প্রফেসর ড. রাউল কানো
মিলিয়ন বছরের ঘুমন্ত জীবের জেগে ওঠা
ছায়াবীথি শ্যামলিমাপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২০
মিলিয়ন বছর বাঁচতে পারে এমন জীবও পৃথিবীতে রয়েছে। অবাক করার মতো এ আবিষ্কারটি করেছেন আমেরিকান মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং ক্যালিফোর্নিয়া পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটির স্বনামধন্য প্রফেসর ড. রাউল কানো। প্রাচীন নমুনা থেকে অণুজীবের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে গবেষণা করা, তা থেকে জীবনের রহস্য বের করা ও অন্যান্য জীবের সাথে পারস্পরিক কী কী বৈশিষ্ট্যগত মিল আছে, তা নিয়ে গবেষণা করাই তার নেশা। একবার তিনি মেক্সিকো ও ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে কয়েকটি অ্যাম্বার (Amber) সংগ্রহ করলেন গবেষণার জন্য।
অ্যাম্বার হলো গাছের রেজিন (আঁঠা জাতীয় পদার্থ)। প্রায় ৪০ লাখ বছর আগে হুলবিহীন একপ্রকার মৌমাছি (এখন বিলুপ্ত) মৌচাক তৈরির জন্য এসব রেজিন সংগ্রহ করতো। রেজিনগুলো পরবর্তীতে শক্ত হয়ে গিয়ে অ্যাম্বারের ক্রিস্টালে পরিণত হতো। ফলে মৌমাছি তার ভিতর আটকা পড়ে যেত। মৌমাছির পেটে স্বভাবতই এক প্রকার অণুজীব থাকে। এদের নাম Bacillus sphaericus, এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া। মৌমাছি হাবিজাবি যাই খায়, তা পরিপাকে এরা সাহায্য করে। পাশাপাশি মৌমাছির কাছে আশ্রয় পায় ও অতিরিক্ত পুষ্টি, যা মৌমাছির লাগে না, তা এরা গ্রহণ করে। অর্থাৎ উভয়ই উপকৃত হয়। এদের এই ভালোবাসাকে বলে মিথোজীবিতা।
তিনি প্রথমে এর বয়স মাপলেন। ২৫-৪০ মিলিয়ন বছরের কাছাকাছি কোনো এক সময়ের অ্যাম্বার ছিল এটা। তিনি এটা ছিদ্র করে দেখলেন, ভিতরে মরা মৌমাছি। তাও তিনি থামলেন না। মৌমাছির পেট কেটে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে অন্ত্র পর্যবেক্ষণ করলেন। দেখলেন, গোল গোল স্থির কী জানি দেখা যায়! তিনি এগুলা আলাদা করলেন, তারপর এগুলো একটি কালচার প্লেটে নিয়ে রাখলেন। পরে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেন, ওগুলো স্থির নেই, নড়ছে। এর পেছনে কারণ কি? আরো কয়েকটি অ্যাম্বার ছিদ্র করে তিনি একই কাজ করলেন, ফলাফল একই। এরপর আরেকটি অ্যাম্বার নিলেন, এতে মৌমাছি বা গোল কিছু নেই। এর নমুনা কালচার প্লেটে নিয়ে রাখলেন। কিছুই কিলবিল করল না।
পরে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি জানতে পারলেন, কিলবিল করা জীবগুলোর সাথে বর্তমান সময়ের Bacillus sphaericus এর ৯৯% মিল রয়েছে, শুধু ডিএনএ-এর গঠনে সামান্য পার্থক্য আছে। আর গোল গোল বস্তুগুলো তার স্পোর। কোনো অণুজীব যেখানে থাকে, সেখানে যদি প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশের উদ্ভব হয়, তখন বেশিরভাগ অণুজীবই নিজেদের মোটা প্রোটিন আবরণ দিয়ে ঢেকে ফেলে। তার সকল শারীরিক কার্যকলাপ তখন বন্ধ করে দেয়। একে স্পোর বলে। এভাবে তারা শত বছর থাকতে পারে। তবে একটা সময়ে তাপ, চাপ, রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ প্রভৃতি কারণে স্পোর নষ্ট হয়ে যায়। আর অণুজীবও মারা যায়।
এখানে বিজ্ঞানী রাউল কানো শত বছর না, মিলিয়ন বছরের পুরাতন অণুজীবকে পুনরুজ্জীবিত করে ফেলেছেন। তাকে সমর্থনকারী বিজ্ঞানী ড. পাবো দেখিয়েছেন জীব জীবিত থাকলে অ্যামাইনো এসিডগুলো L-amino acid হিসেবে থাকে। আর মারা গেলে, তা সময়ের সাথে সাথে L-amino acid ও D-amino acid এর রেসিমিক মিশ্রণে পরিণত হতে থাকে।
কোনো যৌগ যদি তল সমাবর্তিত আলোর দিক পরিবর্তন করতে পারে তবে তাকে আলোক সক্রিয় যৌগ বলে। যদি যৌগটির একটি সমাণু ঘড়ির কাঁটার দিকে তল সমাবর্তিত আলো ঘুরিয়ে দেয় তবে তা dextrorotatory (D) সমাণু। আর যদি অপর সমাণু ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেয় তবে তা levorotatory (L) সমাণু। রেসেমিক মিশ্রণ হলো একটি যৌগের dextrorotatory ও levorotatory সমাণুর মিশ্রণ। ড. পাবো অণুজীবকে মেরে দ্রুত অ্যাম্বারে ঢুকিয়ে অনেক দিন পর বের করে দেখলেন L-amino acid এখনও অপরিবর্তিত আছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, অ্যাম্বার একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রোটেক্টিভ শিল্ড, যা কোনো জৈব রাসায়নিক বস্তুকে পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতা, তাপ, চাপ, রাসায়নিক পদার্থ, বিকিরণ, ph পরিবর্তন, অন্য জীবের আক্রমণ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে বছরের পর বছর।
ড. কানো বলেন, তিনি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট সাবধানতার সাথে করেছেন, যার ফলে এ নিয়ে সমালোচনার কোনো সুযোগ নেই। অণুজীবগুলো আসলেই ২৫-৪০ লাখ বছরের পুরাতন। আর ডিএনএ-র গঠনে যে পার্থক্য দেখা গিয়েছে, তার কারণ অ্যাম্বারের বাইরের মৌমাছিরা মিলিয়ন বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে গিয়েছে, তাই তারা আলাদা। কিন্তু ওই বেচারা অ্যাম্বারে আটকে গিয়ে জাগতিক সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ কারণে তার বিবর্তন হয়নি।