মাসুদ পথিক
মাসুদ পথিকের ৪ কবিতা
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১
তিনজন বাস্তবতা
বাইরে, দাঁড়িয়ে আছে অতীত, উঁচুনিচু
দরজা আগলে, উঠোনে তার বুড়ো বাপ
চাঁদ গিলে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তিনমুখো সাপ
এই ঘামডোরার পথ;
বর্তমানের হয়ে অতীত ও ভবিষ্যতে নিয়েছে বাঁক
ঘরে শুয়ে আছে অতীতের প্রিয়তমা স্ত্রী
কেবল শব্দ হচ্ছে, সারারাত, প্রবল শীৎকার
কেঁপে উঠছে খাট, ঘামভেজা আকাশ
লাফিয়ে পড়ছে টিকটিকি, আর
সাপের জিভ, তো, পালিয়ে ছুটছে বোধের ইঁদুর
বাইরে, জড়ো হলো ক`জন ভোর
একজন দিলো আজান, কেউ বাজালো শঙ্খ
এখনই জন্মালো সন্তান, ভবিষ্যৎ
শুধু শুধু মারা গেল মা, বর্তমান
কাঁপছে খাট, হাওয়ায় আর পাড়ায় পাড়ায়
চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো তার গান
তবুও, বিছানায় রইলো পড়ে, পাশাপাশি তারা
কান্না ও শীৎকার!
হাওয়ায় উড়ছে নিশ্বাস, রাত্রির মুণ্ডু আর বাস্তবতার।
দুই,
মুখ ফুটে হয় না বলা আসো, যদিও কিছু প্রেম হয় ধৃত
প্রকৃতই অনেক মানুষ বাইরে সুখি, ভিতরে ভেতর মৃত
চাষার জীবনী লেখে দলছুট পাখি
অর্থাৎ, মৌসুমের পূর্বে বাবাকে দেখি, জমিনে
লাঙল চালানোর ফাঁকে ছুঁড়ে মারছেন ঢিল
কীট খেতে আসা পাখিদের
পাখিরা বাতাসের বাঁকা রাস্তা ধরে পালিয়ে গিয়ে
পুনরায় ফিরে ফিরে আসছে
সারারাত বৃষ্টির পর আজানের লাগাম বেয়ে আসে ভোর
বাবা ঘাসভেজা আলেই আদায় করেন নামাজ, যখন
খাদ্যের অন্বেষণ শেষে ফিরে যায় ক`জন খিঞ্জির
পাশের জঙ্গলে শিকারি শেয়ালের শেষ গান
মাছরাঙাদের উলুধ্বনি
এক যৌন প্রগলভ ষাঁড় ওড়ে পাখিদের নির্মিত রাস্তায়
হাম্বা হাম্বা শোনা যায় প্রজনন উন্মুখ ধামরির
কেবল লক্ষ্যের থেকে কিছু দূরে রাস্তা নিয়েছে বাঁক
হেঁটে হেঁটে ছড়িয়ে পড়ে পাখির কলতান
দিগন্তের চূড়ার কাছে থাকেই পড়ে কাঁচা আল
এইপথে কোনো কক্ষচ্যূত বিমান হেঁটে হেঁটে ফেরে বাড়ি
অতএব মাঠে লাঙল চালান বাবা, নিরবধিকাল
চারধারে মূর্ছিত আগাছার গান
মা এখনো চুলোয় শূন্য হাড়ি চড়িয়ে বসে আছেন
আগুন হাঁড়ির ফুটন্ত জলে বাবার জীবনী লিখছেন
আমরা ক্ষুধা ও প্রতীক্ষার হরফে করছি পাঠ
কীট খেতে আসা পাখিরা কেবল জানে
চাষার জীবনী লেখা হয় ঘামে
যা সংরক্ষিত হয় হাওয়ায়— ঘাসের জীবনী গ্রন্থটির পাশে
বাসমতির বাজার
যাত্রা করেছি, গ্লোবাল ধান উৎসবের দিকে
চেপে বসেছি ডানাকাটা বাসের পেটে
ছুটছি রায়পুরা থেকে ঢাকা
বাসমতি ধানকে তুলে নেব বলে
নরসিংদির ভেলা নগর মোড়ে নামি
দেখি না মেয়েটিকে, বাসস্ট্যান্ড কোলাহল মুখর
অনেক কাল পূর্বে এইখানেও বাসমতির চাষ হতো
পাশের নদীটিও ছিল স্রোতস্বিনী
এখন, জনারণ্য ভেদ করে তার দাদা এসে জানালো,
ভাই ইরি, বাসমতি তো পালিয়েছে আলোক ধানের সঙ্গে
জানোই তো, ওর বাপ অমনটা কেমন ঘাড় ত্যাড়া
মুনশি বাড়ির বটঝুরির লগে বিয়ে ঠিক করছিল,
বিয়ের আগের রাতে হাওয়া
শুনেছি, তারা দুইজন গার্মেন্টসে চাকরি নিছে
হায় কপাল! ছোট নাতি বালামটাও নিখোঁজ বহুকাল
শূন্য খা খা করে বাড়িটা
বাসের যাত্রীরা তাড়া দিলো, বাস ছেড়ে যায়
বাতাসে পিষে যাচ্ছে সমন্বিত দীর্ঘশ্বাসগুলি
কেবল এক গোপন দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল
উঁচুনিচু দীর্ঘশ্বাসের মিছিলে
পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,
এইভাবে কোনো ব্যবসা-ই হয় না প্রেমিক ভাই!
কবি নজরুলে সঙ্গে, আমার এক কাপ চা, আর
আর বিকালের চায়ের কাপ হাতে বসে আছি, বনঘেঁষা ধানক্ষেতের আলে
ঢালে, সামান্য ঢালুতে হিজল আর কদম গাছের সারি
চোখের সৌন্দর্য মিশ্রিত বাক্য ছুঁড়ে দিচ্ছি ওদিকে,
ওদিকে গোয়ালাদের উঁচুনিচু বাড়ি
গোয়ালার ছোট মেয়ে মিনতির শুনেছি সুনাম
ফাঁকে, এই ফাঁকে, একে একে জলফড়িং ও তৃষ্ণার্ত ষাঁড়গরু
খেয়ে গেল চা, আমার হাতের কাপ থেকে
কাছে, কাছেই উঠলো বেজে কোনো নূপুর
নাকের চারধারে ঘুরছে ঘ্রাণ, বিদেশি বিজ্ঞাপন মাখা পাউডার, আর
কোথাও বাজছে বাঁশি, মোহন
সামনে, সামনেই কদমতলায় ত্রিশাল গ্রাম, ওদিকটায় কেউ বাজাচ্ছে বাঁশি
কাছে গেলে দেখা গেল, গাছের নিচে বসে আছেন কবি নজরুল!
ইশারায় বললো বসতে, আমি মাটিতে বসতে বসতে বললাম, জয় গুরু
কবি বললো, তথাস্তু
দুটি ফড়িং উড়ে এসে বসলো কবির বাঁশিতে, আর সুরে সুরে নাচতে লাগলো
আমাদের কেটে গেল, গেল কেটে নিরবধিকাল, বাঁশি ও নূপুরের লহরীতে
পাশে বসেছিল কেবল দুটি দলছুট নক্ষত্র, যারা একদা পৃথিবীতে বুনেছিল প্রথম ধান
তাদের খোলা গায়ে ছিলো ঘাম, আর... নুন