‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা: এক কিশোরীর যুদ্ধযাত্রা’ বইয়ের প্রচ্ছদ
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুগ্ধ হবার মতো একটি গ্রন্থ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ১৩, ২০১৯
ব্যাপারটা হঠাৎ করেই ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়কার বাম আন্দোলনের নেতা জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, গতকাল তার কলাবাগানের বাসায় যাওয়া হয় একটা কাজে। বাসা থেকে যখন বের হয়ে আসব আমরা দুজন, তখন জ্যোতি বললেন, কৃষ্ণার লেখা বইটা পড়েছেন?
বললাম, না তো! কী বই?
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা: এক কিশোরীর যুদ্ধযাত্রা’ বইটা আমাকে দিলেন। কয়েকমাস আগে তাদের কন্যার বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম, বহুক্ষণ ছিলাম। তখন বইটার কথা কিছু বলেননি তারা। আমিও জানতাম না। কৃষ্ণা বললেন, বইটা পড়ার পর আপনার মন্তব্য শুনবো।
বললাম, আগরতলা যাচ্ছি দুদিন পর, সেখান থেকে আঠারো তারিখ ফিরে এসে বইটা পড়বো।
বইটা বড় নয়, খুবই ছোট; মাত্র চৌষট্টি পৃষ্ঠার। পরিকল্পনা ছিলে, আগরতলা থেকে ফিরে এসে পড়বো। সকালে আজ নাস্তা খেতে খেতে বইটায় চোখ বুলাচ্ছিলাম, কিন্তু কখন যেনে তার মধ্যেই পড়তে শুরু করে দিয়েছি। কিছুটা পড়তে গিয়ে এতেই ভালো লাগছিলো যে, আর রাখতে পারলাম না।
মুক্তিযুদ্ধ এমন একটা বিষয়, এর স্মৃতি এখনো নানাভাবে আমাদের তাড়িত করে। বহু কথা মনে পড়ে যায়। কৃষ্ণার বইটা পড়তে পড়তে কতে কিছুই যে মনে পড়ছিলে। দুপুরের খাবারের আগেই বইয়ের প্রায় সবটা পড়ে ফেললাম। দুপুরের খাওয়ার পর বাকি পাতাগুলো শেষ করলাম। বইটা আমার এতটাই ভালো লেগেছে যে, কিছু না লিখে আর পারলাম না। বইটা আমি সুযোগ হলে সবাইকে পড়তে বলবো। মুক্তিযুদ্ধের উপর এটা খুবই সুখপাঠ্য বই; একই সঙ্গে তা মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে বুঝবার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
লিখবার ঢংটা খুবই সাবলীল। স্মৃতিকার সামান্য দর্শন আওয়াননি, বড় বড় বুলি নেই লেখাটার মধ্যে; আছে ব্যক্তিগত স্মৃতি যা খুব জীবন্তভাবে প্রকাশিত। বইটার বিশেষ গুণ হচ্ছে, খুবই অকৃত্রিম একটি রচনা। বইটার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে পাকসামরিক বাহিনীর অত্যাচার আর হত্যাকাণ্ডের ভয়ে ভীত একদল মানুষের নিজের দেশ ছেড়ে আগরতলা চলে যাবার বর্ণনা। কিন্তু গ্রন্থটির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সবকিছুই আছে। রয়েছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, মুক্তিযোদ্ধাদেরে আত্মত্যাগের ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনা।
গ্রন্থটি পাঠ করতে করতে আমি ফিরে গিয়েছিলাম সম্পূর্ণভাবে সেই একাত্তরের দিনগুলিতে। বর্তমান প্রজন্ম কতেটা তা ধারণ করতে পারবে, জানি না। কিন্তু সে দিনের যেকোনো মানুষ বইটা পাঠ করতে করতে কৃষ্ণার সঙ্গে হাঁটবেন বরিশাল থেকে আগরতলা যাত্রার পুরো পথটুকু। চারুকলার ছাত্রী কৃষ্ণা যে বরিশালে বড় হয়েছেন সে কথা বইটা পড়ে প্রথমবার জানলাম। কৃষ্ণাকে চিনি বহু বছর। খুব ঘনিষ্ঠ আমি অনেক বছর জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আর জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ বললে কম বলা হয়, জয়ন্তদার পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব সব কিছু মিলিয়ে ভিন্ন রকম।
কৃষ্ণাকে চিনি কতে বছর হয়ে গেল, কত কথা হয়েছে, কিন্তু জানতাম না কৃষ্ণা মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভ্রাম্যমাণ ফিল্ড হাসপাতালে নার্সের দায়িত্ব পালন করেছেন। বহু মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি সাড়ে তেরো বছর বয়সে নার্সিংয়ের সেবা দিয়েছেন। কখনো এসব নিয়ে না কৃষ্ণাকে, না জ্যোতিকে, না জয়ন্তদাকে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই এসব নিয়ে তারা গর্ব করতে পারতেন। বহু বছর ধরে এটা আমার অভিজ্ঞতা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃত অংশ নিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগ মানুষ খুব উচ্চস্বরে সেটা প্রকাশ করেন না। নিজেদের ত্যাগের কথা বলে বাহবা নিতে চান না। যারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, দেখেছি তাদেরই গলাবাজি করতে আর দেখেছি একদল যারা যুদ্ধ করেছেন ঠিকই আর সেসঙ্গে সুবিধা নিতে বাদ রাখেননি; সবসময় তারা নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি দিতে ব্যস্ত।
কৃষ্ণা কখনো আগে সে পরিচয়টা দেননি অথচ কৃষ্ণারা দু’বোন নার্সের দায়িত্ব পালন করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। কৃষ্ণা গ্রন্থের শেষে লিখেছেন, "ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি, আমি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দেশত্যাগী একজন কর্মী ছিলাম, মনে ছাড়া তার কোনও চিহ্ন নেই। স্মৃতি আছে, ছবি নেই। সর্বোপরি সার্টিফিকেট নেই। সার্টিফিকেট নিতে হয় আমরা সে সময় তাই-ই জানতাম না। সেই স্মৃতি শুধুই অন্তরে গাঁথা।" তৃষ্ণা তারপরই লিখেছেন, "আগে ভাবতাম শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেই সে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু যুদ্ধশেষে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে শুনলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করলেও সে মুক্তিযোদ্ধা। সেই থেকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে মনে মনে সুখ পাই। এ সুখের এক অন্যরকম আনন্দ আছে।” বইটি এখানেই শেষ হয় এ কয়টি কথা বলার মধ্য দিয়ে।
সামান্য কয়েক পৃষ্ঠার বইতে অনেক কথা বলেছেন কৃষ্ণা। বইটিতে মেদ নেই, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়তি কথা নেই। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক বাংলাদেশের নদনদী, খালবিল, নির্জন গ্রাম, শষ্যের ক্ষেত, ধূ ধূ প্রন্তর সব পাবেন সাড়ে তেরো বছরের বালিকার ভিন্ন চোখে দেখা। পালিয়ে বেড়ানো মানুষদের সঙ্গে এক হয়ে যাবেন। বিপদের অস্তিত্ব টের পাবেন বারবার। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, আবার মানুষের স্বার্থপরতা, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের সদ্যজাত সন্তান হারানো বেদনাকে তুচ্ছ করে বাঁচার লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনাগুলি এ গ্রন্থে অসাধারণ। পাক হানাদারের ভয়ে পালাবার সময় হাঁটতে হাঁটতে এক গৃহবধুর প্রসব বেদনা ওঠা, গ্রামের মেঠো পথে রাতের অন্ধকারে পথ চলতে চলতে সামান্য কিছু সময়ের জন্য একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়ে সেখানেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া, আর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সদ্যোজাত সন্তানটিকে কাঁথায় জড়িয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে আরম্ভ করা— এ সকল ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা আছে বইটিতে।
ষাট জনের দলের সঙ্গে ভারত সীমান্তের দিকে স্বামী-সন্তা সহ ধাবিত যে নারী, নিজের ব্যক্তিগত সুখ বলে কিছু নেই তার; নিজের একার জন্য সকলকে বিপদে ফেলতে পারে না সে, সন্তান প্রসবের পর নারীটির শরীর থেকে তখনো ঝরছে রক্ত; অথচ না খেয়ে তাকে পথ চলতে হচ্ছে; এসব সত্যি বর্ণনাগুলি কৃষ্ণার রচনাকে অনবদ্য করে তোলে। রচনাটি ভিন্ন মাত্রা পায়। বইটি দেয়ার সময় কৃষ্ণা আমাকে বলেছিলেন, আমার অনভিজ্ঞ হাতের প্রথম লেখা। আমি বলেছিলাম, যারা অনিভজ্ঞ এবং সহজভাবে লিখে যায় তাদের লেখাই অকৃত্রিম হয়; কথাটা দেখলাম আসলেই কৃষ্ণার ক্ষেত্রে শতভাগ সত্যি হলো। তিনি গ্রন্থটি লিখেছেন বুদ্ধি ফলাবার জন্য নয়, নিজের আকুতিগুলিকে প্রাণ দেবার জন্য। অসংখ্য ধন্যবাদ কৃষ্ণা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা চমৎকার এ গ্রন্থটির জন্য। বইটি তক্ষশীলা, ৪১ আজিজ সুপার মার্কেটে পাওয়া যাবে।