মৃত্যুর ধূসর চোখ
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : মে ০২, ২০১৯
ধূসর ছবি তার সামনে।
মৃত্যুর ধূসর চোখে চারপাশ তিনি দেখছেন। টের পাচ্ছেন, এই সময় এই রকম যন্ত্রণা পেতে হয়। মারা যাচ্ছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে স্ত্রীর মুখ। খুব কাঁদছেন কমলা দেবী।
বাইরে ফেরিঅলার হাঁক শোনা যাচ্ছে। জানলার ওপাশে সটান দাঁড়িয়ে থাকা গাছটা থেকে ভেসে আসছে ছাইতেন ফুলের মাদকতা ছড়ানো ঘ্রাণ। ওই জানলার কাছে বসে কত কত যে বার তিনি বুক ভরে টেনে নিয়েছেন ওই মাদক, আর ঝিরঝির ভালোলাগায় কেঁপে উঠেছেন, সেসবই আজ ঢেকে যাচ্ছে গাঢ় কুয়াশার নিচে। মুছে যাচ্ছে ছবি। নৈঃশব্দ্যের গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে শব্দ। কিছুই নয়, যন্ত্রণায় চিরে যেতে যেতে তিনি অনুভব করলেন, প্রেম। প্রেমের ভেতর দিয়ে জগৎকে দেখাই আসলে মানুষের কাজ।
হাতের আঙুল কাঁপছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের। ঠোঁট নড়ছে। কী যেন বলতে চাইছেন তিনি। বিড়বিড় করছেন। তার মুখের ওপর আরও ঝুঁকে এলো কমলা দেবীর মুখ। চূড়ান্ত বিস্ফোরণের অপেক্ষায় এখন তিনি। কাঁদছেন না আর, তবে কেঁপে কেঁপে উঠছেন।
চৌকির মাথার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানিক বাবুর ছেলে। কিশোর বয়েস। ছেলেটি তালগোল হারিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেঝেতে বসে আছে ছোট ছোট দুটি মেয়ে। ভয় খেয়ে গেছে তারা। চেহারায় আতঙ্ক। কাঁদবে কীনা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো কুঁকড়ে বসে আছে।
কমলা দেবী ছেলেকে বললেন, দৌড়ে যা খোকা, তোর নারাণ কাকুকে খবর দে।
ছেলেটি ছুটল।
অন্ধকার এক টানেল পেরিয়ে যেতে লাগলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছেন তিনি। আর হঠাৎ মুহূর্তের মতো আলোর ঝলক দেখতে পেলেন। আর ঠিক তখনই শুনতে পেলেন কেউ যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। নাড়ি ছেঁড়া সেই কান্না। মানিক বুঝলেন, একা হয়ে গেলেন তার স্ত্রী।
ভাসমান হয়ে গেল তার সংসার।
শেষনিশ্বাস ছাড়লেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার মুখের ওপর ঝুঁকে থেকে পাথর হয়ে গেলেন কমলা দেবী। মায়ের দিকে পলকহীন চোখে কিছু সময় চেয়ে ভয়ার্ত স্বরে কেঁদে উঠল মেয়ে দুটো।
সময় যেন এই ঘরে মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল।
নারাণ এলো ছেলেটির সাথে। নারাণ পেশায় নাপিত। মানিক বাবুর অনুরক্ত। মাঝেসাঝে সন্ধের পর দোকান বন্ধ করে সে আসত মানিক বাবুর কাছে। এটা-ওটা গল্প-চাটাম করত। আর কেন যেন, মানিকেরও বেশ লাগত এই নাপিত ব্যাটাকে। খুব বেশি ঠেকে গেলে তার কাছ থেকে যে দু’চার আনা ধার তিনি নেননি, তা নয়। আবার ফেরত দিতে গেলে বিনীত হেসে নারাণ বলেছে, আর লজ্জা কেন দ্যান লেখকদাদা। এরপর একটু মাথা চুলকে নিয়েছে।
নারাণ এসেই মরদেহের পাশে দাঁড়ালো স্থির হয়ে। থমথমে মুখ। একটু পর ফিরল কমলা দেবীর দিকে। ধরা গলায় বলল, কাঁদবেন না বৌদি… লেখকদাদা চলে গেলেন… কী আর বলি, আচ্ছা, আমি দেখছি। আপনি বাচ্চাদের সামলান বৌদি, ওরা কাঁদছে… বলতে বলতে বের হয়ে গেল নারাণ।
খবর পেয়ে ছুটে এসেছে কয়েকজন প্রতিবেশী। নানা আফসোসের টুকরো টুকরো কথা বাতাসে ঢেউ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, বৌদি, লাশ তো এবার বের করে ফেলতে হবে। আপনি কাঁদবেন না… এই যে খোকা, এদিকে এসো তো একটু…
প্রতিবেশীরা সৎকারের ব্যবস্থা করতে লাগল।
এতক্ষণ পর নড়েচড়ে উঠলেন কমলা দেবী। মৃত মুখের দিকে চেয়ে তার ঠোঁট নড়ে উঠল। একটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিলেন মৃত মুখের এই মানুষটার সাথে। অভাবের পৃথিবী ছিল এই সংসারে। কখনও একটু ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচার সুযোগ হয়নি। মানুষটা কীসব যেন লিখত সারাদিন। সারারাত। আরসব মানুষ যেরকম কাজটাজ করে, খেয়ে-পরে সংসারে বেঁচে থাকে, মানুষটা এসব লোকের বাইরে ছিল। কত যে অপমান আর কথার বাণ যে তিনি ছুঁড়েছেন তার লেখক স্বামীটার দিকে। মানুষটা যে লেখালেখির জন্য একটা জীবন দিয়ে গেল, সত্যিই কি এর কোনো দাম আছে?
উঠলেন কমলা দেবী। ছেলেকে পাঠিয়ে খবরটা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে জানাতে হবে। সুভাষ মানুষটার খুব কাছের বন্ধু। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মানুষটার মতো সে-ও লেখালেখি করে। কিন্তু ছেলেকে এখন পাঠাবেন কীভাবে? ঘরে তো টাকা-পয়সা কিছু নেই। ট্রামে চেপে গেলেও তিন আনা তো লাগবেই।
ঘরের আনাচে-কানাচে, তোষকের নিচে, বালিশের নিচে আর সম্ভাব্য জায়গাগুলো আতিপাতি করে খুঁজলেন কমলা দেবী, কিন্তু কানাকড়িও পেলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। প্রতিবেশী এক নারী এগিয়ে এসে তার কাঁধ ধরল। সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কাঁদবেন না দিদি। হরি নাম লেন গো… হরিই সহায়… বল হরি, হরি বোল…
মহিলা উলুধ্বনি ছড়িয়ে দিতে লাগল হাওয়ায়।
নারাণকে ডেকে আনলেন কমলা দেবী। নারাণ এলে তিনি বললেন, একটা কাজ করে দিতে পারো ভাই? তোমার লেখকদাদা তো তোমাকে খুবই পছন্দ করতেন।
বিনয়ে গলে যেতে যেতে নারাণ বলল, কী করতে হবে বলুন বউদি, ও কথা বলে আর লজ্জা দেয়া কেন!
তোমাকে একটু কলকাতায় যেতে হবে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে খবরটা পৌঁছাতে হবে।
তিনি কোতায় থাকেন?
দাঁড়াও, তোমাকে ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি… আর শোনও… থেমে গেলেন কমলা দেবী। স্ত্রী। তার গলার ভেতর কথা যেন আটকে গেছে। ফ্যালফ্যাল চোখে তিনি চেয়ে রইলেন নারাণের মুখের দিকে।
নারাণ কাঁচুমাচু হলো। বলল, বলুন বৌদি, এসময় সংকোচ করলে কী আর চলবে।
আমার কাছে কোনো পয়সা নেই নারাণ। তোমাকে তো আমি ভাড়াটা দিতে পারব না ভাই। তোমাকে নাহয় পরে ভাড়াটা আমি শোধ করে দেব।
সে না হয় হলো, এখন ওই সুভাষ বাবুর ঠিকানাটা নিখে দ্যান। খবরটা দ্রুত পৌঁছাতে হবে। লেখকদাদা অনেক বড় মানুষ। তার মৃত্যুর খবর কলকাতাবাসী জানবে না, তা তো হয় না বৌদি…
খবর পেয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছুটে এলেন। সাথে নিয়ে এলেন সোনার খাটিয়া। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মরদেহ সোনার খাটিয়ায় ওঠানো হলো। এরপর চলল শবযাত্রা। খাটিয়ার সামনে হাঁটছেন সুভাস মুখোপাধ্যায়। কথাটথা বন্ধ হয়ে গেছে তার। এ শোক দেহের গভীরে শেকড় ধরে যেন টান দেয়।
পৃথিবীতে এমন অনেক লেখক আছেন, ছিলেন, থাকবেন, যাদের মৃত্যুর খবর কেউ জানতেও পারে না। সুভাষের মতো বন্ধুদের কাছে খবর পৌঁছানোর টাকাও হয়তো ওই লেখকের সংসারে থাকে না। আর যাদের ভেতর তিনি বেঁচে ছিলেন, তারা তো লেখককে পাগল হিসেবেই জানত। তার লেখালেখি মানে পাগলের কথা। এসবের আর মূল্য কী।
মানুষের দায় না থাকলেও মহাকালের দায় আছে। মানুষ মারা যায়। এরপর হারিয়ে যায়। যে যে মানুষের কাছে মহাকালের দায় থাকে, সে সে মানুষকে মহাকাল হারিয়ে যেতে দেয় না। কোনও না কোনোভাবে তাকে সোনার খাটিয়ায় তুলে আনে, মৃত্যুর পরও। মহাকাল নির্বাচিত এসব মানুষই কিংবদন্তি।