মুক্তিযুদ্ধের লাল মওলানা

অতনু সিংহ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৮

বাঙালি কমিউনিস্টরা কৃষকের হাঁটুর কাছে বসে মাটির কথা শোনেনি, তাই কৃষিনিবিড় সভ্যতায় মওলানা ভাসানীর মতো মরমীয় লোকবামপন্থীর ভাষ্যকে বঙ্গীয় বামপন্থীর ইতিহাসে তথা গোটা উপমহাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে উপেক্ষা করা হয়েছে। বর্ণবাদে আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলগুলি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী  ভাসানীর কথাকে চেপে গিয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে। এমনকি পূর্ববঙ্গেও বামপন্থীদের দূরদর্শীহীনতার পাকেচক্রে হারিয়ে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের  লাল মওলানা। আর গোটা বাংলাতেই কমিউনিস্টদের ইউরোসেন্ত্রিক হাভাতেপনায় গেঁয়ো যোগী ভাসানীরা ইতিহাসের ধূসরতায় হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তার ভাষ্য কি হারিয়ে গেছে?

ভাসানী সোভিয়েত ও চীন দুই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেই ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। যদিও চীনের নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবে উনি বেশি অনুপ্রাণিত। এর পিছনেও যে কারণ তা ওই লোকভাবনা। মাও তার নিজের দেশে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে ইউরোপিয়ান চশমা দিয়ে দেখে প্রয়োগ করতে চাননি... বরং নিজের দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও চিরায়ত চীনা লোকসংস্কৃতিকে মার্ক্সীয় আলোকে পর্যালোচোনা করে মার্ক্সবাদের চৈনিকীকরণ করেছিলেন। মাও-এর লেখা পড়লেই বোঝা যাবে, চীনের গণমনস্তত্ত্বকে উনি কতটা কালচারালি অনুভব করেছিলেন... ভাসানী বঙ্গের লোকভাবনা, এখানকার ইসলাম-সূফি, ভক্তি-আন্দোলন ইত্যাদিকে পর্যালোচনা করেছিলেন কৃষিনিবিড় সভ্যতার ভাষাকে বুঝতে।

না, ইউরোসেন্ত্রিক আখ্যানে গা না ভাসিয়ে তিনি শ্রেণীরাজনীতির মধ্যে বপন করেছিলেন রুহুনিয়াতের প্রাণ। প্রতিপালনের ব্যাখ্যার ভিতর দিয়ে যে সমাজতন্ত্রের আলাপ কিংবা যে বয়ান মওলানা হাজির করেছিলেন, তা শুধুই মনুষ্য সমাজের বস্তুনিবিড় আলাপ নয় বরং তা প্রকৃতি-বস্তু-মানুষের আন্তঃসম্পর্কের ভারসাম্যের আলাপ। জল-জমি-জঙ্গল, বৃক্ষমালা, নদ-নদী, বায়ু, সকল লিঙ্গ, সকল বর্ণ, সকল ধর্ম রক্ষার আলাপ। মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টিকে রবুবিয়াতের আলাপে তিনিই বোধহয় প্রথম তুলে ধরেছিলেন। আজকাল ইকো-সোশ্যালইজম, ইকো-ফেমিনিজম ইত্যাদি শব্দগুলি পরিচিত। কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি, শ্রেণি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে হকের লড়াইয়ের সঙ্গে বাস্তুভারসাম্যের কথা প্রতিপালনের সন্দর্ভের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম হাজির করেছিলেন লাল মওলানা। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম এক বামপন্থী। আর বাংলায় লিবারেশন থিয়োলজির তিনিই এক ও একমাত্র গণনেতা।

মওলানা বুঝেছিলেন, বাংলার বা বাংলাদেশ হলো প্রকৃতি নির্ভর। এর অর্থনীতি, সংস্কৃতি, গণযাপন, উৎসব— সবই প্রকৃতিকেন্দ্রিক, কৃষি ও নদীকেন্দ্রিক এবং অরণ্যসম্পর্কিত, সমুদ্রমুখর— তাই শ্রেণি ও সংস্কৃতির আলাপে প্রকৃতিকে হাজির করেছিলেন। কেননা তিনি একজন পির, তিনি লালন সাঁইয়ের দেশের মানুষ, তার দেশ শিল্পবিপ্লবের অনেক আগে থেকে জানে, যৌথযাপন। তার দেশের মানুষের শিরায়-রক্তে-চৈতন্যে আছে সমবণ্টনের যৌথনির্জ্ঞান। রবুবিয়াতের আলাপে তিনি আকাশবাসী ঈশ্বরের থেকেও প্রকৃতি ও গণনিবিড় লোকেশ্বরের ভাবনাকে মূর্ত করেছিলেন বলে আমার মনে হয়। ওই ঈশ্বরের প্রতিপালনে থাকা সমাজের সকল প্রাণস্পন্দনের সমাধিকারের মাধ্যমে মজলুম জনতার অধিকার অর্জনের কথা বলেছিলেন আমাদের প্রিয় লাল মওলানা।
 
ওয়াহাবি শরিয়তে নয়, সালাফিজমে নয়, ইসলামের গণতান্ত্রিকতা, সৌভাতৃত্বকে উনি বাঙালিয়ানা দিয়েই বুঝেছিলেন, এবং এই বোঝার পদ্ধতিটাও ছিল দ্বান্দ্বিক ও লোকবস্তুবাদী। প্রত্যক্ষভাবে মার্ক্সবাদী না হয়েও উনি ছিলেন লোকবামপন্থী সাম্যবাদী।

কিছু কি হারায়ে যায় কমরেড? নাকি ইতিহাসে, মানুষের ঘুমন্ত (অ) চেতনা থেকে কয়েকটি সন্দর্ভ একদিন ভোরবেলা পাখির ডাকের মতো ফিরে আসে! মওলানা ভাসানী, লাল সালাম।