কাফকা

কাফকা

মৃদুল মাহবুবের গদ্য ‘কাফকা কোনও বিষণ্ণ ব্যাপার নয়’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২০

কাফকা‌ কি নতুন ফ‌র্মে লেখ‌ার জন্য মহ‌তের মহৎ ঔপন্যা‌সিক হ‌য়ে উঠছিলেন বিশ্বসা‌হি‌ত্যে? না ম‌নে হয়। সা‌হি‌ত্যে ফর্ম, ভাষা, প্রকাশভ‌ঙ্গি তেমন কোনও বিষয় না। কাফকা আস‌লে আগামীর দু‌নিয়া কোথায় আটকা‌য়ে যা‌বে, তা ধর‌তে পার‌ছি‌লেন তার সা‌হি‌ত্যে। ব্যক্তি যে ব্যু‌রো‌ক্রে‌সি আর বৃহৎ সি‌স্টেমের একটা নাটবল্টু হ‌য়ে উঠ‌বে, তা তি‌নি আবছা ধর‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন। দুনিয়ার এই সি‌স্টে‌মের কোনও প‌রিবর্তন গ্রেগর সামসা বা জে‌সোফ কে কর‌তে পার‌বে না। কাফকার হা‌তে কোনও সমাধান ছি‌লে না। থাক‌লে উত্তর দি‌তেন। দু‌নিয়ায় লক্ষ্য লক্ষ্য কাফকা আছে। কাফকা একজন না। কো‌টি কোটি গ্রেগর সামসা ও  জো‌সেফ কে আছে। এই অগণন মানু‌ষের ভ‌বিষ্যতের কথা তিনি ধর‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন যখন উইরোপে শিল্পবিপ্ল‌বে ঢু‌কে প‌ড়ে‌ছে। এই সি‌স্টেমের পুরাটা কাফকা ধর‌তে পা‌রেন নাই। এ কার‌ণে হয়‌তো নি‌জের লেখা পু‌ড়ি‌য়ে ফেল‌তে ব‌লেছি‌লে।

বহু‌কিছু তার কা‌ছে বিমূর্ত ছিলে কম বয়‌সে মারা যাবার কার‌ণে। ফ‌লে তার লেখাপত্র খুব বিমূর্ত, শত শত অর্থের মুখ নি‌য়ে উন্মুক্ত। কাফকা দু‌নিয়ার সা‌হিত্যকে বিমর্ষ ক‌রে দি‌য়ে‌ছেন ব‌লে যে অভি‌যোগ কারো কা‌রো, তারা মূলত কাফকা‌কে ধর‌তে পা‌রে নাই। একইভা‌বে কাফকার মিস‌রি‌ডিং ও তার দর্শ‌নের ভাব ধর‌তে না পে‌রে তার বা‌হ্যিক অনুকর‌ণে যারা উপন্যাস লিখ‌তে এসেছে, তারা নি‌জে‌দের লেখায় হুদাই হতাশায় ভ‌রে দি‌য়ে‌ছে। কাফকা পরবর্তী‌তে বিশ্ব সা‌হি‌ত্যে তিনজন লোক কাফকাকে ঠিক মতো ধর‌তে পে‌রে‌ছে ব‌লে আমার ম‌নে হয়। মা‌র্কেজ, কু‌ন্ডেরা ও মুরাকা‌মি। ফ‌লে এই তিনজ‌নের গুরু কাফকা। কিন্তু তা‌দের লেখায় বিমর্ষতা পা‌বেন না। কেন? তারাও চূড়ান্ত শিল্পবিপ্লব পরবর্তী দু‌নিয়া‌কে আবিষ্কার ক‌রে‌ছে যেখা‌নে অস্তিত্ব লঘু থেকে লঘুতর হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছে। নো সি‌রিয়ান‌নেস অ্যাট অল। প্রতি‌রো‌ধ ও প্রতি‌শো‌ধের কিছু নাই।

গল্প বলুন। খাপছাড়া ভি‌ডিও গে‌মের মতো জীবন, বারবার মরে গি‌য়ে ক‌য়েন দি‌য়ে আবার জীবন‌কে জীবন্ত ক‌রে নেয়া যায়। সমা‌জে এখন মানুষ বারবার ম‌রে, দাফন মাত্র একবার হয়। অসহায় হাল ছাড়া অবস্থা। কাফকার এই তিন উত্তরসূরী‌কে দেখুন। আমি দে‌খি আর অবাক হই তাদের দ‌ু‌নিয়া দেখার উপায় দে‌খে।

কাফকাকে বাইরে থে‌কে দেখার কিছু নাই। ভেতর থে‌কে দেখ‌তে হয়। কাফকা নি‌য়ে এদেশে যা‌দের সা‌থে কথা ব‌লে‌ছি তা‌দের কাফকার রি‌ডিং খুব বা‌হ্যিক, উপ‌রি উপ‌রি। তারা কাফকার ফর্মটা‌কে টেক‌নিক্যা‌লি নি‌তে চায়। সে খুব টেক‌নিক্যাল রাইটার না। তার দু‌নিয়া আধেক বুঝ‌তে পারাটাই তি‌নি লি‌খে‌ছেন। তিনি যেটুকু উপল‌ব্ধি ক‌রে‌ছেন সেটুকুই লি‌খে‌ছেন। সে আনা কা‌রে‌নিনা লে‌খে নাই কার‌ণে মানুষ নামক ধারণার সকল উত্তর নি‌য়ে। তলস্তয় বা রবীন্দ্রনাথ যেখা‌নে প্রফে‌সি ক‌রে‌ছে, কাফকা সেখা‌নে লাজুক খারাপ ছাত্রের মতো প্রশ্ন রে‌খে‌ছে‌। তার লেখাপ‌ত্রে এই কার‌ণে কোনও সমাধান নাই। কাফকা মূলত নতুন কিছু লে‌খে‌নি। সমা‌জে হাজা‌রে হাজার মানুষ যে তেলা‌পোকা হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছে তা‌দের একজ‌নের কথা লি‌খে‌ছে মাত্র। দুনিয়া নতুন দার্শ‌নিক বাস্তবতায় প্রবেশ ক‌রে‌ছে। ফ‌লে কাফকা আর তেমন প্রাস‌ঙ্গিক না এখন।

অথচ বাংলা সা‌হিত্যের অনেক লেখাপত্র কাফকার বিষণ্ণতা থে‌কে বের হ‌তে পার‌ছে না এখ‌নো। আট‌কে গি‌য়ে‌ছি আমরা। কারণ দুনিয়াটা অন্যের চো‌খে দেখ‌লে কাফকাই লিখ‌তে হ‌বে, ভাষার জন্য হাহাকার কর‌তে হ‌বে শুধু। কাফকা কোনও বিষণ্ণ ব্যাপার নয়। ফি‌লোস‌ফিক্যাল ডিস‌কোর্স উপন্যা‌সের ফ‌র্মে। একমাত্র কমলকুমার মজুমদার তার অন্তর্জলী যাত্রায় বাংলা ভাষায় দর্শন‌কে উপন্যা‌সের ফর্মে ডিল কর‌তে পে‌রে‌ছি‌লেন। আর কাউকে আমি পাই না বাংলা ভাষায়। বোদ্ধা‌দের কমলকুমার আলোচনায় ভাষা নি‌য়ে কচকচা‌নি শুন‌লে ভা‌বি, হায় কমল! হায় কমল! কী অদ্ভুত মিস‌রি‌ডিং। এই মিস‌রি‌ডিংয়ের ফলাফল হ‌লো, ভাষানির্ভর উপন্যাস বা গল্প, যেখা‌নে ভাষাখ‌চিত কারুকা‌জের জন্য স্টো‌রিলাইনটা পর্যন্ত বোঝা যায় না। অন্তর্জলী যাত্রা কোনও উপাখ্যান না, তার ভাষার জন্যও এটা সু‌বি‌শেষ না আমার কা‌ছে।

সামাজিক শিক্ষা, মানু‌ষের প্রবৃ‌ত্তি কীভা‌বে এই অঞ্চ‌লে ঈশ্বর প্রদত্ত নিয়‌তি হ‌য়ে ওঠে তা বোঝার জন্য কমলকুমার য‌থেষ্ট। ঈশ্বর থাকুক বা না থাকুক, তা‌তে কিছু আসে যায় না। সমাজে আমা‌দের আচরণ জা‌স্টি‌ফি‌কেশন পায় ঐতিহ্যের নাম ধ‌রে, ঈশ্বর‌কে ডে‌কে। কমলকুমার এই ডিল ক‌রে‌ছেন। কাফকা বা কমলকুমা‌রের দু‌নিয়া দেখার বাইরে আমরা কী কী দে‌খতে পার‌ছি এখন আমা‌দের নি‌জে‌দের সা‌হি‌ত্যে?

লেখক: কবি