মিশকালো হুরমতি ও পিতা টেংরামোল্লার গল্প
মেহেদী হাসান তামিমপ্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০১৮
জীবনভর যুদ্ধ আর যুদ্ধ। যুদ্ধ আর জীবন। জীবন আর যুদ্ধ। যুদ্ধ ও জীবন দুটো শব্দের একটিই অর্থ হুরমতির কাছে— এককোচা চাল, একমুঠো ডাল, পঙ্গু বাপের বিড়ি আর ঘাগরাপারের বস্তিতে বসত গড়া। ছোট্ট ঘরটার ভাড়া চারশো টাকা। এর থেকে বেশিকিছু কখনোই তাদের চাওয়া-পাওয়ার আঙিনায় মনের ভুলেও ঢুকতে পারে না। শরীরের রং কালো আলকাতরা থেকে মিশকালো হওয়ায় গা-গতর নিয়ে কোনো চিন্তাও আসে না হুরমতির মনে। চিন্তা, সে তো তখনি আসে যখন কোনোকিছু নিয়ে কারো আগ্রহ থাকে, আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। আগ্রহ! আকাঙ্ক্ষা! সশব্দে বড় একটা দম ফেলে হুরমতি। নিজেকে যাচাই করে নিতে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, এপাশে কখনো ওপাশে চুল বেঁধে, খোঁপা করে, না করে, টকটকে লাল পলাশফুল গুঁজে, না গুঁজে, সূর্যালোকে, সূর্যহীণ সময়ে— কোনোভাবেই হয়নি। হয়নি যখন, এনিয়ে আর কোনো আশা-আফসোস কোনোটিই মনের ভেতরে ঠায় দেয়নি সে। মাঝেমধ্যে বেমালুম ভুলে যায়, এমনতর কোনো এক হুহু করা কষ্ট তার জীবনের সঙ্গী।
রাস্তায় চললে ফুড অফিসের সামনে বসা লেংড়া ফকির আতর আলীও একবারের বেশি দু’বার তাকায় না। আতর আলী, তাও শুধু লেংড়া না, দু`পা নেই এমন একজন পরনির্ভরশীল মানুষটাও হুরমতির উপস্থিতি গ্রাহ্য করে না। এনিয়ে তার বুকের মধ্যের চাপাব্যথা কিছুদিন আগেও খানিকটা টনটন করে উঠলেও, ইদানীং সেটা শরীরের দিন-রাত্রি, ওঠা-বসা, নাওয়া-খাওয়া এমনকি জীবনযাপনের সাথেও মানিয়ে নিয়েছে। এখন কিছুই যায় আসে না তার। একচিলতে পরিমানেও। প্রথম যৌবনে পা রাখার সময়ের মতো এখন আর দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসগুলিও দীর্ঘতর হয় না। শেষবার যখন প্লাস্টিকের ফ্রেমের ছোট্ট চৌকোণা আয়নাতে তার বাপ দাঁড়ি সাইজ করতে গিয়ে সেটা ভেঙে ফেলল, তারপরে হুরমতি আর কখনো আয়নার প্রয়োজনই বোধ করেনি। যদিও তার বাপ টেংরামোল্লা ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো থেকে বেছে বেছে বড় দুটি টুকরো রেখে দিয়েছে, কখনো সেটা দিয়েও আলগোছে আলতো করে কপালে নামা চুলগুলি সরিয়ে একবারের জন্য চেহারাবন্দি করার সাধটিও জাগে না হুরমতির।
হুরমতির ডিউটি বলতে ছিল বহুদিন আগে বল্লভ দারোয়ানের কাছে বানিয়ে নেয়া ঘুণে ধরা কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি লেগে পচন ধরা কেরোসিন কাঠের চেয়ারটি যার নিচে দু’দিকে তিনটি করে পুরান রিক্সার বলবিয়ারিং লাগানো হয়েছিল সেটার উপরে বাপকে ধরে বসিয়ে পিছন থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সামনের দিকে ঠেলা। অবশ্য যতই সামনের দিকে ঠেলেছে কিন্তু কখনো সামনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাদের। বরং লালচে দগদগে মরচেপড়া বিয়ারিংয়ের উপরে ভর করা চেয়ারগাড়ি আর তারও উপরে ভর করা টেংরামোল্লা বারবার থমকে দাঁড়িয়েছে ঢাকা শহরের কিছু নির্দিষ্ট প্রমাণ সাইজের বিলবোর্ডগুলোর সামনে এসে। অন্য কোনো বিলবোর্ড নিয়ে তার বাপের বিন্দুমাত্র আহ্লাদ আগ্রহ না থাকলেও কয়েকটি মোড়ে যেখানে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের ছবি দেয়া থাকে, সে রাস্তাগুলো ধরেই তার বাপের এগুনোর সাধটা বেশি। এরপরেও ওসব বোর্ডের সামনে যেতে না যেতেই টেংরা আওয়াজ তোলে, আম্মা একটুভি থাইমবা। বিশাল কিলান্তি ঠিকতিছে। একটুভি জিরায়া লই। তারপর কিছুক্ষণ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে বিলবোর্ড জুড়ে থাকা ফর্সা রমণীগুলোর দিকে। মনে সন্দেহ জাগে হুরমতির, যে বাপেরে দেখল অকালে বৌ মরার পরেও যৌবনকালে কোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকালো না, সেই বেটাছেলের এই পড়তি বয়সে এসে ভিমরতিতে ধরল নাকি!
বিয়ারিংগুলোর ভিতর থেকেও সম্ভবত কয়েকটি করে বল পড়ে গিয়েছে, তাইতো এখন আর আগের মতো অত সহজে ঠেলতে পারে না হুরমতি। অবশ্য একবার রাস্তায় নেমে গেলে আর কষ্ট-টষ্ট কিছুতে খেয়াল থাকে না। চারদিকে চোখকান খোলা রাখতে হয়। ‘কহন কার মইনটাভি যে নরম হইয়া যাইবো উপরওয়ালাভি কইতে পারবনা রে মতি মা। খেয়াল রাগবার হইব। খুব খেয়ালগো আম্মাজননী।’ যদিও বাপের দীক্ষা এটাই কিন্তু টেংরামোল্লাও এখন আর এসবে কেন জানি খেয়াল রাখে না। এমনকি রাস্তায় নামার পরে আগের মতো সুরেলা গমগমা আওয়াজে গান ধরতেও পারে না তার বাপ। খুব মনে পড়ে হুরমতির, বাপ যখন কোনো এক উকিল সাহেবের একটা গান ধরত:
ভিখারি দুয়ারে খাড়া ভিক্ষা দিয়া বিদায় কর
আমার ঘরের মালিকরে...
ক্ষুধায় ভিখারি মরলে কলংক তোর।
ও মালিকরে...
বানাইয়া রংমহল ঘর করতেছো বসতি
ভিক্ষা চাইলে কথা কও না এই কি তোমার রীতি?
এই অভাগা যেদিকে যায় বলেগো সর সর
কোরআনে প্রমাণ দিয়াছ কেউ নাই তোমার পর।
ক্ষুধায় ভিখারি মরলে,
ও মালিকরে,
তোমার কাছে আছে জানি মধু আর চিনি
শরাবন তহুরা আছে কাওসারের পানি
হুর গেলমান আছে মালিক করিতে আদর
আমি তোমার তুমি আমার একটু হও অগ্রসর।
ক্ষুধায় ভিখারি মরলে,
ও মালিকরে,
নাম বড় যার কাজ বড় তার সঠিক হওয়া চাই
নইলে তোমার কলংক নাম রটিবে ঠাঁই ঠাঁই
ভিক্ষার ছলে
কাঙাল উকিল ছাড়ল বাড়ি ঘর
একদিনও তো লইলে না তুই দুঃখিনীর খবর।
একটা সময় ছিল, তার বাপ যতবার এই গানটা ধরত তার মায়ের দিকে হুরমতি আড়চোখে তাকালে দেখতে পেত মার চোখবেয়ে টপটপ করে বৃষ্টিফোঁটা পড়ছে। তারপর নিজেও লুকিয়ে ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে নিত নিজের। হুরমতির কোনোকিছু নিয়ে অতটা আফসোস নেই যতটা না বাপের গলাটা নিয়ে। সে যখন আট-দশ বছর আগেও ডিউটিতে বের হতো, বাপের গলায় গান শুনে তার মনে হতো, রাস্তারপাশের কোনো এক চা-বিস্কুটের টংদোকানের পাশে নিবিষ্টমনে দাঁড়িয়ে রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত খালিদ হাসান মিলুর কণ্ঠে কোনো দুঃখভরা গান শুনছে।
‘আব্বা, তুমার গলাডা কুনান দিয়া যে এত পইড়া গেল। ইস, কী সোন্দর যে ছেল তুমার গলা, শুনলেই আমার চক্ষে পানি আইয়া পড়ত।’ টেংরামোল্লা উত্তর দেয়, দূরো পাগলি মাইয়া। আমগো বয়েসভি কি আর হেই আগের মত্তন আছে। চিরকালভি কারো গলা থাকেরে আম্মাজননী! বাপের গলার যে মিনমিনে অবস্থা হুরমতিকেও এখন তার সাথে গান ধরতে হয়, নইলে যে পাবলিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না। এনিয়ে বাপের আরেকটা বাণীর কথা মনে পড়ে হুরমতির, হাবলিকভি হালায় চালাক হয়া গেছে। এহেন হাছা হাছা কাইন্দা গান গাইতি না হারলে ফিইরাওভি চাইবোনা কেহও।
তার বাপের আরেকটা ব্যাপারেও ভীষণ আপত্তি হুরমতির, শত অভিমান, কপট রাগ দেখিয়েও বিড়ি খাওয়ার অভ্যাসটা ছাড়াতে পারেনি মতি। একসময়ে হুরমতি বিড়ি কিনে দেয়া বন্ধ করলে টেংরামোল্লা পাশের ঘরের একচোখা জরিনাখালার সাথে ব্যাপক পিরিতি জমায়, সারাদিন গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর, দিনশেষে বাপের পোকায় ধরা, হলদে, আধক্ষয়িত ভাঙা দাঁতগুলো বের করে হুরমতির দিকে কেলিয়ে গা জ্বালা ধরানো হাসি মেরে আকিজ বিড়ির ধোঁয়া ভকভক করে কুণ্ডলি বানিয়ে ছাড়তে থাকে আর রুক্ষশুষ্ক দাঁড়িগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে রাগে কন্যার কপালের দু’পাশের কপালের রগফুলেউঠা মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে।
হুরমতির বাপের নিজস্ব কায়দায় বানানো ভাষাটা খুব প্রিয়। একটা সোলেমানি ভাব আছে, চারপাশে তাদের যত পরিচিত সহকর্মী আছে কেউ এত সুন্দর করে কথায় কথায় জায়গামতো শব্দে ভি লাগিয়ে কথা বলতে পারে না। মতি মাঝেমাঝে দাঁতিলাগা অবাক হয়ে যায় বাপের মেধা দেখে, লোকটা কী যে আজব রকমের মেধাবী! একবার মুখ দিয়ে কোনো কথা বলে ফেললে আজ হোক কাল হোক তা ফলবেই। আজকাল তাদের আয়-রোজগার অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে দিনশেষে ভাত জুটাতে পারবে কীনা তা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হতো, এখন ভাত তরকারি নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। দু`একদিন কর্মে না গেলেও তাদের চলার মতো অর্থ বাপের জামার ভেতরের দিকের পকেটে জমা থাকে। যে পকেটটিতে হাত দেবার এখতিয়ার হুরমতিরও নেই।
এ প্রসঙ্গেও টেংরামোল্লার বাণী আছে, বহুদিন আগে হাইকোর্টের সামনে দুপুরবেলায় চোখ বন্ধ করে জিরিয়ে নেবার সময় পাশ থেকে কেউ একজন তাদের পিতলের বাটিটিতে একটাকার একটা কয়েন দিলে ঢং করে শব্দ হয়, এতে তার মাত্র লেগে আসা ঘুমটা ধক করে ভেঙে যায়। বিরক্তি নিয়ে সে পাশের ফুটপাতে বসে লাল ইটের খোয়ার দাগ কেটে ঝড়া চিকন ডাল ভেঙে গুটি বানিয়ে নিজমনে কাটাকুটি খেলা হুরমতিকে আচমকা বলে ওঠে, বুঝলি মা মতি, দেহিস একদিন আইবভি কেউ আর এই কয়েনহয়েন দিয়া ঝনঝননা আওয়াজভি তোলব না। নোট দিব। সবাইভি খালি নোট দিব।
হুরমতি দিন শেষে ঘরে ফিরে যখন ক্যাশ নিয়ে হিসাবে বসে, কালেভদ্রে দু`চারটা কয়েন পায় অথচ একসময় এই চিত্রটা ছিল পুরোটাই উল্টা। ইদানীং সে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে বাপের ভিতর। সুযোগ পেলেই যাকে তাকে তার বিবাহশাদির ব্যাপারে সেধে কথা বলে, আমগো মাইয়াডাভি কালা হইলে কি হইবো, হের মনডাভি আসমানের সমাইনা। যে বেডায় হেই ছেরিরে বিয়া করব তারভি কপালডা খুইল্যা যাইবো। এই ব্যাপারটা মতির একেবারেই পছন্দ না, এখন আর বিয়েশাদির ব্যাপার নিয়ে মোটেই ভাবতে চায়না সে। ভালো করেই বোঝে সে, বেজায় কালো বলে তার বাপের মনে বেজায় দুঃখ। আতর আলীকে পর্যন্ত তার বাপকে একদিন বলতে শুনল, বুঝলাভি মিয়া আতর, তুমি হইলা লেংড়া খোঁড়া মানউষ। তোমারভি দিন একরকেম থাইকব না। তারউপর আল্লার কি বিচারভি কও, তোমার দুইডা ঠ্যাংভি নাইকা। বিবাহশাদিভি কইরা হালাও। কতা কওনের লাগি তো ভি কাউরে লাহে।
আতর আলী সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ও কাহা কী কইবার চাইছো, কয়া ফালাও তো।
না, কইবার চাইহিলামভি, তুমারতো দুই ঠ্যাংভি নাই, তুমারে কিডাভি মাইয়ে দিব। তাও আমি তুমারে ছুডো থাকা চেনি, আয়-রোজগারভি ভাল করবার লাইগছ, আমিভি চিন্তা কইরবার পারি তুমারে হুরের লাগি বিয়া দিয়া দেইভি। তুমারারে একডা চেয়ারভি বানায়া দেহনের শক আছিল।
এইডা তুমি কিতা কইলা টেংরামোল্লা তোমহার হেই বেশুমার কালা মাইয়ারে কিঢা নিকাহ করবো। আমররে গাড়ি দিবার চাইলেও তো হেইয়া কালা ছুড়ির লগে নিকাহ কর্তাম ন।
হুরমতি কিছুটা আড়ালে থেকে যখন চুপিচুপি কথাগুলো শুনছিল বাহিরে চেহারায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা না গেলেও ভেতরে মনটা ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও চমমন করে উঠেছিল। আতর আলীর ওই কথাটা শুনে বাপের উপর ভীষণ রাগ হলেও সেটা দেখাবার সুযোগই পেল না। কারণ তার আগেই তার বাপ যেভাবে আতর আলীর উপর রেগে উঠেছিল, বাপের অমন রাগ কোনোদিন আর দেখেনি সে। সমানে আতর আলীর উপর চেঁচাতে শুরু করল, হালা চুতিয়া, আল্লাহ এমনিভি তরে কি লেংড়া খোড়া বানাইচছে, ভালো হইছেভি দুই ঠ্যাং...
এরপর থেকে টেংরামোল্লা আর ফুডঅফিসের ওমুখো হয়নি। তিনমাইল ঘুরে ফুড অফিসের পিছন দিয়ে যায় তবু আতর আলীর মুখ দেখতে রাজী নয় সে। বাপের কষ্ট ভীষণরকম ব্যথিত করে হুরমতিকে। মাঝেমাঝে রাতে বাপকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে একা একা নিঃশব্দে কাঁদে। নিজের বিয়ে হচ্ছে না বলে নয়, তাকে নিয়ে বাপের কষ্ট হচ্ছে, সেটা ভেবে। আবার বেশ রাগ হয় বাপের উপর। কন্যার বিবাহের জন্য চেয়ার বানিয়ে দেবার মতোও মিছা কথা বলা শুরু করেছে যে। কয়েকদিন হলো হুরমতির বাপের শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। কর্মেও বেরোতে পারছে না। অনেক জ্বর তার। চোখখুলে তাকাতে পারে না ঠিকমতো। কিছু খেতেও পারে না। পানিভাত কাঁচামরিচ দিয়ে চটকিয়ে কন্যা আদর করে মুখে তুলে দিলে দু’একবার মুখে নেয়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। জরিনাখালা একপাতা ট্যাবলেট দিয়ে গিয়েছে। সাদা কাগজের পাতায় স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা বড় গোল সাদাবড়ি। কিন্তু কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই। শুধু কয়েকদিনের পড়ে থাকা জামাটা পাল্টে দিতে খুলতে গেলেই ধড়মড়িয়ে ওঠে। কোনোভাবেই কাউকে জামা ধরতে দেবে না। জেগে থাকলে সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হুরমতি অভ্যাসমতো বাপকে ডেকে টিনের মগভরা পানি দিতে গিয়ে দেখল, টেংরামোল্লার দেহ নিথর। শত ডাকাডাকিতেও সে চোখ মেলে না আর। প্রতিবেশীরা তাদের ঘর থেকে সেদিনের সকালে গগনবিদারী চিৎকার আর কান্নার আওয়াজে বুঝল, আবার কেউ একজন চলে গেল! পাড়া-প্রতিবেশী টেংরামোল্লার মৃতদেহকে গোসল করাতে নিলে বহুদিনের না ধোওয়া, নোংরা, কালচে তিলাপড়া, মরা ইঁদুরের গন্ধছড়ানো জামাটা খুলতে গিয়ে সামান্য অসাবধানতাতেই ঘটনাটি ঘটে গেল। তার জামার ভেতরের পকেট থেকে হুট করেই কিছু অকল্পনীয় সামগ্রী এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তেই ঘরের সকলকে কান্নার কষ্টকে ছাপিয়ে আজন্ম নিস্তব্ধতা যেন গ্রাস করল। টেংলামোল্লার সেই জামার পকেট থেকে যা যা উদ্ধার হলো, হাত রাঙানোর আনকোরা না-খোলা মেহেদী টিউব। ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের নতুন একটি টিউব। শরীরের নোনা ঘামে ভেতর পকেটে থেকে স্যাতলা ভাব ধারণ করা ছোটবড় নোট মিলিয়ে মোট আট হাজার সাতশো ৬২ টাকা, এবং বহু আগে কোনো এক এনজিও বস্তির সকলকে যে পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলে দিয়েছিল, যা হুরমতি তার চেনাজানা জ্ঞানের জগতের মধ্য দিয়ে কোনোভাবে মনে করতে পারছিল না।
ছবিটা টাকাগুলোর থেকেও নরম তুলতুলে শিমুল তুলোর বাহ্যিক অবস্থা ধারণ করেছে, যাতে মেয়েটিকে তার সত্য জগতে দণ্ডায়মান বর্ণ থেকে বেশ খানিকটা আভাময় করেছিল। সাদাকালো হয়েও হুরমতির ময়ূরাক্ষী, মনরঙিন করা, জীবনের কোনো বাঁকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা, পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি।
ব্যবহৃত গানটির গীতিকার উকিল মুন্সী (১১ জুন ১৮৮৫-১২ ডিসেম্বর ১৯৭৮)। তিনি একজন অনন্য অনুপম বাঙালি বাউল সাধক। তার অসংখ্য গানের মধ্যের ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে’, ‘সোনা বন্ধুয়ারে এত দুঃখ দিলি তুই আমারে’ উল্লেখযোগ্য