
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে যেন
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২৫
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ঘটেছিল? সরাসরি অস্ত্রহাতে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের পঁচাশি শতাংশ ছিলেন গ্রামগঞ্জের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ। নিজেদের কর্তব্যটুকু করার পর তারা যুদ্ধেশেষে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য তারা পদ, পদক, পুরস্কার, উপাধি কিছুই দাবি করেননি।
তেমনি আবার এসব কিছুই তারা পাননি। এসব পেয়েছেন সব শিক্ষিত ভদ্রলোকরা। সেইসব ভদ্রলোকরাও এই ধরনের পদক, পুরস্কার পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে যাঁদের সামান্য কোনো অবদান ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেও এমন পদক, পুরস্কার পেয়েছেন অনেকে।
যুদ্ধশেষে পঁচাশি শতাংশ প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধারা যখন নিজের নিত্যদিনের কাজে ফিরে গেলেন, ভদ্রলোকরা তখন নামলেন ক্ষমতার ভাগাভাগিতে। যুদ্ধকালীন সময়ে পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ ছিলেন একতাবদ্ধ, এইবার ক্ষমতার লড়াইয়ে সকলেই আলাদা হতে থাকলেন লুটের বা ক্ষমতার ভাগ পেতে।
যু্দ্ধ করুক কিংবা নাই করুক, স্বাধীন দেশে তাঁদের কিছু পেতেই হবে। ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে বিভেদ বাড়াটা স্বাভাবিক। প্রথম বিরাট ভাঙন দেখা গেল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে। যুদ্ধশেষ হবার পর ছয়মাস সময় পার হতে পারলো না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ নিজেরা বিভিন্ন দলে উপদলে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কিছু মানুষ অবশ্য সরে দাঁড়ালেন মতাদর্শগত জায়গা থেকে।
যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি শতদলে বিভক্ত, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ পক্ষ তখনি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কতিপয় মানুষরা যখন ক্ষমতায় বসে প্রতিবার ভয়াবহ লুটপাট চালিয়েছিল, তার দায় বহন করতে হয়েছিল পুরো জাতিকে। মুক্তিযুদ্ধকে শুরু থেকেই তারা বিতর্কিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরা সবসময় কেনাবেচা করেছিল দেশের কোটি কোটি মানুষকে বঞ্চিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর বিরুদ্ধপক্ষ চমৎকার আঁতাত গড়ে তুলেছিল এই সময়ে। প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখা গেছে তা। নিজেরা আঁতাত করে প্রত্যেকে এর ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে, দেশের বৃহত্তর সাধারণ মানুষকে বারবার বিভ্রান্ত করেছে।
মনে রাখতে হবে,, কিছু ব্যতিক্রমবাদে সর্বক্ষেত্রেই এরা শিক্ষিত ভদ্রলোক ও লুটেরা। বাহাত্তর সাল থেকেই এই ঘটনার আরম্ভ, চুয়ান্ন বছরে কখনো তা থামেনি। এইসব কাজে সবচেয়ে বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছে পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারটি। বিগত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাংবাদিক, গণমাধ্যম মালিক, শিক্ষক, আমলা, সৈনিক, ছাত্র, শিল্প-সাহিত্যের জগতের প্রথম সারির ব্যক্তিবর্গ ভয়াবহ রকম লুটপাটে অংশ নিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিক্রি করতেও দ্বিধা করেনি।
সাধারণ জনতা বিস্মিত হয়ে দেখেছে কেবল, বহু মানুষ প্রাণ দিয়ে যে স্বাধীনতা এনেছিল তা পুনরায় সম্পূর্ণ বিক্রি করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে। সাধারণ মানুষ তার পরাধীনতা বুঝতে পারবে না, এটা কি কখনো হয়? দেশের সার্বভৌমত্ব অন্যদের দখলে চলে গেলে সেটা ধরতে পারবে না, এমনটা হতেই পারে না। যার অনিবার্য পরিণতি ২৪ জুলাইয়ের আন্দোলন।
ছাত্রদের দাবি-দাওয়া দিয়ে যে আন্দালন শুরু, ক্ষমতার মদমত্ত সরকার যখন চরম নিষ্ঠুরভাবে সেই আন্দোলন দমন করতে গেল, আন্দোলন ভিন্ন চেহারা পেল। জুলাইয়ের আন্দোলনে একপর্যায়ে সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক, মজুর, সাধারণ মানুষ, শহুরে ভদ্রলোক সকলেই রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলন সফল করে তুলতে। পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আবার।
বহু নেতাকে রাজপথে দেখা গেল না। বহু নামি স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী রাস্তায় নামেননি। ভদ্রলোকদের কাছে নমস্য এক বুদ্ধিজীবী আগস্ট মাসের চার তারিখে সমকাল পত্রিকায় ছাত্রদের পরামর্শ দিলেন হাসিনা সরকারের সঙ্গে আপস করতে। বলে দিলেন, এই সংগ্রাম সফল হবে না। কারণ, এর পেছনে কোনো আদর্শ নেই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে, রাস্তায় নেমেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রাণ দিচ্ছে তরুণ শিক্ষার্থীরা, প্রাণ দিচ্ছে শ্রমিকরা। মুটে, মজুর ও শ্রমিকদের সাহস সকলকে আরো বেশি উদ্দীপ্ত করে, যারা কখনো ক্ষমতা পাবে না। কিন্তু মহান সেই বুদ্ধিজীবী হাসিনা সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত তথাকথিত অধ্যাপকটি বলে দিলেন, এর পেছনে কোনো আদর্শ নেই।
সাধারণ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিল মানুষের মুক্তির জন্য, বুদ্ধিজীবীটি তার মধ্যে আদর্শ খুঁজে পেলেন না, বৃহৎ কোনো উদ্দেশ্য দেখতে পেলেন না। ১৯৭১ সালেও বহু বুদ্ধিজীবী এমন কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করতে। তখন আলোচ্য বুদ্ধিজীবীটি পাক-সামরিকজান্তার অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। তিনি সেদিনও বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন হবে না। সেই বুদ্ধিজীবীর মুখে ছাই দিয়ে গত বছরের পাঁচ আগস্টে আন্দোলন সফল হয়েছিল।
আন্দোলনটি সফল হবার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পরের নানা পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেল। সত্যি বলতে, সেদিন দুপুরেই দেখা গেল ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি। আন্দোলনারী ছাত্রছাত্রীরাই নেই সেখানে। মনে হতে থাকলো, আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন যেন কয়েকজন ব্যক্তি। কিন্তু তার চেয়ে বড় ঘটনা, আগস্টের এই বিজয়ের দিনের বিকাল থেকেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ আরম্ভ হলো।
নানারকম প্রশ্ন তৈরি হতে দেখা গেল তাদের মধ্যে। বিভেদের নানা কারণের মধ্যে প্রধান একটি হলো, শত্রুপক্ষের সুকৌশল প্রচার ও নানা কারসাজি যা তারা আগে থেকেই সযত্নে সাজিয়ে রেখেছিল। শত্রুপক্ষের হিসাব সহজ, আন্দোলনের মধ্যে বিভেদ ঘটানো গেলেই আবার তাদের পক্ষে দ্রুত ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। আন্দোলনকারীরা এইসব বিভেদে পা দিতে সামান্য দেরি করলেন না।
কখনো প্রচারগুলোকে বিশ্লেষণ না করেই শত্রু পক্ষের সঙ্গে বহু ব্যাপারে কণ্ঠ মেলালেন। ভিন্ন দিকে আরম্ভ হলো ক্ষমতার লড়াই। রাজনীতিবিদ, আন্দোলনকারী সবাই যেন তখন ক্ষমতায় যেতে চান। কিন্তু ক্ষমতায় যাবার জন্য সবাই যে পথ বেছে নিয়েছেন, এরই মধ্যে তা শত্রুপক্ষের হাতকে শক্তিশালী করেছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারো কারো ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু লেখেছে। ক্ষমতায় যাবার এই ধরনের তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা বা ক্ষমতায় যাবার জন্য নানা অপকৌশল, ১৯৭১ এর পরের ঘটনাকে সুস্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার আগে সবাই দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, স্বাধীনতার পরপরই শতধা বিভক্ত হয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যকার এই ধরনের বিভক্তি মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য থেকে সব কিছুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
যৌক্তিক ক্ষোভের বশে বা ক্ষমতায় যাবার ভাবনা নিয়ে তখনো রাতারাতি নতুন দল গঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যেই ভয়াবহ বিভেদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র দল গঠন নয়, একে ছিল অপরের প্রতি আক্রমণাত্বক। যা একটি তৃতীয় পক্ষকে শক্তিশালী করেছিল। শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করেছিল পরাজিত শক্তিকে। সেই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা গেল জুলাই আন্দোলনের পর।
ঠিক একই রকম ঘটে চলেছে সবকিছু। নিজেরা বসে পারস্পরিক আলোচনা, সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে যুক্তিসঙ্গত পথে হাঁটছেন না যেন কেউ। এ ওর বিরুদ্ধে কাদা ছুড়ছেন। মনে মনে বা উচ্চস্বরে হাসছে এখন শত্রুপক্ষ। যদি গভীরভাবে কেউ হিসেবটা মেলাতে চান, আশা করি কথাটা সত্য প্রমাণিত হবে।
দুর্ভাগ্য যে, যারা একসঙ্গে একটি অবৈধ সরকারকে উৎখাত করতে একত্রে আন্দোলন করেছিলেন, তিন মাসও তাদের মধ্যে ঐক্য বজায় রইলো না। নিজেরা যে সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, তাদেরকেও গঠনমূলক পথে চলতে সাহায্য করতে পারলেন না। শত্রুরা যা চাইছিল তাই যেন ঘটছে এখন প্রতিদিন। যাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশিত হবার কথা আজকের এই সমাজে প্রতিমুহূর্তে, তাদের সম্পর্কে নানা ইতিবাচক বাক্য শোনা যায় জুলাইয়ের আন্দোলনকারীদের মুখে।
দেখা গেল, শত্রুপক্ষ ক্ষমতার বিভিন্ন জায়গায় বসার সুযোগ পাচ্ছে। ১৯৭২-১৯৭৩ সালেও এমনটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তারপরে ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনে তা আরো বেশি লক্ষ্য করা গেছে। যার পরিণতিতে শত্রুরা গুছিয়ে নিয়ে একের পর এক নিধন করছে মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত নেতৃত্বের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে। জিয়ার হত্যাকাণ্ড বা সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের ঘটনাগুলো তার থেকে আলাদা কিছু নয়।
যখন সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় এলো, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছাড়িয়ে উপলক্ষ্যগুলো বড় হয়ে উঠেছিল। মূল লক্ষ্যটাই হারিয়ে গিয়েছিল। জুলাইয়ের আন্দোলন কি তার মূল লক্ষ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে? এই যে এত মানুষের প্রাণ দেয়া, এত এত মানুষের রাস্তায় নামা এবং বহু মানুষের আহত হয়ে হাসপাতালে ধুঁকতে থাকা, এই রকম একটি আন্দোলনকে কি যথাযোগ্য সম্মান দেখানো সম্ভব হবে? নাকি ধনীদের টাকার কাছে, ক্ষমতাবানদের ইচ্ছার কাছে জুলাইয়ের আন্দোলন ভূলুণ্ডিত হবে? এটি একটি আন্তরিক জিজ্ঞাসা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক