মুসলমান পাক্কা মুসলমান হয়েছে, তাই উদারতার গল্প বলে না!

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০১৯

গল্পটা সবাই জানেন, তবু বলি। ইসলামের নবি মক্কার যে পথে চলাচল করতেন, এক বুড়ি সেই পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। নবির পায়ে কাঁটা বিঁধলে দূরে বসা বুড়ি খিলখিল করে হাসত। নবি রোজ পায়ে ব্যথা পেলেও বুড়িকে কিছুই বলতেন না। একদিন দেখলেন পথে কাঁটা নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুড়িকেও দেখতে পেলেন না। তার মনে সন্দেহ জাগল। খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন বুড়ির বাড়ি। দেখলেন, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে বুড়ি। নবিকে দেখে বুড়ি তো ভয়ে তটস্থ। ভাবল, এবার বুঝি তার অপকর্মের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু নবি কাঁটার কথা তুললেনই না। সেবা-যত্ন করে বুড়িকে সুস্থ করে তুললেন। নবির এই মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে বুড়ি কী করল জানেন? নিজের অপকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে নবির কাছে ক্ষমা চাইল।

নবি ও বুড়ির এই কাহিনি আল-হাদিস, না জাল হাদিস? ইদানীং হাদিসের কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক, তা নির্ণয় করা সাধারণের পক্ষে কঠিন। যেমন ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ইসলামের নবি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও।’ আজকাল একদল মৌলবি-মওলানা বেরিয়েছে, যারা বলে, এটা নাকি জাল হাদিস। আল-হাদিস আর জাল হাদিস নিয়ে মৌলবি-মওলানাদের কাদা ছোঁড়াছুড়ির শেষ নেই। নবি ও বুড়ির এই কাহিনিটা কিন্তু হাদিসে আছে। আমাদের ছোটবেলায় মৌলবি-মওলানারা নবির এসব উদারতার কাহিনিগুলো মানুষকে শোনাতেন। শোনাতেন নবি ও হরিণের সেই কাহিনিটিও। গ্রামের মুরুব্বিরা সুরে সুরে গাইতেন: ‘দ্বীনের নবি মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়/হরিণ একটি বান্দা ছিল গাছেরই তলায়..।’ পুরো গল্পটি আপনারা নিশ্চয়ই জানেন।

নবির এসব কাহিনি শুনে মানুষের মধ্যে জন্ম নিতো উদারতার। কিন্তু সময় বদলেছে। মুসলমানরা আরো পাক্কা মুলমান হয়েছে, হচ্ছে। তাই এসব উদারতার গল্প এখন আর বলে না। বলে সেইসব গল্প, যেগুলো দিয়ে হিংসা ছড়ানো যাবে, ভায়োলেন্স সৃষ্টি করা যাবে, দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়া যাবে। ইদানীং আবার একদল মৌলবি-মওলানা বলে বেড়াচ্ছে, নবি ও বুড়ির এই কাহিনিটিও নাকি ভূয়া, এর নাকি কোনো ভিত্তি নেই। যেহেতু কাহিনিটি হাদিসে রয়েছে, সেহেতু ওসব মৌলবি-মওলানাদের কথা না ধরে এটিকে সত্যি বলেই ধরে নিচ্ছি। নবি যদি এমন উদারতার নজির রাখতে পারেন, তাহলে তার উম্মতরা এত নিষ্ঠুর কেন? এত নির্মম কেন? উম্মতেরা কেন নবির এই উদারতা থেকে শিক্ষা নেয় না?

ভোলার বোরহানউদ্দিনের বিপ্লবচন্দ্র শুভর আইডি যে হ্যাক হয়েছে, এটা আপাতত প্রমাণিত হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য মতে, যারা আইডি হ্যাক করেছে এবং আল্লাহ-নবিকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছে, সেই শরীফ ও ইমন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং দুজনেই মুসলিম। নিজেরা মুসলিম হয়ে তাদের আল্লাহ-নবিকে নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করল! অথচ ভোলার মুসলমানরা করল কী? ঘটনার পুরো ভিডিওটি দেখলাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় মুসলমানরা গতকাল পুলিশের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এই ঘটনায় তারা কোনো সভা-সমাবেশ করবে না। কিন্তু তারা আজ সকালে সভার জন্য মঞ্চ তৈরি শুরু করল, মাইক বাজিয়ে মুসলমানদের যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে লাগল। খবর পেয়ে দূরদূরান্ত থেকে মুসলমানরা আসতে লাগল দলে দলে। পুলিশের অনুরোধে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সভা সমাপ্তের ঘোষণা দিলেও উন্মত্ত মুসলমানরা ইমামের উপর চড়াও হলো, চড়াও হলো পুলিশের উপর। বেগতিক বুঝে আত্মরক্ষায় পুলিশ আশ্রয় নিল স্থানীয় মসজিদে। উন্মত্ত মুসলমানরা পাশ্ববর্তী মাদ্রাসা ভাঙচুর করল, মসজিদ ভাঙচুর করল। পুলিশ বাধ্য হলো গুলি চালাতে। ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা, ঝরে গেল চারটি প্রাণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, হে মুসলমানগণ, আপনারাই তো বলেন মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর, আর মাদ্রাসা নবির ঘর। (যদিও মাদ্রাসা নবির ঘর কিনা এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদের শেষ নেই)। যদি তাই হয়, আপনারা যেভাবে মাদ্রাসা ও মসজিদ ভাঙচুর করলেন, তাতে কি ধর্মের অবমাননা হয়নি? এতে কি আল্লাহ ও নবি খুশি হলেন? বিপ্লবচন্দ্র শুভর আইডি হ্যাক করে যে মুসলমান তরুণ (শরীফ ও ইমন) আল্লাহ ও নবি সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করল, তাতে কি ধর্ম অবমাননা হয়নি? নাকি তারা মুসলমান বলে আপনাদের অনুভূতি দুর্বল হয়ে গেল? সে কারণেই আপনারা এখন তাদের কোনো বিচার চাইবেন না? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা বলতেই পারি― এই ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো ষড়যন্ত্র ছিল। শান্তি-শৃঙ্খলা নস্যাতের ষড়যন্ত্র। দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র।

এবার দুটি গল্প বলি। পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামকে তো আপনারা চেনেন। খৈয়ামকে একদা এক গোঁড়া ধার্মিক প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি মুসলমান নন?’ উত্তরে খৈয়াম বললেন, ‘না, আমি মুসলমান নই।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে কি আপনি কাফের?’ খৈয়াম বললেন, ‘না, তাও নই, আমি মানুষ। কিন্তু আপনি?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘আমি মুসলমান।’ ঈষৎ হেসে খৈয়াম বললেন, ‘আপনি তাহলে মুসলমান, কিন্তু মানুষ তো নন?’

আপনারা নিশ্চয়ই কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত ‘রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম’ পড়েছেন। রুবাইয়াত লেখার পর খৈয়ামের বিরুদ্ধে মুসলমানরা অভিযোগ তুলল, খৈয়াম নাকি কুফুরি মত ব্যক্ত করেছেন রুবাইয়াতে। মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে তিনি কুফুরি শেখাচ্ছেন। তাই তাকে মুরতাদ ও নাস্তিক আখ্যা দিয়ে খোরাসানের নিযামিয়া মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হলো। এরপরও তিনি নিজের মতবাদে অটল রইলেন। আর্থিক অনটনে পড়ে শহরের এক প্রান্তে একটা কুটির নির্মাণ করে বসবাস শুরু করলেন। তার ভক্ত নারী-পুরুষরা এরপরও তার কাছে আশীর্বাদের জন্য ওই কুটিরে যেত। তিনি দোয়া-দরুদ ঝাড়-ফুঁ’তে বিশ্বাসী না হলেও অনেকটা বাধ্য হয়ে আগতদের হাতে ফুঁ না দিয়ে সেব পাতায় জাফরান কালিতে দু-চার লাইন রুবাই লিখে দিতেন। সেসব রুবাই ধুয়ে পানি খেয়ে তারা ভালো হয়ে যাবে―এমন বিশ্বাস ছিল ভক্তদের। পরে এক ভক্ত এগুলোর সংকলন করে ‘কেতাবে দর রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থ প্রকাশ করে।

গোঁড়া ধার্মিকরা এবার খৈয়ামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল যে, খৈয়াম নাকি তার শয়তানি বুদ্ধি সেব পাতায় লিখে দিচ্ছেন, এর কারণে নাকি অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। এই অভিযোগে সবাই দল বেঁধে একদিন তার কুটিরে হামলা চালাল। খৈয়াম তখন বই-পুস্তকসহ কাঁটা-কম্পাস নিয়ে সূর্য পরীক্ষা করছিলেন। হৈহৈ করে গোঁড়া মুসলমানরা তার ঘর থেকে সব বই-পুস্তক বের করে আগুন ধরিয়ে দিল। একদল তাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলো। খৈয়াম তার প্রিয় কুটিরের এই দশা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হায় আল্লাহ!’ উত্তেজিত কয়েকজন মোল্লা তার মুখে আল্লাহর নাম শুনে বিদ্রুপভরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আবার আল্লাহ বিশ্বাস করো নাকি?’ খৈয়াম বিনম্র হয়ে বললেন, ‘আল্লাহ তো খুবই দুয়ালু, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তার বান্দারা তা নয় কেন?’

এবার আসুন একটি কবিতা পাঠ করি। জীবনানন্দ দাশের কবিতা:

‘...প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;
মানুষ মেরেছি আমি―তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ ক’রে ঘুমাতেছি―তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী
সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে
তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।’

পরিশেষে বলি, সর্বমানবের সম্মিলিত সংগীত উৎসবে মুখর হোক পৃথিবী। শুভ রাত্রি।

টুকে রাখা কথামালা
২০.১০.২০১৯