মাস্ক, সাবান, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, লকডাউন

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০২০

করোনা মহামারি আমাকে নাজেহাল করে ফেলেছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার খবরটা প্রথম যখন শোনা গিয়েছিল, টেলিভিশনে পত্রপত্রিকায় যখন একটু একটু করে মুখ দেখাচ্ছিল ভাইরাসটা, ব্যাটা বেশ দূরে আছে ভেবে খুব একটা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম না। তারপর যখন একদিন শুনলাম, ভাইরাসটা ঢুকে পড়েছে আমাদের দেশেও, পত্রপত্রিকা টেলিভিশনে হাজির হচ্ছেন কপালে ভাঁজ ফেলা চিন্তাক্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা— একটু আধটু চিন্তা ঢুকলো আমার মনেও। সত্যিই তো, ভাইরাসটা যদি আমাকে ধরে ফেলে, যদি নাক-মুখের ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়ে আমার ফুসফুসে, যদি ফুসফুসের কোষগুলিকে সম্মোহিত করে আমার দম বন্ধ করে দেয়, যদি আমাকে মেরে ফেলে— এসব চিন্তা আমাকে বেঁধে ফেললো আষ্টেপৃষ্ঠে। অবশ্য এরজন্য বিশেষজ্ঞরাই দায়ী— ওরাই তো টেলিভিশনে পত্রপত্রিকায় করোনা ভাইরাসের চরিত্র, তার হামলা করার কৌশল, আমাদের অসুস্থতার লক্ষণ, মৃত্যুভয় ছড়িয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। ফলে ভাইরাসের চেয়েও আমি বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলাম বিশেষজ্ঞদের কথায়। তবে ভরসা পাচ্ছিলাম বিশেষজ্ঞদেরই আরেকটা কথায়, এই ভাইরাসকে ঠেকিয়ে দেয়া যায় সাবান আর মাস্ক দিয়েই। ফলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম যেই, অমনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানালো, কেবল মাস্ক হলেই হবে না বরং ভাইরাস ঠেকানোর এন ৯৫ মাস্ক চাই, নইলে নাকমুখ সব খোলা দরজা হয়ে যাবে ভাইরাসের কাছে।

এতদিন গার্মেন্টসের তৈরি করা গেঞ্জির কাপড়ের মাস্কে বেশ চলে যাচ্ছিল। সাথে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে নিজেকে মনে হচ্ছিল দুর্গাধিপতি, যার দুর্গের দেয়াল টপকানোর সাধ্য করোনার নেই। কিন্তু এবার এন ৯৫ মাস্কের খোঁজে নেমে যেই দেখলাম বস্তুটির অস্তিত্ব নেই কোথাও এবং যদিও বা আছে, সেটাও নকল— মাথাটা আমার ঘুরে গেল। ঠিক তখনই পথ দেখালো সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নামের একটা শব্দ। টেলিভিশন পত্রপত্রিকাতো বটেই, সরকারি সব পরামর্শও মহামারির এই বিশাল সমুদ্রে শব্দটাকে যেন হাতে পেল লাইফবয়ের মতো। এরকম সব অথেনটিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যখন নির্ভর করবার মতো কিছু একটা খুঁজে পায়, আমার মতো নিরীহ জনতা তাকে অস্বীকার করে কিভাবে? এবার আর মৃত্যুর ডোবায় ডুবছি না, বড়জোর কিছু ঝড়ঝাপটা হয়তো সহ্য করতে হবে।

সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের পথে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম, এ এক দম বন্ধ করা অবস্থা। আকাশ থেকে উড়ন্ত একটা পাখিকে ধরে এ যেন খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া। তখন কেবল শিকের ফাঁক দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখা যায়, হয়তো গন্ধও নেয়া যায়, কিন্তু স্পর্শ— কখনো না। তবে আমি ভাইরাস আর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এইটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হলাম। করোনা ভাইরাস দেশে ঢোকার পর যেভাবে প্রতিদিন দশ বারোজন করে আক্রান্ত হচ্ছে আর দুই একজন করে মারা যাচ্ছে— সরকার প্রতিদিন বুলেটিন প্রচার করে জানাচ্ছে এসব, অবিশ্বাস করি কি করে— আমার সাহস হচ্ছে না ঘরের দরজার চোয়াল চেপে রাখা ছিটকানিতে হাত দেই। এদিকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই যখন দেখি মানুষজন সব নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তাঘাটে, সস্তায় জিনিসপত্র কিনছে, খাবারদাবার থেকে ডেটল পর্যন্ত সব শেষ হয়ে যাচ্ছে— মনটা ছটফট করে ওঠে। সন্দেহ হয় সরকারি বুলেটিনকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেও ইচ্ছা করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারি না, মৃত্যুভয় সরকারি সাবধানতাকেও ম্লান করে দেয়। আর আমিও নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করা চিড়িয়াখানার এক ম্লান বাঘের মতো সারাক্ষণ ঘরে পায়চারী করি।

এর মধ্যেই একদিন শোনা গেল, লকডাউন নামের আরেকটা নতুন শব্দ। এটা দিয়ে নাকি রাস্তায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষজনকে ঘরে আটকানো হবে, ঠেকানো হবে করোনার ছড়িয়ে পড়ার পথ। সাথে সাথেই মনটা আমার প্রতিশোধের তীব্র জ্বালায় হেসে উঠলো। এবার সবাই বুঝবে ঘরে আটকে থাকার যন্ত্রণা। রাস্তায় ঘোরাঘুরি, হাসিঠাট্টা, সস্তায় জিনিসপত্র কেনার মজা এবার বের হবে। এদিকে সরকারি বুলেটিনে একটু একটু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। পত্রপত্রিকায় টেলিভিশনে শোনা যাচ্ছে হাসপাতালে ও কবরখানায় আক্রান্ত ও মৃতদের হেনস্থা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অফিস আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দৈব সব ঘোষণা দেয়া বন্ধ করে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিশোধ ছাপিয়ে আমার মনে আবার চাড়া দিয়ে উঠলো ভয়। ঘরের বাইরের পৃথিবীটাকে মনে হতে থাকলো বিষের মতো, যার সামান্য স্পর্শে আমি পুড়ে যাব, শেষ হয়ে যাব। এখন আমি ঘরের ভিতরেও মাস্ক পরে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিবারের সবার থেকে দূরে গিয়ে বসে থাকি আর পত্রপত্রিকায় টেলিভিশনে খুঁজতে থাকি নিরাময়ের উপায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন বিষয়ক খবরগুলি গোগ্রাসে গিলতে থাকি। কিন্তু আশার আলো কোথাও নাই।

পৃথিবীটাও এখন যেন একটা চিড়িয়াখানার মতো। প্রত্যেকটা দেশ একেকটা খাঁচায় বন্দি। তবে আজকাল আক্রান্ত আর মৃত্যুর বাইরেও কিছু নতুন খবর পাই, কেউ কেউ সুস্থ হয়ে উঠছে। ফেসবুকে গর্ব করে জানাচ্ছেও তাদের নিরাময়ের কথা। আহা! আমি যদি ওদের মতো হতে পারতাম। কিংবা যদি আক্রান্তও হতাম, তাহলেও ভালো হতো। হয়তো তখন আমি সুস্থ হতাম বা মৃত্যু হতো আমার। নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে, সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়ে, একা হয়ে এই বেঁচে থাকা যে আরো কঠিন।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী