`মুক্তির দূত` ট্রাম্পের কাছে আবেদন আর আসামের চল্লিশ লক্ষ মানুষ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০১৯
সারা জীবন ধরে জেনেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের শ্লোগানে সবসময় শুনেছি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রায় সকলেই শ্লোগান দিতেন তখন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের ডান-বাম কট্টোপন্থী সকলের শত্রু ছিল, ঘৃণার পাত্র ছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সম্ভবত অন্যদের চেয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে গালাগাল করেছে বেশি, না করার কারণ ছিল না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা কী, আমাদের জানা। ভিয়েতনামসহ কত দেশকে রক্তাক্ত করেছে এই দেশটি গত শতকে; হত্যা করেছে অন্যায়ভাবে বহুদেশের গণতান্ত্রিক মানসিকতার শাসকদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা দারোগার ভূমিকায় অবতীর্ণ, এটা তার সম্পর্কে একটা প্রবাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক-আফগানিস্তানে আক্রমণের কথা কে না জানে। ইরাক এখনো অন্যায়ভাবে তার দখলে। লিবিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কী আচরণ করেছে সেটা কি বাংলাদেশের মানুষের অজানা? সাদ্দাম আর গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কীভাবে ঘটিয়েছে সকলেই কি আমরা ভুলে গেছি!
সবকিছুর পর যারা একদা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, সকলেই কি তারা বর্তমানে মনে করছেন, মানবতাবেরোধী কাজের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই সবচেয়ে বড় আশ্রয় পাওয়া যাবে? নাহলে তার কাছে আমাদের আবেদন নিবেদন কেন? ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক অনেকে কি মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রই এখন সারা বিশ্বের ত্রাণকর্তা এক মহানুভব রাষ্ট্র?
হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বাস নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিজের তথাকথিত বিশ্বাস বা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে হাসপাতালগুলিতে বোমা ফেলে শিশুদের হত্যা করেছে। বলেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিশ্বকে মুক্ত করতে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতার কারণে বহু মুসলিম প্রধান দেশের শিশুরা তাদের পিতামাতা পরিবারকে হারিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছে, খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জান্তা বহু নীরিহ মানুষের ঘড়বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। শুনলাম, প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়নরা নাকি বিশ্বাস করে সেই যুক্তরাষ্ট্র কারো কারো জন্য মুক্তির দূত হয়ে দেখা দিতে পারেন। প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়নের কেউ কেউ নাকি বিশ্বাস করে তাদের পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘর রক্ষা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। যারা একদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়েছিলেন, এখন নাকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মুক্তির দূত মনে করছেন।
বাংলাদেশের বহু মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, একদা ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী নাকি মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার দায়িত্ব যেন ট্রাম্প নেন। কীভাবে ট্রাম্প এই দায়িত্ব নেবেন, অন্য দেশের মতো বোমা ফেলে? আমরা কি অপেক্ষা করবো, মানবতাবিরোধী কাজে যুক্তরাষ্ট্রের মহান দায়িত্ব পালন করার পদ্ধতিটি কী হবে তা দেখার জন্য?
চল্লিশ লক্ষ আসামের যে মানুষদেরকে অন্যায়ভাবে ‘পুশব্যাক’ করার কথা বলা হচ্ছে, সে ঘটনার জন্য কি তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হবেন তারা? মহান ট্রাম্পের কাছে গিয়ে বিচার দেবেন? বাংলাদেশের বহু মানুষের বিশ্বাস যখন মানবতার পক্ষে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করাটা ন্যায়সঙ্গত কাজ, চল্লিশ লক্ষ আসামের মানুষ কি সেই একই বিশ্বাস নিয়ে ট্রাম্পের কাছে যাবে? নাকি সেই চল্লিশ লক্ষ মানুষ ভারতের যে কোটি কোটি মানুষ তাদের রক্ষা করার জন্য বারবার পথে নেমেছে তাদের উপর ভরসা রাখবে? বিশ্বাস কার উপর রাখবে তারা নিজ দেশের জনগণের উপর নাকি ট্রাম্পের দয়ার উপর।
নাকি ঘটনা এমন দাঁড়াতে পারে, যারা আজ আসামের চল্লিশ লক্ষ মানুষকে রক্ষার জন্য পথে নেমেছে কালকে তারা বলবে, ‘পুশব্যাক’ করার সিদ্ধান্ত তো ঠিকই তো আছে। সবই তো ঠিক দেখছি এখন। তিনকোটি সত্তর লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল। হ্যাঁ, এই চল্লিশ লাখ তাদের একটি সামান্য অংশ মাত্র। বাকি তো রয়ে গেল আরো দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ।
বাহ! বৃহৎ দেশের শাসকরাই সর্বদা সত্যি কথা বলে। নিজেরাই আমরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত এখন যে তারা সত্যিই কথাই বলে। সঠিক সিদ্ধান্তই তারা নিয়ে থাকে। ট্রাম্পের কাছে মানবতার পক্ষে অভিযোগ আসলে কার হাতকে শক্ত করছে? কাদেরকে মদত জোগাচ্ছে। কাদের ভাষাকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করছে? চল্লিশ লক্ষ অসহায় মানুষকে কোথায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে? ট্রাম্পে প্রতি আমাদের অনেকের এতটা আস্থা বা সংখ্যা উল্লেখ করে আবেদন নিবেদন কি সরল বিশ্বাসে নাকি ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রণোদিত?
হায়রে আসামের চল্লিশ লক্ষ মানুষ! তোমাদের জন্য যারা লড়ছে তাদের যুক্তিকে আমরা অসার করে দিতে চাইছি কি, মহাপ্রাণ ট্রাম্পের কাছে গিয়ে মানবতার পক্ষে তার দয়া চেয়ে? বিশ্বের বহু মানুষ কি মানবতার নামে আসলে বর্বরতাকে ইন্ধন যুগিয়ে থাকে? স্বল্প বুদ্ধি নিয়ে এইসব বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই। সকল দোষ নন্দঘোষের, এ তো প্রবাদ বাক্য।