌদের ওপর অনেকের নজর পড়ে। তোমার তো সেই অবস্থা না। বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। তারা হামিদাকে দেখে রাখতে পারবে।
রোমেনা ভাবির কথায় যে যুক্তি আছে, তা তো গ্রামে এসে মেম্বর-মাতবরদের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে ওসমান। এর মাঝেই দুটো সালিশ হয়েছে। হানিফের বৌ পাশের বাড়ির একজনের সাথে পালিয়েছে। দুই পরিবারের সম্মতিতে সালিশ করে সমাধান করেছে। সালিশে অবৈধ মেলামেশার জন্য শাস্তি দেয়া হলো রহিম উদ্দিনকে আর তালাক হলো জরিনার। এসব ঘটনা গ্রামের সবাই জানে। নানা মুখরোচক গল্পও হয়। রোমেনা ভাবি হয়তো এসব জেনেই ওসমানকে সতর্ক করেছে। কিন্ত হামিদা তো কোনোদিন এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি যে, তার এমন কোনো সমস্যা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে এত গায়ে খাটা কাজ তার ভালো লাগে না তা নানাভাবে জানিয়েছে। তবে গ্রামের পরিবেশ হয়তো আগের মতো নেই। এসব বিবেচনায় অনেকেই এখন বাড়িতে বৌ রাখতে চায় না। কিন্তু গ্রামের বাইরে থাকলে যে আর অন্যরকম কিছু ঘটতে পারে না তা তো নয়। এসব ভাবনায় ওসমানের ঘুম আসে না। চলবে