মেহেদি হাসানের গল্প ‘রূপার নাকফুল’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯
নীলের ইদানীং তেমন কিছু করার থাকে না। বিকেলের পর থেকে পদ্মার পাড়ে বসে একটার পর একটা সিগারেট ধরায় আর সাথে কয়েক কাপ কফি। আজকের দিনটায় কিছু একটা সমস্যা আছে। বিকেলের পর থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। শীতের বৃষ্টি। সন্ধ্যা নেমে গেছে একটু আগেই, লোকজনও কমে গেছে নদীর পাড়ে। উঠবে উঠবে করেও নীল বসে আছে এই বৃষ্টির মধ্যেই। কিসের জন্য অপেক্ষা করছে, নিজেই বুঝতে পারছে না।
আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেই নীলের চোখ আটকে গেল রাস্তায় থামা রিকশাটার দিকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল সে। হ্যাঁ, রূপাই তো! কী আদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে মেয়েটা। কিন্তু চেহারার সেই পুরানো বিষণ্ণ ভাবটা সেরকমই রয়ে গেছে। নীল দ্রুত হিসাব করল, কত বছর? প্রায় বিশ বছর বাদে দেখল সে রূপাকে। অথচ পুরানো গল্পগুলো এখনও নীলের কাছে একদম নতুন। বিশ বছর আগের রূপার কপট রাগী রাগী মুখটা মনে করে নীল। নিজের মনেই হাসে। রূপা কিভাবে বিরক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, সেটা মনে করে।
রূপার বিরক্তির কারণ ছিল, একজন মানুষ কোনও কিছু না বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী করে তাকে ফলো করতে পারে, তাও দোতলায় নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে তিনতলায় বারবার ওর ক্লাসে এসে। আরও বড় বিরক্তির কারণ ছিল, ছেলেটা গুণে গুণে ঠিক একশো ফিট দূর থেকেই ওকে ফলো করছে। যখনি রূপা পিছে ফিরে ছেলেটার দিকে তাকিয়েছে, ছেলেটা এমন ভাব করছে যেন অন্য কিছু একটা খুঁজছে।
এই একশো ফিটের একটা রহস্য ছিল। একদিন টিফিন পিরিয়ডে ক্যান্টিন থেকে ক্লাসের পথে রূপা। হঠাৎ খেয়াল করে, নীলকণ্ঠ তার পিছে পিছে আসছে। এতেই রূপার রাগ। এমন না যে, রূপা নীলকে খুব অপছন্দ করে। তবে গাধা টাইপ হওয়ায় রূপা একটু বিরক্ত। কেউ বোকার মতো ফলো করলে বিরক্ত হওয়ায় স্বাভাবিক। চেহারায় কঠিন ভাব এনে রূপা নীলকে ডাক দেয়, এই শোন, আমার পিছে পিছে কেন ঘুরছিস?
নীল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, কই না তো।
রূপা আরো রেগে যায়, শোন, প্রেম প্রেম ভাব নিয়ে আমার পিছে ঘুরবি না। কলেজের সবাই জানে, আমি মারশাল আর্টে অরেঞ্জ বেল্ট। এমন মাইর দেব, সাত জন্মেও রূপার নাম ভুলবি না।
সরি, আর এই ভুল হবে না, কথাটা বলে নীল অন্যদিকে তাকায়। চোখের পানিটা লুকনো খুব জরুরি। নীল জানে, সাত জন্ম কেন, কোনও জন্মেই ঈশ্বর তাকে রূপাকে ভুলতে দেবে না।
কাল থেকে আমার থেকে একশো মাইল দূরে থাকবি, কড়া করে বলে রুপা। নীলের চোখে পানি রূপার নজরে পড়ে। মায়া হয় অনেক। কিন্তু রূপা জানে, মায়া প্রকাশ করা যাবে না। তার অনেক দায়িত্ব। এই বয়সেই তার নিজের সব খরচ নিজেকে চালাতে হয়। রূপা জানে, তাকে অনেক কিছু করতে হবে, ভাইবোনদের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য। তার মাথায় অনেক চাপ।
তুমি অনুমতি দিলে একটা কথা বলবো রূপা? নীল ভয়ে ভয়ে বলে।
বল, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে রূপা।
একশো মাইল দূরে থাকতে হলে তো কাল থেকে আর কলেজে আসতে পারবো না, অন্য শহরে যেতে হবে, বোকা বোকা গলায় বলে নীল। রূপার মায়া আরও বেড়ে যায়। কিন্তু সে জানে, মায়া জিনিসটা তার জন্য নয়। সামনে অনেক পথ হাঁটতে হবে। অনেক কাজ তার।
গলা নরম করে রূপা বলে, ঠিক আছে, একশো ফিট দূরে থাকবি। আর বোকা বোকা ভাব করে আমার সামনে আসবি না। বোকা মানুষ আমার দু’চোখের বিষ।
থ্যাঙ্কস রূপা, বলেই হাঁটা দেয় নীল। রূপা ওর চলে যাওয়া দেখে। রূপা আবিষ্কার করে, কোনও এক অজানা কারণে ছেলেটাকে তার ভালো লাগে। ভালোবাসা না মায়া, ধরতে পারে না। ধরতেও চায় না রূপা।
রূপাকে কেমন ইচ্ছা করেই অস্বস্তিতে ফেলত, সেটা মনে করে আবার হাসে নীল। ক্লাস থেকে বের হলেই বের হলেই রূপা দেখত, নীল করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরবেলায়ও একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো নীল। একদিন হন্তদন্ত হয়ে ফিজিক্স ক্লাস শেষ করে ব্যবহারিক ক্লাসে যাওয়ার সময় রূপা দেখে, নীল সেখানেও আছে। রূপার রাগী রাগী মুখ দেখে নীল বুঝে, আজ তাকে কঠিন বকা খেতে হবে। বেশি মেজাজ খারাপ হলে দুই একটা চড়ও দিতে পারে রূপা। সামনে ইয়ার ফাইনাল এক্সাম, এখন এরকম ফাজলামি মানবে না রূপা।
ব্যবহারিক ক্লাস থেকে বের হয়ে নীলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ইশারায় ডাকে রূপা, এই গাধা, এই দিকে আয়। নীল বুঝতে পারে, আজ রূপা অনেক ক্ষেপে আছে। আজ অনেক বকা খাবে। সে মাথা নিচু করে রূপার কাছে যায়।
তোর এক্সাম নাই? বি ব্যাচের ক্লাস বাদ দিয়ে সি ব্যাচের করিডোরে ফাইজলামি করিস? এক চড় দিয়ে তোর সামনের দুইটা দাঁত ফেলে দেব। আর একবার এই রকম ফাইজলামি দেখলে পিটিয়ে তোর হাড্ডি-মাংস আলাদা করে নওগাঁয় তোর বাপ মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব, তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না, বুঝেছিস, এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে রূপা।
নীল মাথা নিচু করে আছে। নীল জানে, আজ একটি বিশেষ দিন। রূপা যতই রাগারাগি করুক, নীল আজ ওর মন খারাপ হতে দেবে না। নীল মাথা নিচু করেই আস্তে আস্তে বললো, রূপা, ক্ষমা করো। আমি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কিন্তু আমাকে দুই মিনিট সময় দিতে হবে। প্লিজ।
নীলের আকুতিতে রূপা একটু নরম হয়, ঠিক দুই মিনিট। মানে একশো বিশ সেকেন্ড। একশো একুশ সেকেন্ড হলেই তোর খবর আছে। নীল সাহস করে রাগান্বিত রূপার মুখের দিকে তাকায়। নীল জানে, এই মুখের দিকে তাকিয়ে সে অনন্ত কাল অপেক্ষা করতে পারবে। আরও জানে, এই রাগি মুখটার আড়ালে আছে অদ্ভুত এক মায়ার জগৎ।
রূপা, আমি দুইটা বিষয়ে কথা বলবো। কথা শেষ না করে প্লিজ রাগ করবে না।
তাড়াতাড়ি বল।
আজ তোমার জন্মদিন, শুভ জন্মদিন রূপা। আর দ্বিতীয় কথা, তুমি তো জানো, গত মাসে আমি পড়ানো শুরু করেছিলাম, তার স্যালারি পেয়েছি গতকাল। আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। আমি তোমার জন্মদিনে একটা সামান্য উপহার এনেছি। সেটা তুমি ফিরিয়ে দিবা না। নিলে নাও, না নিলে ফেলে দিও।
রূপা অদ্ভুত বোকার মতো তাকিয়ে আছে। তার আর কোনও রাগ হচ্ছে না। এ যেন অন্য নীল। নীল রূপার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে, না রূপা। তুমি ফেলতে পারবে না। তোমাকে নিতেই হবে।
নীলের আবদারের কাছে কেমন যেন অসহায় হয়ে যায় রূপা। যে কঠিন রূপাকে সবাই চেনে, রূপা আজ সেই রূপা না। ঠিক আছে, কি দিবি দে। কিন্তু আজই শেষ।
রূপা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছে। এত এত বন্ধু রূপার, কেউ তার জন্মদিনে এভাবে উপহার নিয়ে জোর করেনি। সে নিজেও কারো কাছে এসব আশা করেনি। নিজের তৈরি করা কাঠিন্য ধরে রাখতে পারেনি রূপা, নরম গলায় বলেছে, প্লিজ আর এমন করবি না।
রূপা, চোখ বন্ধ করো প্লিজ।
শোন, আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। চোখ বন্ধ করলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমাকে বিশ্বাস করো রূপা... শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য করো।
রূপা চোখ বন্ধ করে। নীল ওর হাতে তুলে দেয় গোলাপি কাগজে মুড়ানো একটা রূপার নাকফুল।
রূপা চোখ খুলে দেখে, নীল অনেকদূর চলে গেছে। নাকফুল হাতে নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে রূপা। বিড়বিড় করে বলে, নাকফুল কে কাকে দেয়, এই গাধা জানে না?
নিজের বয়কাট চুল, জিন্স আর ছেলেদের আড্ডায় নিজের নারীত্বকে লুকিয়ে রেখেছিল রূপা সযত্নে। এই বোকা ছেলেটা কিভাবে যেন রূপার লুকনো নারীত্বকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। শেষ বিকেলের আলোতে রূপাকে পরাজিত মনে হয় নীলের।
নীল নিজেকেই বলে, রূপাকে সে হারতে দেবে না। আর কোনও দিন এই মেয়েটাকে বিরক্ত করা যাবে না। তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাব রূপা, অন্যকারো কাছে।
এই তুমি নীল? হঠাৎ রূপার ডাকে নীলের ঘোর কাটে। নীল দেখে, রূপা ওর একদম সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। সেই রাগী রাগী ভাবটা একদম নেই ওর মুখে। নীল অবাক হয়ে খেয়াল করে, রূপার নাকে ওর দেয়া নাকফুলটা।
নীলের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সেটা লুকাতে নীল একশো ফিট দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। বোকার মতো হেসে বলে, এখন ঠিক আছে না রূপা?