মুখোমুখি অবস্থানে বিশ্বের পরাশক্তি
ফারুক ইমনপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭
পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকেও এ স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। জেরুজালেম সংকট নিয়ে তুরস্কের বাণিজ্যিক নগরী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে ৫৭টি মুসলিম দেশের ৪৮ প্রতিনিধি অংশ নেয়। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর এ ঘোষণা আসে। পঞ্চাশ বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে ফের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এ অংশটি নিয়ে দুই পক্ষের লড়াই বহু দিনের। জেরুজালেমে রয়েছে মুসলিমদের একাধিক পবিত্র স্থান। রয়েছে আল আকসা মসজিদ। ফলে ওই এলাকার দখল সহজে ছাড়বে না ফিলিস্তিন। পাশাপাশি ইহুদিদের কাছেও এ জায়গাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই রয়েছে ওয়েলিং ওয়াল, ডোম অব দ্যা রক-এর মতো ঐতিহাসিক স্থান।
প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের আমল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ট্রুম্যানের যুক্তি ছিল, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রেসিডেন্ট বুশ (সিনিয়র) থেকে বারাক ওবামা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে দুটি দেশে পৃথক করার পক্ষপাতী ছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, এক্ষেত্রে দুটি দেশেরই রাজধানী হবে জেরুজালেম। কিন্তু ট্রাম্প একেবারে উল্টোপথে হাঁটলেন। এমনকি মার্কিন দূতাবাস ভবনটিও তেল আবিব থেকে জেরুজালমে নিয়ে আসার ইজ্ঞিত দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোর ঘোষণার মাধমে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের জড়ো হতে শুরু করে। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এ সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।
১৯১৮ সালে বৃটেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সন্ত্রাসী ইহুদি বাহিনী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথমে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের বিতাড়নের কাজ ত্বরান্বিত করা ছিল হাগানাহ বাহিনীকে দিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রধান সমস্যাগুলো ও সংকটের জায়গাগুলো হচ্ছে, জেরুসালেম, শরণার্থী, আবাসন, নিরাপত্তা, সীমান্ত এবং পানি নিয়ে দ্বন্দ।
২০০৬ সালের পর থেকে প্যালেস্টাইনীয়রা দুটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় ফাতাহ এবং হামাস। পশ্চিম তীরে ফাতাহ এবং গাজা উপত্যকায় হামাস প্রভাব রয়েছে। এতে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, ইসরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন দাবি করে। ফলে ২০০৬ এর নির্বাচনে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পরও ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিলে হামাসের পতন ঘটাতে তৎপর হয়।
ইসরায়েল পশ্চিম এশিয়াতে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এই ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল ধরে সমভূমি অবস্থিত। দক্ষিণে রয়েছে বিশাল নেগেভ মরুভূমি আর উত্তরে আছে বরফাবৃত পর্বতমালা। অর্থনীতি আধুনিক পশ্চিমা অর্থনীতির ধাঁচের। ইসরায়েলের নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ খুব কম। ১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান পেয়ে আসছে। ইসরায়েল ও.ই.সি.ডি. (অরগ্যানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট) এর সদস্য। ইসরায়েলভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে বিচিত্র ইসরায়েলে ৩৩টির মত ছোট-বড় ভাষা ও উপভাষা প্রচলিত। ইসরায়েলি ভূখণ্ডের নাগরিকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদানের জন্য মূলত আধুনিক হিব্রু ভাষা ব্যবহার করে। আধুনিক হিব্রু ভাষাটি ১৯শ শতকের শেষ দিকে প্রাচীন হিব্রু ভাষার বিভিন্ন উপভাষার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে হিব্রু ও আরবিইসরায়েলের সরকারি ভাষা।
অন্যদিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল বৃটেন বিরোধী জোটে৷ বর্তমান সংকটের শুরুটা অনেক গভীরেই। নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের এই সঙ্কট আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের দাবি রাখে কিন্তু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছেও এই সংকটের মূল্য অনেক। আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক নীতিই নির্ধারণ হবে এই সংকটের সাথে বা উত্তরণের পথে। ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া, চীন ও রাশিয়া ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। হতে পারে এই সঙ্কট চলমান থাকবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর জন্য চরম মূল্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকে।